সূর্যশিশির
২০.
ছাদের দরজা পর্যন্ত ছুটে এসে থমকে দাঁড়াল অরুনিকা৷ হাতে তার জীববিজ্ঞান বই। উঁকি দিয়ে দেখল, হিরণ বসে আছে, তার কোলে গিটার; সে অন্যমনস্ক। মাঝেমধ্যে গিটারে টুংটাং ধ্বনি তুলছে।
অরুনিকা ভাবল, ” লোকটা গিটার বাজাতেও পারে!”
সে মন্হরগতিতে হেঁটে ছাদে গেল। তার চোখ বিদ্ধ বইয়ের পৃষ্ঠায়, প্রতিটি ইন্দ্রিয় সজাগ হিরণের জন্য। হিরণ তাকে দেখে উঠে দাঁড়াল।
তীব্র উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, “অবশেষে এসেছো। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম।”
অরুনিকা বই থেকে চোখ তুলে অবাক হবার ভান ধরে বলল, “আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন?”
হিরণ বলল, “এরইমধ্যে গতকালের কথা ভুলে গেছো?”
অরুনিকা মনে করার নাটক করে বলল, “ওহ, মনে পড়েছে। কিন্তু আমি আপনার জন্য আসিনি। আপনার কথা আমার মনেই ছিল না।”
“তাহলে কেন এসেছো?”
“হাঁটতে। আর এইযে দেখছেন না বই হাতে। খোলা হাওয়ায় পড়াশোনা করতে এসেছি।”
হিরণ হাসল। বলল, “আচ্ছা, পড়ো।”
অরুনিকা বইয়ে মনোনিবেশ করল। সে বইয়ের অক্ষরের দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক কিন্তু চোখের পর্দায় অক্ষরগুলো নেই, হিরণের মুখ। সে ভাবল, “বেশি দাম্ভিকতা দেখিয়ে ফেললাম নাকি!”
হিরণের সাড়াশব্দ না পেয়ে পিছনে ফিরে তাকাল। হিরণ তাকিয়ে আছে। অরুনিকা বই বন্ধ করে বলল, “আপনি ছাদে কী করে আসেন?”
হিরণ বলল, “চার তলায় উঠেছি, সাবলেট।”
অরুনিকা আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইল। হিরণ এই বিল্ডিংয়েই থাকে! সে ভেতরে ভেতরে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। হিরণের সঙ্গে কথা বলার প্রবৃত্তির সামনে নকল দাম্ভিকতা আর টিকতে পারল না।
সে বলল, “আপনি এখানে থাকেন!”
হিরণ মাথা ঝাঁকাল। পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে বলল, “এটা তোমার জন্য।”
অরুনিকা চকলেট পছন্দ করে না। তবুও আজ চকলেট পেয়ে সে খুব খুশি হলো। হাত বাড়িয়ে বলল, “আপনি আমাকে খুঁজে পেলেন কী করে?”
পারভেজ হুড়মুড়িয়ে রুমে প্রবেশ করল। তার ভয়ার্ত চেহারা দেখে রুমি হাত থেকে গ্লাস রেখে বলল, “কী ব্যাপার? কিছু হয়েছে?”
পারভেজ দ্রুত ব্যাগপত্র গুছিয়ে বলল, “বাইরে তোমার বোনকে দেখেছি।”
রুমির মুখ থেকে ছিটকে বের হলো, “রূপা আপা?”
“আর কে হবে? ডাকাত মহিলা। পিছু নিয়ে এখানে চলে এসেছে। এই জায়গা ছাড়তে হবে, দ্রুত চলো।”
“দাঁড়াও, বোরকা পরতে দাও।”
রুমি বোরকা পরতে পরতে বিড়বিড় করে, “আপা আঠার মতো লেগে থাকে আমার সাথে, অসহ্য।”
পারভেজ রুমিকে নিয়ে তুরন্ত সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়।
রুমি ব্যথা পেয়ে বলল, “উফ! আস্তে হাঁটো।”
তাদের পলায়নের গতি দেখে হোটেলের অনেকে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছে। তারা দুজন সোহাগি থেকে বের হয়ে এলো। যখন গেইট পার হতে যাবে, তখনই বারেক মিয়াকে দেখে তারা আঁতকে ওঠল। দুজন শীঘ্রই গেইটের অন্যপাশে লুকিয়ে পড়ল।
বারেক দৌর্বল্য পায়ে একটা টং দোকানে গিয়ে বসলেন চা খেতে।
পারভেজ রিক্সা আনতে যেতে চাইলে রুমি বলল, “তোমার বাইক কোথায়?”
পারভেজ বলল, “এক ভাই নিয়েছে।”
রুমি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলল, “কেন দিতে গেলে? আমাদের তো প্রয়োজন এখন।”
“এখন এসব বলার সময় না। তুমি দাঁড়াও, আমি রিক্সা নিয়ে আসছি।”
পারভেজ রিক্সা নিয়ে আসলে, দুজন রিক্সায় করে বারেকের পাশ কেটে চলে যায় অন্যদিকে।
পরদিন। বারেক, সুমনা তাদের দুই ছেলেকে নিয়ে ফিরে এসেছে শুনে জেসমিন তাদের বাড়িতে আসল৷
সুমনা জেসমিনকে ডাইনিং রুমে বসিয়ে দুঃখী কণ্ঠে বললেন, “আম্মা শয্যাশায়ী। তিনটা মেয়েকে আসতেই দিলেন না। জীবন-মৃত্যুর দোটানায় থাকা মানুষটার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আর যেতে ইচ্ছে করেনি। তাই মেয়েদের রেখে এসেছি। দোকানটার জন্যই আমাদের আসতে হয়েছে। নয়তো আমরাও থেকে যেতাম। ব্যাপারটা হঠাৎ ঘটে গেল যে, তখনই জানাতে পারিনি।”
জেসমিন হাস্যমুখে বললেন, “এতো অস্থির হবেন না। পাশেই তো আছি। রুমি আসলে তখনই আংটি পরানো হবে৷ আপনার আম্মার রোগটা কী?”
সুমনা মান-সম্মানের ভয়ে এতোটাই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছেন যে অকপটে বলে ফেললেন, “ক্যান্সার। লাস্ট স্টেজে আছে। দোয়া করবেন। এজন্যই মেয়ের গুরুত্বপূর্ণ সময়েও তাকে মায়ের কাছে রেখে এসেছি। শেষ ইচ্ছেটা তো আর ফেলে দেয়া যায় না।”
“আল্লাহ উনার সহায় হোক।”
সুমনা বলল, “তুমি বসো আমি চা বানিয়ে আনি।”
“প্রয়োজন নেই চাচি। আমি কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছি।”
“তা বললে কী হয়? তুমি বসোতো।”
সুমনা রান্নাঘরে চলে যায়। তাৎক্ষণিক জেসমিনের চোখমুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। ঘটনাগুলো অস্বাভাবিক! সুমনার কথাবার্তাও এলোমেলো, আলগা ভাব। কিছু একটা লুকাচ্ছে যেন!
অদ্ভুতভাবে গতকাল সকাল থেকে ফাইয়াজও উধাও। জেসমিন ফাইয়াজকে না পেয়ে ভয় পেয়েছিলেন। পরে শুনলেন, রুমিও বাড়িতে নেই।
তিনি পুর্নবার কল করলেন ফাইয়াজের নাম্বারে।
বন্ধ!
সূর্য দিগন্তে হেলে পড়েছে। নদীর পাড়ে বসে উদাস নয়নে দিগন্ত দেখছে রূপা। তার পাশে রিনি। অরুনিকার সঙ্গে দুইদিন যাবৎ কথা হয় না৷ কিছুক্ষণ আগে অন্যজনের ফোন থেকে আন্টির নাম্বারে কল করেছিল, কিন্তু তিনি বললেন, অরুনিকা রুমে নেই, ছাদে। রূপার নিজেকে খুব একা লাগছে। এই মুহূর্তে সূর্যটাই বড় আপন মনে হচ্ছে৷ সূর্যের হলুদ রঙ ধীরে ধীরে হলুদ থেকে কমলা, কমলা থেকে টুকটুকে লাল হয়ে গিয়ে নানা রঙের বর্ণচ্ছটা ছড়িয়ে দিগন্তে হারিয়ে যায়। রূপা বিস্ময়বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে অস্তমিত সূর্যের দিকে। একসময় নেমে আসে সন্ধ্যা। রিনি বিরক্তবোধ করে বলল, “বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না আপা।”
রূপা অনুনয়ের সুরে বলল, “বোন আমার, আরেকটু থাক। হোটেলের রুমে দম বন্ধ লাগে।”
“আমি ঘুমাব। এখানে থাকব না।” রিনির চোখ জলে টলটল করছে। বাবা-মা ছাড়া থাকতে তার কষ্ট হচ্ছে।
বাধ্য হয়ে রূপা রিনিকে নিয়ে হোটেলে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলো। উঠে দাঁড়াতেই মুখোমুখি হলো অপ্রত্যাশিত এক মুখের। ফাইয়াজ প্যান্টের দুই পকেটে দুই হাত রেখে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে আছে!
রূপার পিলে চমকে ওঠল। তার হঠাৎ মনে হয়, কোথায় যেন বিনা মেঘে পরপর বজ্রপাত হচ্ছে! সে হতবিহ্বল হয়ে স্তব্ধ হয়ে রইল। কিছু বলল না।
ফাইয়াজ সোজাসাপটা বলল, “আমার জীবনে আমি অনেক কষ্ট করেছি। এমন কোনো শুভ মুহূর্ত নেই যা সময়মতো সহজে হয়েছে। কিছু কিছু চাওয়া পূরণ হতে গিয়েও হয়নি, কখনোই হয়নি। একসময় আমার অপ্রতিরোধ্য জেদ সৃষ্টি হলো, আমার সকল ভালো মুহূর্ত আমি যেভাবে হোক নিজের করে নেব, হারাতে দেব না। তোমার বোন পালিয়েছে তাতে আমার সমস্যা নেই। বিয়ে তো রুমিকে করছি না, তোমাকে করছি। তাহলে তুমি কেন চোরের মতো পালাতে গেলে?”
ফাইয়াজ উত্তরের অপেক্ষায় থাকল না।
রূপার হাতটা টেনে নিয়ে মধ্যমা আঙুলে আংটি পরিয়ে দিয়ে বলল, “বাড়ি চলো।”
রূপার হৃদয় জুড়ে এক তীব্র কাঁপুনি শুরু হয়। আকস্মিকতায় সে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। কী হচ্ছে, কী হলো, কেন হলো, তার মাথায় ঢুকছে না৷ সে হাতের আংটিটার দিকে তাকাল।
চলবে…