#ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ০৭
ক্লিওপেট্রা শোয়া থেকে উঠে বসে আচমকা ওর দু’হাত দিয়ে আমার গাল চেপে ধরল। আমার চোখে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘আমাকে বিয়ে করবে, আহান?’
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কিছু সময় পেরিয়ে গেল নিরবতায়। আমাকে চুপ থাকতে দেখে ক্লিওপেট্রা অভিমানিনী হল হঠাৎ। মন খারাপ করে বলল, ‘থাক বলতে হবে না। আমি জানি।’
‘কী জানো?’
‘তুমি যে আমাকে বিয়ে করতে চাও না।’
আমি কিছু বললাম না। ও হঠাৎ তড়িৎ গতিতে একদম আমার কাছে চলে এল। হুট করেই আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার থুতনিতে চুমু খেয়ে নিল।
এই মেয়ে এমন করছে কেন! প্রত্যেক মুহূর্তে ওর কথা ও কাজ দ্বারা আমাকে স্তম্ভিত করে দিচ্ছে!
ক্লিওপেট্রা আমার বুকে ওর মাথা রাখল। আমি ওকে বাঁধা দিলাম না। ও নিচু স্বরে বলতে লাগল, ‘তুমি আমাকে বিয়ে নাই-বা করলে। তাতে আমার কোনো আফসোস নেই। তোমার দেখা পেয়েছি, তোমার সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি, এই যে তোমাকে ছুঁয়ে আছি আর কি চাই! এইতো বড় ভাগ্য! বিয়ে! ওটা তো বামন হয়ে চাঁদ ছোঁয়া হবে! তুমি আমার চাইতে হাজারগুন ভালো মেয়ে ডিজার্ভ করো, আহান।’
কথা শেষ করেই ক্লিওপেট্রা কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে আমার হাত খামচে ধরল। নখ বসে গেল তাতে। আমি ওকে সরিয়ে দিলাম না। কাঁদুক। কাঁদলে মন হালকা হয়।
কিছুক্ষণ বাদে ও নিজে থেকেই সরে গেল। সরে বলল, ‘ভোর হয়ে যাচ্ছে ঘুমোও।’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও বলল, ‘আমি যাচ্ছি না। আমি জানি তুমি আমাকে ছাড়া ঘুমুতে পারো না।’
আমি চমকে উঠলাম। ‘কে বলেছে?’
‘কাউকে বলতে হবে কেন? আমি সব জানি। গত এক মাস ধরে দেখছি তুমি ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকো শুধু। আমি এলে তবেই ঘুমাও।’
একটু থেমে ও জিজ্ঞেস করল, ‘এ অভ্যাস কেন বানালে আহান?’
আমি কিছু বলতে পারলাম না। ও আবার বলল, ‘এখন ঘুমাও। কাল থেকে আমি আর আসবো না।’
আমি এবারও কিছু বললাম না। বসা থেকে লেপ টেনে গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ও পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলাম।
সকালে ঘুম ভাঙ্গলে পাশে ক্লিওপেট্রাকে দেখতে পেলাম না। চলে গেছে বোধহয়। আর আসবে না। আসবে না মনে হতেই আমার বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা হতে লাগল। আশ্চর্য! আমার কেন এমন অনুভব হচ্ছে! ও তো আমার কেউ না! দু’দিনের জন্য এসেছিল। আবার চলে গেছে। এতে তো কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই!
একদিন, দুদিন, তিনদিন করতে করতে সাতদিন চলে গেল। আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেল ক্লিওপেট্রা আসে না। মিথিও নিখোঁজ সাত দিন যাবৎ। স্বাভাবিক। কারণ মিথিই তো ক্লিওপেট্রা।
মা মিথির শোকে জর্জরিত। অহনা মিথির লিটারবক্সের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আর বলে, ‘আহারে! লক্ষী বেড়ালটা এখানে বসে বাথরুম সারতো!’
তখন রাগে আমার গা পিত্তি জ্বলে যায়। দুনিয়াতে মিথির এত কিছু থাকতে ওর লিটারবক্স দেখে ওকে স্মরণ করতে হবে কেন! অহনার বদ স্বভাব। নোংরা কোথাকার!
★
পনেরো দিন হতে চলল ক্লিওপেট্রা আসছে না। এই পনেরো দিন আমার কতটা ভয়ংকরভাবে কেটেছে বলে বোঝাতে পারব না। যেখানেই যাই ওকে দেখি। সেদিন দেখি ফ্রিজের ভেতর বোতলের ওপর বসে আছে। এটা কখনো সম্ভব! আমি আসলে পাগল হয়ে যাচ্ছি। তারই আলামত এগুলো। ইদানীং আমার মনে হচ্ছে ক্লিওপেট্রাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। নির্ঘাত মারা পড়ব।
ওকে ফেরানোর উপায় খুঁজতে লাগলাম। মনে মনে একটা প্ল্যানও এটে ফেললাম। যেই ভাবা সেই কাজ। ফারিয়াকে ফোন করে বললাম, আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই। ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাবে। কিন্তু আপাতত এর চাইতে ভালো উপায় আর মাথায় আসছে না।
সেদিন সারাদিন ফারিয়ার সঙ্গে ঘুরলাম। ওকে শপিং করে দিলাম, ওর সঙ্গে লাঞ্চ করলাম। শেষে এক রিকশা করে ওর সঙ্গে বাড়ি ফিরলাম। ও রিকশায় আমার হাতের ওপর ওর হাত রাখল। আমি মনে মনে হাসলাম।
এতেই কাজ হবার কথা!
রাতে বিছানায় শুয়ে আছি। এখন আর ঘুমের ওষুধ না খেলে ঘুম হয় না। কিন্তু আজ খেলাম না। শুয়ে শুয়ে ক্লিওপেট্রার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাত বারোটা বাজল। একসময় ঘড়ির কাঁটা দুটোয় গিয়ে থামল। তবুও ও এল না।
তিনটা বাজতে চলল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তবে কি ও আমাকে ছেড়ে একেবারেই চলে গেছে! আমার ভাবনায় ছেদ ঘটালো কারো পায়ের আওয়াজ। আমার বুক ধুকপুক করতে লাগল। তবে কি ও ফিরে এসেছে!
আমি শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসলাম। ডিম লাইটের আবছা আলোয় ক্লিওপেট্রাকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। ও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হল ভীষণ মন খারাপ। আমি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে একপ্রকার ঝাঁপিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গেই ও পালটা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি ওর গাল চেপে বললাম, ‘এতদিন আসোনি কেন?’
ও শান্ত গলায় বলল, ‘আমার তো আসার কথা ছিল না আহান! তুমিই তো আজ বাধ্য করলে!’
আমি হেসে ফেললাম। ‘কী করেছি আমি?’
ও রেগে বলল, ‘কী করোনি বলো! ওই মেয়ে তোমার হাত ধরেছে কেন? তুমি কেন ফোন করে ওকে তোমার সঙ্গে দেখা করতে বলেছ? ও তোমার কী হয়? বলো ওই বদ নারী তোমার কী হয়?’
বলতে বলতে ক্লিওপেট্রা কেঁদে দিল। আমার খুব হাসি পেল। এজন্য কেউ কাঁদে! ওর চোখ মুছে দিয়ে বললাম, ‘বোকা মেয়ে! এজন্য চোখের জল ফেলতে হয়!’
ও বলল, ‘তুমি বুঝবে না ওসব।’
আমি বললাম, ‘কে বলেছে বুঝব না? তুমি ভেবেছ তুমি একাই সবার মনের কথা পড়তে পারো? আমিও পারি।’
‘কী পড়তে পারো তুমি?’
আমি বললাম, ‘এইযে তুমি মনে মনে বলছ, যেভাবেই হোক আমার সঙ্গে তোমার বিয়েটা হয়ে যাক!’
ও চমকে আমার দিকে তাকাল। আমি শব্দ করে হাসতে লাগলাম। আজ যে আমার কি হল! শুধু হাসতে ইচ্ছে করছে!
ও আমাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল। ‘বদমাইশ!’
আমার আরো হাসি পেয়ে গেল। আমি ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পর হাসি থামতেই ওকে বললাম, ‘দু’মিনিট দাড়াও। আমি আসছি।’
আলমারি থেকে ওর জন্যে কেনা সেই লাল শাড়িটি নিয়ে এলাম। ওর হাতে দিয়ে বললাম, ‘এটা একটু পরে আসবে, প্লিজ?’
ও আমার হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। আমি ঘরে আলো জ্বালিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
পাঁচ মিনিট পর ক্লিওপেট্রা ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই দেখলাম, শাড়িটা ঠিকমতো পরতে পারেনি। শুধুমাত্র গায়ে কোনোরকম ভাবে পেঁচিয়ে রেখেছে। বেচারির জন্য আমার মায়া লাগল। তবুও আমাকে না করেনি।
এই এলোমেলো প্যাঁচানো শাড়িতেই ক্লিওপেট্রাকে অপ্সরীর মতো দেখাচ্ছে। লাল শাড়িটা গায়ে একদম মানিয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে এর কারিগর যেন ওর কথা চিন্তা করেই শাড়িটাকে তৈরি করেছে।
ক্লিওপেট্রা আমার সামনে এসে বলল, ‘স্যরি! ঠিকভাবে পড়তে পারিনি।’
আমি কিছু বললাম না। হাটু গেড়ে ওর সামনে বসে পড়লাম। এরপর ডায়মন্ডের আংটিটা ওর সামনে এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি ক্লিওপেট্রা! প্লিজ আমাকে বিয়ে করবে?’
ক্লিওপেট্রা আমার সামনে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘কেন করবো না! একশো বার করবো। হাজার বার করবো। তুমি চাইলে কোটি কোটি বারও বিয়ে করবো!’
আমি ওর থুতনি ধরে মুখ উঁচু করে ওর কপালে চুমু খেলাম।
ঠিক সে সময়ে দরজা ঠেলে মা, অহনা ভেতরে ঢুকে পড়ল।
আমি, ক্লিওপেট্রা দুজনেই বসা থেকে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম। নিজেই নিজেকে লানত দিতে থাকলাম কেন যে দরজাটা না আটকে ভিজিয়ে রেখেছিলাম!
মা ক্লিওপেট্রাকে দেখে আবার অজ্ঞান হয়ে গেল। আমার আগেই দৌড়ে গিয়ে ক্লিওপেট্রা মা’কে গিয়ে ধরল। মা’র হাত ধরে বলতে লাগল, ‘ও মা তোমার কী হলো! আমার দিকে তাকাও মা!’
আমি, অহনা দুজনেই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও উঠে কোথায় যেন চলে গেল। ফিরে এল পানিভর্তি গ্লাস নিয়ে। সামান্য পানি ছিটিয়ে দিতেই মার জ্ঞান ফিরে এল। মা ক্লিওপেট্রার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মা’র জ্ঞান ফিরতেই ক্লিওপেট্রা মা ‘কে জড়িয়ে ধরল। মা’র চোখে এবার রাগের পরিবর্তে বিস্ময় দেখতে পেলাম। প্রথম সাক্ষাতেই কোনো মেয়ে যে শত বছরের পূর্ব পরিচিত মানুষের মতো আচরণ করতে পারে তা বোধহয় মা’র জানা ছিল না।
কিছুক্ষণ পর সব স্বাভাবিক হতেই মা ক্লিওপেট্রাকে বলল, ‘তুমি আমার ঘরে এসো। তোমার সঙ্গে আমার কিছু জরুরী কথা বলার আছে।’
এরপর অহনাকে বলল, ‘অহনা ওকে নিয়ে আমার ঘরে আয়।’
অহনা মা’র পিছুপিছু ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে মা’র ঘরে চলে গেল। যাবার আগে ক্লিওপেট্রা একবার আমার দিকে পিছু ফিরে তাকাল। আমি বুঝলাম না ওই দৃষ্টিতে কী ছিল। আত্নবিশ্বাস না কি ভয়!
চলবে…
লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা
(প্রিয় পাঠক, আপনাদের পড়তে বোরিং লাগছে না তো??)