তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি সুচনা পর্ব

0
2726

–প্রথমবারের ভুলে সম্পর্কটা আংটি পর্যন্ত গড়িয়েছে। এবার কোন ভুল করলে সেটা সোজা কাজি অফিসের রাস্তা চিনিয়ে তবেই ছাড়বে।
ঈশার ডান হাতের আঙ্গুলে জ্বলজ্বল করা হিরের আংটিটা নাড়াচাড়া করতে করতে কথাটা বলল ইভান। ঈশা স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে। ইভানের মুখে এমন কথা সে শুনবে সেটা তার ধারনা ছিলোনা। অবশ্য এখন আর ধারনা করার মতো কোন অবস্থাই বাকি নেই। গত কয়েকদিনে ইভান কে নতুন ভাবে চিনেছে ঈশা। কিন্তু ইভানের এই রুপ শুধু তার জন্যই বরাদ্দ। তার বাবার কাছে এখনো তো ইভান সেই সোনার টুকরো ছেলেই। ঈশা ইভানের দিকে এক নিস্পলক তাকিয়ে আছে।

–এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার প্রেমে পড়তে তোর খুব বেশী সময় লাগবে না। আর আমার প্রেমে পড়া মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা।

ঈশা ছল ছল চোখ বন্ধ করতেই দুই ফোটা পানি গাল বেয়ে ঝরে পড়লো। ইভান ঈশার হাত ছেড়ে দিলো। এক আঙ্গুলে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
–তোর এই বিষাক্ত ভালবাসাও হজম হয় কিন্তু এই মায়াবী চোখের পানি……

একটু থেমে বুকের বা পাশে এক হাত রেখে বলল
–ঠিক এই খানটায় জালিয়ে দেয়। দুনিয়াতে এই একটাই জিনিস আমার অসহ্য!

কথা শেষ করে এদিক সেদিক ভালো করে তাকাল ইভান। বারান্দার দরজাটা খোলা। তারপর চোখ ফিরিয়ে টেবিলের পাশের জানালাটাও খোলা দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো। জানালা বন্ধ করে বারান্দার দিকে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করতে করতে বলল
–এতো রাত অব্দি এগুলো কেন খোলা রেখেছিস? ভালো করে বন্ধ করে তারপর ঘুমাবি।

–এসবের জন্যও কি এখন আমাকে তোমার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে?

ইভান একটু হেসে ঈশার সামনে এসে দাঁড়ালো। মোহনীয় কণ্ঠে বলল
–পারলে তো তোর প্রতি সেকেন্ডে ফেলা নিঃশ্বাসের কৈফিয়তটাও নিতাম। কিন্তু আফসোস সেটার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেয়নি।

টেবিলের সাথে থাকা চেয়ারে বসে সামনে থেকে ঈশার ফোনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল
–মাঝ রাত অব্দি কার সাথে ফোনে ব্যস্ত থাকিস?

–সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সব কিছুর কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিতে পারব না।

ঈশা ঝাঝাল কণ্ঠে কথাটা বলেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ইভান উঠে এসে ঈশার হাত ধরে আংটিটার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–‘ব্যক্তিগত’ শব্দটা জিবনের ডিকশনারি থেকে বাদ দিয়ে দেয়াই তোর জন্য ভালো হবে। তুই এখন আর নিজের ব্যক্তিগত নয়। শুধুই এই ব্যক্তিটার! আর কৈফিয়তের কথা……

বলেই থেমে গেলো। ঈশার মুখের দিকে তাকিয়ে এক আঙ্গুলে ধরে থাকা হাত দিয়ে স্লাইড করতেই ঈশার সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। প্রথমবার ইভানের এমন স্পর্শে ঈশার লোম গুলো মুহূর্তেই শিউরে উঠলো। সেদিকে তাকিয়েই বাকা হেসে বলল
–তোর শরীরের থেমে থেমে শিউরে উঠা লোম গুলোও আমাকে কৈফিয়ত দেয়। আর বাকি বিষয় গুলো তো নিতান্তই তুচ্ছ।

ঈশা নিজের হাত টেনে নিতে চাইলে ইভান আরও শক্ত করে ধরে। ঈশা অনেকটা ব্যাথা পায়। ব্যথায় চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নেয়। ইভান বুঝতে পেরে হাত ছেড়ে সরে দাড়ায়। ঈশা নিজের চোখের পানি ফেলে পিছনে ঘুরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে
–এই সময় কেন এসেছ আমার ঘরে?

–তোর ঘরে আসার জন্য সময় হিসাব করার কথা তো আমার নয়।

–চলে যাও প্লিজ! এতো রাতে এভাবে কেউ দেখলে বিষয়টা ভালো দেখাবে না।

–ইভান কারও কেয়ার করেনা।

–কিন্তু আমি করি।

–কেয়ারটা শুধু আমার জন্য হলেই ভালো হতো।

–চলে যাও প্লিজ!

–এতো বার প্লিজ বলতে হবে না। আমার সাথে ভালো করে কথা বল আমি তোর সব কথা শুনবো। তোর কথায় উঠবো তোর কথায় বসব। কিন্তু উল্টো ব্যবহার করলে ঠিক উল্টোটাই হবে।

বেশ কিছুক্ষন পর ইভান চলে গেছে ভেবে ঈশা পিছনে ঘুরে দাড়ায়। কিন্তু ইভান তখনও দাড়িয়ে আছে। ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোন বেজে উঠে। ঈশা ফোন নেয়ার আগে ইভান হাতে নেয়। ফোনের দিকে তাকিয়ে বলে
–এতো রাতে তোর ছেলে বন্ধুর ফোন ইন্টারেস্টিং!

ঈশা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায়। না জানি এবার নতুন কোন নাটকের স্বীকার হতে হবে। ইভান ফোনটা হাতে নিয়ে ঈশার সামনে এসে দাড়ায়। ঈশার মুখের উপরে উড়ে বেড়ানো এলোমেলো চুলগুলো জত্ন করে এক আঙ্গুলে সরে দিয়ে খুব শান্ত ভাবে বলে
–ইভান এখন একদম ভদ্র ছেলে। আমাকে আগের মতো হতে বাধ্য করিস না। না হলে যা হবে সব কিছুর জন্য তুই দায়ি থাকবি।

ঈশা কোন কথা বলল না। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকল। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে করুন সরে বলল
–ভালবাসিস না তাই ভালবাসার মানেও বুঝিস না। আমি তোকে ভালবাসা শেখাবো যেটা শুধুই আমার জন্য বরাদ্দ। সেটার ছিটেফোঁটা অন্য কারও দিকে গেলে তার জীবন থাকবে না বলে দিলাম।

ফোনটা বিছানার উপরে ছুড়ে দিয়ে বাইরে যেতে যেতে কঠিন গলায় বলল
–ভুল করেছিলি আমাকে হালকা ভাবে নিয়ে। নেহাত তোর মাঝেই আমার জান আটকে আছে নাহলে তোকেই মেরে ফেলতাম শাস্তি হিসেবে। আমার ঘৃণা তুই হয়ত সহ্য করতে পারবি কিন্তু আমার ভালবাসার অধিকার তোকে প্রতি মুহূর্তে জালিয়ে দিবে। প্রতি মুহূর্তে তুই জলে পুড়ে আবার নতুন করে এক ভালবাসার সম্মুখীন হবি। না পারবি সেটা থেকে বাচতে না পারবি সেটা সাদরে গ্রহন করতে। স্পষ্ট করেই বলেছিলাম। আমাকে আমার মতো ভালবাসতে দে। প্রথমবার ভুল করেছিলি আমার ভালবাসা রিজেক্ট করে। সেটাও মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু বড় ভুল করেছিস অন্য কারও হতে চেয়ে। সেই অধিকার আমি তোকে দেইনি। আর কখনও দিবনা। আমি বেচে থাকতে তুই অন্য কারও হতে পারবি না।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো ইভান। ঈশা বিছানায় বসে পড়লো। নিশব্দে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। জিবনের এক অদ্ভুত পরিক্ষার সম্মুখীন সে। কারও ভালবাসা যে কাউকে এতটা কষ্ট দিতে পারে সেটা ঈশার কখনই ধারনা ছিলোনা। ঈশার কাছে ভালবাসার অনুভুতি সব সময় সুখের বলেই জানা ছিল। কিন্তু তার জিবনের এই তিক্ত অনুভুতি ভালবাসার প্রতি সমস্ত ধারনা বদলে দিয়েছে।

————-
ঈশা টেবিলে বসে নাস্তা খাচ্ছিল। এমন সময় কলিং বেল বাজতেই ঈশার ভাবি রুমা দরজা খুলে দিলেন। ইভান কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সে একটু হেসে দুষ্টুমির সুরে বলল
–কি ব্যাপার হবু জামাই বাবু? এতো সকালে? ঈশাকে দেখতে এসেছ বুঝি?

ইভান হেসে বলল
–দেখেতে আসিনি নিয়ে যেতে এসেছি।

ঈশা খাবার মুখে নিয়ে চিবাচ্ছিল। কথাটা কানে আসতেই গলায় খাবার আটকে গেলো। কাশতে লাগলো সে। রুমা তার দিকে ঘুরে তাকাল। এর মাঝেই ইভান ভিতরে ঢুকে গেলো। ঈশার সামনে পানির গ্লাস ধরে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকল। ঈশা ইভানের দিকে একবার তাকাল। কি শান্ত চাহুনি। দেখেই মনে হচ্ছে এই ছেলের মতো ভদ্র ছেলে আর দুনিয়াতে একটাও নেই। তাই তো বাবার ভুল ধারনা এই ছেলে সম্পর্কে। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে চোখ নামাতেই ইভান এক হাত টেনে শক্ত করে চেপে ধরে পানির গ্লাসটা হাত ধরিয়ে দিয়ে দাতে দাত চেপে বলল
–ভালই ভালই খেয়ে নে। সকাল বেলা কোন সিন ক্রিয়েট করতে চাইছি না।

ঈশা একবার পিছনে রুমার দিকে তাকাল। রুমা দরজা লাগিয়ে সেখানে দাড়িয়ে তাদের দিকে দেখছে। এই মুহূর্তে যে কোন ধরনের সিন ক্রিয়েট করতে পারে ইভান। তাই তার কথা শোনা ছাড়া কোন উপায় নেই। ঈশা পানি নিয়ে একটু খেয়ে উঠে দাঁড়ালো। রুমা এগিয়ে এসে হাসি মুখে বলল
–সকাল সকাল এতো রোম্যান্টিক সিন দেখতে পাব সেটা ভাবিইনি। দিনটা আজ সার্থক!

ইভান ঈশার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। ঈশার এখন কোন ভাবেই তার হাত ধরতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু রুমা দুষ্টুমি করে বলল
–কি গো ননদিনী লজ্জা পাচ্ছ বুঝি? এই হাত কিন্তু সারাজীবন ধরেই রাখতে হবে। তাই আর লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।

সারাজীবন কথাটা শুনে ঈশার বুকের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। এই মানুষটার সাথে কিভাবে সারাজীবন কাটানো যায়? এতো মানুষ না জল্লাদ একটা। রুমা ঈশাকে ভাবতে দেখে আবারো বলল
–আর কতো অপেক্ষা করাবে? নাও এবার হাতটা ধরেই ফেল।

–আমি সারাজীবন এভাবে অপেক্ষা করতে পারব ভাবি। সেটা শুধু তোমার ননদ বুঝলেই হয়।

ইভানের কথা শুনে ঈশা চোখ তুলে তার দিকে তাকাল। এই মুহূর্তে ঈশার কিছুই করার নেই। সে অনিচ্ছাতেই ইভানের হাত ধরে ফেলল। ইভান রুমার দিকে তাকিয়ে বলল
–আমরা এখন আসি ভাবি। আমার ডিউটি আছে আর ওর ক্লাস আছে। দেরি হয়ে যাবে।

–বাহ বাহ! কি ভালবাসা। এঙ্গেজমেন্টের পরে মনে হচ্ছে ভালবাসা আরও বেড়ে গেছে।

রুমার কথায় ইভান একটু হেসে বলল
–আগেও এমনি ছিল। এতদিন সুপ্ত ছিল আর এখন প্রকাশ করছি।

বলেই আর দেরি না করে ঈশাকে এক প্রকার টেনে নিয়ে গেলো। লিফটের মাঝেও ঈশার হাত ছাড়ল না ইভান। কেউ কোন কথা বলছে না। চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। লিফট এসে নিচে নামতেই দেখে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। ইভান দরজা খুলে ঈশাকে ভিতরে বসিয়ে দিলো। তারপর নিজে বসে দরজা লাগিয়ে দিলো। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো। ঈশা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বাইরের পরিবেশ অনেক সুন্দর কিন্তু এই মুহূর্তে তার সব থেকে অসহ্য লাগছে। ইভান পাশে থাকার কারনে। জীবনটা কেমন থমকে গেছে মনে হয়। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। জানালার কাচে মাথা ঠেকিয়ে দিতেই ইভান শান্ত কণ্ঠে বলল
–খারাপ লাগছে?

ঈশার এই কথাটাও যেন অসহ্য লাগছে। আসলে এই কয়দিনে ইভানের সব কথাই ঈশার অসহ্য লাগছে। তাকে আশে পাশে দেখলেই কেমন বিরক্ত হয়ে উঠছে সব কিছু। ইভান এবার গম্ভির গলায় বলল
–কথা কি বন্ধ হয়ে গেছে নাকি?

ঈশা একদিকে তাকিয়ে বলল
–ঠিক আছি।

ইভান জানালা দিয়ে এদিক সেদিক দেখতে দেখতে বলল
–আমি সারা শহরের মানুষের ট্রিটমেন্ট করি আর হবু বউ অসুস্থ হলে অন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। সেটা কি মানা যায়?

ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান তার দিকে তাকাল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–তুই তো নিজেও ডাক্তার হবি। আমার কাছে ট্রিটমেন্ট নিতে না চাইলে নিজের ট্রিটমেন্ট নিজেই করতে শেখ। অন্য কারও কাছে গেলে সেটা মানুষের জন্য আর তোর জন্য দুজনের জন্যই খারাপ হবে।

ঈশা এবার ভালভাবে বুঝতে পারছে ইভান কি বলতে চাইছে। কিছুদিন আগে ঈশা ক্লাস করার সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে। কলেজের অন্য পাশে ইভানের ডিউটি ছিল। সে তখন রোগী দেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ঈশার অসুস্থতার কথা শুনে সব কাজ ফেলে চলে আসে সে। কিন্তু এসে দেখে অন্য একজন ঈশার ট্রিটমেন্ট করছে। তখন ইভান কোন রিয়াক্ট করেনি। শুধু শান্ত ভাবে বলেছিল
–তোর আশে পাশে থেকেও আমি তোর অসুস্থতার কথা জানতে পারলাম না। কিন্তু এটা তো শুধু আমারি জানার অধিকার ছিল।

–সরি!

শব্দটা কানে আসতেই ঈশা খেয়াল করলো গাড়ি থেমে গেছে। ইভান ফোনের দিকে তাকিয়েই কথাটা বলেছে। ঈশা অবুঝের মতো তাকিয়ে থাকল। ইভান ঈশার দিকে ঘুরে আবার স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–কাল রাতের ব্যাবহারের জন্য সরি! ওভাবে বলতে চাইনি। রাগ হয়েছিলো খুব। আমি তোর সাথে রুড হতে চাইনা। কিন্তু তুই যে ভালো কথা বুঝিস না। আমি যেটা পছন্দ করিনা সেটা তুই ইচ্ছা করে করিস। আমাকে কষ্ট দিয়েও যদি ভালো থাকিস তাহলে সেটাই ভালো।

একটু থেমে আবার বলল
–আমার ভালবাসা এতটাই গভির যার গভিরতা মাপার জন্য সেখানে হারিয়ে যেতে হবে। উপর থেকে শুধু পাগলামিটাই মাপতে পারবি ভালবাসা নয়। আর সেখানে একবার হারিয়ে গেলে ফেরার রাস্তা আর পাবি না জান।
তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
সুচনা পর্ব
লেখক-এ রহমান

চলবে……?
(একটু বড় করে জানাবেন চলবে কিনা? নতুন নামে নতুন গল্প। কেমন লাগছে?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here