#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫৫
প্রায়শ্চিত্ত মানে চিত্তের বিশুদ্ধতাসাধন। এই বোধ জাগ্রত হওয়ার পর আর কখনো কষ্ট পাননি সুরভি বেগম। তবে বুকের গহীনে আফসোস রয়েছে। গর্হিত সেই পাপটির জন্য। যেই আফসোস আমৃত্যু যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সেলাই মেশিনে ছিঁড়ে যাওয়া মেকসির হাতা সেলাই করে চুপচাপ বসে সুরভি বেগম। আজকাল অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে সে। একটু সেলাই করেই হাঁপিয়ে গেছে। ইদানীং বেশ বুঝতে পারে, বয়স বাড়ছে। চমকে ওঠল সুরভি। বয়স? কত বয়স তার? এক মুহুর্ত শ্বাস আঁটকে গেল যেন। যৌবনের শুরুতেই বিয়ে হয়েছিল তার। রুদ্রর বাবার সঙ্গে। সদ্য আঠারোতে পা পড়েছে। তরতাজা ফুলটাকে নিজের ঘরে তুলেছিল সুস্বাস্থ্যের প্রাপ্তবয়স্ক যুবকটি। কত প্রেম, কত স্নেহ, কত সুখ। আহা,সেই রঙিন দিনগুলো স্মরণে আসা মাত্রই বুক ভার হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হিসেব কষল তার বর্তমান বয়স কত? ঊনিশের মাঝামাঝিতে রুদ্রর জন্ম। চব্বিশে সূচনার। দুই সন্তানের পরিপূর্ণ সংসার ছিল তার। আহা! একেই বোধহয় বলে, মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝে না। পাপে ধরেছিল তাকে। একেবারে নিঃস্ব করেই ছাড়ল। ছাব্বিশ বছর বয়সে যৌবনের উত্তাপে বুকের ভেতর যে খরা নেমেছিল। সেই খরায় আষাঢ়ে বৃষ্টির মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দিলওয়ার শেখ। শুরুতে সে সায় দেয়নি। ভয় পেতো। কিন্তু ধীরেধীরে মনের ভিতর শয়তান বাসা বাঁধল। সেই একটি রাত সবকিছু ওলটপালট করে দিল। সেদিন কেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল না? কেন আচমকা সেই স্পর্শের বিনিময়ে কষিয়ে এক থাপ্পড় লাগালো না ভাসুরের গালে? তাহলেই তো আজ সব অন্যরকম হতো। দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে ওঠল সুরভি। বয়স আজ ছেচল্লিশে এসে ঠেকেছে। কিন্তু কাঁধে থাকা পাপটা এত ভারি যে তার ভারে বয়স পঞ্চাশের অধিক মনে হয়। পাপ করা সহজ কিন্তু
পাপের বোঝা বহন করা বড়ো কঠিন।
সেদিন, ফাঁকা বাড়িতে দুই সন্তান নিয়ে একা ছিল সে। ঝড়বৃষ্টির রাত। রুদ্র, আর সূচনাকে ঘুম পাড়িয়েছে মাত্র। এমন সময় বাড়ির সদর দরজায় টোকা পড়ে। সে গিয়ে দরজা খুললে দিলওয়ারের ভিজে চুপেচুপে বলিষ্ঠ শরীরটা নজরে আসে। মাথায় কাপড় তুলে সরে দাঁড়ায় সে। পূর্বে তার থেকে অনৈতিক আহ্বান পেয়েছিল। বিধায় সে মুহুর্তে তীব্র অস্বস্তিতে পড়ল। দিলওয়ার স্বাভাবিক চিত্তে ভেতরে ঢুকে। বলে,
-” খাবার গরম করতে পারবে? খুব খিদে পেয়েছে। ”
বাঙালি ভীতু নারী সে। অধিক লজ্জাবতীও। তাই সে মুহুর্তে মাথা নুইয়ে খাবার গরম করে দিল। দিলওয়ার তৃপ্তি ভরে খেল। সুরভি সব গুছিয়ে বেসিনে হাত ধুতে গেলে আচমকা তার পেছনে এসে দাঁড়ায় দিলওয়ার। আঁচল সরে যাওয়া ন’গ্ন কোমরটা স্পর্শ করে আবেগঘন হয়ে। সুরভির মস্তিষ্ক তখন দিশেহারা। ফাঁকা বাড়ি। দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ। প্রকৃতি শীতল। হৃদয়ে উত্তাপ। সবমিলিয়ে শয়তানের প্ররোচনায় ক্রমশ তারা লিপ্ত হতে থাকে অবৈধ স্পর্শে। সেই স্পর্শ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় শেখ বাড়ির দোতলার তৃতীয় ঘরটায়। যতক্ষণে জগতে হুঁশ ফেরে ততক্ষণে তার শরীরটাকে ইচ্ছে মতো ব্যবহার করে ফেলেছে দিলওয়ার। আর পিছু হটার সুযোগ নেই। একবার পিছুপা হয়েছিলও। সন্তানদের কথা ভেবে। কিন্তু সেই সময় দিলওয়ারের প্রেম তাকে বাঁধ্য করেছিল সব ছেড়ে এক তাকেই আঁকড়ে ধরতে।
যে স্পর্শ শুরুতে তাকে ভয়, লজ্জা দিয়েছিল। সেই স্পর্শই সেদিনের পর থেকে তাকে আনন্দ দিতে লাগল। মন, শরীর এতটাই পাপে জর্জরিত হলো যে। দু’জন মিলে দু’টো সংসার ধ্বংস করে চলে এলো। শুধু কি দু’টো সংসার? সে কি নিজেকে ধ্বংস করেনি? আজ তার জীবন তার ছেলের জীবন অনিশ্চিত। এর দায় কার? তারই তো। সে মা হারা করেছিল রুদ্র, সূচনাকে। বাবা হারা করেছিল রাদিফ, সাদমানকে। পুরষ্কার সরূপ কী পেয়েছে? এই তো জীবন। একাকী, নিঃসঙ্গতা।
দরজায় করাঘাত হতেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল সুরভি। দরজা খুলতেই রিমনের ক্লান্ত মুখের দেখা মিলল। সুরভি ছুটে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে দিল তাকে। রিমন সেটা খেয়ে মায়ের হাতে চারহাজার টাকা গুঁজে দিল। বলল,
-” টিউশনির টাকা। কালকে আরো দুহাজার পাবো। ঘর ভাড়াটা আজ দিয়ে দাও মা। ”
-” গোসল করে আয় ভাত বাড়ছি। ”
শার্ট খুলতে খুলতে রিমন বলল,
-” কী রেঁধেছ? ”
-” ছোটো মাছ চর্চরী। ”
-” কাল মাংস আনব। ”
মৃদু হেসে সুরভি বলল,
-” আনিস। ”
রিমন গোসলে চলে গেল। সুরভি নিজেকে শক্ত করে নিয়ে ভাত বাড়তে লাগল। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! ছেলেটা একসময় মাংস ছাড়া ভাত খেতো না। বাবা ছাড়া এক মুহুর্ত ভাবতে পারতো না। অথচ আজ? সবকিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। মাসান্তর একবার মাংস খেতে পারে। বাবা ছাড়া কাটিয়ে দিল দু’টো বছর। মানুষটা কি নিষ্ঠুর! মুহুর্তেই চমকাল। যে প্রথম দু’টো সন্তান ছেড়ে তার হাত ধরতে পারে সে অবশ্যই তৃতীয় সন্তান ছেড়েও অন্য কারো হাত ধরার ক্ষমতা রাখে? একেই বোধহয় বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ। সে রিদওয়ানকে নিঃসঙ্গ করে এসেছিল। আজ নিজেই নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছে। রিদওয়ানের পরিস্থিতি তার মতো শোচনীয় নয়। বরং সে পরিবার নিয়ে সুখেই আছে। শুনেছে রুদ্রর বউ গর্ভবতী। ক’দিন পর নিশ্চয়ই পরিবারে সুখের ঢেউ খেলবে? বড়ো ছেলের কথা মনে হতেই মেয়েটাকে মনে পড়ে গেল। বুক ভার হলো আবারো। সে কী জঘন্য। সময়ের বেড়াজালে না আটকালে কখনোই টের পেত না। রিদওয়ান তাকে ছাড় দিলেও সৃষ্টিকর্তা এক চুলও ছাড় দেননি।
__________________________
মাঝরাত। হৈমীর পেটের দিকে ভীতু চোখে তাকিয়ে আছে রুদ্র। ঘুমন্ত হৈমী যেন জেগে না যায় তাই খুব সাবধানে মেকসি উপরে তুলল। আলগা করল পেট। নিঃশ্বাসের সঙ্গে ওঠানামা করছে জায়গাটা। রুদ্র ভয় ভয়ে তাকিয়ে। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। এই অল্প জায়গাতে দু’দুটো বাচ্চা আছে। তার এমন ছোটো বউ। ছোট্ট একটা পেট। সেখানে কিনা দু’টো বাচ্চা! নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। সেই দুপুর থেকে বড্ড পাগলামি করছে রুদ্র। হৈমীর ভেতরের পাগলাটে সত্তা আজ যেন নিজের মাঝে ধারণ করেছে সে। হাত বাড়িয়ে পেটে স্পর্শ করল রুদ্র। সারাদিন ঠিকভাবে দেখতে পারেনি। আদর করতে পারেনি। সূচনা, মাহের, হামিদা সকলেই এসেছিল। আলট্রা করার পর সবাই হসপিটাল থেকে বাড়ি এলো। কত হৈচৈ করল। তাকে কেউ সুযোগ দেয়নি। আর যখন সুযোগ পেয়েছে নিজের ভারিক্কি খোলসটা খুলতে পারেনি। হৈমী ঘুমানোর পর সেই খোলস উন্মুক্ত হয়েছে। মন ভরে আদর করল রুদ্র। ভাবল কত কী। এরপর ঠোঁট এগিয়ে চুমুতে চুমুতে ভিজিয়ে দিল উঁচু হওয়া পেটটা। হৈমী নড়েচড়ে ওঠল। সে কিঞ্চিৎ দমে আবারো চুমু খেল। এক, দুই, তিন কত হলো? একশো হয়েছে কি? হতেও পারে। একশো চুমুতে সিক্ত করে তুলল। সহসা হৈমীর পেটের ভিতর নড়াচড়া শুরু হলো। রুদ্র চমকে ওঠল। বেবি রেসপন্স করছে তাকে! ঘুম ছুটে গেল হৈমীর৷ হাত চলে গেল পেটে। বাবুরা বেশি নড়াচড়া করছে। আশপাশে তাকিতুকি করতেই দেখল রুদ্র তার পেটের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। কয়েক পল পর যেখানটায় বাবু নড়ল ওখানটায় হাত রাখল রুদ্র। হৈমী বলল,
-” উহ এত নড়ছে ওরা। ”
হৈমীর কণ্ঠ শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়ল রুদ্র। বিস্মিত স্বরে বলল,
-” অ্যাঁই হৈমী, আমি ওদের ছুঁতে পাচ্ছি। ওরা আমাকে ছুঁতে সাহায্য করছে। ওয়েট তোমাকে ছবি তুলে দেখাচ্ছি। ”
রুদ্র ঝটপট কয়েকটা ছবি ওঠিয়ে ফোনটা হৈমীকে দিল। হৈমী যা দেখল তাতে ওর শরীর শিউরে ওঠল। নাভির কিঞ্চিৎ নিচে পেটের দু’পাশে উঁচু হয়ে আছে। বাবুরা কি হাত বা পা দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করছে? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই মুখে বলে ফেলল। রুদ্র উন্মাদের মতো মাথা নাড়াল। বাচ্চাদের মতো বলল,
-” ওরা এখানে আর থাকতে চাইছে না। আমার কাছে আসতে চাচ্ছে। আমার বুকে ঘুমাতে চাইছে। ”
মিটিমিটি হাসল হৈমী। আরাম করে শুয়ে বলল,
-” হ্যাঁ আপনার বুকেই তো ঘুমাতে হবে। ওরা এলেই তো আমার ছুটি। ”
সহসা চমকে ওঠল রুদ্র। বলল,
-” ছুটি মানে? ”
খিলখিল করে হাসল হৈমী। বলল,
-” বারে, নিজের কথা নিজেই ভুলে গেছেন? ”
মুহুর্তেই শক্ত হয়ে গেল রুদ্র। ধীরেধীরে পাশে শুইয়ে পড়ল। শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। এক মুহুর্ত কী যেন ভাবল। এরপর হৈমীকে টেনে নিজের মুখোমুখি করল। বলল,
-” তুমি ছাড়া ওদের ভাবতে পারি না আমি। ”
ভেঙচি কাটল হৈমী। বলল,
-” সব জানা আছে আমার। সময় বুঝে গিরগিটি হওয়ার ওস্তাদ আপনি। ”
আচমকা হৈমীকে জড়িয়ে ধরল রুদ্র। পুরুষরা তো হাউমাউ করে কাঁদে না। পুরুষ কাঁদে নিঃশব্দে। রুদ্র কি কাঁদল? আলগোছে রুদ্রর মাথাটা নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরল হৈমী। ফিসফিস করে বলল,
-” যারা নিজের ভুল বুঝে মাথা নত করে, ভুল স্বীকার করে তাদের ক্ষমা করা মহৎ গুণ৷ কিন্তু যারা ভুল বুঝে ইগো দেখিয়ে গুমরে মরে ওদের কী করা উচিৎ জানেন? ”
রুদ্র মাথা নাড়াল। অর্থাৎ সে জানে না। হৈমী চোখ কটমটিয়ে বলল,
-” আচ্ছা জানাচ্ছি। ”
বলেই রুদ্রর ঝুঁটিতে শক্ত করে চেপে ধরল। মাথাটা বুকের ওপর থেকে সরালো ওভাবেই। কিঞ্চিৎ ব্যথায় রুদ্র বলল,
-” আহ, কী হচ্ছে টা কী? ”
-” কিছু হয়নি এবার হবে। ”
কথা বলেই সঙ্গে সঙ্গে রুদ্রর বুকের বা’পাশে শক্ত এক কামড় বসালো। দাঁত ডাবিয়ে! ব্যথায় উহু, আহ করল রুদ্র। ইচ্ছে করলেই পারত এক ঝটকায় সরিয়ে দিতে। কিন্তু সরালো না। হৈমী নিজের মতো ওকে শাস্তি দিল। রক্ত বেরোতেই আচমকা সরে গেল। সে। রুদ্রর চোখের কার্ণিশে এক ফোঁটা অশ্রু। হৈমী নিঃশব্দে সরে গেল। পাশফিরে ভারি নিঃশ্বাস ফেলল চোখ বন্ধ করে। রুদ্র রক্তে লাল বুকের বা’পাশটায় তাকিয়ে এক হাত চেপে ধরল। নিঃশব্দে হৈমীর গা ঘেঁষে চিবুক ছোঁয়াল কাঁধে। বলল,
-” কাঁদছ কেন? আমিত বকিনি। কামড়েছ বেশ করেছ। ইট’স গুড। ”
হৈমী কথা বলল না। বুকে ভার হয়ে ওঠেছে তার। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। সে তো সত্যিই ছাড়তে পারবে না এই মানুষটাকে। এই মানুষটাও কি পারবে? সেই প্রমাণ তো এখনো পায়নি। তবে পাবে নিশ্চিত।
________________________
ভরদুপুরে দাদিন খবর পেল তার বড়ো ছেলে দু’বছর আগে তৃতীয় বিয়ে করেছে। খবরটি টেলিফোনে ফোন করে দিল তার বড়ো বোন। বড়ো বোনের ছেলের বউ যে হাসপাতালের নার্স হিসেবে যুক্ত। সেই হাসপাতালে দিলওয়ারের তৃতীয় বউ কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে। তরতাজা এ খবরটি পেয়ে দাদিন আঁচ করল, এতদিন দিলওয়ার তাকে মিথ্যা কথা বলে টাকা নিয়েছে। সে আসলে সুরভি বা ছেলে রিমনের জন্য নয়। তৃতীয় বউ, তৃতীয় সংসার খরচের টাকা নিয়েছে মায়ের থেকে। তাহলে সুরভি, রিমন ওরা কোথায়? ওদের পথে বসিয়ে দিলওয়ার নতুন সংসার পেতেছে! আর কত অমানুষী রূপ দেখাবে ছেলেটা? রক্তে চাপ পড়ল দাদিনের। প্রেশার বেড়ে জ্ঞান হারালো আচমকা। হৈমী খাচ্ছিল, জেরিন বাসনপত্র ধুতে ব্যস্ত। এমন সময় দাদিন জ্ঞান হারানোয় সবার প্রথম নজরে পড়ল হৈমীরই৷ সে ছুটে আসতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল! চিৎকার করে কেবল উচ্চারণ করল,
-” দাদিন! ”
চলবে…