#মন_দিতে_চাই
#দ্বিতীয়_পর্ব
#লেখনীতে_সুপ্রিয়া_চক্রবর্তী
আজ আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। আমি মাথায় একহাত ঘোমটা দিয়ে বসে আসি। ১৫ দিন যে কিভাবে দেখতে দেখতে চলে গেল বুঝতে পারলাম না। এই ক’দিন মামা বাড়িতে থাকায় মামি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারে নি। তাই আমার সময় খুব ভালো গেছে।
আমি আজ অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি নিজের হবু স্বামীকে দেখার জন্য। স্নিগ্ধা আপি যখন আমাকে ফোনে ছবি দেখাতে চাইছিল তখনই আমি বলেছিলাম এভাবে দেখব না। একেবারে সামনাসামনি ওনাকে দেখতে চাই।
আমার কথা মেনে নিয়ে স্নিগ্ধা আপিও আর জোরাজুরি করে নি।
ইতিমধ্যেই মামা উঠে দাঁড়ালেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, যা উপরে গিয়ে তৈরি হয়ে আয়৷ ওনারা এয়ারপোর্টে নেমে গেছে। একটু পরেই চলে আসবে।
মামার কথা শুনে আমি আর দাঁড়ালাম না। স্নিগ্ধা আপিকে সাথে নিয়ে উপরে চলে গেলাম। স্নিগ্ধা আপি আমাকে অনেক সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। আমি সুন্দর দেখতে একটা লাল শাড়ি পড়ে নিলাম।
সাজানো শেষ হলে স্নিগ্ধা আপি আমাকে আয়নার সামনে দাঁড় করালো। আমার বেশ প্রশংসা করে বলল, তুই কিন্তু অনেক বেশি সুন্দরী রে। এইজন্যই এত ভালো একটা জামাই পাবি।
কি যে বলো না আপি।
আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। স্নিগ্ধা আপির ফোনে কল চলে আসল। ফোনে কথা বলতে বলতে বাইরে চলে গেল। আমি ঘরের মধ্যেই বসে রইলাম। একটু পর মামি এলো রুমে। কোন কথা না বলে আমার সামনে এসে আমার মেকআপ তুলে দিল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
মামি বলতে লাগল, ওনাদের সামনে গিয়ে খুব খারাপ ব্যবহার করবি। যাতে ওনারা তোকে পছন্দ না করেন।
আমার খুব রাগ হলো মামির কথা শুনে। তাই বললাম, আমি তোমার কথা শুনব কেন? আমি মোটেই এমন কাজ করব না।
মামি আমার চুলের মুঠি ধরে বলল, বেশি বাড় বেড়েছিস তাইনা। তোর পাখা কিভাবে কে*টে দিতে হয় আমার জানা আছে। বলেই আমার গলার চেইনটা খুলে কেড়ে নিল। যা আমার মায়ের দেওয়া শেষ উপহার।
আমি এরকম করোনা। আমাকে দিয়ে দাও চেইনটা। এটার সাথে আমার মায়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
না দেবো না। আমার কথামতো না চললে তুই এই চেইন আর ফেরত পাবি না।
কেন এমন করছ মামি? আমি কিন্তু মামাকে সব বলে দেবো।
বেশি সাহস হয়েছে তাইনা? যদি তুই তোর মামাকে কিছু বলিস তাহলে আমি এই চেইনটা নষ্ট করে দেব।
মামি জানে আমার দূর্বলতা কোথায়। এই চেইনের সাথে আমার আবেগ জড়িয়ে। মামি সেটাকেই ব্যবহার করতে চাইছে।
আমার দিকে তাকিয়ে একটা শয়তানী মার্কা হাসি দিয়ে মামি চলে গেল। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম। আমার জীবন কখনো আমাকে সুখ দিলনা। যখন একটু সুখের আশা দেখলাম তখনই সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। বাম হাত দিয়ে আমি নিজের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া সামান্য অশ্রুটুকু মুছে নিলাম।
এভাবে কেঁদে কোন লাভ নেই। আমার ভাগ্যে হয়তো সৃষ্টিকর্তা এসবই লিখে রেখেছেন।
একটু পর সিগ্ধা আপি এসে আমাকে বলল, তুই চল আমার সাথে। ওনারা এসে পড়েছেন।
আমি যেতে নেবো তখন আপি আমাকে দেখে বলল, একি তোর মেকআপ তুলেছিস কেন?
ভালো লাগছিল না। চলো এখন।
স্নিগ্ধা আপি কথা বাড়ালো না। আমার নিয়ে চলল নিচে। আমি কিছু একটা ভেবে বললাম, আপি বিয়ে কিভাবে ভাঙা যায় তুমি জানো?
স্নিগ্ধা আপি অবাক নয়নে আমার দিকে তাকালো।
তুই এসব কি বলছিস? বিয়ে ভাঙতে চাস কেন?
এমনি।
আপি আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে এই বিয়েটা আমার জন্য ঠিক হবে। তবে আমি সেসব কথা কানে তুললাম না। নিচে এসে সবার সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসলাম।
মামা সবে আমার সাথে তার বসের পরিচয় করিয়ে দেবে তখনই এই কাহিনি ঘটিয়ে ফেললাম আমি। মামা অনেকটা লজ্জা পেলো। মামি দূরে দাঁড়িয়ে তৃপ্তির হাসি হাসছে। এটাই যেন চেয়েছিল সে।
মামা আমাকে বলল, পা নামিয়ে বস ঝিনু। এটা কেমন অভদ্রতা?
একজন মধ্যবয়সী লোক সম্ভবত মামার বস হবেন। মানে যিনি আমাকে নিজের ছেলের জন্য পছন্দ করেছেন। তিনি মামাকে বললেন, এসব কিছুই না। আমাদের ছেলেও আমাদের সামনে এভাবে বসে। গুরুজনদের সামনে পায়ে পা তুলে বসা যাবে না এটা এদেশীয় সংস্কৃতি। বিদেশে তো এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
আমি তাকালাম সামনের দিকে। শুধু দুজন এসেছেন। মামার বসের সাথে একজন মধ্যবয়সী মহিলা যিনি সম্ভবত ওনার স্ত্রী। পোশাক আশাকে বেশ বিদেশি ভাব। একটা কোর্ট পড়ে আছেন ভদ্রমহিলা।
তারও কোন ভাবাবেগ দেখলাম না। মামার বস এবার নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি শাহরিয়ার কবির আর ইনি হলেন আমার স্ত্রী মমতাজ পারভিন। আমার ছেলে শাহরিয়ার মুক্তোর জন্য তোমায় দেখতে এসেছি। যদিও বিদেশে ও সবার কাছে রকস্টার মুক্তো নামে বেশি পরিচিত। ওর আজ একটা কনসার্ট আছে জন্য আসতে পারেনি।
রকস্টার মুক্তো নামটা আমার কানের কাছে কয়েকবার বাজল। এই নাম শুনেই আমার বুকে মৃদু কম্পন শুরু হয়ে গেছে। এরমাঝে আমার চোখ গেল মামির দিকে। মামি ইশারা করে আমায় বলছেন যে করেই হোক ওনাদের রাগিয়ে দিতে।
আমি মুক্তোর না আসার সুযোগ নিয়েই বললাম, কেমন ছেলে আপনাদের যে নিজের হবু বউয়ের থেকে নিজের কনসার্টকে বেশি দাম দেয়? এরকম ইরেসপন্সিবল ছেলেকে কি বিয়ে করা যায়?
আমার এমন কাঠকাঠ কথা শুনে মামা মুখ কঠোর করে আমার দিকে তাকালেন। কিছু বলতে যাবে তার আগেই মমতাজ পারভিন বললেন, একদম ঠিক বলেছো তুমি। এই বাপ ছেলে একদম একইরকম হয়েছে। কাজ ছাড়া কিছু বোঝে না। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত বেশি। বাই দা ওয়ে তোমার নাম কি?
ঝিনুক।
ওয়াও মুক্তো-ঝিনুক কি দারুণ কম্বিনেশন। আমার তোমাকেই আমার ছেলের বউ হিসেবে পছন্দ হয়েছে।
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে রইলাম। বিয়ে ভাঙার জন্য এতকিছু করলাম অথচ কিছুতেই কিছু কাজ হলো না। উল্টো এনারা আমাকে পছন্দ করলেন।
শাহরিয়ার কবির এবার নিজের স্ত্রীকে বললেন, দেখলে মমতাজ আমার পছন্দ কত ভালো। আমি বলেছিলাম না আমার জহুরির চোখ। ডায়মন্ড চিনতে ভুল করব না।
সবার অগোচরে আমি মামির দিকে তাকালাম। জানি না মামি এবার কি করবে চেইনের সাথে। আমি একবার শেষ চেষ্টা করলাম। চোখ বন্ধ করে বললাম, আমি নিজের ব্যাপারে আপনাদের কিছু জানাতে চাই। আমি অনেক ছেলের সাথে রিলেশনে ছিলাম। আজ অব্দি আমার কতগুলো বয়ফ্রেন্ড ছিল তা গুনে শেষ করা যাবে না। এটা জেনেও কি আপনারা আমাকে নিজের ছেলের বউ করতে রাজি।
নিজের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করেই কথাগুলো বললাম। কি করবো নিজের মায়ের শেষ স্মৃতি বাঁচানোর জন্য এমনটা করা প্রয়োজন ছিল। মামি বোধহয় এবার ধরেই নিল বিয়েটা ভেঙে যাবে।
মামাও উঠে পড়েছে আমাকে চ*ড় মা*রার জন্য। এসবের মাঝে শাহরিয়ার কবির বলে উঠলেন, ব্রাভো ব্রাভো। তোমার ট্রুথফুলনেস দেখে আমি মুগ্ধ। জানো আমার ছেলে আজ অব্দি কতগুলো রিলেশন করেছে তারও কোন ঠিক নেই। বিদেশে বড় হয়েছে তো আর ওখানে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তবুও যদি তুমি ওকে জিজ্ঞাসা করো ও আজ অব্দি কয়টা প্রেম করেছে ও কি বলবে জানো? বলবে একটাও না। সেখানে তুমি কত সহজেই নিজের ব্যাপারে বলে দিলে। কাউকে ধোকা দিতে চাওনা তুমি। আমি এবার শতভাগ নিশ্চিত যে তোমাকে পছন্দ করে আমি মোটেও ভুল করিনি।
আমি পরে গেলাম মহা ঝামেলায়। এত কিছু করেও বিয়েটা ভাঙতে পারলাম না। উলটো এনারা আমাকে পছন্দ করে বসলেন। মমতাজ পারভিন একটি ডায়মন্ড নেকলেস আমাকে পড়িয়ে দিয়ে বললেন, খুব দ্রুত তোমাকে নিজের বৌমা করে নিয়ে যাবো। তৈরি থেকো।
ওনারা জানালেন আজকেই চলে যাবেন। মামা অনেক অনুরোধ করলেন খেয়ে যেতে কিন্তু ওনাদের ফ্লাইটের টাইম হয়ে যাওয়ায় আর থাকলেন না। এদিকে মামী অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।
#চলবে