#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি
পর্ব__১৪
__হয়েছে তো স্পন্দন। এবার কোল থেকে নামিয়ে দিবেন দয়া করে।এতো সময় ধরে তো কম লোক হাসালেন না। এবার কি জনাবের মর্জি হবে কোল থেকে নামাতে?
__আমার বউ। আমি কোলে নিয়ে থাকবো না মাথায় নিয়ে নাচবো সেটা নিয়ে তুই কথা বলার কে চন্দ্র?
__আচ্ছা মসিবত তো। আচ্ছা আপনার হয়েছে টা কি বলেন তো?
স্প্দন আর কিছু না বলেই চন্দ্রকে কোলে নিয়েই টুপ করে বিছানায় গিয়ে বসলো। চন্দ্র এবার স্পন্দনের কপালে হাত রেখে বললো,
__কোথায় শরীরে তো জ্বর নেই। তাপমাত্রা তো ঠিকই আছে।
__তো আমি কখন বললাম যে আমার জ্বর আসছে।
__নাহ্।তা বলেন নি। কিন্তু আপনার হাবভাব দেখে আমার মনে হলো হয়তো জ্বর টর এসেছে।তাই আপনার মাথার স্ক্রু গুলো ঠিকমতো কাজ করছে না।
চন্দ্র এবার নাক এগিয়ে স্পন্দনের গায়ের থেকে ঘ্রাণ নিতে নিতে বললো,
__নেশা টেসাও তো করেন নি বলে মনে হচ্ছে।গায়ে তো কোনো নেশার ঘ্রাণ পাচ্ছিনা।
__আমি নেশায়ই ডুবেছি চন্দ্র।তবে এ নেশা সে নেশা নয় যেটা তুই ভাবছিস।
__আল্লাহ বলেন কি?এই জন্যই তো তখন থেকেই উল্টাপাল্টা কথা আর কাজ করছেন।চলেন ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিবেন স্পন্দন।
__তুই কিন্তু আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছিস চন্দ্র।
__আরে রেগে যাচ্ছেন কেনো? আমি তো শুধু বলছি আপনি যদি কিছু খেয়ে থাকেন? তাই আর কি?
__আমি কিছু খাইনি চন্দ্র।তবে তুই বললে খেতে পারি।
স্পন্দনের কথায় থতমত খেয়ে চন্দ্র তোতলাতে তোতলাতে বললো,
__ক্ কি খাবেন আপনি?
__চুমু।
চন্দ্রর আবার কান গরম হয়ে উঠলো।এই লোকটি আজকে আমাকে ইচ্ছা মতো লজ্জায় ফেলতেই উঠে পড়ে লেগেছে দেখছি। তারপর একটু পিছিয়ে স্পন্দনের থেকে দূরে বসে চন্দ্র বললো,
__দেখুন স্পন্দন।
__দেখা চন্দ্র।
__এমন উদ্ভট আচরণের কারণ কি স্পন্দন?জ্বীনে টিনে ধরেনি তো?
__ধরেছে কঠিন অসুখে ধরেছে।
__বলেন কি? তাহলে বাইরে চলেন।সবাইকে বলে একটা ডাক্তার আনা যায় কিনা দেখি।
স্পন্দন একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে চন্দ্রের কোলের উপর শুয়ে পড়ল। এরপর বললো,
__ডাক্তার আনতে হবে না। তুই পাশে থাকলে এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।ঘুম পাচ্ছে। নড়াচড়া না করে ঘুমাতে দে চন্দ্র।
অগত্যা চন্দ্র বসে থেকে স্পন্দনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। এদিকে স্পন্দনের মা এসে উনার শ্বাশুড়ি আম্মাকে সালাম করে চোখ মুছতে মুছতে বললো,
__আম্মা আমার স্পন্দন ফিরে এসেছে।
__দাদুভাই কোথাও গিয়েছিলো বড় বৌমা?
__দু’বছর আগে হারিয়ে যাওয়া আমার সেই স্পন্দন আবার ফিরে এসেছে আম্মা। আমার হাসিখুশি ছেলেটাকে এতো দিন পরে আবার সেই আগের মতোই স্বাভাবিক ভাবে দেখলাম আম্মা।
এরপর একটু আগে যা যা ঘটেছে সব খুলে বললেন স্পন্দনের মা।সব শুনে উনার শ্বাশুড়ি বললেন,
__আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো না বড় বৌমা। আমি জানতাম চন্দ্র দিভাই যা পারবে তা আর কেউ পারবেনা বৌমা।
__কিন্তু আম্মা চন্দ্র আমাদের উপর এখনো রেগে আছে যে।আমরা সবাই স্পন্দনের জীবন বাঁচাতে গিয়ে ওর সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি আম্মা।জানি এর জন্য চন্দ্র আমাদের কখনোই ক্ষমা করবে না আম্মা।
__জানি বড় বৌমা। কিন্তু সত্যিটা যখন চন্দ্র জানবে তখন এই রাগ অভিমান আর থাকবে না বৌমা। তুমি দেখে নিও।আসলে ওকে আমার সব কিছু খুলে বলা উচিত। কিন্তু ও আমার উপর যেভাবে অভিমান করে আছে তাতে এই মুহূর্তে এসব বললে ও বিশ্বাস করতে পারবেনা।সময় আসুক আমি নিজেই সব বলবো বড় বৌমা।
__হ্যাঁ আম্মা। আপনি যা বলবেন তাই হবে।
__আমি জানতাম আমার ভেঙে পড়া দাদুভাইয়ের মনটা যদি কেউ জোড়া লাগাতে পারে সেটা শুধু চন্দ্র দিভাই ই পারবে। তুমি আর এসব নিয়ে চিন্তা করো না বড় বৌমা।
__জ্বী আম্মা।
পরদিন সকালে কারো ধাক্কাধাক্কিতে চন্দ্রের ঘুম ভাঙলো। উঠে বসে দেখে সিঁথি। চারপাশে তাকিয়ে দেখে স্পন্দন নেই।চোখ ডলতে যাবে তখনই সিঁথি চন্দ্রের হাতটা ধরে বললো,
__চন্দ্র আপু?কি সুন্দর করে মেহেদী পড়েছো তুমি।কখন পড়লে?
চন্দ্র নিজেও অবাক। তবুও সিঁথিকে বুঝতে না দিয়ে বললো,
__রাতে পড়েছি সিঁথি।
__খুব সুন্দর হয়েছে আপু। এখন উঠে পড়ো। অনেক বেলা হয়ে গেছে।বড় মামানি তোমাকে ডাকতে পাঠিয়েছেন।কাল রাতে বুঝি ভাইয়া তোমাকে ঘুমাতে দেয়নি?
চন্দ্র ওর কানটা টেনে ধরে বললো,
__বেশি পাকা পাকা কথা বলতে শিখেছিস সিঁথি।দিবো এক থা’প্পড়।
সিঁথি মুখ ফুলিয়ে পড়লো।তা দেখে চন্দ্র ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,
__তুই যা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
সিঁথি চলে যেতেই চন্দ্র হাতটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। আসলেই সুন্দর লাগছে দেখতে মেহেদী।ওর আর বুঝতে বাকি নেই যে এসব স্পন্দন করেছে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে। আবার ওকে বিছানায় ঠিক করে শুইয়ে ও দিয়েছে। এরপর ফ্রেশ হয়ে নিচে নামার সময় চন্দ্রের মনে হল মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে।হয়তো কাল থেকে না খেয়ে থাকার জন্য হয়েছে। মেহেদী দিতে গিয়ে খাবার যে খায়নি সেটাই ভুলে গেছে ও। এখন এই কথা যদি স্পন্দন শুনতে পায় তাহলে বাড়ি মাথায় তুলে হাঙ্গামা খাড়া করে দিবে।তাই নিরার কাছে গিয়ে বসলো চন্দ্র।বললো,
__বাড়ির সবাই কোথায় রে নিরা?
__ছেলেরা বাজারে গেছে।আর বাবা বড় আব্বু মেজো আব্বু বাইরে ডেকোরেশনের ওদিকটা দেখছে।আর তোমার জ্ঞাতার্থে বলে রাখি ভাইয়াও বাজারে গেছে।যাবার আগে বড় আম্মুকে বলে গেছে তোমাকে যেনো দশটার আগে কেউ না ডাকে।আর এরপর উঠিয়ে খেতে দেয়।তো এবার তুমি খেয়ে এসো আপু। অনেক বেলা হয়ে গেছে যে।
__মিতু আপু কোথায় নিরা?
__ঘরেই আছে।ফুপির সাথে কথা বলছে।জানো তো সকাল থেকেই কান্নাকাটি করছে আপু।
চন্দ্র আর কিছু না বলে উঠে ডাইনিং এ গিয়ে বসলো।মাথার ভেতর ভীষণ খারাপ লাগছে।বসে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে। তবুও বড় আম্মুকে ডেকে বললো,
__বড় আম্মু? খাবার দাও।
__বস চন্দ্র।আমি খাইয়ে দেই।
মায়ের কথাটা আর ফেলতে পারলো না।তাই মায়ের হাতে খেতে লাগলো। চন্দ্রের যেমন চোখ ছলছল করছে তেমন ওর মায়ের ও করছে। আরেকজন রান্না ঘরের আড়ালে বসে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে আর হাসছে।সে আর কেউ নয়।স্পন্দনের মা। চন্দ্র যে ওর মায়ের সাথে ঠিকমতো কথা বলতে চায়না সেটার জন্য উনি নিজে না এসে এই সুযোগে চন্দ্রের মা’কে পাঠিয়েছেন। খাবার শেষের পথে। এমন সময় চন্দ্র বললো,
__আর দিও না আম্মু। কেমন বমি বমি পাচ্ছে।মাথাটাও ঘুরাচ্ছে।আর খাবো না।
__কি হয়েছে চন্দ্র?শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?
__তেমন কিছু না আম্মু।কাল রাতে খাওয়ার কথা মনে ছিল না।তাই হয়তো এমন লাগছে।
__আচ্ছা তুই তাহলে একটু শুয়ে রেস্ট নে।আমি একটু শরবত করে আনছি।
চন্দ্র মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই আবার কেমন ঘুরে উঠলো মাথাটা। সামনে আবছা আবছা দেখতে পেলো স্পন্দন মনে হয় দৌড়ে ওর দিকে আসছে। এরপর আর কিছুই মনে নেই।যখন জ্ঞান ফিরলো দেখে একটা হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে স্পন্দন।মুখটা শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে।চোখে মুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ স্পষ্ট।আরেক পাশে ওর বড় আম্মু মেঝো আম্মু ওর আম্মু ফুপা ফুপিরা দাঁড়িয়ে।ডাক্তার প্রেসার মাপতে ব্যস্ত। চন্দ্র নড়ে উঠতেই স্পন্দন দুই হাতে ওর হাতটা ধরে বললো,
__এখন কেমন লাগছে চন্দ্র?শরীর কি একটু ভালো লাগছে?
__তোমাদের বাপ ছেলের জন্য আজকে আমার মেয়ের এই অবস্থা।তোমরা ওকে এতো মানসিকভাবে বির্পযস্ত করে দিয়েছো যে মেয়েটা আমার মরতে বসেছে।
হঠাৎ করেই আব্বুর এসব কথা শুনে বুঝতে পারলো চন্দ্র নিশ্চিত এতো সময় ওর অসুস্থতার জন্য এমন আরো অনেক কথা বলাবলি হয়েছে।তাই স্পন্দনের চোখ মুখের এই অবস্থা। চন্দ্র খেয়াল করলো স্পন্দনের চোখ মুখ আরো পাংসুটে বর্ণের হয়ে আসছে।সাথে চোখে রাগের চিহ্ন। চন্দ্র স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললো,
__আমি ঠিক আছি স্পন্দন। বিশ্বাস করেন আমার কিছু হয়নি স্পন্দন।
স্পন্দন কিছু না বলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
__এসব কিছু নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না চন্দ্র।চোখ বন্ধ করে একটু শান্ত হয়ে থাক।আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
প্রায় সাথে সাথেই চন্দ্রের আব্বু আবার হু’ঙ্কার দিয়ে উঠলো। বললেন,
__এখন আর লোক দেখানো আদর সোহাগ দেখাতে হবে না তোমাকে স্পন্দন। শুধু আম্মার কথাতেই আমি এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম।না হলে আমার মেয়েকে সারাজীবন ঘরে বসিয়ে রাখলেও তোমার মতো ছেলের সাথে বিয়ে দিতাম না।আর ছেড়ে দেবো না। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে আজকেই আমার বাড়িতে যাবো। এভাবে তোমাদের কাছে ফেলে রাখলে মেয়েটা আমার এভাবেই মরে যাবে।তা আমি ওর আব্বু হয়ে কিছুতেই সহ্য করতে পারবোনা।
স্পন্দন সহ সেখানে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সামান্য একটা ঘটনা নিয়ে জল এতো দূরে গড়াবে সেটা বোধকরি কেউই ভাবতে পারেনি।
#চলবে,,,,,,,