সূর্যশিশির পর্ব ১৯

0
323

সূর্যশিশির
১৯.
অরুনিকা মোহে আবিষ্ট। সর্বক্ষণ হিরণকে নিয়ে ভাবছে আর ক্ষণে ক্ষণে দেখছে দিবাস্বপ্ন। হিরণের প্রতিটি কথা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
বিকেলের অপেক্ষায় সে অধৈর্য্য, কাতর। ছটফটানির জন্য সারাদিন পড়াশোনাও হয়নি। গতকাল অপরাহ্ন থেকে ভেতরটা অস্থির হয়ে আছে। যখনই পড়তে উদ্যত হয় হিরণের মুখ থেকে নিঃসৃত শব্দগুলো কর্ণকুহরে বাজতে থাকে।
হৃদয়জুড়ে এখন একটাই স্লোগান, “হিরণ, হিরণ, হিরণ —”
এমতাবস্থায় কী করে হবে পড়াশোনা?

অরুনিকার অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করে সেলিনা বললেন, “কী ব্যাপার? এতো অস্থির হয়ে আছো কেন?”

এহেন প্রশ্নে অরুনিকা প্রথমে চমকে গেলেও পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে অকপটে বলল, “রূপা কল রিসিভ করল না বলে চিন্তা হচ্ছে।”

সেলিনা ভ্রুবক্র করে বললেন, “প্রতিদিনই কথা হতে হবে এমন কোনো কথা আছে? এতো ঘনিষ্ঠতা ভালো না। তোমার এই অতিরিক্ত টান আমার ভালো লাগে না। পড়াশোনা করো মন দিয়ে, ভালো জায়গায় চান্স পেতে হবে।”

অরুনিকা অংক বই নিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, যাও এখন। আমি পড়ছি।”

“কিছু প্রয়োজন হলে ডাক দিও।”

সেলিনা চলে যাচ্ছিলেন, অরুনিকা বলল, “মা শুনো, পাপা কি বিকেলে বাসায় থাকবে?”

“থাকবে তো৷ কোনো দরকার?”

“বিকেলে হাঁটতে যেতে চাই ছাদে। বই নিয়েই যাব।”

“এখন পড় মন দিয়ে৷ তাহলে আমি ব্যবস্থা করে দেব।”

রাস্তার পাশে পাশাপাশি তিনটি আবাসিক হোটেল। নামগুলো হচ্ছে — তিলোত্তমা, সোহাগি ও সুবর্ণা। এগুলোতে খুব সস্তায় রাত কাটানো যায়৷ পরিবেশ খুব নোংরা। তিলোত্তমা ও সোহাগিতে প্রবেশ করলে বোটকা গন্ধ লাগে নাকে৷ সুবর্ণা মোটামুটি পরিষ্কার। সেখানেই উঠেছে রূপার পরিবার। দুপুরের খাবার কিনতে হোটেল থেকে বের হয় রূপা। রাস্তার বিপরীত পাশে অনেক দোকানপাট এবং কাঁচাবাজার৷
যতদূর চোখ যায় উঁচুনিচু বিল্ডিং৷ এখানে কোন সবুজ নেই, নির্মল হাওয়া নেই, বুক ভরে শ্বাস নেয়ার কোন সুযোগ নেই। রূপার ভীষণ হাঁসফাঁস লাগে।

চারপাশ কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও ব্যস্ত হয়ে উঠে খাবারের দোকানগুলো, ফুটপাতের ভাসমান হোটেলগুলো। সেখানকার পরিবেশও অপরিচ্ছন্ন। তবুও মানুষ এই হোটেলগুলোতে খাচ্ছে। দাম কম হওয়াতে, খাবারের মান ও পরিবেশ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, প্রশ্ন তুলে না।
একটা রেস্টুরেন্টে ডাল-ভাত কিনতে প্রবেশ করে রূপা। সেখানে অনেক মানুষ আনাগোনা করছে। সুমনা বলে দিয়েছেন, আশিক-আরমানের জন্য ডিমের ঝোল নিতে আর বাকিরা ডাল-ভাত খাবে। রূপা নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করে রিনির জন্যও ডিমের ঝোল নিয়ে নিলো।

তিনটি ডিম দেখে সুমনা বললেন, “তিনটে কেন?”

রূপা বলল, “রিনি তো আশিক-আরমানের থেকেও ছোট। ওর সামনে বড় ভাইয়েরা ডিম খাবে তখন কষ্ট পাবে না? তাই আরেকটা এনেছি। চিন্তা করো না, তোমার টাকায় আনিনি।”

“তুই টাকা কোথায় পেয়েছিস?”

“আমি কী কাজ করি না যে, টাকা থাকবে না?”

সুমনা দুটো ডিম রেখে বাকি ডিমটি ঝোলসহ পলিথিনে বেঁধে দিয়ে বললেন, “এটা ফের‍ত দিয়ে টাকা ফেরত নিয়ে আসবি। এক মেয়ে তো মুখে কালি মাখিয়ে পালিয়েছে, আরেক মেয়েকে এতো আদরের দরকার নেই। যা, ফেরত নিয়ে আয়।”

রূপা নিজের রাগ সংবরণ করতে পারল না। উচ্চস্বরে বলল, “আম্মা, অনেক করেছো, এখনো করছো। তোমার পাগলামিতে আমরা অতিষ্ঠ, এবার চুপ হও। রিনিকে ডিমটা খেতে দাও।”

সুমনা তেজপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, “তুই আমাকে হুকুম করছিস? তোর ভাত খাই আমি, হা?”

রূপা বলল, “আমারই খাও৷ আমি না থাকলে আব্বা ওই রেস্টুরেন্টের টাকায় তোমাদের ভরণপোষণ করতে পারত না৷ কারো পড়াশোনাও হতো না। ”

সুমনা বিস্ফোরিত নয়নে বারেকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার মেয়ে কী বলছে? আমরা নাকি ওর ভাত খাই! খোঁটা দিচ্ছে আমাদের। এরপরও তুমি চুপ করে বসে থাকবে?”

বারেক তেজশূন্য গলায় বললেন, “কখন খোঁটা দিলো? আর রূপা তো ঠিকই বলেছে। ভুল কোনটা?”

সুমনার চোখ ফেটে জল নামল। তিনি খুবই সংবেদনশীল এবং আবেগপ্রবণ গোছের মানুষ। কথায় কথায় কান্না করার অসীম ক্ষমতা আছে তার।
কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমি তো এখন উচ্ছিষ্ট। জীবনটা সংসারের জন্য বরবাদ করলাম। এখন আমার কোনো মূল্য নেই। এতো মানুষ মরে আমি মরি না কেন!”

রূপার করুণা হলো। যে কারো কান্না তার হৃদয়কে কাতর করে তোলে৷ সে সুমনাকে জাপটে ধরে নরম সুরে বলল, “আমি তোমাকে খোঁটা দেইনি, আম্মা। সব মেয়ে তো একরকম হয় মা। রুমির থেকে আমি কি আলাদা না? এমন তো হতেই পারে, একদিন রিনি তোমার গর্বের কারণ হলো। ও অনেক ছোট। রুমির রাগটা ওর উপর চাপিও না। আমরা তোমাকে মূল্য দেই বলেই, তোমার কথাতে রাতারাতি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। তুমি ঠিক নাকি বেঠিক সেসব তোয়াক্কা করছি না। তুমি যা চাইবে তাই হবে। যা বলবে তাই করব।”

সুমনা কিছু বললেন না৷ তবে ভেতরে ভেতরে রূপার প্রতি তার তীব্র ভালোবাসা অনুভূত হয়।
যে ভালোবাসা এতকাল দেখানো হয়নি, সে ভালোবাসা আজও দেখানোর প্রয়োজনবোধ হচ্ছে না। তিনি তখনো কাঁদছেন। রূপা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বলল, “কান্না থামাও।”

সুমনা উঠে বাথরুমে চলে যান গোসল করতে। গোসল সেড়ে বের হতেই বারেক হতাশার ভঙ্গিতে বললেন, “এখন কী করবে? এই অশান্তি তো আর সহ্য হচ্ছে না। দোকানটাও বন্ধ এখন।”

সুমনা কর্কশ গলায় বললেন, “ফাইয়াজের বোনকে কল করে বলেছি, আম্মা অসুস্থ তাই রাতেই গ্রামে চলে এসেছি। ফেরার পর আংটি পরানো হবে। প্রথমে একটু গাইগুই করেছেন তারপর মেনে নিয়েছেন। এখন মেয়েকে খুঁজে বের করো। তোমার বড় মেয়েকে বলো, যেভাবে হোক, যেখান থেকেই হোক রুমিকে নিয়ে আসতে।”

বারেক অবাকচিত্তে বললেন, “রূপা কোথায় পাবে?”

সুমনা নিশ্চুপ। রূপা খাওয়াদাওয়া সেড়ে বেরিয়ে গেল।

সোহাগি হোটেলের দ্বিতীয় তলার চৌত্রিশ নম্বর রুমে বিষণ্ণ মুখে বসে আছে রুমি। মাস দেড়েক আগে উচ্চ মধ্যবিত্ত, সুদর্শন এক ছেলের সাথে তার ফেসবুকে পরিচয় হয়। সাত দিনের মাথায় পূর্বের প্রেমিককে ধোঁকা দিয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তারা। সেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে গভীর হয়।

বিয়ের কথাবার্তা চলছে শুনে প্রেমিক পারভেজ প্রস্তাব দিয়েছিল, “চলো, পালিয়ে যাই।”

রুমি বলেছিল, “পালাব কেন? তুমি তোমার বাসায় বলো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে।”

“আমি সবেমাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। বাবা এখন বিয়ে দিতে রাজি হবে না। হুট করে তোমাকে নিয়ে বাসায় উঠব। তখন বাবা বাধ্য হবে তোমাকে মেনে নিতে আর বিয়ে দিতে। বোঝার চেষ্টা করো, এছাড়া আর অপশন নেই।”

রুমিকে দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখে পারভেজ তাকে বুকে চেপে ধরে স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বলল, “তোমাকে ছাড়া আমার বাঁচা সম্ভব নয় রুমি। তুমি আমার ধ্রুব, তুমিই আমার জীবনের শুভ। পালিয়ে গেলে, আমার বাবার সুনাম নষ্ট হবে। কিন্তু আমি সেসবের কেয়ার করি না। বাবার সম্মানের থেকেও তুমি মূল্যবান। যদি সম্ভব হতো, এখুনি প্রস্তাব নিয়ে যেতাম, বিশ্বাস করো আমাকে।”

অগত্যা রুমি পালানোর ব্যাপারটাকে সমর্থন করে এবং সেই অনুযায়ী পালিয়ে এসে এই হোটেলে ওঠে।

“খুব মন খারাপ?” পারভেজের গলা।

রুমি চমকে তাকাল। ভাবনায় এতোটা ডুবে ছিল যে, দরজা খোলার শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছায়নি।

সে বলল, “এতক্ষণ লাগে আসতে? আমি ভয় পেয়েছিলাম।”

পারভেজ বিরিয়ানির প্যাকেট টেবিলে রেখে বলল, “ভেবেছিলে তোমাকে রেখে পালিয়ে গেছি?”

রুমি অপ্রতিভ হয়ে ওঠল। সে সত্যি তাই ভেবেছিল। পারভেজ রুমির পাশে বসে তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, “তুমি আমার সুখ। সুখ এখানে রেখে আমি আর কোথায় যাব?”

রুমি লজ্জা পেল৷ সরে যেতে চাইলে পারভেজ আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল, “সকালেও এমন করেছো। শুধু দূরে সরে যেতে চাও। আমার ছোঁয়া কি ভালো লাগে না? বিরক্তবোধ করো?”

রুমি বলল, “না, না। ভুল বুঝছো। শুধু লজ্জা পাচ্ছি।”

“খেয়ে নাও, তারপর লজ্জা ভাঙাচ্ছি।”

রুমি লজ্জায় কুঁকড়ে গেছে। সে বিরিয়ানির প্যাকেট হাতে নিয়ে অন্য প্রসঙ্গে যাবার চেষ্টা করল, “এই হোটেলটা খুব নোংরা৷ আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। তোমার বাড়িতে কবে নিয়ে যাবে?”

পারভেজ রুমির গাল আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলল, “আরেকটা দিন সহ্য করো৷ আগামীকাল আমরা বিয়ে করব। তারপর থেকে শ্বশুরবাড়ি থাকবে।”

“আজ কেন বিয়ে করছি না?”

“বিয়ে করতে তো স্বাক্ষী প্রয়োজন। আমার যে দুজন বন্ধুর আসার কথা ছিল, তারা কক্সবাজার ঘুরতে গেছে৷ কাল ফিরবে, আমাদের বিয়ের স্বাক্ষী হবে।”

রুমি কিছু বলল না। পর পুরুষের সঙ্গে এই প্রথম তার নির্জনাবাস। সে লজ্জিত, হৃদয় কাঁপছে ক্রমাগত; তীব্র গতিতে কাঁপুনি হচ্ছে।

মাঝেমধ্যে মনে একটা প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছে, “পারভেজের মতো ধনী ছেলে এরকম নোংরা হোটেলে উঠল কেন?”

যদিও অনুভূতির তাড়নায় প্রশ্নটি মনে শক্ত করে গেঁড়ে বসতে পারছে না। রুমি বলল, “তুমি খাবে না?”

পারভেজের ফোন বেজে ওঠে৷ স্ক্রিনে কলদাতার নাম দেখে সে রুমিকে বলল, “তুমি খাও। আমি আসছি।”

পারভেজ হোটেলের বাইরে এসে কল ঘুরিয়ে অপর প্রান্তের কাউকে ক্রোধ নিয়ে বলল, “শুয়ো′রের বাচ্চা, তোরে বলি নাই কল না দিতে!”

অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর আসার পর পারভেজ আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ে। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। আশেপাশের মানুষ বিরক্তি নিয়ে তাকায়, তাতে তার ভ্রুক্ষেপ নেই।

রূপা পারভেজের মুখের ভাষা শুনে এগিয়ে আসল।
বলল, “এইযে, শুনুন।”

পারভেজ পাত্তা দিলো না। রূপা আবার ডাকল।

পারভেজ চোখমুখ কুঁচকে গ্রীবা ঘুরিয়ে তাকিয়েই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল।

রূপা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বলল, “আপনার গালিগালাজ শুনে মানুষ বিরক্ত হচ্ছে৷ দয়া করে অন্য কোথাও গিয়ে ফোনে কথা বলুন।”

পারভেজ স্তব্ধ হয়ে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। বোধ হতেই দ্রুত হেঁটে চলে গেল হোটেলের ভেতর৷ রূপা কিছু বুঝতে না পেরে শ্রাগ করে ঠোঁট উল্টাল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here