মেয়েবেলা পর্ব ৩

0
600

#মেয়েবেলা
#৩য়_পর্ব
#লেখনীতে_সুপ্রিয়া_চক্রবর্তী

মালিহাকে নিতে এসেছে সোহেল। মালিহার তা নিয়ে কোন ভাবাবেগ নেই। সে নিজের মতো বসে আছে। মালিহার ভাবি সুলতানা সোহেলের আগমনেই বুঝে গেল তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই কোন ঝামেলা হয়েছে। তাই সে ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। সোহেল মালিহাকে বলল, “আমি আমার সব ভুল স্বীকার করছি। জানি তোমাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছি। তুমি আমার সাথে ফিরে চলো প্লিজ।”

“তুমি কি ভেবেছ টা কি? আমি মেয়ে জন্য আমার কোন আত্মসম্মান থাকবে না? যখন ইচ্ছা আমাকে ছু*ড়ে ফেলে দেবে, আবার এসে বলবে আমার ভুল হয়েছে আমাকে ক্ষমা করে দেও। আর আমিও নাচতে নাচতে তোমাকে ক্ষমা করে দিয়ে তোমার সাথে চলে যাবো৷ যদি এমনই ভেবে থাকো তাহলে তুমি ভুল ভাবছ। আমার কাছে আমার আত্মসম্মানটাই সবার আগে। তুমি যেভাবে আমাকে অপমান করে চলে আসতে বলেছ তারপর আমি আর ফিরব না।”

সোহেল ভীষণ রেগে যায় মালিহার এমন কথায়। তার মানে লাগে কথাটা। তাই সোহেল বলে, “ভেবেছিলাম তোমাকে একবার সুযোগ দেব। কিন্তু না তুমি তো কোন কথা শোনার মেয়ে নও। ঠিক আছে তুমি থাকো তোমার আত্মসম্মান নিয়ে। আমিও দেখব কতদিন টিকে থাকে তোমার এই আত্মসম্মান। দুদিন পর যখন বাপের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে তখন বুঝতে পারবে।”

মালিহা খুব জোরে হাসতে হাসতে বলে, “আমার কথা আপনাকে ভাবতে হবে না মিস্টার সোহেল। আপনার মতো কাপুরুষের সাথে আমি সংসার করতে চাই না। যে শুধুমাত্র সন্তান জন্ম না হওয়ায় তার স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। কোন বাধ বিচার ছাড়াই। আচ্ছা সমস্যাটা কি আমার? আপনার কি সমস্যা হতে পারে না? হতে পারে। কিন্তু আপনি সেটা মানবেন না। কারণ আপনার পুরুষত্বে আঘাত হানবে সেটা। যাইহোক আমি আর কথা বাড়াতে চাই না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনি আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিলেই আমি বিনাশর্তে সই করে দিয়ে মুক্তি দেব আপনাকে।”

সোহেল এই পর্যায়ে রেগে গিয়ে বলে,“আইনি ভাবে তোমাকে ডিভোর্স তো দেবোই। তার আগে আমি তালাক দিয়ে দিচ্ছি। এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক। যাও আজ থেকে মুক্ত তুমি।”

মালিহা প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়। যেন আজ কোন বড় একটা অভিশাপ থেকে মুক্তি ঘটল তার।

❤️
সুবর্ণা আজ সকাল থেকে দুই বার বমি করেছে। এর কারণ কি সেটাই উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে। সুবর্ণার মনে সন্দেহ হতেই সে চলে যায় প্রেগ্ন্যাসি কিট কিনতে। আর প্রেগ্ন্যাসি কিট নিয়ে আসার পর যখন টেস্ট করে তখন এমন কিছু দেখে যা অবিশ্বাস্য আর একইসাথে যন্ত্রণাদায়ক ছিল সুবর্ণার জন্য। কারণ সুবর্ণা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয় সে মা হতে চলেছে। তার মধ্যে বেড়ে উঠছে আরো একটি নিষ্পাপ প্রাণ। সুবর্ণা প্রথমদিকে ভেঙে পড়ে। তবে সহসাই নিজেকে দৃঢ় করে তোলে। সুবর্ণা মনে করে, “এখন কিছুতেই ভেঙে পড়লে আমার চলবে না। এই সময় নিজের অনাগত সন্তানের জন্য হলেও আমাকে শক্ত হতে হবে। জানি আমার এই জীবনে সহজে কিছু হবে না। সামনে অনেক বেশি অসুবিধার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এই সমাজ আমাকে ভালো থাকতে দেবে না। কিন্তু আমাকে সবার সাথে লড়াই করতে হবে।”

সুবর্ণা তার মায়ের কাছে যায়। সিতারা বেগম রান্না করছিলেন। সুবর্ণাকে দেখামাত্রই মুখ অন্ধকার করে নেন। মূলত মালিহার হয়ে কথা বলায় তিনি রেগে আছেন নিজের মেয়ের উপর। এমন সময় ঘটে সোহেলের আগমন। রাগী চেহারা নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে সোহেল। তাকে দেখামাত্রই সুবর্ণা ছুটে যায়। সোহেলকে প্রশ্ন করে, “তুমি একা কেন? তুমি তো গিয়েছিলে মালিহা ভাবিকে ফিরিয়ে আনার জন্য। ভাবিকে আনোনি?”

সোহেল সিংহের মতো গর্জন করে বলে, “আজকের পর থেকে ঐ মেয়ের নাম আর আমার সামনে নিবি না। আমি আজ সব ঠিক করে এসেছি। খুব দেমাগ ঐ মেয়ের না। একেবারে তিন তালাক দিয়ে চলে এসেছি। খুব তাড়াতাড়ি ডিভোর্স পেপারও পাঠিয়ে দেব। ডিভোর্সের খুব ইচ্ছা ঐ মেয়ের। এবার ওর ডিভোর্সের ইচ্ছাই আমি পূরণ করে দেবো।”

সিতারা বেগম খুশিতে গদগদ হয়ে বলেন, “তুই একদম ঠিক কাজ করেছিস সোহেল। ঐ মেয়েকে তালাক দিয়েছিস। কি এমন মেয়ে, মা হতে পারেনি তার আবার দেমাগ। আমি তোকে আগেই বলেছিলাম এভাবে আলগা পিরিত না দেখাতে যেতে। তখন তো আমার কথা শুনলি না। এখন বুঝলি তো মায়েরা যা বলে ভালোর জন্যই করে।”

“হ্যাঁ আম্মু আমি বুঝতে পারছি। তুমি যা বলেছিলে একদম ঠিক।”

“তুই কোন চিন্তা করিস না বাপ। আমি তোর আবার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করব। আগেও থেকে সুন্দরী বউ আনব। আর দেখবি এবার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তুই বাবা ডাক শুনতে পারবি।”

সুবর্ণা খুবই অবাক হয় নিজের মা-ভাইয়ের এহেন কথোপকথন শুনে। তার প্রতিবাদী সত্তা হঠাৎ করেই জেগে ওঠে। সুবর্ণা নিজের মাকে প্রতিবাদ করে বলে, “তুমি এমন কথা কিভাবে বলছ আম্মু? একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট করে তোমাকে এত খুশি লাগছে। একবার ভাবির যায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখো তো কেমন লাগে।”

সিতারা বেগম নিজের মেয়েকেও ছাড় দেন না। মুখ ঝামটি দিয়ে বলেন,
“আমাকে এত জ্ঞান দেওয়ার দরকার নেই। তুই নিজের চিন্তা কর। এখন বুঝতে পারছি তোর স্বামী কেন তোকে ছেড়ে দিয়েছে। মেয়ে মানুষ মুখে মুখে এত তর্ক করলে সংসার টিকে নাকি। মেয়েদের থাকতে হয় নম্র ভদ্র।”

“তুমি কি মেয়ে নও আম্মু? কই তোমার ব্যবহার তো আমার নম্র ভদ্র মনে হচ্ছেনা।”

নিজের মেয়ের থেকে এমন জবাব প্রত্যাশা করেন নি সিতারা বেগম। তবে তিনি দমে যাওয়ার পাত্রী নন। আবারও বলেন, “আমি তোর মা। তুই আমাকে জন্ম দিস নি আমি তোকে জন্ম দিয়েছি। তোর থেকে দুনিয়া বেশি দেখেছি আমাকে তাই এসব শেখাতে আসিস না।”

সুবর্ণা বলে, “আমি কিন্তু সবে এক বছর হলো বিয়ে করেছি আম্মু। তাই জানি কে কেমন। ভাবি তো শুরু থেকে নম্র ভদ্রই ছিল। কোনদিন কারো মুখের উপর কথা বলেনি। তুমি, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনরা তো তাকে কম কথা শোনাও নি। কই ভাবি তো সব মুখ বুজেই সহ্য করেছিল। কিন্তু সহ্যেরও একটা লিমিট থাকে। লিমিট ক্রস করলে প্রতিবাদ তো করবেই। জানোই তো লেবু বেশি চটকালে তিতা লাগে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে পিঁপড়াও ঘুরে দাঁড়ায়। সেখানে ভাবি তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ।”

সিতারা বেগম কিছু বলতে যাবেন তার আগেই সোহেল তাদের থামিয়ে দেয়। যার কারণে সব কথা এখানেই থেমে যায়।

❤️
সুলতানা অনেকক্ষণ থেকে মালিহাকে কথা শোনাতে আছে। তার একটাই কথা এভাবে স্বামীর সাথে ঝগড়া করে ডিভোর্স নিয়ে এসে মালিহা কেন তাদের ঘাড়ের উপর বোঝা হয়ে থাকবে। মালিহা সবকিছু চুপচাপ শুনছিল। একসময় ধৈর্য হারিয়ে বলে ফেলে, “তুমি নিজের অবস্থান ভুলে যেওনা ভাবি। তুমি বিয়ের আগে সৎমায়ের ঘরে ছিলে। তাদের ঘাড়ে বোঝা ছিলে। ভাইয়াই তোমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে এনেছে। তাই আমাকে নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করো না।”

সুলতানা দমে যায় এই কথায়। মালিহা পুনরায় বলে, “আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। শুধু আমার অবস্থা বোঝাতে চেয়েছি। সমাজে মেয়েরাই মেয়েদের নিয়ে বেশি কথা বলে, বেশি সমালোচনা করে। আমরা মেয়েরা একে অপরের শত্রু হয়ে আছি। এই কারণেই যুগে যুগে এতটা পিছিয়ে যাই আমরা।”

#চলবে

(সিতারা বেগমকে আপনাদের কেমন লাগে?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here