সূর্যশিশির
৩.
হোটেলে খরিদ্দারদের উপচে পড়া ভিড়। সন্ধ্যার সময়টুকু হোটেল ব্যবসায়ীদের জন্য লাভজনক। দিনমজুর শ্রেণীর লোকেরা আহার করতে আসে। বয়স্ক ও বেকার লোকেরা আসে আড্ডাবাজি করতে। রূপা ভিড় কাটিয়ে প্রথমে হেঁশেলে গিয়ে ঢুকলো। বারেক মিয়া পুরোদমে রান্না করছেন। রূপাকে দেখে বললেন, ‘তোর কি আক্কেল জ্ঞান নাই? কই ছিলি?’
রূপা ঘাড় ম্যাসাজ করতে করতে বললো, ‘আশেপাশেই।’
বারেক গামছা দিয়ে কপালের ঘর্ম মুছে বললেন, ‘মাংস বসাইছি খেয়াল রাখিস৷ বেসিনে প্লেটগুলো রাখা, জলদি ধুয়ে রাখ৷ আমি গিয়ে দেখি কী অবস্থা।’
‘জি আব্বা।’
মাংসের ঝোলে তেলের পরিমাণ দেখে রূপার গা রি রি করে ওঠলো। তেলের দাম কমে গেল নাকি!
কিছুক্ষণের মধ্যে সুজন প্লেট নিতে এলো। বারো-তেরো বছরের কিশোর সুজন ‘সুমনা হোটেলে’ কাজ করছে মাস তিনেক ধরে। রূপার সাথে তার সখ্যতা দেখার মতো। সুজন প্লেটগুলো হাতে নিয়ে রূপার নিকটে এসে চাপাস্বরে বললো, ‘ওস্তাদ, কাহিনি তো ঘইট্টা গেছে।’
রূপা চুলার আগুন কমিয়ে দিয়ে বললো, ‘কী হলো আবার? ‘
‘বেইন্নাবেলা দোকানে সন্ত্রাস আইছিলো।’
রূপা আঁতকে উঠলো, ‘কী বলিস! কেন?’
‘চান্দা নিতে আইছিলো। কম হইলেও পাঁচ হাজার টেকা দেওন লাগবো। কাকার কাছে এক হাজার টেকা আছিলো। হাতেপায়ে ধইরা কইছে রাইতে আইয়া বাকি টেকা নিতে।’
‘এই পাড়াতেও চাঁদাবাজি শুরু হয়ে গেল! বাজারের অন্য দোকানিরা কিছু বলেনি?’
‘না, সবাই চান্দা দিছে। সন্ত্রাসদের যে নেতা হে কার নাকি ভাতিজা লাগে। সবগুলা হাতে ছু’রি নিয়া আইছিলো।’
রূপার ললাটজুড়ে দৃশ্যায়িত হয় চিন্তার ভাঁজ। ৯৯৯-এ কি কল করা উচিত? বারেক সুজন সুজন বলে চেঁচাচ্ছেন। সুজন চলে যাওয়ার পূর্বে বললো, ‘ওহ ওস্তাদ কইতে মনে নাই। তোমার গালপেরেন বাইরে খাড়ায়া আছে।’
‘তুই এটা এখন বললি! শালা বদমাশ।’ মুহূর্তে রূপার মাথা থেকে চাঁদাবাজরা মিলিয়ে গেল। সে সুজনকে ঠেলে তুরন্ত হোটেলের বাইরে গিয়ে দেখে অরুনিকা দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে কালো বোরকা; চোখমুখ নিকাবে ঢাকা। বাজারে যতবার তার চরণ পড়েছে নিজেকে আগাগোড়া বোরকা দিয়ে আবদ্ধ করে তবেই এসেছে। অরুনিকার হাতে টিফিনবাক্স দেখে রূপা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে।
এই ভালোবাসার জন্য একটা কেন শত প্রেমিক ত্যাগ করা যায়। রূপাকে দেখে অরুনিকা তেড়ে এলো, ‘আমি কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি? তোর চামচারে আমি কখন বলছি গিয়ে খবর দিতে। তা না করে আমার সাথে ফ্লার্ট করছিলো।’
রূপা হেসে টিফিনবাক্সটি নিয়ে বললো, ‘সুজন ফ্লার্ট করছে! কী বলে?’
‘তুই হাসছিস! ও আমাকে বললো, ওস্তাদ তো মাইয়া আমি হইলাম পোলা আমনে আমার লগে প্রেম করেন। আমনেরে আমি বড় হইয়া বিয়া করমু।’
‘অল্প বয়সে পেকে গেছে। আমাকে বলে, তুই নাকি আমার গার্লফ্রেন্ড।’
অরুনিকা আরেকটু কাছে এসে গলা খাদে নামিয়ে বললো, ‘আর তুই আমার বয়ফ্রেন্ড। চল আমরা পালিয়ে যাই।’
‘হুরর! ফাজলামো বন্ধ কর৷ রাতবিরেতে বাজারে চলে এলি যে বাসার কেউ দেখেনি?’
‘মা সিরিয়াল দেখে। পাপা বাসায় নাই। দারোয়ান যদিও আসতে দিচ্ছিলো না। অনেক অনুরোধ করে আসতে হয়েছে।’
‘বেহুদা কষ্ট করলি। এখন বাড়ি যা। বাজারে অনেক মানুষ। কখন কার কু-নজর পড়ে ঠিক নাই৷ রিক্সা ডেকে দিচ্ছি।’
অরুনিকা আরো কিছুক্ষণ থাকতে চেয়েছিলো। রূপা জোর করে তাকে রিক্সায় তুলে দেয়। সে চায় না অরুনিকা এখানে থাকুক। এখানকার লোকজন খুব একটা সুবিধের না।
রূপা হেঁশেলে টিফিনবাক্সটি লুকিয়ে রেখে খরিদ্দারদের প্রতি যত্নশীল হয়৷ যে যা অর্ডার করে সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত করে নিয়ে আসে।
রূপা যখন ছয় বছরে পদার্পণ করে তখন থেকে সে এই হোটেলের কাজে নিয়োজিত। ব্যবসার খুঁটিনাটি তার নখদর্পনে। রাঁধুনি হিসেবেও চমৎকার। বারেক মিয়ার রান্না অতিরিক্ত তেলমশলা যুক্ত হলেও তার রান্না সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর হয়। নিজের অজান্তেই বহুদিন ধরে বুকে একটি স্বপ্ন লালন করে চলেছে , একদিন শহরের সবচেয়ে বড় রেস্টুরেন্টটির মালিক হবে সে।
‘এ ভাই এক কাপ চা দেন।’
রূপা ছুটে চা বানাতে যায়। এরই মধ্যে বারেক এসে বললেন, ‘ও মা, ডাল তো শেষ। ভাতও শেষের পথে।’
রাত এগারোটায় ফুরসত মিলে তার। টিফিনবাক্স নিয়ে চেয়ারে বসতেই কিছু ছেলেপেলে এসে প্রবেশ করে হোটেলে। তাদের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে রূপা খেতে শুরু করলো। ছেলেগুলো চেয়ারে না বসে এলোমেলো হয়ে যে যেখানে পারে বসে পড়ে। কেউ বা শুয়ে পড়ে বেঞ্চির উপর।
তাদের ব্যবহার দেখে সে আন্দাজ করে, এরাই চাঁদাবাজ, সুজনের ভাষায় সন্ত্রাস। বারেক মিয়া চার হাজার টাকা নিয়ে এলে ছেলেগুলোর মধ্য থেকে একজন বললো, ‘সারাদিন অপেক্ষা করাইলেন কাকা, জরিমানা হাজারখানেক না দিলে হয়?’
বারেক মিয়া যেন ব্যাটারি চালিত পুতুল! যেভাবে চালানো হয় সেভাবেই চলে। কোনো প্রতিবাদ না করে কথামতো সঙ্গে সঙ্গে আরো এক হাজার টাকা যোগ করে দিলেন। তিনি ভয়ে কাবু হয়ে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তে কেঁদে দিবেন! রূপা মনে মনে হাসলো।
খাওয়া শেষে হাত ধুতে গেলে ভ্রু কাঁটা ছেলেটি ডেকে বললো, ‘এই ছেলে, এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আয়।’
রূপা হাত ধুয়ে টিফিনবাক্স পরিষ্কার করলো। এরপর এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এলো। ভ্রু কাঁটা ছেলেটি প্যাকেটটি হাতে নিয়ে বললো, ‘এটিটিউড দেখাচ্ছিস দেখি! নাম কী?’
‘রূপা।’
‘মেয়ে নাকি?’ ছেলেটি অবাক হলো। রূপা কিছু বুঝে উঠার আগে তার মাথার ক্যাপ টেনে খুলে ফেললো। রূপার লম্বা চুলের খোঁপা দেখে ছেলেটি নিশ্চিত হলো, এটি মেয়ে! ততক্ষণে বাকি ছেলেগুলোর নজরেও সে চলে আসে। ভ্রু কাঁটা ছেলেটি জহুরি চোখে রূপার আপাদমস্তক দেখে বললো, ‘শরীরে তো কিছুই নাই। সামনে পিছনে সব সমান। মনেই হয় না যে মেয়ে।’
সবগুলো ছেলের ঠোঁটে বিশ্রি হাসি ফুটে ওঠে। পেছন থেকে একজন বললো, ‘ছুঁইয়া দেহেন হীরা ভাই। থাকতেও পারে।’
ছেলেটির নাম হীরা! হীরা হাত বাড়াতেই রূপা সরে যায়। এই ঘটনা নতুন নয়। প্রতিদিনই বুলিংয়ের শিকার হয় সে৷ লম্বায় তরতর করে বাড়লেও, স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো নয়। এতে তার সমস্যা নেই, সমস্যা সমাজের।
হীরা বারেককে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘আপনার দোকানে নাকি কাস্টমারদের অনেক ভিড় হয়। এটাই কারণ ? মেয়ে দিয়ে ব্যবসা করেন?’
কথাটি শুনে রূপার কর্ণকুহরে ভোঁভোঁ শব্দ শুরু হয়। সমাজের নিচু শ্রেণীর কিছু লোক কানাঘুঁষা করলেও সরাসরি কেউ এভাবে বলেনি! বারেক মিনমিনে সুরে বললেন, ‘এমন কিছু না।’
রূপা মেঝে থেকে ক্যাপ তুলে মাথায় পরে নিল। এসব লোকদের যত এড়িয়ে চলা যায় ততই ভালো। সে চুপচাপ ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে বসলো। রূপাকে নিয়ে চাঁদাবাজদের আসর জমে উঠছিল না বলে, কোনো এক ভাইয়ের বউ তাদের আলোচনার মূখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। গা গুলিয়ে উঠার মতো অশ্লীল কথাবার্তা! রূপা আড়চোখে হীরাকে দেখে। নারী দেহ নিয়ে মন্তব্য করছে আর হো হো করে হাসছে। ছিঃ! এই অসভ্যকে সে আর কখনো দেখতে চায় না, কখনো না!
বের হওয়ার সময় ক্যাশ কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালো হীরা। রূপার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো। বললো, ‘মনে হচ্ছে, আমাদের আবার দেখা হবে।’
চলবে…