সূর্যশিশির
৩১.
বিয়ের পর্ব শেষ হতেই নবদম্পতিকে রুমে গিয়ে আলাদা কথা বলতে, একান্ত সময় কাটাতে বলা হয়।
ফাইয়াজ বলল, “বাহিরে যেতে চাই।”
জেসমিন অবাক হয়ে বলল, “এখন বাহিরে কেন? মাত্র বিয়ে করলি, বউ রেখে কোথায় যাবি?”
ফাইয়াজ চোখ তুলে উপস্থিত গুরুজনদের এক পলক দেখল।
কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলল, “রূপাকে নিয়ে।”
এক গাল হাসি দিয়ে জেসমিন বলল, “দাঁড়া, ব্যবস্থা করছি।”
তারপর বারেককে বলল, “চাচা, ফাইয়াজ আর রূপা ঘুরে আসুক। আপনার অনুমতি আছে?”
বারেক বিগলিত কণ্ঠে বললেন, “অনুমতির কী আছে? এখন থেকে তো জামাই আর তুমি রূপার অভিভাবক। যা রূপা, জামাইয়ের সঙ্গে যা।”
জামাই শব্দটা রূপার শ্রুতিপথে উদ্ভট লাগছে৷ কোচিংয়ে যখন প্রথমবার ফাইয়াজ ক্লাসে এসে কঠিন গলায় বলেছিল, “প্রথমে বলে রাখি, আমি বেয়াদবি একদমই সহ্য করতে পারি না৷ হাসাহাসি, ফিসফিসানিও আমার পছন্দ নয়৷ এর কোনোটা যদি হয় সোজা ক্লাসের বাইরে বের করে দেব। মনোযোগ দিয়ে সবাই আমার কথা শুনবে, কিছু না বুঝলে প্রশ্ন করবে। বোঝা গেছে?”
সেদিন কী সে ভুলেও কল্পনা করেছিল, এই কাঠখোট্টা মানুষটাই তার জীবনসঙ্গী হবে!
সকলের অনুমতিতে ফাইয়াজ রূপাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্য সম্পর্কে রূপার ধারণা নেই। সে এখন অপ্রীতিকর অবস্থায় আছে৷ পরনের শাড়ির জন্য সুবিধামতো বসতে পারেনি। সবসময় দুই পা দুইদিকে দিয়ে বসেছে, আজ দুই পা একপাশে রাখতে হচ্ছে! সে এতে অভ্যস্ত নয়।
পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ফাইয়াজের কাঁধে দুই হাত রাখল৷ ফাইয়াজ বলল, “কাঁধে ব্যথা, ধরো না।”
“কোথায় ধরব? পড়ে যাব তো।”
“আপা তো কোমড়ে ধরে। তুমিও তাই করো।”
বলতে বলতে ফাইয়াজ হেলমেট পরে নিল।
অগত্যা রূপাকে তাই করতে হলো। প্রথমে এই ঘনিষ্ঠতা অস্বস্তির ধারালো সূচ হয়ে আঘাত করলেও ধীরে ধীরে তা ভালোলাগায় পরিণত হয়। ফাইয়াজের গায়ের সুগন্ধির প্রখর ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে। রূপার মাথা ভনভন করতে থাকল।
এলাকার মানুষেরা প্রথমবারের মতো রূপাকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখে বিস্ময়ে হতবিহ্বল। কেউ কেউ রসন ভিলার দিকে রওনা হয়, কী হয়েছে জানতে। হঠাৎ এই মেয়ে শাড়ি পরল কেন?
চল্লিশ মিনিটের মাথায় নদীর পাশের রোডে এসে বাইক থামাল ফাইয়াজ। রোডের বাম পাশে বিস্তৃত ক্ষেত, ডান পাশে সাহানি নদী৷ নদীর পাড় সবুজ ঘাসে ছেয়ে আছে। নরম বাতাস বইছে।
বাইক রেখে ফাইয়াজ রূপার দিকে তাকাল। হঠাৎ তাকানোতে রূপা অপ্রতিভ হয়ে উঠল, কিঞ্চিৎ লজ্জাও যেন পেল। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজের ভাবমূর্তি আড়াল করার চেষ্টা করে।
ফাইয়াজ বলল, “চলো, ওদিকে গিয়ে বসি।”
ফাইয়াজকে অনুসরণ করে নদীর পাড়ে গাছের ছায়ায় এসে বসে দুজন। রূপা সহজ আচরণ করতে চাইছে কিন্তু কোনো এক কারণে তার বুকের ভেতরটা অনবরত ঢিপঢিপ করছে৷ রোড দিয়ে মাঝেমধ্যে এক-দুটো গাড়ি যাচ্ছে, আশেপাশে মানুষের আনাগোনা নেই। ফাইয়াজ চশমা খুলে পাশে রেখে চুপচাপ নদীর দিকে তাকিয়ে রইল।
বেশ কিছুক্ষণ পরে বলল, “নদীর ওই পাড়ের যে বাজার, বাজার থেকে দুই কিলোমিটার দূরে আমার বেড়ে ওঠা।”
রূপা তাকিয়ে দেখল, নদীর ওপাড়ের বাজারটি অনেকটা দূরে। মানুষগুলোকে ছোট ছোট পিঁপড়ার মতো দেখা যাচ্ছে। ব্রিজ পার হয়ে সেখানে যেতে হয়৷ সে কিছু বলার আগে ফাইয়াজ পুনরায় বলল, “এখান থেকে হেঁটে গিয়ে তোমাদের কোচিংয়ে পড়াতে হতো। মন খারাপ হলেই এখানে, নদীর পাড়ে এসে বসে থাকতাম, কখনো কখনো ক্লান্তির জন্য ঘুমিয়েও পড়তাম। বালিশ হতো আমার দুই হাত। আবার কখনো কখনো প্রচন্ড গরমের জন্য এখানে এসে শুতে হতো৷ বিদ্যুৎ খরচের ভয়ে ফ্যান ছেড়ে ঘুমানোর সাহস হতো না।”
রূপা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
ফাইয়াজ ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি এখানে এতো ঘুমিয়েছি যে, এই স্থানটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। গত পাঁচ বছরে জীবন পাল্টেছে ঠিকই কিন্তু আমি আজও মাঝেমধ্যে এখানে এসে বসে থাকি। শুধু ঘুমাতে পারি না। ক্যারিয়ার দাঁড় করাতে গিয়ে এখানে এসে অতীতের পুরোটা সুখ খোঁজার সুযোগ হয়ে উঠেনি। আজ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে চাই, হয়তো ঘুমিয়েও যেতে পারি। তুমি অপেক্ষা করবে?”
রূপা দ্রুত বলল, “জি স্যার।”
স্যার শব্দটা শুনে ফাইয়াজ হেসে ফেলল। রূপার সামনে সে প্রথমবার হেসেছে। আজ সবকিছুই প্রথম, প্রথম হচ্ছে! রূপা শুরুতে থতমত খেয়ে গেলেও পরে বুঝতে পারল, সে নিজের বরকে স্যার বলে সম্বোধন করছে!
রূপা অন্যদিকে ফিরে হাসল। সম্পর্কটা কী সহজ হচ্ছে?
ফাইয়াজ স্যুট খুলে পাশে রেখে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। আকাশ পরিষ্কার। উদাসী বাতাস কানে, কানে কত কী বলে যাচ্ছে। প্রথমে বলল, “রূপার প্রতি তোমার হৃদয়ের দূর্বলতা কবে থেকে শুরু হয়েছিল, আজ জানিয়ে দাও।”
কিন্তু এখন তো সময় হয়নি! সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বহুদিন পর মাটিতে মাথা রেখেছে, মাথায় ব্যথা লাগছে৷ নিত্যকার অভ্যাস এভাবে পাল্টে গেছে! ফাইয়াজ দুই হাতের তালু রাখল মাথার নিচে।
রূপা ফাইয়াজের দিকে চেয়ে আছে। হাতে মাথা রাখতে দেখে তার মনে হলো, ফাইয়াজ তার কোলেই মাথা রাখতে পারত। ভেবেই সে আশ্চর্যবোধ করে। নিজের অজান্তে এ কী হচ্ছে তার হৃদয়ে! কীসের দাবানল ধেয়ে আসছে?
রূপা দ্বিধায় পড়ে যায়। দাতে নখ খুঁটতে থাকল।
হঠাৎ ফাইয়াজ বলল, “মাটি শক্ত হয়ে গেছে নাকি আমার মাথা নরম হয়ে গেছে বুঝতে পারছি না!”
রূপা তুরন্ত বলে ফেলল, “আপনি আমার কোলে মাথা রাখতে পারেন।”
কথাটা বলেই মনে হয়, “যেচে বলা একদমই ঠিক হয়নি৷ স্যার কী না কী ভাবছে কে জানে!”
ফাইয়াজ রূপার দিকে তাকাল৷ রূপার মনে হলো, এখুনি ফাইয়াজ তাকে নানা ধরনের কথা শুনাবে৷ এতে অবশ্য তার সমস্যা নেই। কিন্তু ফাইয়াজ বকল না৷ নিশ্চুপে রূপার কোলে মাথা রাখল। রূপার পায়ে ঝিম ধরে যায়। গা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
ফাইয়াজ চোখ বুজল। নাকে একটা মেয়েলি ঘ্রাণ এসে লাগছে। প্রতিটি নারী-পুরুষই একজন আরেকজনের নিজস্ব ঘ্রাণ পায়। যেটা সে এ মুহূর্তে পাচ্ছে। ঘ্রাণের ব্যাপারটা এড়াতে সে চোখ বোজা অবস্থায় বলল, “আমার নিজের বাড়ি নেই জানো?”
“জানি।”
“জেনে-বুঝে রাজি হয়েছো!”
রূপা প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না।
ফাইয়াজ বলল, “নিজের টাকায় জমি কিনেছি। বাড়ি করতে পারিনি। আমরা দুই ভাইবোন বনেদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও সেসব ভোগ করতে পারিনি৷ বাবার মৃত্যু আমাদের রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে। এরপর বড় হলাম। গত দুই বছরের চেষ্টায় চাচাদের থেকে বাবার সম্পত্তি উদ্ধার করেছি। খুব দ্রুত সেগুলো বিক্রি করে একটা বাড়ি করব। স্বামী হিসেবে তোমাকে সব জানানো উচিত, তাই জানিয়ে আমার দায়িত্ব পালন করলাম। আশা করি, ভবিষ্যতে এসব নিয়ে খোঁটা দিবে না। মেয়েদের তো আবার খোঁটা দেয়ার স্বভাব। খোঁটা একদমই সহ্য হয় না আমার।”
কথা শেষ করেই ফাইয়াজ অন্যদিকে কাত হয়ে চোখ বুজল। এই স্থানে, এই প্রিয় জায়গায় অর্ধাঙ্গিনীর কোলে মাথা রেখে নদীর স্রোত দেখার সুযোগ হবে কখনো ভাবেনি সে। ডুবন্ত সূর্যের রক্তিম আলো নদীর পানিকে সোনালী আভায় স্বর্গীয় একটি রূপ দিয়েছে — সেদিকে ছেয়ে থেকে ফাইয়াজ অনুভব করে রূপার প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস।
অরুনিকা গলির মুখে এসে দেখে হিরণ তার জন্য অপেক্ষা করছে।
অরুনিকা এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি যাওনি?”
হিরণ ঠিক করে বসে বলল, “একা এতোটা পথ যাবে ভেবে অপেক্ষা করছিলাম। চলো, পৌঁছে দেই।”
“চার ঘন্টা অপেক্ষা করেছো!”
বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে সে।
“এটা আর তেমন কী? তোমার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারব।”
শেষ বাক্যটি হিরণ অরুনিকার চোখে চোখ রেখে বলল।
অরুনিকা মুগ্ধ হয়ে গেল। এতক্ষণ হিরণ তার জন্য বসেছিল! এতোটা যত্ন করে তার!
সে হিরণের বাইকের পিছনে বসে বলল, “এক ঘন্টার জন্য কোথাও নিয়ে চলো।”
“বাসায় বকবে না?”
“এমনিতেও বকবে। তার চেয়ে বরং এক ঘন্টা ঘুরে এরপর বাসায় যাই। আর প্রশ্ন না করে, চলো প্লিজ।”
আশকারা পেয়ে হিরণের কায়া জ্বলজ্বল করে ওঠল।
সন্ধ্যা পেরিয়েছে সেই কখন, ফাইয়াজ তখনো ঘুমাচ্ছে। রূপা এরমধ্যে সুমনাকে কল করেছিল, অরুনিকার খোঁজ নিতে। অরুনিকা নাকি চলে গেছে। বাসায় গিয়ে কত বকা খাবে ভেবেই সে চিন্তিত!
রূপার অস্থিরতায় ফাইয়াজের নিদ্রাভঙ্গ হলো। সে চারপাশ অন্ধকার দেখে বলল, “রাত হয়ে গেছে?”
রূপা বলল, “হু। আটটা নয় বাজে।”
ফাইয়াজ চমকাল না। স্বাভাবিকভাবেই নিল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “ভার্সিটিতে ভর্তি হবে কবে?”
“হব না।”
“কেন? অবশ্যই পড়াশোনা করতে হবে তোমাকে। আমার স্ত্রী শুধু এইচএসসি পাস তা হবে না।”
রূপা বলল, “পড়াশোনা আমার ভালো লাগে না।”
ফাইয়াজ চট করে উঠে বসে চশমা পরে বলল, “তাহলে কী করবে? টইটই করে ছেলেদের বাইকে করে ঘুরে বেড়াবে আর সিগারেট খাবে? তুমি লাস্ট কবে সিগারেট খেয়েছো বলো তো? আমার বউ সিগারেট খায়, পড়াশোনা করে না! মানুষ জানলে কী হবে? মান-সম্মান থাকবে?”
ফাইয়াজের চোখমুখের আতঙ্ক দেখে মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তাকে আগের রূপে ফিরে আসতে দেখে রূপা ভড়কে যায়। বলল, “পড়াশোনা করে কী হবে স্যার?”
“আমি কী হয়েছি?”
“চাকরিজীবী হয়েছেন৷ কিন্তু আমিতো রাঁধুনি হতে চাই। রাঁধুনি হতে গেলে কী অনেক পড়াশোনার প্রয়োজন?”
“অবশ্যই প্রয়োজন। তোমার রেজিস্টার নাম্বারসহ, এপ্লাইয়ের জন্য যা যা প্রয়োজন সব আগামীকালের মধ্যে দিয়ে যাবে বাসায়। অশিক্ষিত বউ নিয়ে আমি সংসার করব না।”
ফাইয়াজ গা ঝাড়তে ঝাড়তে দাঁড়িয়ে বলল, “এবার চলো, বাড়ি ফিরতে হবে।”
ফাইয়াজ হাত বাড়িয়ে দিল রূপার দিকে; ধরে উঠার জন্য। যতই বকুক, শেষ মুহূর্তের যত্নগুলো সন্তর্পণে রূপার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। সে প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।
চলবে…
(আগেরদিনের তুলনায় ছোট পর্ব হওয়াতে দুঃখিত।)