#মন_দিতে_চাই
#১১তম_পর্ব
#লেখনীতে_সুপ্রিয়া_চক্রবর্তী
মুক্তোর সাথে করে তার বাড়িতে চলে এলাম আমি। মুক্তোর বাড়িটা বিশাল। বাড়িতে রহিমা খালা নামের একজন রয়েছে যে বাড়ির সবকিছু দেখাশোনা করে। আমাকে তার দায়িত্বে রেখেই অফিসে চলে গেলেন মুক্তো।
রহিমা খালা অনেক ভালো মহিলা। তার সাথে কথা বলেই আমি এটা অনুধাবন করতে পারলাম। বড্ড অল্প সময়ে আমাকে ভীষণ আপন করে নিলেন। রহিমা খালা আমার কাছে জানতে চাইল আমি দুপুরে কি খেতে চাই। আমি কি খাবার পছন্দ করি সেটা তো মনেই করতে পারছি না। তাই বললাম, তুমি যা পারো করো। আমি সেটাই খাবো।
রহিমা খালা আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল, আমারও তোর মতো একটা মেয়ে ছিল।
রহিমা খালার কথায় কেমন একটা লাগল আমার। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ছিল কেন বলছ? এখন কি স্ব নেই?
রহিমা খালার চোখ জলে ভরে গেল। নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে সেই জল লেপন করে বলল, আমার আগে সব ছিল। আমার স্বামী আর মেয়েকে নিয়ে কতো সুখী ছিলাম। কিন্তু সর্বনাশা পদ্মা আমার সব কেড়ে নিয়েছে। বন্যার পানি তে আমার সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি। আমার স্বামী এবং মেয়েকেও
বলেই কাঁদতে লাগল। রহিমা খালার কথা শুনে আমার কেন জানি তার সাথে ঘটা ঘটনাগুলো বেশ চেনা চেনা লাগল। মনে হলো এইরকম ঘটনা আমি আগেও কোথাও শুনেছি। কিন্তু কি সম্পর্ক এই ঘটনার সাথে আমার?
হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না। ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলাম। হঠাৎ করেই আমার মাথায় প্রচণ্ড ব্যাথা শুরু হলো। সাথে করে ঝাপসা ঝাপসা কিছু স্মৃতি মানসপটে ভেসে এলো। একটা মেয়ে ডুবে যাচ্ছে। সে নিজের ভাইদের আগলে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। তার বাবা-মা, ভাই বোন তার চোখের সামনে ডুবে যাচ্ছে।
এসব ভেবেই জোরে চিৎকার করে উঠলাম। সাথে সাথে রহিমা খালা চলে এলেন আমার কক্ষে। উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, কি হয়েছে? তোমার কি কোন সমস্যা হয়েছে?
আমি বলতে লাগলাম, ডুবে যাচ্ছে, সবকিছু ডুবে যাচ্ছে?
“কি ডুবে যাচ্ছে?”
কন্ঠস্বরটি কানে ভেসে আসতেই আমি তাকালাম দরজার দিকে। মুক্তো উদ্বিগ্ন চিত্তে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বলার আগেই রহিমা খালা বলল, স্যার আমি ওকে আমার জীবনের ঘটনাগুলো বললাম। তারপর ওর ভালো লাগছিল না জন্য নিজের রুমে চলে এলো। এসেই এভাবে বলছে। আমার মনে হয় মেয়েটির সাথেও অতীতে এমন কিছু হয়েছিল। হয়তো ও বন্যায় নিজের পরিবারকে হারিয়েছে।
মুক্তো এবার আমার সামনে এসে বলল, তুমি কি কিছু মনে করতে পারছ দিশা?
আপনি আমাকে দিশা বলছেন কেন? আমার নাম কি দিশা নাকি? আমার নাম তো
মাথায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। নিজের নাম মনে করার ব্যর্থ চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না আমার নাম কি।
মুক্তো বললেন, হ্যাঁ বলো তোমার নাম কি? মনে করার চেষ্টা করো। তুমি পারবে।
আমি বললাম, জোনাকি না না জলপড়ি এমনই কিছু একটা নাম আমার। কিছুতেই বুঝতে পারছি না।
ঠিক আছে। নিজেকে আর স্ট্রেস দিও না। স্বাভাবিক থাকো। দেখবে ঠিক মনে পড়বে।
আমি আপাতত শান্ত হলাম। কিন্তু মনে একটা খারাপ লাগা কাজ করছিল। আমি শুয়ে পড়লাম। মুক্তো আর রহিমা খালা আমার কক্ষ থেকে প্রস্থান করল। শুয়ে পড়ার কিছু সময় পর রাজ্যের ঘুম এসে ধরা দিল আমার চোখে। ঘুমানোর মধ্যে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নে দেখি কেউ আমাকে টানতে টানতে মুক্তোর সামনে থেকে নিয়ে যাচ্ছে। আর মুক্তো দাঁড়িয়ে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছেন। স্বপ্নটি দেখে আমার মনটাই পুরো খারাপ হয়ে গেল।
স্বপ্ন দেখে উঠে আমি নিচে এলাম। রহিমা খালা টিভিতে বাংলা সিরিয়াল দেখছে। আর সেই সিরিয়ালে দেখাচ্ছে বিয়ের দিন নায়িকাকে তার সৎমা ঘরে বন্দি করে রাখে । এই ঘটনাটা দেখে আবার আমার মাথায় ব্যাথা শুরু হয়।
এমন সময় মুক্তো আমার সামনে চলে আসে। আর রেডিওতে বেজে ওঠে শ্রেয়া ঘোষালের গান
♪প্রাণ দিতে চাই, মন দিতে চাই
সবটুকু ধ্যান সারাক্ষন দিতে চাই
তোমাকে, ও.. তোমাকে।
স্বপ্ন সাজাই, নিজেকে হারাই
দুটি নিয়নে রোজ নিয়ে শুতে যাই
তোমাকে, ও.. তোমাকে।
জেনেও তোমার আঁখি চুপ করে থাকে
রোজ দুইফোঁটা যেন আরও ভালো লাগে
গানে, অভিসারে, চাই শুধু বারেবারে
তোমাকে, ও.. তোমাকে।
যেদিন কানে কানে সব বলবো তোমাকে
বুকের মাঝে জাপটে জড়িয়ে ধরবো তোমাকে।
পথ চেয়ে রই, দেরি করোনা যতই
আর ভোলা যাবেনা জীবনে কখনোই,
তোমাকে, ও.. তোমাকে।
তুমি হাসলে আমার ঠোঁটে হাসি,
তুমি আসলে জোনাকি রাশি রাশি
রাখি আগলে তোমায় অনুরাগে
বলো কিভাবে বোঝাই ভালোবাসি?
সব চিঠি সব কল্পনা জুড়ে
রং মিশে যায় রুক্ষ দুপুরে
সেই রং দিয়ে তোমাকেই আঁকি
আর কিভাবে বোঝাই ভালোবাসি।
হ্যাঁ প্রাণ দিতে চাই, মন দিতে চাই
সবটুকু ধ্যান সারাক্ষন দিতে চাই
তোমাকে, ও.. তোমাকে।
স্বপ্ন সাজাই, নিজেকে হারাই
আর দুটি নিয়নে রোজ নিয়ে শুতে যাই
তোমাকে, ও.. তোমাকে।♪
গানের সুরের মাঝে আমি হারিয়ে যাই মুক্তোর মাঝে। কিছু তো একটা আছে ছেলেটার মধ্যে যা আমাকে আকর্ষণ করে। আচ্ছা এটা কি সামান্য কিছু? নাকি আমাদের মধ্যে গভীর কোন বন্ধন আছে?
মুক্তো আমাকে বলল, আমি জানি আপনি নিজের পরিবারের কথা ভাবেন। আপনি এই নিয়ে আর চিন্তা করবেন না। আমি অলরেডি নিউজ পেপারে আপনার ছবি ছেপে দিয়েছি। আপনার পরিবারের লোকজন সেটা দেখলে ঠিকই আপনাকে নিতে আসবে।
কথাটা শুনে হয়তো আমার আনন্দিত হওয়ার বা খুশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমি পারলাম না খুশি হতে। মুক্তোকে ছেড়ে যেতে হবে এই কথা মনে আসতেই কেন জানি আমার খুশি মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি চাই মুক্তোর কাছে থাকতে। তার থেকে দূরে থাকা কি আদৌ আমার জন্য ভালো হবে? এই মুহুর্তে কেন জানি আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে চাইলাম যেন আমার পরিবারকে খুঁজে পাওয়া না যায়। যাতে আমি আরো কিছুদিন মুক্তোর সাথে থাকতে পারি।
এরপর আরো দুই দুইটি দিন অতিবাহিত হলো। সবকিছু স্বাভাবিক চললো। রহিমা খালার সাথেই দিনের অধিকাংশ সময় আমার গল্প করে অতিবাহিত হয়। আমার পরিবারের ব্যাপারে এখনো খোঁজ পান নি মুক্তো। তিনি অবশ্য দিনের অধিকাংশ সময় নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। অনেক রাত করে বাড়ি ফেরেন। ইদানীং তাকে সেরকম ভাবে দেখাও যায়না। অথচ আমার বেহায়া মন তাকেই খুঁজে বেড়ায়। কেন জানি তাকে দেখার বাসনা আমি ত্যাগ করতে পারি না। জানি না কি জন্য এমন হয়।
আজ অন্যদিনের তুলনায় একটু তাড়াতাড়ি ফিরল মুক্তো। আমার সামনে এসে হাসি হাসি মুখশ্রী নিয়ে বলল,
‘অবশেষে তোমার পরিবারকে আমি খুঁজে পেয়েছি!’
#চলবে