কৃষ্ণময়ীর অলংকার পর্ব ৪

0
1338

#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০৪

চারদিকে অন্ধকারের পরিবর্তে আলো দেখে নিজেকে কিছুটা সামলে নিল তপা। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। রুমের ভেতরেও অন্য কারো উপস্থিতি টের পাচ্ছে না এখন। দরদর করে গড়িয়ে যাওয়া ঘামের বিন্দুগুলো ওড়নার কোণে মুছে চোখ বন্ধ করে বিরবির করে বলল,
“এটা নিছকই একটা স্বপ্ন ছিল। এত ঘাবড়ানোর কিছু হয় নি। নিজেকে সামলা তপা। এভাবে ভয় পেলে জীবন চলবে না। তাদের থেকে তুই বহুদূরে। চাইলেও তারা তোকে ছুঁতে পারবে না। শান্ত হ তপা।”
নিজেকে সামলানোর হাজারো চেষ্টা করলেও সে রাতে আর ঘুম ধরা দিল না। নির্ঘুম কেটে যাওয়া রাতের তালিকায় যোগ হলো আরও একটি রাত।

পৃথার সহায়তায় কেকের ব্যবসাটা মোটামুটি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। খুব ভালো চলছে না বললেও মোটামুটি চলছে বলা যায়। অনলাইনের পাশাপাশি ছোট ছোট সুপার শপ গুলোতেও কেক ডেলিভারি করছে ওরা। এত অল্প সময়ে এতটুকু সাফল্য কেবল পৃথার জন্যই সম্ভব হয়েছে। পৃথাই নিজের পরিচিতদের বলেছে তপার থেকে কেক নিতে।সুপারশপগুলোতে কেক দিতে পারাটাও ওরই অবদান। কেকের মান ভালো হওয়ায় তারাও কোনো আপত্তি ছাড়াই গ্রহণ করছে। তপা বিছানায় বসে চুলে তেল দিচ্ছিল। হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় বিরক্ত হলো। বিরবির করে বলল, “আমি চুলে তেল দেওয়ার সময়ই কি সবার আমাকে মনে পড়ে? অসহ্যকর ব্যাপার।”
মনে বিরক্তি থাকলেও তা মোহনীয় কণ্ঠে এক ফোঁটাও প্রকাশ পেল না।
সুরেলা কণ্ঠে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”

দুটো পাঁচ পাউন্ড কেকের অর্ডার। খুশির সংবাদ।কিন্তু বিপত্তি বাঁধে ডেলিভারি ডেট শুনে। আগামীকাল সকাল নয়টার মধ্যে । কিন্তু কাল তপার পরীক্ষা। পৃথাটাও নেই। নানু বাড়ি গেছে। তপা পড়ে গেল মহা মুশকিলে। বাধ্য হয়ে অর্ডার ক্যানসেল করে দিল। কিছুক্ষণ পর পুনরায় বেজে উঠল ফোনটা। অন্য নাম্বার দেখে মৃদু স্বরে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”
একই অর্ডারের জন্য আবারও আরেকজন কল দিয়েছে। তপা নিরুপায় হয়ে অর্ডার টা নিয়ে নিল। কিন্তু বিনয়ের সহিত বলল,
“ভাইয়া আমি অবশ্যই অর্ডারটা নেব।কিন্তু আপনি কি কাইন্ডলি আমার বাসার সামনে থেকে নিয়ে যেতে পারবেন? একচুয়ালি কাল আমার পরীক্ষা। কেক ডেলিভারি দিয়ে এসে পরীক্ষা দিতে পারব না। প্লিজ একটু দেখবেন ব্যাপারটা?”
অপর প্রান্ত থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“জ্বি ঠিকানা টা বলুন। আমি লোক পাঠিয়ে দেব।”
তপা ঠিকানা বলতেই লোকটা গড়গড় করে বলল,
“দ্বিতীয় তলায় সিঁড়ির সাথের ফ্লাটের সামনেই বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘তাজমহল’। তাজমহলের দরজার সামনে রেখে চলে যাবেন। আমি বিকাশে পেমেন্ট করে দিচ্ছি কত হলো?”
তপা হ্যাং মেরে বসে রইল। এই অ্যাপার্টমেন্টের কেউ কেক চাইছে। আর ও কিনা ডেলিভারি করার চিন্তায় এতক্ষণ প্যাচাল পাড়ল।

পরীক্ষা শেষ করে অলস ভঙ্গিতে হাই তুলল তপা। খুব একটা ভালো হয় নি পরীক্ষা। আবার খারাপও হয় নি। চলবে টাইপ । স্বপ্নগুলো মাঝরাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে বলে মনে হলো তপার। পড়াশোনায় আরও বেশি ফোকাস করতে হবে ভাবতে ভাবতে লিফটের দিকে গেল। বেশি ছাত্রছাত্রীর ভীড় দেখে বারান্দার রেলিং ধরে নিচে তাকাল। ছয়তলার উপর থেকে লাফ দিলে মরে যাবে কিনা ভাবছিল তপা। পরক্ষণেই নিজের ভাবনাকে ঝেড়ে ফেলে সিঁড়ির দিকে ছুট লাগালো লিফটের তোয়াক্কা না করেই।
লাইব্রেরীতে গিয়ে পরের পরীক্ষার জন্য কিছু বই খুঁজে বের করল। সবগুলো বই তপার নেই। শুধু যেগুলো দরকার সেগুলোই কিনেছে। একেক বইয়ে একেক লেখক একেক রকমভাবে লিখেছে। সেগুলো কালেক্ট করতেই এসেছে মূলত তপা।
বই খুঁজতে খুঁজতেই হঠাৎ বাইরে শোরগোল শুনতে পেল। পাত্তা না দিয়ে আবারও মনোযোগ দিল বই খোঁজায়। লাইব্রেরী পুরো ফাঁকা থাকায় তপার খানিকটা ভয় ভয়ও লাগছে। তার ওপর বাইরে চেঁচামেচি।
পলক কে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে সজল বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিল। পলক রাগে ফুঁসছে। একহাতে চুলগুলো টেনে ধরে অনবরত পায়চারি করতে ব্যস্ত সে।
তপা বইয়ের তাকের আড়াল থেকে পলকের রাগী চেহারা দেখে ভড়কে গেল। কিন্তু মুখের দিকে ভালো করে তাকাতেই খেয়াল করল গাল গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। ফর্সা চেহারায় রক্তের দাগ ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে তপার কাছে। তপা ভয় ঠেলে দ্রুত গতিতে পলকের সামনে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“আপনার কপাল থেকে রক্ত পড়ছে তো।”
পলক তপাকে খেয়াল করে অবাক হলো। মনে মনে ভাবল “এই মেয়ে এখানে কি করছে?”
তপা ব্যাগ খুলে মিনি ফার্স্ট এইড বক্স বের করে বলল,
“বসুন।”
পলক বিস্মিত হলো।
“তুমি ব্যাগে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে ঘুরো?”
তপা ঈষৎ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলল,
” মিনি বক্স তো। আপনি বসুন না প্লিজ। আমি এত উঁচুতে নাগাল পাব না।”
“লাগবে না। বাদ দাও। কিছু হবে না। আমার অভ্যাস আছে। এত অল্পতে পলক তাজওয়ারের কিছু হয় না।”
তপা করুন গলায় বলল,
“আমার অভ্যাস নেই তো আঘাত দেখার। প্লিজ বসুন।”
পলক বসল না। মস্তিষ্ক তার এখনো রাগে ধপধপ করছে। আঘাতে মলম লাগানোর সময় এখন নয়। সজল কে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে নিতে ইচ্ছে করছে তার । কেন লাইব্রেরীতে এনে বন্ধ করে দিল। ওদিকে কি অবস্থা কে জানে।
তপা উপায় না পেয়ে একটা চেয়ার টেনে দাঁড়িয়ে গেল চেয়ারের উপর। পলক তপার কান্ড দেখে রাগের মধ্যেও হেঁসে ফেলল। তপা নির্বিকার ভঙ্গিতে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। কটনের সাহায্যে রক্ত পরিষ্কার করে ক্ষত টাও পরিষ্কার করে দিল। ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে ভাল করে তাকাল পলকের মুখের দিকে। সে ধ্যানমগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে তপার মুখশ্রীতে। চোখের পলক পড়ছে না পলকের। তপা ইতস্তত বোধ করল এভাবে তাকিয়ে থাকায়। মাথা নিচু করে চেয়ার থেকে নামতে চাইলে পলক বলল,
“ডাক্তার ম্যাডাম ব্যথা তো কমার পরিবর্তে আরও বেড়ে গেল। এখন কি হবে?”
তপা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। পলক হেসে ফেলল।পরক্ষণেই গম্ভীর হওয়ার ভান করে বলল,
“তুমি আমাকে কুঁচকানো ভ্রু দেখাচ্ছো? চেনো আমাকে?”
তপা ঈষৎ কেঁপে উঠল। এতক্ষণ তো ভালোই ছিল। আবার নিজের ক্যারেক্টারে ফিরে যাচ্ছে লোকটা। অগ্যতা তপা জোর করে হেসে বলল,
“আপনাকে কে না চেনে? আপনি এই ভার্সিটির একমাত্র ফ্যামাস পারসন। আপনাকে না চিনলে চলে? ইনফ্যাক্ট আমার আরও ভালো করে চেনা উচিৎ। আপনিই তো আমাকে প্রথম দিন বাঁচিয়ে ছিলেন। ”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“হঠাৎ এত মিষ্টি মিষ্টি কথা বের হচ্ছে কেন বলো তো?” দরজার দিকে চোখ পড়তেই শয়তানি হেসে বলল,
“বন্ধ রুমে আছি বলে কনভেন্স করছো আমাকে?”

তপা চোখ বড় বড় করে দ্রুত গতিতে বইয়ের তাকের আড়ালে চলে গেল। চেঁচিয়ে বলল,
“আপনি এপাশে আসবেন না প্লিজ।”
কিন্তু পলক সে তো পলকই। না বললে সে অবশ্যই সেখানে যাবে। একপা দুপা করে তপার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তপা পেছনে সরে যেতে যেতে বইয়ের সেলফের সাথে লেগে গেল। সাইডে সরে যেতে চাইলে দু’হাতের বাঁধনে আঁটকে ফেলল। না স্পর্শ করে নি এক বিন্দুও। তপা ভয় ভয় চোখে তাকাল পলকের মুখশ্রীতে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে সে। তপা ভেবে পেল না তার মধ্যে মুগ্ধ হওয়ার মত এমন কি আছে। টের পেল তখন যখন পলক হাত বাড়িয়ে চুলের কাটা থেকে চুলগুলো আলগা করে দিল। কাটা খুলে ফেলতেই ঝলমলে চুলগুলো বাঁধনহারা হয়ে ছড়িয়ে গেল পিঠ বেয়ে হাঁটু অবধি। হাত বাড়াতে গিয়েও ফিরিয়ে নিল। তপা ততক্ষণে চোখ বন্ধ করে বিরবির করছে। ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়েও দরদর করে ঘামছে তপা।
পলক মিনিট দুয়েক পর আচমকা তপাকে টেনে নিয়ে বসে পড়ল। তপা তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল পলকের বুকের উপর। পলক পিঠে হাত রেখে নিজের সাথে জড়িয়ে আড়াল করে নিল। সামলে উঠে তপা কিছু বলার চেষ্টা করতেই পলক একহাতে মুখ চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,
“আমি লাইব্রেরী থেকে একা বের হবো। খবরদার আমার পেছন পেছন বের হবে না তুমি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমি তোমাকে নিয়ে যাব এখান থেকে।”
তপা হাত সরিয়ে নিজেও ফিসফিস করে বলল,
“কিন্তু কেন? আমি আপনার সাথে বের হলে কি আপনার জাত যাবে ?”
“জাত আমার যাবে না। কিন্তু একসাথে বের হলে কথা উঠতে পারে বন্ধ লাইব্রেরীতে তুমি আমি কি করছিলাম। অনেকক্ষণ তো হলো আঁটকে আছি। সেজন্যই বলছিলাম। অবশ্য আমার এসবে কিছু যায় আসে না। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই এসব ব্যাপারে সেনসিটিভ। তাই বলছিলাম। এখন তুমি যদি চাও আমার সাথে নিজের রং তামাশার নিউজ দেখতে তাহলে বের হতেই পারি একসাথে। যাবে? এসো।”
তপা চোখ পাকিয়ে তাকাল। পলক ভ্রু কুঁচকে মুখটা এগিয়ে নিয়ে বলল,
” পলক তাজওয়ার কে চোখ দেখাচ্ছো মেয়ে!”
তপা ছিটকে সরে বসে বলল,
“যান তাড়াতাড়ি। আশ্চর্য বাড়ি ফিরব তো আমি।”
পলক যেতে যেতে বলল,
“কিছুক্ষণে ফিরছি আমি। খবরদার বের হবে না।”
সজল এসে দরজা খুলে দিল। জানালা দিয়ে সজলের সাথে কয়েকজনকে আসতে দেখেই তপাকে টেনে বসিয়ে দিয়েছিল পলক।
সজলকে কড়া গলায় বলল,
“তুই পাঁচ মিনিট দাঁড়া দরজার সামনে। খবরদার না নিজে ভেতরে ঢুকবি আর না অন্য কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিবি। এই কাজটা করতে পারলে আমাকে বন্ধ করে রাখার অপরাধটা মাফ করে দেব।”
বলেই হনহন করে ছুটে গেল সামনের দিকে। ঠিক সেদিকে যেদিকে তার মাথায় আঘাত করা হয়েছিল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here