সূর্যশিশির
১৭.
কে এই হিরণ মজুমদার? তাদের বিল্ডিংয়ে তো এই নামে কেউ নেই। অরুনিকার কপালে সৃষ্টি হয় গুটি কয়েক ভাঁজ। সে চিরকুটটি হাতে নিয়ে থম মেরে বসে রইল অনেকক্ষণ। পার্সেলটি রুমেই বা কে রাখল? অরুনিকা সংশয় কাটাতে চিরকুটটি ড্রয়ারে রেখে রান্নাঘরে গিয়ে সেলিনাকে প্রশ্ন করল, “মা, রুমে পার্সেল কে রেখেছে?”
“তুই কিছু অর্ডার করিসনি?”
অরুনিকা দ্বিধায় পড়ে যায়। কীরকম উত্তর দেয়া সমীচীন হবে আন্দাজ করতে পারছে না৷ সেলিনা জহুরি চোখে তাকালেন। বললেন, “ডেলিভারি ম্যান দিয়ে গেল। এটা তোর পার্সেল না?”
অরুনিকা অম্লানবদনে বলল, “হু আমারই। ডেলিভারি আরো এক সপ্তাহ পর পাওয়ার কথা ছিল, তাই অবাক হয়েছি। আচ্ছা, তুমি কাজ করো। পাপা কোথায়?”
“একটু বের হয়েছে। চলে আসবে। কোথাও যাওয়ার কথা ভেবো না।”
“একটু ছাদে যেতে চাই।”
“ছাদে কেন?”
“রুমে দমবন্ধ লাগছে। এতো বেঁধে ফেলো না আমাকে, প্লিজ। ছাদে অন্তত যেতে দাও।”
“আটকাচ্ছি না। শুধু প্রশ্ন করেছি। টি-শার্ট পরিবর্তন করে সালোয়ার কামিজ পরে যাও।”
“ঠিক আছে।”
অরুনিকা রুমে এসে পোশাক পরিবর্তন করে, থ্রিপিস পরে নিলো। সে পুনরায় চিরকুটটি হাতে নিয়ে দেখল, অবাক হলো। মনে মনে আওড়াল, “চৌধুরী বাড়ির ছাদে চলে আসার মতো সাহস দেখিয়েছো তুমি, যে সাহস রূপাও কখনো করেনি। তোমাকে না দেখা অবধি আমার শান্তি নেই।”
অরুনিকা বের হতেই সেলিনা দারোয়ানকে কল করে বললেন, অরুনিকা বাহিরে যেতে চাইলে যেন না দেয়া হয়। আজ যদি অরুনিকা বের হয়, আজিজুর তাকে জীবন্ত কবর দিয়ে ফেলবে।
তখন গোধূলী লগ্ন। পাখিরা আকাশে হুটোপুটি খাচ্ছে। তা দাঁড়িয়ে দেখছে হিরণ। তার লম্বা গড়ন। পরনে কালো শার্ট এবং কার্গো প্যান্ট। মাথায় গ্রে শেড কটন হ্যাট। অরুনিকা ছাদে পৌঁছে সোজাসাপটা প্রশ্ন করল, “ছাদে কী করে এলেন?”
হিরণ ঘুরে দাঁড়াতেই অরুনিকা স্তব্ধ হয়ে গেল। তার ধ্যান-জ্ঞান জুড়ে উত্তুরে হাওয়া বইতে লাগল। সেই তীক্ষ্ণ চোখ, ললাটে ছড়িয়ে থাকা চিকচিক করা চুল! যে মানুষটা এতদিন তার শয়নেস্বপনে ছিল সেই রক্তে-মাংসে গড়া মানুষটা আজ তার সামনে! অরুনিকা হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল।
হিরণ মৃদু সুরে বলল, “সাত-সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তোমার দুয়ারে এসেছি।”
কথাটি কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই অরুনিকা হৃদয় চঞ্চল হয়ে ওঠল। সে বিভ্রম নিয়ে বলল, “আপনি আমাকে চিনেন?”
“চিনি। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছি সেদিন থেকে চিনি।”
অরুনিকা বাঁধভাঙা আনন্দ অনুভব করে। বুকজুড়ে একটা উত্তাল ঢেউ খেলে যায়। মানুষটা এমনভাবে চেয়ে আছে, এমনভাবে কথা বলছে যেন তাদের হাজার বছরের চেনা-পরিচয়। অরুনিকার ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কোনো রকমে বলল, “কেন ডেকেছেন?”
“দেখতে ইচ্ছে করল তাই।” তার অকপট স্বীকারোক্তি।
অরুনিকা সু-নয়নে তাকাল। হিরণের জোড়া ভ্রুয়ে আটকে গেল চোখ। সে বলল, “ভয় হয়নি? যদি আমি আমার পাপা অথবা মা’কে নিয়ে আসতাম?”
“না, হয়নি। কাউকে দেখতে চাওয়া নিশ্চয়ই অপরাধ না?”
অরুনিকা বিব্রতবোধ করছে। এমনভাবে সাক্ষাৎ ঘটবে সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। হিরণ এতো সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে, মনে হচ্ছে না এটা তাদের সরাসরি প্রথম দেখা৷ তার খুব লজ্জা করছে৷ সে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই হিরণ বলল, “প্রতিদিন বিকেলে এখানে অপেক্ষা করব৷”
অরুনিকা না ফিরেই প্রশ্ন করল, “যদি না আসি?”
“জীবনভর অপেক্ষা করব।”
_
সকাল থেকে সুমনা ও রুমির মধ্যে বাকবিতন্ডা লেগে আছে৷ আগামীকাল পাত্রপক্ষ আসবে শোনার পর থেকে রুমি উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। ঘরের বেশকিছু জিনিসপত্র ভাংচুর করেছে। সে এখন বিয়ে করতে চায় না। সুমনা রুমির চুলের মুঠি ধরে পিটিয়েছেন; রেখেছেন ঘরবন্দী করে। তার দৃঢ় প্রত্যয়, রুমির বিয়ে ফাইয়াজের সাথেই হবে৷
রূপার এসব ভালো লাগছে না৷ বিয়ে সারাজীবনের ব্যাপার। এভাবে জোর করে পনেরো বছরের মেয়েকে একজন সাতাশ-আটাশ বছরের পুরুষের কাছে বিয়ে দেয়ার কী মানে? সুমনা বিকেলে তন্দ্রাঘোরে গেলে, রূপা রুমির রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। রুমি হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফ্লোরে বসে আছে। ফোপাঁচ্ছে। রূপা পালঙের এক কোণে বসে লঘু সুরে ডাকল, “রুমি?’
রুমি মুখ তুলে তাকাল। সে বিধ্বস্ত। তার এলো কেশ ছড়িয়ে আছে মুখজুড়ে। রূপা বলল, “জোর করে তোর বিয়ে দিতে পারবে না। বাল্য বিবাহ রোধে পুলিশ আছে৷ দরকার পড়লে আমি পুলিশ নিয়ে আসব।”
রুমি কিচ্ছুটি বলল না। রূপা রুমির সামনে বসে বলল, “দেখতে আসলেই বিয়ে হয়ে যায় না৷ আমি স্যারের সাথে কথা বলব। স্যার এতোটা অবিবেচক হবে না৷ উনি বুঝবেন, নিজেই বিয়ে ভেঙে দিবেন।”
“তুই যা আপা।” বলল রুমি।
রূপা রুমির মাথায় হাত রাখতেই রুমি এক ঝটকায় হাতখানা সরিয়ে দিয়ে বলল, “তোর কোনো সাহায্য আমার প্রয়োজন নেই।”
“সবসময় জেদ দেখানো ভালো না। আমিতো তোরই বোন, বড় বোন। কেন এমন করিস?”
রুমি চিৎকার করে উঠে, “আমার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। তুই যা আপা, প্লিজ যা।”
রুমি এখন অশান্ত হয়ে আছে৷ তার সাথে কথা না বাড়ানোই মঙ্গল। অগত্যা রূপা বেরিয়ে এলো।
রেস্টুরেন্টে গিয়ে বারেককে বলল, “আব্বা, কথা ছিল।”
বারেক খরিদ্দারদের থেকে টাকা সংগ্রহ করে বললেন, “রুমির সম্পর্কে হলে বলার দরকার নেই। রুমি ওর মায়ের মেয়ে, ওদেরটা ওরা দেখুক। আমার কোনো মূল্য নেই এখানে। আমার অনুমতি ছাড়া সুমনা যা মন চায় করছে। করুক।” বারেকের কণ্ঠে স্পষ্ট অভিমান। তিনি মেয়ের বাপ হয়েও জানতেন না, আগামীকাল পাত্রপক্ষ আসবে তার ঔরসের সন্তানকে দেখতে।
রূপা বলল, “কিন্তু রুমি তো রাজি না। এখন রুমির পাশে আমরা যদি না দাঁড়াই আর কে দাঁড়াবে? যদি রাগে-অভিমানে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে?”
বারেক কাষ্ঠ গলায় বললেন, “আগামীকাল আসুক পাত্রপক্ষ, তাদের সাথেই কথা হবে।”
“ফাইয়াজ স্যার কীভাবে রুমিকে বিয়ে করতে চাইছেন! উনি কি রুমির বয়স জানেন না?” রূপা কিছুতেই ফাইয়াজের ব্যক্তিত্বের সাথে তার এই সিদ্ধান্ত মিলাতে পারছে না।
বারেক উপহাস করে বললেন, “তার শিক্ষা-দীক্ষা হাঁটুতে নেমে এসেছে।”
কথাটি কেন যেন রূপার গায়ে বিঁধল। ফাইয়াজ স্যার কি সত্যি এতোটা বিবেকহীন?
সে মাথার ক্যাপ খুলে সুজনের কাছে গিয়ে চাপাস্বরে বলল, “আজ ফাইয়াজ স্যার এসেছিল?”
সুজন থালাবাসন পরিষ্কার করছিল। পানির কল চালু থাকায় রূপার প্রশ্নটি তার কুর্ণকুহরে পৌঁছায় না৷ সে দুই চোখ ছোট ছোট করে বলল, “কী কইলা?”
রূপা পানির কল বন্ধ করে বলল, “ফাইয়াজ স্যারকে দেখেছিস?”
“না, স্যার তো আইজ কিছু কিনতে আয় নাই৷”
“আসলে আমাকে ডাক দিস।”
“কেরে? কুনু দরকার আছিলো? ”
রূপা সুজনের মাথায় টোকা দিয়ে বলল, “সব তোকে বলতে হবে? কাজ কর।”
রূপা হেঁশেলে গিয়ে ঢুকল। যাই হয়ে যাক, কাজকর্ম বন্ধ করা যাবে না৷
সে বাড়ি ফিরে রাত বারোটায়। অরুনিকার সঙ্গে তার প্রতিদিন সকালে একবার কথা হয়। যতক্ষণ অরুনিকা কথা বলে ততক্ষণ সেলিনা তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তাই তাদের মধ্যকার অনেক কথা আদান-প্রদান করা সম্ভব হয় না।
রূপা ফোন চার্জে লাগিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। সারাদিনের কথাগুলো বলার মতো কেউ না থাকলে, বুকের ভেতরটা কেমন ভার হয়ে থাকে৷ এইযে রূপার এখন মনে হচ্ছে, তার বুকের ওপর পুরো পৃথিবীটা উঠে বসে আছে৷ সে মধ্যরাত অবধি এপাশ-ওপাশ করল। কিছুতেই ঘুম এলো না। ঘুমন্ত শহরজুড়ে তখন শুধু বেওয়ারিশ কুকুররা ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাঁকডাক করছে। মাঝেমধ্যে রূপারও নিজেকে বেওয়ারিশ মনে হয়! যার কোনো দাবিদার নেই। কেন এমন মনে হয়?
রাতের শেষ প্রহরে তন্দ্রামত লেগেছিল মাত্র, তখন ইঞ্জিনের শব্দ ভেসে এলো কানে। রূপা তড়াক করে উঠে বসল। তার বাড়ির সামনে ইঞ্জিনের শব্দ কেন আসবে? সে দরজা খুলে দেখে বাড়ির গেইটের সামনে মোটরসাইকেল নিয়ে বসে আছে একজন৷ তার মাথায় হেলমেট। দেখে মনে হচ্ছে, কারো জন্য অপেক্ষা করছে।
রূপা উচ্চকণ্ঠে বলল, “কে ওখানে?”
লোকটি চকিতে তাকায়। রূপা আরেকটু এগিয়ে দেখে রুমি বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে লোকটির দিকে এগোচ্ছে। তার হাতে ব্যাগ৷ রূপা চমকে ওঠে। রুমি কোথায় যাচ্ছে? হাতে ব্যাগ কেন? সে কি পালাচ্ছে?
রূপা দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চিৎকার করল, “রুমি…রুমি। কোথায় যাচ্ছিস? দাঁড়া।”
ততক্ষণে রুমি মোটর সাইকেলে উঠে পড়েছে। রূপা চিৎকার করে ডাকল, “আম্মা, আব্বা রুমি পালাচ্ছে।”
তারপর সে তাড়াহুড়ো করে সাইকেলে চড়ে বসে। মোটর সাইকেলটি শব্দ তুলে বিদ্যুৎ বেগে জায়গা ত্যাগ করে।
চলবে…
(কপি করা নিষেধ।)