কৃষ্ণময়ীর অলংকার পর্ব ১২

0
1168

#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১২

“তোর মনে কি ভাইয়ার জন্য একটুও ভালবাসা নেই?”
পৃথার কথা শুনে তপা মুচকি হেসে বলল,
“আমি তো ভাইয়াকে ভালবাসি। তোর এতদিনে কেন মনে হচ্ছে আমি ভাইয়াকে ভালবাসি না?”
“আমি পলক ভাইয়ার কথা বলছি ইডিয়ট।”
তপা ঈষৎ অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
” উনি আবার তোর ভাই কবে থেকে হলো?”
“ভাইয়ার বন্ধু তো ভাইয়াই হবে। তাই না?” ভ্রু জোড়ার মাঝ বরাবর সামান্য ভাজ ফেলে বলল পৃথা।
তপা আবারও এক চিলতে হাসল। ঠোঁটের কোণে হাসির রেশটুকু ধরে রেখেই বলল,
” ভাইয়া আমারও ভাইয়া হয়। তোর একা না। সেদিক থেকে ভাইয়ার বন্ধু তো আমারও ভাইয়া রাইট? তাহলে ভালবাসার প্রশ্ন কেন আসছে?”
পৃথা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইল দু দন্ড। এরপর মৃদু স্বরে শুধালো,
“সত্যি করে বল না। ভাইয়া কিন্তু তোকে ভালবাসে। কতটা সেটা তুই পরিমাপও করতে পারবি না। একটুখানি কি ভালবাসা যায় না?”
তপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার জীবনের ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাস। চোখ বন্ধ করে মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে বলল,
” উনার সাথে কি আমাকে মানায় বল? উনি দেখতে কতটা আকর্ষণীয় সেটা নিশ্চয়ই আমার বলে দিতে হবে না। উনি ছেলে হয়েও উনার গায়ের রঙ দেখেছিস? কিন্তু আমার দিকে চেয়ে দেখ। উনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক সম্ভব নয় রে আমার। ধরে নে বিয়ে হলো আমাদের। কিন্তু তারপর? একসঙ্গে কোথাও বের হলে লোকে কি বলবে জানিস? বাদুড়ের গলায় মুক্তোর মালা। আরো বলে কাকের মুখে পাক্কা আম। এগুলো আমি শুনতে পারব না রে। উনি নিসন্দেহে একজন ভাল মানুষ। কিছু মানুষ আছে যাদের চোখের দিকে তাকালে মন পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। আমার উনাকে তাদের দলেরই একজন মনে হয়। উনার মনটা গায়ের রঙের মতোই স্বচ্ছ। উনার সাথে আমার কোনোদিন কিছু হওয়া সম্ভব নয় রে। কালাচাঁদ হয়ে জন্মে সাদা মানিকের আশা করতে নেই। উনি হচ্ছেন হোয়াইট গোল্ড বুঝলি? কালো রঙে যা বেমানান।”

“তুই কখনো ব্ল্যাক ডায়মন্ডের নাম শুনেছিস? ডায়মন্ড মানেই কিন্তু সাদা ফকফকা নয়। ব্ল্যাক ডায়মন্ডও কিন্তু অমূল্য, নিখাঁদ। তো উনি হোয়াইট গোল্ড হলে তুই ব্ল্যাক ডায়মন্ড। উনার থেকেও বেশি মূল্যবান। তোকে জেনে, বুঝেই সে ভালবেসেছে তপা। একটু তো ভেবে দেখ। ফর্সা রঙ দেখে ভালবাসতে হলে ভার্সিটিতে নিশ্চয়ই অনেক সুন্দরী আছে। তাদেরকেই আই লাভ ইউ বলতো। তোকে নয়। একটা বার ভেবে দেখ বোন আমার। তোর ভরসা করার মতো কাউকে তো দরকার। একা একা আর কতদিন?”
“যতদিন আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছে ততদিন।”
“ভাইয়ার দোষটা কোথায় বলবি? ফরসা রঙটাই কি তার ভালবাসা না পাওয়ার একমাত্র কারন?”
তপা মৃদু ধমকের সুরে বলল,
“তুই থামবি? ভাল লাগছে না আমার।”
তপা জেদি, আপসহীন গলায় বলল,
“আমি থামব না আজ। তোকে বলতেই হবে। কেন তপা? কি অপরাধে তুই এত ভালবাসা পায়ে ঠেলে দিচ্ছিস?”
“তুই কেন দিয়েছিস? তুই তো নিজেই ভালবাসতি। তবে কেন সেদিন অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলি?”
পৃথা নির্লিপ্ত নয়নে তাকিয়ে রইল। কি বলবে সে?
তপা তাড়া দিয়ে বলল,
“বল। কি হলো?”
“সে তোকে, আমার ভাইয়াকে অপমান করেছে তপা। কলঙ্কিত করতে চেয়েছে তোদের সম্পর্ক কে। সেই জঘন্য মানসিকতার মানুষ কে ভালবাসতে পারি না আমি। আমার দুজন ভালবাসার মানুষ কে যে কাঁদাতে পারে তাকে কি করে আমার মনে জায়গা দেব আমি? যে এই মন টাকেই ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে। অসুস্থ মন নিয়ে তো আর ভালবাসা যায় না।”
বলতে বলতে চোখের কার্নিশে জমা হওয়া জলটুকু মুছে ঠোঁটের কোণে মেকি হাসি ফুটিয়ে তপার দিকে তাকাল।
তপা পৃথার একহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“ঠিক বলেছিস। অসুস্থ মন নিয়ে তো ভালবাসা যায় না। আমার তো শরীর, মন দুটোই পঁচে গেছে পৃথা।আমি কি করে তার ভালবাসা গ্রহণ করি? হ্যা মানুষটা ভাল। বিশ্বাস, ভরসা দুটোই আমি করি তাকে। নয়তো সেদিন একা, অসুস্থ অবস্থায় তার ফ্ল্যাটে থাকতে পারতাম না। সেদিন আমার এক মূহুর্তের জন্যও ইনসিকিউর ফিল হয় নি। তার সাথে আমার নিজেকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে হয়। তার সামনে থাকলে আমি খুশি থাকি। ভাল থাকি।কিন্তু তাই বলে তো আমি নিজের অতীত ভুলে, নিজের অবস্থান ভুলে তার গলায় ঝুলে যেতে পারি না।”

পৃথা চোখ পিটপিট করে বলল,
“তুই ভাইয়ার ফ্ল্যাটে ছিলি?”
তপা মাথা উপর নিচ করে সায় জানালে পৃথা আবারও বলল,
“তারপরও মনে হচ্ছে তুই ভালবাসিস না? ”
“কারো সাথে এক ফ্ল্যাটে থাকলেই ভালবাসা হয়ে যায় না পৃথা। আমার তাকে ভাল লাগলেও আমি ভালবাসি না তাকে। তার সাথে অনেকটা সময় আমার কেটেছে। সবটাই ভালভাবে হ্যান্ডেল করেছেন তিনি। বাকি জীবনটা উনার সাথে কাটালে অবশ্যই ভালভাবেই কেটে যাবে। কিন্তু পৃথা আমি অন্ধকার জয় করবো কি করে? অন্ধকার যে আমাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে। আর তার ছোঁয়া? সেটা কি করে সইব আমি? ভালবাসলে তো সে আমাকে ছুঁয়ে দেবে পৃথা। আমি মরে যাব পৃথা। কারো ছোঁয়ার কথা মনে হলেই আমার গা ঘিনঘিন করে। ভয়ঙ্কর অন্ধকার আমায় গ্রাস করতে ধেয়ে আসে। নিশ্বাস আঁটকে আসে। মনে হয় এই বুঝি প্রাণটা বেরিয়ে যাবে।ইচ্ছে করে প্রাণটা বেরিয়েই যাক। তারপর সব শান্ত। সবকিছুতে শান্তি বিরাজমান থাকবে। এমনটা হলে ভালই হবে বল। প্রাণটা বেরিয়ে গেলেই আমি মুক্তি পাব এই নরক যন্ত্রণা থেকে। কেন হয় না রে এমন? আমার জীবনটা বড্ড ভারী লাগে রে। কেন এত দীর্ঘ আমার জীবন? কত মানুষ মারা যায়। আমি কেন এখনো বেঁচে আছি? আমার আয়ু কেন কমছে না পৃথা? আমি বাঁচার শক্তি খুঁজে পাই না আর।”
বলতে বলতে ফুপিয়ে উঠল তপা। পৃথা এগিয়ে এসে তপার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“শুধু নিজের কথাটাই ভাবলি? আমাদের কথা একবারও মনে হলো না? আমি, ভাইয়া, তোর মামার কথা? আমরা কি করে থাকব?”
তপা পৃথার কোমর আঁকড়ে ধরে ফুপিয়ে উঠার মাত্রা বাড়িয়ে দিল। পৃথা ব্যস্ত হলো তপা কে শান্ত করতে।

তপা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ফোন ঘাঁটছিল। পরপর কয়েকদিন যাবত পাওয়া অর্ডারগুলো ক্যানসেল করে দিয়েছে, দিচ্ছে । এই অবস্থায় প্রেসার নিতে মন চাচ্ছে না তপার। যদিও পৃথা বলছিল ও সাহায্য করবে। তবুও মন সায় দেয় নি। এমনিতেই পৃথার উপর ওর নিজের সব দায়িত্ব গিয়ে পড়েছে। বিছানা গোছানো থেকে শুরু করে তপার গোসলের পরের আধোয়া জামা কাপড় গুলোও ধুয়ে মেলে দিতে হচ্ছে পৃথার।
পৃথা তপার এক পায়ের উপর মাথা রেখে গুনগুন করে সুর তুলছে,
” প্রাণ চায় চক্ষু না চায়
মরি একি তোর দুস্তরলজ্জা
প্রাণ চায় চক্ষু না চায়

সুন্দর এসে ফিরে যায়
তবে কার লাগি মিথ্যা এ সজ্জা
প্রাণ চায় চক্ষু না চায়
মরি একি তোর দুস্তরলজ্জা”

“বাহ! শালী সাহেবা। আপনি তো দারুণ গাইতে পারেন। তা আমার বউ টাকেও তো একটু আধটু শেখাতে পারেন। এমন রসকষহীন, কাঠখোট্টা বউ আমার। একটু আধটু মধুর বুলি ও তো মাঝে মাঝে শুনতে ইচ্ছে করে এই অধমের।”

পলকের গলার গমগমে আওয়াজ শুনে পৃথা হকচকিয়ে উঠে বসল। তপাও তাড়াহুড়ো করে পাশে মেলে রাখা ওড়না টেনে গায়ের সাথে জড়িয়ে নিল। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল পলক হাত মুড়ে বুকের সাথে লেপ্টে রেখে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একপা সামান্য উঁচু করে, মাথাটা একটুখানি কাত করে দরজায় ঠেকানো।
তপা এক নজর দেখে চোখ ছোট ছোট করে বলল,
” এমন অসভ্যের মতো নক না করে ঢুকে পড়েছেন কেন? আপনি জানেন না কারো রুমে ঢুকার আগে পারমিশন নিতে হয়? তাও আবার দুটো মেয়ের রুম।”
পলক ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“জানি। আমি ম্যানারলেস নই।তোমরা ভাই বোনরা কি জন্মেছোই আমাকে ম্যানারস শেখানোর জন্য? অন্যকারো রুম হলে অবশ্যই নক করে ঢুকতাম। এটা আমার বউয়ের রুম। বউয়ের রুমে ঢুকতে পারমিশন কিসের? যে তিত করলার মত বউ আমার। পারমিশন নিয়ে সব করতে গেলে সারাজীবন আমার কুমারই থেকে যেতে হবে। তাই বউয়ের বেলায় নো পারমিশন। আরেকজন তো আমার শালী সাহেবা। শালী মানেই তো আধা ঘরওয়ালী। তাই না বলুন শালী সাহেবা?”
বলেই চোখ টিপে হাসল পলক। পৃথাও তাতে তাল মিলিয়ে হেসে বলল,
“অবশ্যই ভাইয়া।উপস সরি সরি দুলাভাই।”
তপা বিরবির করে বলল,
” ব্যাটা গাছেরও খাবে, তলারও কুড়োবে।”
বিরবির করে বললেও কথাটা স্পষ্ট পলকের শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছে গেল। পলক দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে তপার দিকে ঝুঁকে বলল,
“গাছের টা খেতে দাও। প্রমিস তলারটা কুড়োবো না। আমি তাকাবোই না তলার দিকে। পলক তাজওয়ারের প্রমিস। পৃথিবী উল্টে গেলেও ভাঙবে না।”
তপা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইল।

কিয়ৎকাল পর তপা শান্ত কণ্ঠে বলল,
“আপনি এখন এখানে কেন?”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেন আসার আগে কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে?”
তপা বিরক্ত ভঙ্গিতে জোরে শ্বাস ফেলল।
পলক সেটা দেখে আর বিরক্ত না করে বলল,
“আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। তুমি দ্রুত রেডি হয়ে নাও।”
তপা ঈষৎ অবাক হয়ে বলল,
“রেডি হবো মানে? কোথায় যাব?”
“কপালে যে এক গজ সাদা কাপড় নিয়ে বসে আছো ওগুলো খুলতে হবে না?”
তপা মৃদু স্বরে বলল,
“আজই?”
পলক তপার নরম কণ্ঠ শুনে নিজেও মোলায়েম গলায় বলল,
“হুম আজই।”
“ব্যথা করবে? জ্বলবে?”
পলক অবাক হয়ে বলল,
“এই তুমি কি ভয় পাচ্ছো?”
তপা মাথা উপর নিচ করে সায় জানালো। পলক একটু এগিয়ে তপার কাছাকাছি বসে বলল,
” একটু খানি জ্বলতে পারে। বেশি ব্যথা করবে না। সেরে গেছে নিশ্চয়ই । এন্টিবায়োটিক খাচ্ছো তো। ঘা শুকিয়ে এসেছে। ব্যথা পাবে না।”
“সেদিনই ভালো ছিল অজ্ঞান হয়ে ছিলাম। ব্যথা লাগে নি। আপনি একটা থাপ্পড় মেরে আমাকে অজ্ঞান করে দিন তো। তারপর ব্যান্ডেজ খুলার পর মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনবেন।”
পলক অবাক চোখে চেয়ে দেখল তপার পাগলামিগুলো। এত শক্ত পোক্ত মনের মেয়েটাও এরকম বাচ্চামি করতে পারে জানা ছিল না তার।
পলক কিছু বলছে না দেখে তপা পলকের হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“দিন না একটা থাপ্পড়। বেশি না তো একটা। প্লিজ।”
পলক মৃদু হেসে বলল,
“রেডি হয়ে নাও। আমি অপেক্ষা করছি।পৃথা কোথায় গেল?”
“পৃথার কথা বলতে বলতেই পৃথা হাজির। নিন ভাইয়া। একটুখানি কফি। জানি ভাল হবে না। তবুও নিন।” মৃদু হেসে বলল পৃথা।
পৃথার হাত থেকে কফির কাপ নিয়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়াতেই তপা মৃদু স্বরে বলল,
“আপনি রুমেই থাকুন। ছাঁদে এখন অনেক রোদ।”
পলক চকিত ভঙ্গিতে তাকাল।ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল মুচকি হাসির রেখা। তার কৃষ্ণময়ী তাকে নিয়ে ভাবছে। ভাবা যায়!
তপা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াতেই পৃথা এসে আগলে নিল। দু’হাতে ধরে ধরে ওয়াশরুম পর্যন্ত নিয়ে গেল।
তপা জামা পাল্টে বেরিয়ে এসে পৃথাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমার চুলগুলো একটু বেঁধে দে না। এখন আর যুদ্ধ করতে ভাল লাগছে না।”
পৃথা হাসি মুখে চিরুনী নিয়ে কাজে লেগে গেল। পলক নিষ্পলক চেয়ে রইল তপার মেঘবরণ কেশের দিকে। দূর থেকেই যেন ওই নিকষ কৃষ্ণ আধারের মত কেশরাশির মাতাল করা ঘ্রাণে মাতোয়ারা হচ্ছিল পলক। নেত্রপল্লব বারবার ঝাপটে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিল সে। নয়তো একটা বার ছুঁয়ে দেওয়ার লোভে চকচক করছিল তার চোখ। নিশপিশ করছিল হাত।মনটা বারবার বলছিল, কি হবে একটা বার ওই মাদকে মাদকাসক্ত হলে? কি হবে একটাবার ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দিলে ওই লম্বা চুলের গাছি? খুব কি অন্যায় হবে? পাপ হবে? কলঙ্ক লাগবে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here