কৃষ্ণময়ীর অলংকার পর্ব ৬

0
1290

#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০৬

“আন্টি এই কথাটা আর বলো না প্লিজ। ভাইয়া আমার কাছে আমার নিজের ভাইয়া। আমার মায়ের পেটের ভাই হলে যেমন হতো ঠিক তেমন। এই পবিত্র সম্পর্কটা তুমি অস্বস্তিতে মুড়িয়ে দিও না।” মাথা নিচু করে বলল তপা।
প্রান্ত এতক্ষণ চুপ থাকলেও আর ধৈর্য বাধ মানল না তার। মায়ের হাত ধরে বলল,
“মা আমার কাছে পৃথা আর তপা আলাদা নয়। ওরা দুটোই আমার বোন। কখনো আলাদা করে দেখিইনি আমি। আমি তো এটাই জানি আমাদের মা বাবা আলাদা হলেও আমরা আপন ভাই বোন। দুটো বোন আমার। পৃথার জন্মের পর আমার খুশি তুমি দেখেছো। কিন্তু তপার আমাদের জীবনে আসার খুশি তুমি দেখনি। আমি দেখাতেই পারি নি। লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেছে। কেন জানো মা এই ভাবনাগুলোর জন্য। যেখানে পৃথাকে আমি নির্দ্বিধায় জড়িয়ে ধরতে পারি, আদর করতে পারি। সেখানে তপার হাতটা ধরে ভরসা দিতেও আমার দুবার চিন্তা করতে হয়। পাছে লোকে পবিত্র সম্পর্কটার অন্য মানে না বের করে ফেলে। কলঙ্কের আগুনে ঝলসে দেয়। কিন্তু দেখ মা আমাদের মনে কিন্তু পাপ নেই। একটা পবিত্র সম্পর্ক বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা দুজন। আমাদের সমাজটাই এমন। আমরা তো তবু আলাদা মায়ের পেটের সন্তান। আজকাল তো একই মায়ের পেটের ভাইবোনও রাস্তায় বের হতে পারে না। মানুষের নোংরা মানসিকতার জন্য। সেখানে আমরা তো কোন ছার। তবে যাই হয়ে যাক মা আমি আমার বোন দুটোকে ঠিক এভাবেই ভালবেসে যাব। আগলে রাখব সারাজীবন। এই দুটো প্রাণ সারাজীবন আমার প্রাণভোমরা হয়েই থাকবে।”

তপার চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। কিন্তু ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে সুখের হাসি। প্রান্ত দুহাত মেলে দুই বোনের দিকে তাকাল। পৃথা, তপা কাছে আসতেই আলতো করে জড়িয়ে নিল দু’হাতে। পৃথা নির্বিকার থাকলেও তপা ফুপিয়ে উঠল। প্রান্ত তপার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“কাঁদে না বোন আমার। আমি আছি তো সারাজীবন তোদের ভালবাসার জন্য। আর মা আমার বিয়ের কথা বাদ দাও। আমার দুই রাজকন্যার জন্য রাজপুত্র খুঁজে দিয়ে তবেই আমার কথা ভাববো।”
আয়েশা চোখ মুছে মুখে সুখের হাসি ফুটিয়ে মাথা নাড়ালেন। তার সন্তানরা আজ বড় হয়ে গেছে। তার চিন্তা করার দিন শেষ।

অদূরেই দাঁড়িয়ে এতক্ষণ যাবত ঘটিত ঘটনাগুলো অবলোকন করছিল পলক তাজওয়ার। এতক্ষণ মেজাজ বিগড়ে গেলেও এখন হৃদমাঝারে বইছে গা হিম করা শীতল সমীরণ।
খাবার টেবিলে বসতেই সামনে পলককে দেখে হকচকিয়ে গেল তপা। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আপনি? আপনি এখানে কি করছেন?”
পলক তপার কুঁচকানো ভ্রু দেখে মুচকি হাসল। কিছু বলার আগেই প্রান্ত শশার স্লাইস মুখে নিয়ে চিবোতে চিবোতে বলল,
“ও আমার বন্ধু। তুই ওকে চিনিস নাকি?”
তপা বিরবির করে বলল,
“চিনি না আবার। আকাইম্মা ব্যাটা সারাক্ষণ আকামের মাথা খায় ভার্সিটিতে গিয়ে।”
পলক ভ্রু কুঁচকে বুঝার চেষ্টা করছে তপার বিরবির করে বলা কথাগুলো। স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও তপা যে তাকে ডিটারজেন্ট ছাড়াই ধুয়ে দিচ্ছে এটা খুব ভাল করেই বুঝতে পারল সে।

প্রান্ত আবারও বলল,
“চিনিস ওকে?”
তপা মৃদু হেসে বলল,
“পলক তাজওয়ার। রাইট?”
পলক ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে তুলে হাত বাড়িয়ে বলল,
“জ্বি। পলক তাজওয়ার। আপনি? ”
তপা কটমট করে তাকাল। কোন লেবেলের ফাজিল লোকটা। এমন ব্যবহার করছে যেন আজই প্রথম দেখা হয়েছে। তপা জোর করে একটু হেসে হাত বাড়িয়ে পলকের হাতে আলতো স্পর্শ করে বলল,
” তিয়াশা তপা।”
পলক হাতটা না ছেড়েই বলল,
” নাইস নেইম। তা কোথায় লেখাপড়া করছেন?”
তপা এবার অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। লোকটা কি নিদারুণ অভিনয়টাই না করছে। একে তো নির্দ্বিধায় সেরা অভিনেতা ২০২২ অ্যাওয়ার্ড টা দেওয়া যাবে।
হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” ফার্স্ট সেমিস্টার ***** ইউনিভার্সিটি। আপনি?”
পলক অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
“সেকি আমিও তো তোমার ইউনিভার্সিটি থেকেই পাস আউট। তোমাকে কখনো দেখি না কেন ভার্সিটিতে? ক্লাস করো না নাকি? এটা তো ঠিক না প্রান্ত। তুই এত ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলি আর তোর বোন কিনা ফাঁকিবাজ। এটা তো ঠিক মানা যাচ্ছে না।”
তপা এবার আর নিতে পারছে না। একটা লোক এত অবলীলায় কিভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পারে? আবার পরক্ষণেই মন হলো তপাকে ক্ষেপাতে চাইছে। তপাও মনে মনে কঠিন পণ করলো। এই লোকের কথায় আজ রেগে যাবে না। না মানে না।
“আপনি তো বললেন পাস আউট। যেহেতু ভাইয়ার বন্ধু সেহেতু আরও দুবছর আগেই বেরিয়ে গেছেন। তাহলে আমাকে দেখবেন কি করে? আপনি তো এক্স স্টুডেন্ট। চেহারা দেখে তো প্রফেসর বলে মনে হচ্ছে না। আবার বখাটে হিসেবেও ঠিক মানাচ্ছে না। আপনি ভার্সিটিতে এক্সাক্টলি কি করেন বলুন তো? আকামের মাথা খান?”

পলক কেশে উঠল অপ্রস্তুত হয়ে। এই মেয়ে যে যথেষ্ট তেজি সেটা ও জানে। কিন্তু তাই বলে এভাবে বলবে? আকামের মাথা খায় মানে কি? পলক তাজওয়ার আকাইম্মা? হাউ ফানি!
পলক কিছু বলার আগেই আয়েশা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
“এসব কি ধরনের কথা তপা? উনি তোমার বড়। সম্মান দিয়ে কথা বলো।”
পলক মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল,
“ঠিক আছে আন্টি। বাচ্চা মানুষ বুঝতে পারে নি।”
মূহুর্তেই তপার চেহারার রঙ পাল্টে গেল। চোখদুটো শুভ্র থেকে রক্তিম আভায় ছেয়ে গেল। রেগে গিয়ে বলল,
“আমি মোটেও বাচ্চা নই। আপনিই বলুন না কি করেন আপনি সারাদিন ভার্সিটিতে? সেই তো এই গাছের তলায় ওই গাছের তলায় আড্ডা মারেন। এটা কি আকামের মাথা খাওয়া নয়? আজ লাইব্রেরী তো কাল লিফট সেগুলো কি আকামের মাথা খাওয়া নয়? আবার বিপক্ষ দল চিরকুটে হাবিজাবি লিখে দিবে সেটা নিয়ে একদফা ঝামেলা হবে সেটাও কি আকামের মাথা খাওয়া নয়? নাকি এগুলোই সবচেয়ে দরকারি কাজ?”
পলক হা করে তাকিয়ে রইল। তপার হঠাৎ ক্ষেপে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারল না সে।
প্রান্ত ব্যাপারটা সামাল দিতে তাড়াহুড়ো করে বলল,
“পলক তোরা আগে থেকে পরিচিত? তপার সাথে তোর আগে থেকে ঝামেলা চলছে?”
পলক অসহায় মুখ করে তাকাল তপার দিকে। তপা তখন মাথা নিচু করে রয়েছে। মিনিট দুয়েক পর খাবার রেখে হাত ধুয়ে চলে গেল সবার চোখের আড়ালে।
পলক প্রান্তের দিকে তাকিয়ে অপরাধী কণ্ঠে বলল,
“আমার জন্য ও না খেয়ে চলে গেল। কিন্তু আমি এমন কি বললাম যাতে ও এত রেগে গেল?”
প্রান্ত পলকের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল,
“হয়তো আগের রাগ ঝেড়েছে। ব্যাপার না কিছুক্ষণ পর রাগ কমে গেলেই খেয়ে নিবে। তুই খাওয়া শেষ কর।”

পলকও আর খেল না। হাত ধুয়ে নিল।
মিনিট পাঁচেক পর প্রান্তের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“তোর বোন কোন দিকে গেল রে?”
প্রান্ত ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল,
“পৃথা?”
“উঁহু। তিয়াশা।”
প্রান্ত ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ওরে দিয়ে কি করবি? এমনিতেই রেগে আছে। আর রাগ বাড়িয়ে দিস না দোস্ত। ও আছে হয়তো নিজের মত।”
পলক অধৈর্য হয়ে বলল,
“বল না কোন দিকে গেল? আমি রাগাব না আর। প্রমিস।”
প্রান্তের ভ্রু আরও খানিকটা কুঁচকে গেলে পলক দুই ভ্রুর দুই পাশে চেপে ধরে বলল,
“তোরা ভাইবোন আমাকে ভ্রু কুঁচকে দেখাচ্ছিস? একজন তো চোখ ও দেখায়। পলক তাজওয়ারের এত খারাপ দিনও আসে নি যে সবার চোখ দেখবে। কুঁচকানো কপাল দেখবে। এগুলো দেখানো শুধু পলক তাজওয়ারের নিজস্ব অধিকার। পলক তাজওয়ার দেখাতে অভ্যস্ত, দেখতে নয়। এখন তাড়াতাড়ি বল তোর বোন কোন দিকে গেল? আমি সব জায়গা খুঁজে দেখতে গেলে কিন্তু বাড়ি আর বাড়ি থাকবে না। ডাস্টবিন হয়ে যাবে।”
প্রান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“সামনে যে রুম পড়বে সেখানেই ঢুকে পড়বি। বারান্দায় আছে হয়তো। নক করে ঢুকবি রুমে। মনে থাকে যেন। আর হ্যা পৃথাও আছে সেখানে।”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুই আমাকে ম্যানার্স শেখাচ্ছিস?”
প্রান্ত মাথা ঝুকিয়ে বুকে হাত রেখে বলল,
“আপনাকে শেখায় কার সাধ্যি?”
পলক আর কিছু না বলে ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেল। পেছনে প্রান্ত মৃদু হেসে বলল,
“বন্ধু আমার অ্যারেস্ট হয়ে গেছে তবে।”

গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে মায়াবী জোছনা উঁকি দিচ্ছে পৃথার রুমের বারান্দায়। লাইট বন্ধ করে রাখায় আধো আলো আধো অন্ধকারে মোহনীয় লাগছে চারিপাশ। তপা একধ্যানে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। স্পষ্ট কিছুই দেখছে না সে। কোনো একটা বস্তুর উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নি সে। শুধু চেয়ে থাকার জন্যই চেয়ে আছে। বাইরের পৃথিবীর প্রতি তার লেশমাত্র আগ্রহ নেই। সে ব্যস্ত জোছনার আলোয় নিজেকে ভেজাতে।
বিছানায় বসে ফোন ঘাটছিল পৃথা। তপার কাছে গিয়েছিল। কিন্তু তপার কোনো ধ্যান জ্ঞান নেই বলে রুমে ফিরে এসেছে। এখন বোম মারলেও তপাকে নিজের ভাবনা থেকে সরানো যাবে না এটা সে খুব ভালো করেই জানে।
পলক রুমে ঢুকে পৃথার থেকে জেনে নিল তপার অবস্থান সম্পর্কে। পৃথা কে খাবার নিয়ে আসতে বলে পা বাড়ালো তপার দিকে।
পলক তপার পেছনে দাড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিল। তপা বুঝতে পেরেও নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। পলক মৃদু স্বরে ডাকল,
“তিয়াশা। এদিকে তাকাও।”
তপা তবুও নির্বিকার। পলক কপালে আঙুল চালিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমি এদিকে ফিরতে বলেছি তোমাকে।”
তপা না ঘুরেই বলল,
” কেন এসেছেন এখানে?তখন ওগুলো বলার আগে মনে ছিল না? চলে যান। আমাকে একা থাকতে দিন। ”
পলক ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কিঞ্চিৎ সময় পর উচ্চস্বরে হেসে উঠল। হাসির দাপটে সারা শরীর কেঁপে উঠল পলকের। হাসি থামিয়ে বলল,
“তুমি কি ভেবেছো? আমি তোমার রাগ ভাঙাতে এসেছি? পলক তাজওয়ার কে চেন নি তুমি। কে হও তুমি আমার? বউ? নাকি গার্লফ্রেন্ড? তোমার রাগ ভাঙাতে কেন আসবো আমি? নাকি প্রতি মাসে বেতন দাও তোমার রাগ ভাঙানোর জন্য? বলো কোনটা?”
তপা পেছন ফিরে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
পলক শুভ্র শার্টের হাতা গোটানোর ভান করে তেড়ে এসে বলল,
” পলক তাজওয়ার কে চোখ দেখাচ্ছো মেয়ে। চেনো আমি কে?”
তপা কঠিন গলায় বলল,
“খুব ভালো করে। আপনি একটা ইতর প্রজাতির প্রাণী।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here