সূর্যশিশির
১৪.
সৃষ্টিকর্তার সহায় যে বড় বিপদ হয়নি। যেহেতু সে রাস্তার এক পাশ দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছিল, উল্টে যাওয়ার পর অর্ধেক শরীর রাস্তায় বাকি অর্ধেক মাটিতে পড়ে। তাই মাথায় আঘাত লাগেনি। তবে হাতে-পায়ে চোট পেয়েছে। বাম পায়ের চোটটা বেশ ভালোই যন্ত্রণা দিচ্ছে। রূপা উঠতে গিয়ে টের পেল, তার মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীরটা ভীষণ দূর্বল লাগছে। ডান পায়ে শক্তি নেই। কষ্ট করে হলেও রূপা সাইকেলটি তুলল। মাটি থেকে ফোন তুলে দেখে ডিসপ্লে ফেটে গেছে অনেকটা৷ মানিব্যাগ, মানিব্যাগ কোথায়? রূপা অস্থির হয়ে এদিকওদিক মানিব্যাগ খুঁজতে থাকল। ওইতো, ঝোঁপের কাছে।
সে মানিব্যাগ পকেটে রেখে সাইকেলের ওপর উঠে বসল। উত্তুরে হাওয়া জোরালো ভাবে বইতে শুরু করেছে। নিরিবিলি রাস্তায় তখন শুধুই রূপা। তার পায়ে ভীষণ ব্যথা, সাইকেল চালাতে ভীষণ পীড়া লাগছে। সে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল।
সাইকেল নিয়ে মিনিট দশেক হাঁটল। এবার পাকা রাস্তা ছেড়ে ডান পাশের বনে থাকা চিকন কাঁচা রাস্তাটি ব্যবহার করতে হবে। এই রাস্তা শর্টকাট রাস্তা হিসেবে অনেকেই ব্যবহার করে। তবে রাস্তাটি বনের ভেতরে হওয়াতে ভয় রূপাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। সে অলৌকিক কিছু নাকি সিরিয়াল কিলারের ভয় পাচ্ছে, বুঝতে পারছে না।
হাতেপায়ে যে আঘাত রূপা পেয়েছে এই মুহূর্তে আবার ঘুরে যাওয়াও অসম্ভব। তার দ্রুত ফিরতে হবে৷ রূপা বিসমিল্লাহ বলে, বনের ভেতরে পা রাখল।
কাঁচা রাস্তার দুই পাশজুড়ে সারি সারি সুউচ্চ গাছ। শোঁ শোঁ শব্দে উঁচু সেই গাছের ছোট-বড় পাতার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে বইছে হাওয়া।
শোনা যাচ্ছে অচেনা পাখি, ব্যাঙের ডাক এবং ঝিঁ ঝিঁ পোকার গুঞ্জন। সাথে আরেকটি শব্দও যেন শুনতে পেল রূপা। তাৎক্ষণিক তার হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। ভয়ে অসার হয়ে এলো দেহ। সে বিড়বিড় করে নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করল, “অশরীরী বলতে কিছু নেই রূপা। কেউ তোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না। সবটাই মনের ভয়। আর আজ যদি সিরিয়াল কি’লার এখানে থাকে তবে ধরে নে তোর আয়ুই এতটুকু ছিল। জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েছিস, মৃ’ত্যু তোর জন্য মুক্তি। সামনে হাঁটতে থাক। তোর কোনো ভয় নেই।”
নিজেকে আশ্বস্ত করে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিল রূপা।
সামনের পথটা অন্ধকারে ঢাকা। সে পকেট থেকে ফোন বের করে টর্চ জ্বালাতে গিয়ে দেখে, ফোনের ডিসপ্লে ফেটেছে শুধু, ভেতরের কোনো ক্ষতি হয়নি৷ সে টর্চ জ্বালিয়ে এগোতে থাকল সামনে। মৃত্যুকে গ্রহণ করার সাহস থাকলে বক্ষে, কোনো কিছুতেই আর ভয় হয় না। এখন রূপারও ভয় লাগছে না। এই রাস্তা দিয়ে সে বহুবার আসা-যাওয়া করেছে। পথ চেনা। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বনের শেষ প্রান্তে চলে আসে। তখন নরম বা সরস কোনো জিনিস কাটার বা দাঁত দিয়ে কামড়ানোর শব্দ শুনতে পায়। সে থমকে দাঁড়াল। বাম দিকে টর্চ ধরে কিছু দেখতে পেল না। শব্দটা কোথা থেকে আসছে? খোঁজার ইচ্ছে বা ধৈর্য্য কোনোটাই হলো না। সে আঁধার ঘেরা বন পশ্চাতে রেখে উঠে আসে চাকচিক্যময় রোডে।
আর কিছুক্ষণ হাঁটলে অরুনিকার বাসার রাস্তা ধরতে পারবে। খুব কাহিল লাগছে। রূপা পায়ের উপর ভর দিয়ে বসল, দশ মিনিট বিশ্রাম নিলো। তারপর অরুনিকার নাম্বারে বেশ কয়েকবার কল করল। এখনো ফোন বন্ধ! সে উৎকণ্ঠা নিয়ে পুনরায় হাঁটতে শুরু করল। রাত এগারোটা ত্রিশ মিনিটে সে অরুনিকার বাড়ির সামনে পৌঁছায়। গেইটে শব্দ করলে একজন দারোয়ান গেইট খুলল। নতুন মুখ! এর আগে তাকে রূপা দেখেনি। এতো রাতে রূপাকে দেখে দারোয়ান চোখমুখ বিকৃত করে জানতে চাইল, “কারে চান?”
অরুনিকার বাবা আজিজুর বাসায় থাকলে রূপা ভেতরে যায় না৷ তাই সে প্রথমে জিজ্ঞাসা করল, “আজিজুর আংকেল বাসায় আছেন?”
“হ, বাসায়। তারে দরকার?”
‘আজিজুর বাসায়’ তথ্যটি শ্রবণ করে রূপা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারল, বাসায় কোনো সমস্য হয়েছে হয়তো! সে দারোয়ানকে পুনরায় প্রশ্ন করল, “অরুনিকা কি বাসায় আছে?”
দারোয়ান নামটা চিনতে পারল না এমন একটা ভান ধরে বলল, “অরুনিকা এই বাড়িত থাহে?”
রূপা বলল, “জি, আজিজুর আংকেলের মেয়ে।”
“ওহ, হে তো বাসাতই। সইন্ধ্যেবেলা দেখলাম।”
“এরপর আর বের হয়নি?” রূপা নিশ্চিত হতে চাইছে, অরুনিকা বাসায় আছে কি না৷ দারোয়ান বলল, “না৷ আইচ্ছা, আপনে এতকিছু জিগাইতেছেন কেরে?” দারোয়ান তাকে সন্দেহ করছে।
রূপা কী বলবে, কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। আজিজুর আংকেল তাকে একদম সহ্য করতে পারেন না। এই মুহূর্তে বাড়ির ভেতর গেলে তুফান শুরু হবে। সে দারোয়ানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, “আপনি কি নতুন দারোয়ান? ”
“জ্বে না। আজকে রাইতের জন্যে আমি এইহানে আছি। কালকা নতুন দারোয়ান আইব। আমগোর বংশে কোনো দারোয়ান নাই। স্যার কইছেন দেইখা…”
রূপা তার পুরো কথা না শুনে গেইটের সামনে থেকে সরে গেল৷ সে নির্বাক হয়ে ভাবছে, হঠাৎ দারোয়ান পরিবর্তন হচ্ছে কেন? বাবা-মেয়ের মাঝে কি আবার বাকযুদ্ধ হয়েছে? তা না জানা অবধি শান্তি মিলবে না৷ অরুনিকার রুমের বারান্দার সম্মুখ বরাবর রাস্তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রূপা। এক টুকরো পাথর নিয়ে ছুঁড়ে মারল রুমের ভেতর। সঙ্গে সঙ্গে অরুনিকা বেরিয়ে এলো। ল্যাম্পপোস্টের নিচে রূপাকে দেখে বিন্দুমাত্র অবাক হলো না সে৷ তার হৃদয় জানত, ফোন বন্ধ পেলে রূপা ঠিক চলে আসবে। তবে আজকের রাতটা মোটেও শুভ নয়।
অরুনিকাকে দেখে রূপা গলা জোর বাড়িয়ে বলল, “তোর ফোন বন্ধ কেন? কী হয়েছে?”
অরুনিকা ইশারায় চুপ হতে বলল। তারপর রুমের ভেতর ছুটে গিয়ে, একটা কাগজ হাতে নিয়ে ফিরে এলো। সঙ্গে একটা কলমও নিয়ে এসেছে৷ সে দ্রুত কিছু একটা লিখে সেই কাগজটা ভাঁজ করে রূপার দিকে ছুঁড়ে মারল।
কাগজটির ভাঁজ খুলে রূপা পড়ল –
“পাপা, আমার ফোন ভেঙেছে। উনি জেনে গেছেন আমি বাজারে যাই। উনার পরিচিত কেউ আমাকে আবাসিক হোটেলের সামনে দেখেছে৷ এজন্য পাপা আমাকে অনেক অপমান করেছেন। তোর সাথে দেখা করতে নিষেধ করেছেন। বরাবরের মতোই উনার ধারণা তোর জন্য আমি এরকম হয়েছি। কিছুদিন বাবা বাড়িতে থাকবে আমাদের দেখা হবে না। চিন্তা করিস না আমার জন্য, আমি সুযোগ পেলেই তোর কাছে আসব। মা’র ফোন দিয়ে মেসেজ দেব। তুই বাবার সামনে আসিস না। অনেক খারাপ কথা বলবে, আমার সহ্য হবে না। আমি তোর কথা শুনলে, বাজারে ঘোরাঘুরি না করলে আজ এমন হতো না৷ আমি সরি দোস্ত। আমার জন্য সব হচ্ছে। আর এতো রাতে বের হয়েছিস কেন? আর কখনো এতো রাতে আসবি না। আজকের মতো একটা বিপদসংকুল রাতে তুই বাইরে! এখুনি বাড়ি ফিরবি। গলিতে ঢুকবি না, বাজার দিয়ে যাবি। লাভ ইউ, গুড নাইট।”
এরকম ঘটনা তাদের বন্ধুত্বের পর বহুবার ঘটেছে৷ রূপা কাগজটি বুকপকেটে রেখে অরুনিকাকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল।
বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াল সামনে৷ অরুনিকা বাসায় এতে সে নিশ্চিন্ত। যতক্ষণ রূপাকে দেখা গেল নির্নিমেষ লোচনে চেয়ে রইল অরুনিকা। সেই সাথে একটা প্রশ্ন তাকে ভাবিয়ে তুলল, রূপা সাইকেলে না চড়ে হেঁটে কেন যাচ্ছে?
ডেকে জিজ্ঞাসা করতেও পারল না। উসখুস লাগছে। কালই সে যেভাবে হোক রূপার কাছে যাবে।
রূপা চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হতেই অরুনিকার স্মরণ হলো, সেই ছেলেটিকে যে সে পেয়েছে তা রূপাকে জানানো হয়নি। ধুর!
_
দুশ্চিন্তায় বারেকের হৃদগতি বেড়ে গেছে৷ তিনি বার বার রূপাকে কল করেছেন, রূপা কল রিসিভ করেনি। তিনি আকাশসম উদ্বেগ নিয়ে দোকানের সামনে মস্তকে হাত রেখে বসে আছেন।
রূপার নয়াবাড়ি যাওয়ার কথা ছিল সে বিষয়ে বারেক অবগত। তার বেশি কিছু জানেন না৷ তাই মেয়ের সন্ধানে বেরোতেও পারছেন না। তিনি ফোন নিয়ে আবার কল করলেন। রিংটোন শোনা যাচ্ছে! তিনি পিছনে ফিরে দেখেন রূপা চলে এসেছে৷ রূপাকে ধমকাতে যাবেন তখনই দেখলেন, রূপা খুঁড়িয়ে হাঁটছে, তার জামাকাপড়ে ময়লা। হাতে নজর পড়ে, হাতের চামড়াও ছিঁড়ে গেছে!
বারেক অস্থির হয়ে প্রশ্ন বললেন, “এভাবে হাঁটছিস কেন? হাতে এসব কী করে হলো? জামাকাপড়েও মাটি লেগে আছে!”
রূপা একপাশে সাইকেল রেখে বলল, “সাইকেল থেকে পড়ে গিয়েছিলাম, অন্ধকার ছিল তাই খেয়াল করিনি। এখন আবার এটা নিয়ে বিলাপ করবেন না আব্বা৷ আমি ঠিক আছি, বাসায় যাচ্ছি।”
“বাসায় পরে যাবি, আগে ডাক্তারের কাছে চল। কী করে এসেছিস তুই? আমার কথা কেন শুনিস না?”
“এখন আবার ডাক্তার কেন? এইটুকুই তো।’
বারেক রূপার বাহু চেপে ধরে জোর করে ফার্মেসীতে নিয়ে গেলেন। ক্ষতগুলো পরিষ্কার করে, ব্যথার ঔষধ নিয়ে তারপর বাসায় ফিরলেন।
সুমনা রূপার অবস্থা দেখে উদগ্রীব হয়ে বললেন, “ওমা! এসব কী করে হলো? আবার কী করেছে তোমার মেয়ে?”
রূপা কিছু বলার আগে বারেক বললেন, “সাইকেল নিয়ে বের হয়েছিল, আমিই এক জায়গায় পাঠিয়েছিলাম। পথে এক্সিডেন্ট করেছে। ”
তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান রূপার অনলাইনে অর্ডার নেয়ার বিষয়টা। যদি সুমনা এই খবর জানে, তাহলে রূপার এই টাকাও নিতে চাইবে।
বারেক মনেপ্রাণে চান, রূপা নিজের জন্য কিছু করুক। নিজের স্বপ্ন পূরণ করুক, নিজের জন্য অর্থ সঞ্চয় করুক। এতগুলো মানুষের জন্য ছোট থেকে নিজের সবকিছুই ত্যাগ করে এসেছে। এমনকি এই বাড়িটাও রূপার! অথচ সে-ই এই বাড়ির সবচেয়ে ছোট, চিলেকোঠার রুমটায় থাকে। আর বাকিরা থাকে খোলামেলা বড় রুমগুলোতে৷ এতো এতো অন্যায়ের মাঝে এইটুকু পুণ্য বারেক করতে চান। রূপা তো তারই রক্ত।
রূপার অবস্থা দেখে সুমনা নরম হলেন। তার ভীষণ মায়া হয়। তিনি বললেন, “একটু দেখেশুনে চলাফেরা করতে পারিস না? কী অবস্থা করেছিস দেখ। এখনতো তোকেই ভুগতে হবে।”
রূপার মাথা ভনভন করছে। ঘুমালে ভালো লাগবে। সে ভ্রুকুটি করে বলল, “আমি যাই, ঘুমাব।”
“আগে ভাত খা। বাপ-মেয়ে বস, ভাত বাড়ছি আমি।”
“আমি এখন খাব না৷ ভালো লাগছে না।”
বারেক কপট রাগ নিয়ে বললেন, ” অবাধ্যতা ভালো না রূপা। মা বলছে, চুপচাপ বসে পড়।”
বারেকের নাটকীয় রোষাগ্নি চেহারা দেখে রূপা টেবিলে বসল। সুমনা ভাত বেড়ে দিতে দিতে বললেন, “খুঁড়িয়ে হাঁটছিস কেন? পা কি মচকে গেছে?”
রূপা হাত ধুতে ধুতে ছোট করে বলল, “হুম।”
“ব্যথা করে?”
“সে তো করবেই।” রূপা উত্তর দিচ্ছে দায়সারাভাবে।
সুমনা ফ্রিজ থেকে বরফের টুকরো নিয়ে এসে রূপাকে বললেন, “বাম পা’টা চেয়ারের উপর রাখ।”
রূপা চকিতে তাকাল। বলল, “কেন?”
“বরফ লাগালে ব্যথা কমবে ফোলা ভাবটা যাবে৷” তারপরই গমগমে গলায় বললেন, “এতো কথা বলছিস কেন তুই? সব কথার উত্তর দিতে হবে?”
রূপা বিস্মিত নয়নে বারেকের দিকে তাকাল। বারেক ইশারা করলেন, রাখতে৷ রূপা পা রাখল। সুমনা তার পায়ের ফোলা অংশে বরফ মর্দন করতে করতে বললেন, “রাত-বিরেতে এদিকওদিক যাওয়ার কী দরকার?” তারপর বারেকের দিকে তাকিয়ে রুষ্ট কণ্ঠে বললেন, “আর তুমি এতো রাতে কেন পাঠাতে গেলে? আজ উনত্রিশ তারিখ জানো না তুমি? ও যে ফিরে আসছে এটাই আমাদের কপাল৷ আর কত বোকামি করবে? বয়স তো কম হলো না।”
বারেক প্রতিত্ত্যুরে কিছু বললেন না৷ সুমনা রুমি-রিনি জন্মানোর আগ অবধি এভাবেই রূপাকে ভালোবাসতেন, যত্ন নিতেন। রূপার কিছু হলে বারেককে বকাবকি করতেন। বহুদিন পর সেই দৃশ্যটা দেখতে পেরে বারেক মনে মনে হৃষ্ট৷
বরফ মর্দন করা শেষে রূপা খেতে উদ্যত হতেই সুমনা বললেন, “আঙুলের চামড়া তো উঠে গেছে, ঝোল মেখে ভাত খেতে পারবি? জ্বলবে না?”
“চেষ্টা করব।” সুমনা পায়ে বরফ মর্দন করে দেয়াতে রূপার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, পায়ের ব্যথা চলে গেছে৷ তার কণ্ঠ নেমে এসেছে খাঁদে।
সুমনা পাতিল নিয়ে এনে টেবিলের উপর রাখলেন। রূপার ভাতের প্লেটে দিলেন মাছের সবচেয়ে বড় টুকরোটি৷ তারপর ভাত মাখিয়ে রূপার মুখের সামনে ধরলেন। রূপা হতবাক। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে, দৃশ্যটি স্বপ্ন লাগছে। মা শব্দটা তার কাছে কখনোই অসাধারণ হতে পারেনি। বুঝ হওয়ার পর থেকে মায়ের আদর পাওয়া হয়নি। সবসময় গঞ্জনাই সইতে হয়েছে। সুমনাকে এখন তার মায়ের মতোই লাগছে৷ সে হা করল। কয়েক লোকমা খাইয়ে হঠাৎ সুমনা বললেন, “রূপা, তোর কি আমার উপর অনেক রাগ?”
রূপা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। সেকেন্ড দুয়েক পর কোনোমতে বলল, “না আম্মা। কোনো রাগ নেই।”
সুমনা হঠাৎ কান্না করতে শুরু করলেন। রূপা চমকে গেল। বলল “কী হলো আম্মা, কাঁদছো কেন?”
সুমনা চোখের জল মুছে বললেন, “তুই বুঝবি না।”
“বললেই তো বুঝি৷ আমি কী ছোট রয়েছি?”
সুমনা আরো দুই লোকমা খাইয়ে চলে গেলেন নিজের রুমে। বলতে গেলে, পালিয়ে গেলেন।
রূপা বারেককে প্রশ্ন করল, “কী হয়েছে আব্বা?”
বারেকও কিছু বললেন না৷ বা হয়তো বলতে চাননি।
রূপা নিজের রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। তার মন এখন ভালো। অরুনিকা নিরাপদে আছে, আবার মা বহু বছর পর আজ তাকে খাইয়ে দিল৷ তবে অনেকগুলো প্রশ্ন মানসপটে ঘূর্ণিপাকে ঘুরছে। বনে কী ছিল ওটা? সুমনা হঠাৎ পালটে গেলেন কেন? কেনই বা কাঁদলেন?
_
পরদিন রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পূর্বে রূপা খেয়াল করল, মানিব্যাগে পাঁচশ টাকা কম!
সে হন্নে হয়ে খুঁজেও মানিব্যাগ বা রুম কোথাও টাকাটা পেল না।
তারপর হঠাৎ মনে পড়ল, সাইকেল থেকে পড়ার সময় মানিব্যাগও পড়ে গিয়েছিল। তখন হয়তো টাকাটা পড়ে গেছে। এখন হাইওয়ে রোডে গেলে যে টাকাটা পাবে তার সম্ভাবনা নেই। রূপার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। পাঁচশ টাকা তার কাছে অনেক!
কিন্তু আসল চমক ঘটে দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে। সে রুমের সামনে একটা খাম পেল। খুলে দেখে সেখানে পাঁচশ টাকার নোট! বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল রূপা। এই টাকাটাই কি তার? তবে কে রেখে গেল?
মাথায় এলোমেলো চিন্তা নিয়ে সে বাজারে এসে শুনে, হাইওয়ে রোডের বনে রাহাতি মণি নামে একজনের লা’শ পাওয়া গেছে!
রাহাতি মণির লাশ, খু’নী আর পাঁচশ টাকার নোটের মধ্যে কী কোনো সূক্ষ্ম সংযোগ রয়েছে?
চলবে…
(প্রতি রবিবার ও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটার পর নতুন পর্ব আপলোড হবে, ইনশাআল্লাহ।)