সূর্যশিশির
২১.
জেসমিন জড়ীভূত হয়ে বসে আছেন। ফাইয়াজকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা তার অনেকদিনের। পড়াশোনা শেষ হোক, চাকরি হোক, ইত্যাদি ইত্যাদি — বলতে বলতে অনেকগুলো বছর গড়িয়েছে। তারপর একদিন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাল, “বাসা পরিবর্তন করার পরই বিয়ে করব।”
এখানে আসার পর রুমিকে পছন্দ হয় জেসমিনের। মেয়েটার বয়স কম ঠিক কিন্তু দেখতে শুনতে বিয়ের উপযুক্ত মেয়েই মনে হয়। ফাইয়াজের সঙ্গে খুব মানায়। ফাইয়াজের যে ঘরোয়া মেয়ে পছন্দ তা জেসমিনের অজানা নয়। রুমিও অনেকটা তাই।
নেহাৎ কথার ছলে একদিন জেসমিন বলেছিলেন, “বারেক চাচার মেয়েকে একটু দেখো তো। আমার খুব ভালো লেগেছে।”
ফাইয়াজ সেদিন কিছু না বললেও পরদিন বলেছিল “দেখেছি। কথা বলে দেখো।”
ফাইয়াজ বিয়ের জন্য প্রথম আগ্রহ দেখিয়েছিল! জেসমিন খুশিতে আত্মহারা হয়ে তাৎক্ষণিক সুমনার সঙ্গে কথা বললেন। সুমনাও সঙ্গে সঙ্গে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিলেন। অতঃপর দুজনের মধ্যে কথাবার্তা হতে থাকে, আংটি পরানোর দিনক্ষণও ঠিক করে ফেলে দুজন মিলে। সুমনার যেন একটু বেশি তাড়াহুড়ো ছিল। জেসমিন বলেছিলেন, “চাচার অনুমতি তো নেয়া হলো না।”
সুমনা তখন বললেন, “আমি যা বলব তাই হবে৷ তোমরা আসো, সবাই মিলে বিয়ের দিন ঠিক করি।”
বেশ কিছু মাস যাবৎ ফাইয়াজের সঙ্গে জেসমিনের নিয়মিত কথা হয় না৷ তাই তাদের পাত্রী নির্বাচনের ভুল বোঝাবুঝিটা খুব শক্তপোক্ত হয়ে দাঁড়ায়। জেসমিন ফাইয়াজকে জানান, “সোমবারে আংটি পরাতে যাব। মানসম্মান নষ্ট করে আগেরবারের মতো কোথাও আবার চলে যেও না।”
ফাইয়াজ তখন অভয় দিয়ে বলেছিল, “নিশ্চিন্তে থাকো। যাব না কোথাও।”
এইটুকুই ছিল বিয়ে নিয়ে তাদের কথপোকথন!
সোমবার প্রাতঃকালে যখন ফাইয়াজকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না, জেসমিন ভেবেছিলেন আবার হয়তো ফাইয়াজ বিয়ে না করার জন্য পালিয়েছে। আতঙ্কে জেসমিনের চোখমুখের রঙ পাল্টে যায়৷ মেয়ে বাড়িতে কী বলবেন, কী বলবেন ভেবে যখন রসন ভিলায় এলেন, দেখতে পেলেন বাসায় তালা লাগানো! তখন অবাক হলেও নিজের অজান্তে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছিলেন।
এখন দেখছেন, অন্য কাহিনি। ফাইয়াজ রূপাকে ভেবে বিয়েতে রাজি হয়েছিল! ওরকম শার্ট-প্যান্ট পরে দোকানদারি করা মেয়ে মানুষকে ফাইয়াজের পছন্দ হবে ঘূনাক্ষরেও ভাবেননি জেসমিন।
তিনি গম্ভীরমুখে বললেন, “ভুল তো তোমার। নাম কেন উল্লেখ করোনি? ”
ফাইয়াজ কণ্ঠে উত্তাপ নিয়ে বলল, “আমি কী করে জানব, একটা স্কুলে পড়া মেয়ের সঙ্গে আমার বোন আমার বিয়ে ঠিক করবে? কী করে ভাবলে আমি এতো ছোট মেয়েকে বিয়ে করব?”
ফাইয়াজ অনেকক্ষণ ধরে তেজ দেখাচ্ছে। জেসমিন এবার গলার স্বর বাড়িয়ে বললেন, “রূপা তোমার পছন্দের সঙ্গে মিলে না। তাই আমি ভুলেও কল্পনা করিনি তুমি রূপাকে বিয়ে করতে চেয়েছো। আমাকে আসামী বানিয়ে জেরা করা বন্ধ করো।”
ফাইয়াজ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকাল। সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রূপা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে! আংটি খুলে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছে, “ভুল বুঝছেন, আমার সাথে নয় রুমির সাথে আপনার বিয়ে। আমি কখনো আপনাকে নিয়ে অন্যকিছু ভাবিনি। এই কথাগুলো আমাকে অস্বস্তি দিচ্ছে, লজ্জা দিচ্ছে।”
ফাইয়াজ আংটিটি জেসমিনের সামনে রেখে, উঠে চলে যেতে উপক্রম হয়। জেসমিন পিছন থেকে বললেন, “আমি কি রূপার জন্য প্রস্তাব দেব আবার?”
ফাইয়াজ দায়সারাভাবে বলল, “প্রয়োজন নেই।”
জেসমিনের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়! আরো কয়েক বছর বিয়ে না করার অজুহাত পেয়ে গেল ফাইয়াজ! ভুলটা যদি না হতো!
রসন ভিলাতেও ইতিমধ্যে এই খবর ছড়িয়ে পড়েছে৷ রূপা ডাইনিং রুমে বসে আছে মধ্যমণি হয়ে। সে তখনো ঘোরের মধ্যে আছে৷ ফাইয়াজের কথাগুলো সারাক্ষণ কানে বাজছে।
সুমনা বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললেন, “তো তুই আসতে গেলি কেন? বলেছিলাম না, রুমি আসলে আসতে।”
রূপা বলল, “জেনেই তো গেছে রুমি পালিয়েছে আর হোটেলে থেকে কী হবে?”
সুমনা সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, “ফাইয়াজ সব জেনে গেছে, নাকি তুই বলেছিস? সত্যি করে বল।”
রূপা বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “আমি কেন বলব আম্মা? স্যার আমাকে খুঁজে বের করেছেন।”
মা-মেয়ের কথার মাঝে অন্য প্রসঙ্গ টেনে খোশ মেজাজে বারেক বললেন, “ফাইয়াজ এতো ছোট মেয়েকে বিয়ে করতেই পারে না। আগেই সন্দেহ হয়েছিল৷ এবার রূপাকে বিয়ে দিয়ে শান্তিতে মরব।”
সুমনা হাতের স্টিলের গ্লাস মেঝেতে ছুঁড়ে মেরে বললেন “রুমি পালিয়েছে শুনে ওরা রং পাল্টেছে। রুমির জন্যই প্রস্তাব দিয়েছিল এখন বলছে রূপাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল! এসব মিথ্যা কথা। ভণ্ড পরিবার! কই থেকে এসেছে তাও জানি না। আমি ওখানে রূপার বিয়ে হতে দেব না।”
বারেক প্রতিবাদ করলেন, “বাজে কথা বলো না। ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে! যদি নতুন করে প্রস্তাব নিয়ে আসে বিয়ে দিতে আপত্তি কী?”
“আছে আপত্তি। যে ঘরে ছোট মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল সে ঘরে বড় মেয়েকে আমি দেব না।”
“রুমি তো মুখে কালি দিয়ে পালিয়েছে৷ এই কালিমাখা মুখ কেউ দেখার আগে রূপার সাথে ফাইয়াজের বিয়েটা দিয়ে দাও।”
এ কথাতে সুমনার ভাব-ভঙ্গি পরিবর্তন হলো।
বললেন, “যদি বিয়ে না দেই ওরা কী সবাইকে বলবে রুমি পালিয়েছে?”
সুমনার উদ্বিগ্নতা বুঝতে পেরে বারেক সুযোগ নিলেন, “বলতেই পারে। তারচেয়ে চলো চুক্তি করি, আমরা রূপাকে দেব। সবাই জানবে, রূপার সাথে ফাইয়াজের বিয়ে হচ্ছে সেই দুঃখে রুমি নানাবাড়ি চলে গেছে। ভালো না?”
মাথামোটা সুমনার মাথায় যে নাটকীয় ব্যাপার স্যাপার প্রভাব ফেলে তা বারেক জানেন। সুমনার চিন্তিত মুখ দেখে তিনি পুর্নবার ইন্ধন দিলেন, “এটাই ভালো হবে। শ্বশুরবাড়ির মান সম্মান রক্ষার্থে হলেও ওরা রুমির পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখবে৷ তুমি ভেবে দেখো।”
সুমনা কিছু বলার পূর্বে রূপা বলল, “আমি বিয়ে করব না আব্বা।”
বারেক বললেন, “কেন করবি না? তুইতো আর ছোট না। ফাইয়াজ ভালো ছেলে। সমস্যা কী?”
রূপা কাতর স্বরে বলল, “স্যারকে আমি স্যার হিসেবেই দেখি। সম্পূর্ণ অচেনা একটা মানুষ। আমার জন্য ব্যাপারটা খুব পীড়াদায়ক।”
বারেক রূপার নিকটে এসে বসলেন। বললেন, “পারিবারিকভাবে যখন বিয়ে হয় কেউ কি কাউকে চিনে? চিনে না। তবুও বিয়ে হয়৷ এখন থেকে স্যার না ভেবে, অন্যকিছু ভাবতে হবে। যদি প্রস্তাব নিয়ে আসে আমি কিন্তু হ্যাঁ বলে দেব। তোর অন্য কোনো পছন্দ থাকলে এখুনি বল। নয়তো ফাইয়াজকেই বিয়ে করতে হবে।”
“পছন্দ নেই আব্বা। কিন্তু আমি বিয়ে করতে চাই না…ও আম্মা আব্বাকে বুঝাও। আমি চলে গেলে দোকান চলবে? আব্বা একা পারবে?”
বারেক বললেন, “তোর মাকে উস্কে দিয়ে কাজ নেই। বাবা-মার সম্মান বাড়ে মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিলে। রুমিকে খুঁজতে হবে, তুই আর চিন্তা বাড়াস না৷ ফাইয়াজ প্রস্তাব নিয়ে আসুক, আমরা তোকে তার হাতে তুলে দেব। কী বলো রূপার মা?”
সুমনা জবাব না দিয়ে হনহনিয়ে ভেতরের রুমে চলে গেলেন৷
রূপা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। তার বিয়ে করতে না চাওয়াটা যে পরিবারে অশান্তি ডেকে আনবে তা স্পষ্ট!
রূপা বলল, “সংসার আমাকে দিয়ে হবে না। এটা ভুল হবে।”
বারেক রূপার কথা অগ্রাহ্য করে বললেন, “কোনো ভুল না। দেখিস মা, তুই অনেক সুখী হবি। তোর কপালে অনেক সুখ আছে, অনেক।”
তিনি রূপার কপালে চুমু খেলেন। অস্বস্তিতে রূপার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এটা কী করে হতে পারে!
চলবে…
(ছোট মনে হলে দুই-তিন দিনের পর্ব জমিয়ে পড়ুন। আমি নিয়মিত লিখতে পারি না হাতের অসুস্থতার জন্য। তবুও লিখছি আপনাদের জন্য।)