#উষাকালে_ঊর্মিমালা
#পর্ব_১০
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
কুয়াশা কাটিয়ে ঝলমলে রোদ্দুর দেখা দিলো। উত্তরের হিমেল হাওয়া শরীরে পিনপিনে ঠান্ডা ধরিয়ে দেয়। গাছের পাতা ঝরে প্রকৃতির নতুন রূপ ধরা দিলো পৃথিবীর বুকে। আশ্চর্য নিস্তব্ধতায় নিস্তেজ প্রকৃতি অপরূপ রূপে সেজে উঠলো। ঘাসের বুকে শিশিরের ছোয়ার মনোরম দৃশ্য মন কেঁড়ে নেয় পথিকের। কনকনে শীতে একটু খানি সূর্যের তেজ দেহে মিষ্টি ভালোলাগার জন্ম দেয়। একটা ক্লাস ছিলো উষার। সেটা শেষ দিয়েই বান্ধবীদের সাথে বেরিয়েছে। গেইটের বাইরে আসতেই বাবাকে দেখতে পেলো।
মোস্তফা সাহেব এদিকে একটি কাজে এসেছিলেন। মেয়ের ডাক পড়তেই পাশ ফিরে তাকালেন। রাস্তার অপর পাশ থেকে দ্রুত হেঁটে আসছে উষা। মোস্তফা সাহেব নিষেধ করলেন এপাশে না আসতে। দুদিক থেকেই গাড়ি আসা-যাওয়া করছে। তিনি নিজেই আসছেন উষার কাছে। উষা বারণ শুনলোনা। বাবার কাছে এসেই দুহাতে ঝাপটে ধরলো। ধমক দিতে গিয়েও মোস্তফা সাহেব ঠান্ডা হয়ে গেলেন। ছেলে-মেয়েদের একটু বকাঝকা করে নিজেই আবার কষ্ট পেয়ে বসেন। শান্তি পান না মনে। এক হাতে মেয়েকে আগলে ধরলেন। পাশ থেকে মোস্তফা সাহেবের সঙ্গে থাকা লোকটি বাবা-মেয়ের ভালোবাসার মূহুর্ত দেখে হেসে উঠে প্রশ্ন করলেন,
-“আপনার মেয়ে?”
-“জি, ছোট মেয়ে।”
উষা জিজ্ঞেস করলো,
-“বাবা ওদিকে কোথায় গিয়েছো?”
পাশের লোকটিকে দেখিয়ে মোস্তফা সাহেব বললেন,
-“তোমার এই আঙ্কেলের সাথে কিছু কাজ ছিলো। উনার সাথেই গিয়েছি।”
উষা এবার ঠিক করে পাশের লোকটির দিকে নজর দিলো। মিষ্টি হেসে সালাম দিলো।
লোকটিও প্রশস্ত হেসে সালামের উত্তর দিলেন।
মোস্তফা সাহেব মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কী খাবে বল? নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে।”
-“স্পিড ক্যান।”
মোস্তফা সাহেব চোখ ছোট করে মেয়ের দিকে তাকালেন।
-“এসব খেলে কি পেট ভরবে?”
-“ভরবে, তুমি কিনে দাও।”
মোস্তফা সাহেব উষার সাথে সাথে বাড়ির দুই মেয়ের জন্যও কিনে নিলেন। উষার মা এসব পছন্দ করেননা। মেয়েদের খাওয়া দেখলে নাক ছিটকান।
ক্যানে চুমুক দিতে দিতেই বাবার সাথে এগোলো উষা। হঠাৎ থেমে গেলো বাবার সাথের আঙ্কেলের কথায়। তিনি গলা ঝেড়ে মোস্তফা সাহেবকে প্রশ্ন করলেন,
-“ছোট মেয়ের বিয়ের কথা ভাবছেন না-কি? আমার বাড়ির জন্য একটা মেয়ে দরকার ছিলো।”
মোস্তফা সাহেব জানালেন,
-“আমার ছেলে-মেয়ে একজন ও বিবাহের বাকি নেই।”
-“ওহ” শব্দে নিজের কথা শেষ করলেন লোকটি।
পরক্ষণেই উষাকে বলল,
-“মামনী, তোমার মতো এমন একটা মিষ্টি মামনী খুঁজে দিও তো!”
খালি ক্যান ছুঁড়ে ফে*লে উষা মুখ ছোট করে বলল,
-“কিন্তু আঙ্কেল আপনি যদি আরও কিছুদিন আগে বলতেন, তাহলে খুঁজে দিতে পারতাম। এখন আমার মতো মেয়েটার তো কিছুদিন পূর্বে বিয়ে হয়ে গিয়েছে।”
লোকটি হতাশার স্বরে বললেন,
-“কী বল মামনী? কে সেই মেয়েটা?”
উষা নিজের দিকে আঙ্গুল তাক করে বলল,
-“সেই মেয়েটা তো আমি আঙ্কেল। আমার মতো মানে তো আমিই, তাইনা?”
লোকটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। মেয়ের কথায় শব্দ করে হেসে উঠলেন মোস্তফা সাহেব। উষাও হাসছে। এবার লোকটিও হেসে বলল,
-“তুমি তো ভারি দুষ্টু মামনী।”
কথা বলতে বলতে বাবা – মেয়ে ভিন্ন পথে হাঁটলেন। উষা বাবাকে বলল,
-“আমি জামা কিনবো বাবা। তুমিও আমার সাথে আসো। রং পছন্দ করে দেবে।”
বাবার পছন্দ বেশ ভালোলাগে উষার। হুটহাট ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীর জন্য এটা-ওটা কিনে নিয়ে যাওয়ার অভ্যেস আছে মোস্তফা সাহেবের।
তাই বাবাকে সঙ্গে নিয়েই গেলো। আসার সময় শামীমই টাকা দিয়েছিল জামা কেনার জন্য।
মোস্তফা সাহেব বেছে বেছে একই ডিজাইনের তিনটে জামা কিনলেন। একটা উষার জন্য, আর দুটো ঊর্মি ও তানজিনার জন্য। উষাকে টাকা পরিশোধ করতে দিলেন না তিনি। তিন মেয়ের জন্য নিজেই কিনে নিলেন। জামা কেনা শেষ করেও বাবাকে হাঁটতে দেখে উষা জিজ্ঞেস করলো,
-“কেনা তো শেষ, এবার চলো।”
মোস্তফা সাহেব মেয়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অন্য দোকানে ঢুকলেন। সবসময়ই মেয়েদের নিয়ে বের হলে তাদের হাত এভাবেই ধরে রাখেন। যেন তারা ছোট বাচ্চা। হাত ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। নিজেদের প্রতি বাবার এই অগাধ ভালোবাসা দেখে মাঝেমাঝে উষার ভীষণ ইচ্ছে হয় বাবাকে সারাজীবন জড়িয়ে বসে থাকতে। কিন্ত এটা যে সম্ভব নয়।
উষার ভাবনার মাঝেই একটা শাড়ি কিনে নিলেন মোস্তফা সাহেব। মেয়েরা পরবে, তাহলে স্ত্রী কেন বাদ যাবে? মায়ের প্রতি বাবার এই ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ দেখে মুগ্ধ হলো উষা। মা ও তো বাবার প্রতি অনেক যত্নবান।
অথচ তার মাঝে সেই পরিবর্তন এখনো আসেনি। হুট করেই গতরাতের কথা মনে পড়লো। অযথাই রা*গ দেখালো সে৷ অথচ শামীম তাকে কিছুই বললোনা। উল্টো তার রা*গ*কে প্রাধান্য দিয়ে তাকে মানানোর চেষ্টা করলো। তাহলে কি সে এখনো পরিপূর্ণভাবে ভালোবাসতে পারেনি? শামীমের প্রতি তার যা আছে, তা কেবল শারিরীক আকর্ষণ?
মোস্তফা সাহেব বললেন,
-“চল, মা।”
চমক কাটলো উষার। ভাবনার অতল গহ্বর থেকে বেরিয়ে বাবাকে বলল,
-“আমার আরেকটা কাজ আছে। একটু অপেক্ষা করো।”
অতঃপর ঘুরেফিরে শামীমের জন্য একটা সফেদ রাঙা শার্ট কিনলো। এই রংটা একটু বেশিই সুট করে শামীমকে। তারপর শশুর আর বাবার জন্য দুটো পাঞ্জাবি কিনলো। বাবার হাতে একটা পাঞ্জাবি দিতেই তার চোখমুখ উজ্জ্বল দেখালো। দেখে বোঝা গেলো মেয়ের দেওয়া উপহারে তিনি ভীষণ সন্তুষ্ট।
মেয়েকে রিকশায় তুলে দিয়ে নিজ গন্তব্যে পা বাড়ালেন মোস্তফা সাহেব।
★★★
দুদিন যাবত বাড়ির প্রতিটি কোণে পিনপতন নীরবতা। কোথাও গুঞ্জন নেই। মধ্যাহ্ন ভোজের সময় কয়েকজন ব্যতীত সবাই টেবিলে উপস্থিত। আনোয়ার হোসেনের প্লেটে খাবার তুলে দিতে গেলেন নাসিমা বেগম। প্লেট সরিয়ে নিলেন আনোয়ার হোসেন। নিজ হাতে খাবার বেড়ে নিলেন। অব*হেলা, অপ*মানে চোখের কোনে জল জমা হলো নাসিমা বেগমের।
উষার নজর এড়ালোনা বিষয়টি। সে তাচ্ছিল্য হাসলো। মনে মনে বলল, “স্বামীর কাছ থেকে সামান্য অব*হেলা পেয়েই এতটা কষ্ট হচ্ছে। অথচ আরেকটি মেয়েকে পুরোপুরিই স্বামীর জীবন থেকে ছাঁটাই করে দিয়েছে। তাহলে তার কতটা কষ্ট হচ্ছে?”
★★★
রান্নাঘরের অবশিষ্ট কাজ শেষ করে ঊর্মিকে ভিডিও কল দিলো উষা। ঊর্মি না চেনার ভান করে বলল,
-“কে আপনি?”
উষা চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর হেসে ফেলে বলল,
-“তোর দাদি লাগি। সালাম কর, বে*য়া*দ*ব নাতনি।”
ঊর্মি বলল,
-“দাদিজান আমার দাদাজানকে ছেড়ে জোয়ান দাদাজানের কাছে কিভাবে যেতে পারলেন? আর বুড়ো বয়সে এত ফিট বডি কিভাবে বানালেন?”
উষা জ্বালাময়ী হাসি দিয়ে বলল,
-“জ্বলে? আমার মতো হতে চাও?”
ঊর্মিও কম যায়না। সেও ভ*য় পাওয়ার ভান ধরে বলল,
-” না, না দাদিজান। এতবড় স্পর্ধা আমার কখনোই হবেনা।”
উষা খিলখিল করে হেসে উঠলো। বলল,
-“দাঁতের ট্রিটমেন্ট কেমন চলে? দেখাও দিখি।”
ঊর্মি ফোনের স্ক্রিনেই ভেঙে যাওয়া দাঁতগুলো দেখালো। কিভাবে কিভাবে ট্রিটমেন্ট হচ্ছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা করলো। উষা জিজ্ঞেস করলো,
-“আর হাঁড়?”
-“দুদিন পর যাবো। জোড়া না লাগলে আরেকটা ব্যান্ডেজ লাগবে।”
প্রয়োজনেই বাড়িতে এসেছিল রাহাত। বসার ঘরে বসেই উষাকে ঊর্মির সাথে কথা বলতে দেখলো। একটু আড়াল করেই দাঁড়ালো সে। যেন উষা বা ঊর্মি কেউ টের না পায় তাকে। অনেকদিন পর ঊর্মিকে দু’চোখ ভরে দেখলো। তড়াক করে উঠলো অন্তঃকরণ। বিষাদে তেতো হলো মন। মনে হচ্ছে অনেকটাই শুকিয়ে গিয়েছে মেয়েটা। রাহাতের চোখের কোনে নিরব মেঘবৃষ্টির সঞ্চার। বক্ষপিঞ্জরে বিষাদের আলপনা। শক্তপোক্ত দেহের আড়ালে ভেঙে যাওয়া এক টুকরো হৃদয় কারো দৃষ্টিগোচর হলোনা। প্রিয় মানুষটিকে কাছে টা*নার উন্মাদনা, করুণ আর্তনাদ অদৃশ্য ক্ষ*ত জন্ম দিলো প্রতিনিয়ত।
বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো ঊর্মিকে। কতটা ক*ষ্ট দিয়েছে সে মেয়েটাকে। মেয়েটি কিভাবে সহ্য করলো এই নিদারুণ যন্ত্রণা? তার কথায় স্পষ্ট সত্য ফোটে ওঠে সে রাহাতকে কতটা ঘৃ*ণি*ত নজরে দেখে। এই ভিন্ন মানুষটিকে চিনতে পারেনা রাহাত। অথচ মানুষটির এই নতুন রূপের জন্ম হয়েছিল রাহাতের কারণে। এর দায়ভার আর কারও নয়।
তাইতো তাকে ফিরিয়ে আনার গোপন অভি*যানে নেমেছে রাহাত। কতটুকু সফল হবে জানা নেই। তবে ঊর্মিকে ফিরে পেতে তার মনে পূর্বের স্থানটি ফেরত পেতে হবে। এতটুকু ধারণা করতে পেরেছে সে।
হুট করেই কল ডিসকানেক্ট হয়ে গেলো। ভ্রু কুঁচকে গেলো উষার। দ্বিতীয়বার কল দিয়ে ঘরের পথে পা বাড়াতেই রাহাতকে নজরে পড়লো। উষা স্পষ্ট বুঝতে পারলো লাইন ডিসকানেক্ট হয়নি, বরং ঊর্মি নিজ থেকেই ডিসকানেক্ট করেছে। কারণটা হয়তো রাহাত। কথা না বাড়িয়ে ত্রস্ত পায়ে ছুটলো উষা। পেছন থেকে পুরুষালি গম্ভীর গলার স্বর,
-“উষা।”
থেমে গেল পা জোড়া। ঘাড় বাঁকা করে পেছনে চাইলো উষা। কাঠকাঠ গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-“কিছু বলতে চান?”
রাহাতের নয়ন জোড়া অভিসন্তপ্ত দেখালো। দ্বিধা ভরা কন্ঠে বলল,
-“ঊর্মিকে একটু বোঝাবে, প্লিজ!”
উষা শান্ত কন্ঠ বলল,
-“আপনি নিজেকে বুঝুন। আপুকে আমার বোঝাতে হবেনা। সে নিজেকে যথেষ্ট বোঝে।
আর প্লিজ! এবার অন্তত আমার আপুকে শান্তিতে থাকতে দিন।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলো রাহাত। এতটা ঘৃ*ণা তো সে চায়নি!
★★★
শরীরে সোয়েটার জড়িয়ে ছাদে এসে দাঁড়ালো উষা। রেলিং থাকলে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো যেত। তাছাড়া তার বোনের ও এতবড় সর্ব*নাশ হতো না। দাঁড়িয়ে এসবই ভাবছিল সে। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেতেই মস্তিষ্ক সজাগ হলো। পাশের ব্যক্তিকে দেখার জন্য সামান্য ঘাড় ফেরালো। লিলি এসে দাঁড়িয়েছে। তার শান্ত দৃষ্টি দূরের শূন্য আকাশে মিলিয়েছে। একইভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে লিলি বলল,
-“তোমার বোনকে আনার চেষ্টা করছো, তাইনা?”
হতভম্ব হয়ে তাকালো উষা। কিছুই বোধগম্য হলোনা তার। বুঝতে না পেরেই শুধালো,
-“মানে?”
লিলি বক্র হেসে বলল,
-“দুপুরে রাহাতের সাথে কাকে নিয়ে কথা বলেছো, আমি শুনিনি ভেবেছ?”
উষা এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা। তবে পাল্টা তাকে কড়া জবাব দিলো,
-“আমার বোনের পেছনে টক্সিসিটি যত কম ছড়াবেন, ততই আপনার জন্য ভালো।
নিজের ঘর সামলাতে না পেরে দো*ষ অন্যের ঘাড়ে চাপানো বন্ধ করুন। দেখবেন জীবন সুন্দর হবে।
আপনার সাথে আমার বোনের বা আমার কোন শ*ত্রু*তা নেই। তাই নিজের সীমার মধ্যে থাকার চেষ্টা করবেন।”
-“আমার অসুখী হওয়ার একমাত্র কারণ তোমার বোন।”
-“প্লিজ! আমার বোনকে শ*ত্রু*তা*য় জড়িয়ে অন্তত আর একটা কথাও বলবেন না। আপনি সবকিছু জেনে, বুঝে এই সংসারে পা দিয়েছেন। তাই ব্যক্তি জীবনে অসুখী হওয়ার দায়*ভার আমার বোনের নয়। সম্পূর্ণ দায়*ভার আপনার।”
চোখ জোড়া জ্বলে উঠলো লিলির।
-“তোমার বোনকে নিয়ে আমার সংসারে আর একটা ঝা*মে*লা হলে, তাকে আমি ছেড়ে কথা বলবোনা।”
নিচে নামার জন্য প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতে গিয়েও থেমে গেল উষা। পেছন ফিরে তেজঃপূর্ণ গলায় বলল,
-” অযথা দো*ষ চাপানোর চেষ্টা করলে, আপনার চেহারাটাও আমি একবার ভালোভাবে দেখে নেবো।”
মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো লিলির হাতের মুঠো।
#চলবে……..