#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি
পর্ব___১৯
__বড় ভাইয়া উত্তর দাও স্পন্দন যা বললো তার।
সৈয়দ মির্জা অসহায় ভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ।কোনো রকম কথাই তার মুখ থেকে বের হচ্ছে না আজ।তা দেখে উনার আম্মা বললেন,
__এটা হাসপাতাল। এখানে এসব পারিবারিক সমস্যার কথা না বলাই ভালো।সবাই বাড়িতে চলো। ওখানে গিয়ে সব কথা হবে।
__আমি কোথাও যাবো না দাদিমা।তোমরা যাও। আমি চন্দ্রকে রেখে কোথাও যেতে পারবোনা।
__সারাদিন অনেক ধকল গেছে তোর স্পন্দন। এবার বাড়িতে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নে। আমি আছি চন্দ্রর কাছে।
__আমি কোথাও যাবো না মা।তোমরা যাও। চন্দ্র ভয় পেয়ে আছে।ঘুম থেকে উঠেই আমাকে খুঁজে না পেলে উত্তেজিত হয়ে যাবে। আমি ঠিক আছি। তুমি বাড়িতে যাও মা।
সবাই চলে যেতেই স্পন্দন হাসপাতালের করিডরে গিয়ে বসলো।মাথার চুলে হাত দিয়ে চন্দ্রকে নিয়ে ভাবতে লাগলো।মিশাল এগিয়ে এলো স্পন্দনের কাছে।বললো,
__স্যার একবার থানায় গিয়ে দেখে আসছি আমি।আবরার চৌধুরীর নামে সব এভিডেন্স গুলো জমা ও তো করতে হবে।
__হুম।তবে ও যেনো ওর কৃতকর্মের উপযুক্ত শাস্তি পায় মিশাল।ওর জন্য হৃদি পৃথিবীতে নেই। আমি হৃদির মৃত্যুর দায়ভার নিয়ে আজ মাথার উপর অপরাধীর ট্যাগ ঝুলছে। সৈয়দ মির্জার এখনো তার অপরাধের শাস্তি দেওয়া বাকি।
__চিন্তা করবেন না স্যার। একবার যখন আবরার চৌধুরী ধরা পড়েছে তখন তার শাস্তি সে পাবেই।আর আপনার বাবা,,,,
__সৈয়দ মির্জার জন্য আমার জীবন আজ ছন্নছাড়া অগোছালো। আমি অপরাধী তার করা কুকর্মের জন্য।তাকেও শাস্তি পেতে হবে মিশাল।
__জ্বী স্যার সব হবে। আপনি এখন ম্যামের কাছে যান। আমি থানায় যাচ্ছি।
__হুম।
মিশাল চলে যেতেই স্পন্দন চন্দ্রের কেভিনে গিয়ে ওর পাশে বসলো। চন্দ্র আজকের ঘটনা গুলো ঠিক কিভাবে নেবে সেটাই ভাবছে।যদি চন্দ্র ওকে ভুল বুঝে?যদি আবরারের বলা কথাগুলো বিশ্বাস করে?যদি ওকে ছেড়ে চলে যেতে চায়?ভাবতে ভাবতেই স্পন্দনের বুকের ভেতরটা চাপা কষ্টে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে।
সৈয়দ মির্জার দিকে সবাই প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।ঘটনা জানার জন্য সবার আগ্রহের ও শেষ নেই। এরপর সৈয়দ মির্জার আম্মা বললেন,
__মির্জা বলো সবাইকে যা জানার জন্য সবাই অপেক্ষা করে আছে।
__আমি আর মাহতাব চৌধুরী ব্যবসায়ীক প্রতিদন্দী ছিলাম অনেক আগে থেকেই।তার ই মেয়ে ছিলো হৃদি। আমার লোকজন যখন আমাকে খবর দেয় স্পন্দন আর হৃদির সম্পর্ক নিয়ে তখন ওরা বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিয়েছে একে অপরকে। আমি এই নিয়ে স্পন্দনকে প্রশ্ন করলে ও সবটাই বলে আমাকে।আরো বলে সে হৃদিকে ভালোবাসে আর বিয়ে করতে চায়। আমার সাথে এই নিয়ে অনেক কথা কাটাকাটি হয় স্পন্দনের।
ওদিকে মাহতাব ও জেনে যায় এই সম্পর্কের ব্যাপারে।সে আমাকে ব্লাকমেইল করতে থাকে এই সম্পর্ক মেনে নিতে।আমি রাজি না হলে ওরা অন্য ভাবে চেষ্টা করে।স্পন্দনের সাথে দেখা করতে চায় হৃদি। কিন্তু মাহতাব ওকে বলে যদি ও স্পন্দনকে বলে আমাকে ওর ব্যবসার পথ থেকে সরিয়ে দিতে পারে তবেই স্পন্দনকে মেনে নেবে।হৃদি তাদের কথা বিশ্বাস করে স্পন্দনকে ফাঁদে ফেলতে হাত মেলায় বাবা ভাইয়ের সাথে। এরপর স্পন্দনকে বলে আমি তোমাকে বিয়ে করব যদি তোমার বাবা আমার বাবার দেওয়া সব শর্ত মেনে নেয়।স্পন্দন হৃদিকে ভালোবেসে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে আমার হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করে। আমি রাজি হই না।এটা যখন স্পন্দন হৃদিকে বলে তখন হৃদি স্পন্দকে বলে তুমি যদি আমার জন্য এটুকু করতে না পারো তবে আমি ও বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবো।
স্পন্দন পাগলের মতো হয়ে যায় এরপর।নেশা করতে থাকে। আমাকে সহ্য করতে পারে না।তখন মাহতাবের সাথে আমার ডিল করার জন্য দেখা করতে বলি। সেদিন উত্তেজিত হয়ে দু পক্ষের সংঘর্ষে মাহতাবের গায়ে গুলি লাগে।সেটা খুব অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘটেছিলো। কিন্তু আবরার আমাকে অপরাধী মনে করে। আমার নামে কেইস ও দেয়। আমি এর থেকে বাঁচতে স্পন্দনকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করি।স্পন্দনকে আশ্বাস দেই হৃদির সাথে বিয়ে দেওয়ার।ও আমার কথায় হৃদির সাথে দেখা করতে যায়। কিন্তু সেদিন হৃদি নিজের ভুল বুঝতে পেরে সুইসাইড করে।আর আবরার স্পন্দনের নামে শারীরিক নির্যাতনের পর হ’ত্যা মামলা দিয়ে দেয়। আমাকেও জেলে যেতে হবে এই ভয়ে আবরারের সাথে মিলে সেই দোষ ও স্পন্দনের উপরেই দিয়ে দেই।জেইল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর স্পন্দন তা জেনে যায়।আর তারপরের ঘটনা তো সবারই জানা।
__ছিঃ ভাইয়া ছিঃ। নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য ছেলের জীবন নিয়ে খেলতে তোমার বিবেকে বিন্দুমাত্র দ্বিধা হলো না। মানুষ সন্তানের জন্য কত কিছুই করে।আর তুমি? নিজের ছেলেকেই অপরাধী বানিয়ে দিলে।একটা চরিত্র হীন লম্পটের খেতাব নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার জীবন দিয়ে দিলে?
__আমি তখন টাকা আর ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়েছিলাম।যখন ভুল বুঝতে পেরেছি তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।স্পন্দনের মনে তখন আমার জন্য ঘৃণা ছাড়া কিছুই নেই।
__এতো কিছু করার পরেও তুমি বলছো তোমার জন্য ভালোবাসা রাখতে। কিভাবে? তুমি পারতে?
__আমাকে ক্ষমা করে দাও তোমরা সবাই। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।
__থানায় খবর দে আশরাফ। এবার আর লুকোচুরি না রেখে ওর উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হোক।
__আচ্ছা আম্মা।আমি ফোন করছি।
সবাই সত্যিটা শুনে বিশ্বাস ই করতে পারছেনা।সবাই এখনো ঘোরের মধ্যে আছে।স্পন্দনের জীবনে এতো কিছু হয়ে গেছে।অথচ ওরা জানেই না।দাদিমা বললেন,
__আমাকেও সবাই ক্ষমা করে দিও।সত্যিটা জেনেও চুপ করে থেকে ছেলেকে বাঁচাতে চেয়েছি।স্পন্দনের সঙ্গে জোর করে চন্দ্রের বিয়ে দিয়েছি।তবে ভালোর জন্যই দিয়েছি।কারণ আমি জানতাম যদি কেউ স্পন্দন দাদুভাইকে ভালো রাখতে পারে সেটা চন্দ্র। তোমাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি বলে মাপ করে দিও তোমরা।
স্পন্দন পরদিন চন্দ্রকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো। চন্দ্র মানসিক ভাবে ভীষণ আঘাত পেয়েছে।বাড়িতে আসতেই ওর মা স্পন্দনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
__আমাকে ক্ষমা করে দে বাবা।এতো কিছু ঘটে গেছে তোর জীবনে আর আমি মা হয়ে কিছুই করতে পারলাম না।
__তোমার কোনো দোষ নেই মা। তুমি কাঁদছো কেনো?যে অপরাধ করেছে তাকে তার পাপের শাস্তি পেতেই হবে মা।
__চন্দ্র মা তুই ঘরে চল।
__আমি থানা থেকে আসছি মা।
চন্দ্র ওর বড় আম্মুর কাছে সব শুনে কেঁদে ফেললো।বললো,
__তোমার এই ছেলেকে অপরাধী ভেবে আমি কত কিছু বলেছি তোমাকে। আমাকে মাপ করে দাও বড় আম্মু।
__তুই তো কিছু ভুল বলিস নি মা। আমরাও তো জানতাম না স্পন্দন যে সত্যি সত্যি তার বাবা আর আবরার চৌধুরীর চক্রান্তের শিকার হয়ে জেল খেটেছে। তুই তারপরও আমার কথা রেখে ওর সাথে থেকে গেছিস।তার জন্যেই আজকে আমি আমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছি। আমার সেই হাসি খুশি স্পন্দন।
__বড় আম্মু?
__বল চন্দ্র।
__বড় আব্বুকে মাপ করে দাও।
__আমি তাকে মাপ করার কেউ না চন্দ্র।সে অপরাধ করেছে স্পন্দনের সাথে।স্পন্দন চাইলেই তাকে মাপ করবে।নয়তো না।তবে যে আমার ছেলের জীবন নিয়ে খেলেছে তাকে আমি অন্তত কোনো দিন আগের চোখে দেখতে পারবোনা।
স্পন্দনের সামনে ওর বাবা লকাপে মাথা নিচু করে আছে।স্পন্দন বললো,
__এসব করে কি পেলেন সৈয়দ মির্জা?
__আমাকে ক্ষমা করে দিও স্পন্দন।
স্পন্দন হাসতে হাসতে বললো,
__আমার জীবন থেকে যে দুটি বছর হারিয়ে গেছে তা আপনি ফেরত দিতে পারবেন সৈয়দ মির্জা?
__আমি অনুতপ্ত স্পন্দন।
স্পন্দন আর কিছু না বলে বেরিয়ে এলো। সোজা গিয়ে দাদিমার সামনে চলে গেলো।দাদিমা মাথা নিচু করে আছে।স্পন্দন বললো,
__তুমি সব জানতে দাদিমা?
__তুমি যখন জেল থেকে বেরিয়ে নেশায় ডুবে থাকতে তখন একদিন মির্জা আমার কাছে এসে সব বললো। আমি চাইলেই সেদিন ওকে পুলিশের কাছে দিতে পারতাম। কিন্তু তোমার বাবা আমার বড় ছেলে।তার প্রতি আমার স্নেহ সেদিন আমাকে সব লুকিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলো দাদুভাই। কিন্তু আমি চাইনি তোমার জীবন এমন অন্ধকার হয়ে থাকুক।তাই চন্দ্র দিভাই এর সাথে তোমার বিয়ে দেওয়ার কথা বলি তোমার বাবাকে।সে প্রথম মেনে নিতে না চাইলেও আমার কথায় বাধ্য হয়ে রাজি হয়ে যায়।
__আমার আর কারো প্রতি কোনো রকম রাগ অভিমান অভিযোগ নেই। তুমি তোমার ছেলেকে বলে দিও তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
__আমাকে ভুল বুঝো না দাদুভাই।
__তোমার জন্য আমি চন্দ্রকে পেয়েছি দাদিমা। চন্দ্র আমাকে যতটা ভালোবাসে এমন করে আর কেউ কখনো ভালোবাসতে পারবেনা।তাই এজন্য তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ দাদিমা।
#চলবে,,,,,,
হ্যাপি রিডিং।