তীব্র প্রেমের নেশা পর্ব ২৩

0
1122

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (২৩)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________

৩ বছর পর..

ডায়েরীটা বন্ধ করে টেবিলের মাঝে বই খাতার ওপর রাখলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের শাড়ির আঁচল ভালো করে নিয়ে পাশের রুমে একবার উঁকি দিলাম। সেখানেই তীব্র শুয়ে আছে। মানুষটা ওই ঘটনার পর থেকে কোমায় আছে। গত ৩ বছর থেকে তাকে লুকিয়ে রেখেছি আমি। সেদিন হসপিটালের আগুন থেকে আমি, পলি, তিহা কোনো রকমে তীব্রকে নিয়ে বেড়িয়ে এসেছিলাম। অথচ কমবেশি অনেক লোক জানে আমি, তীব্র, তিহা আমরা ৩ জনই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছি৷ পলি সবাইকে বলেছে সে কোনোভাবে বের হতে পারলেও বের হতে পারিনি আমরা। সেদিনের পর আমরা শহর ছেড়েছি রাতের অন্ধকারে। আমি আর তিহা তীব্রর চিকিৎসা করে যাচ্ছি একদম গোপনে। সেই শহর থেকে অনেক দুরে আছি যেখানে আমার আর তীব্রর শ’ত্রুর অভাব নেই। আজাদ আঙ্কেল ছাড়া সবাই জানে আমরা মা’রা গেছি। এমনকি তাফিয়া আন্টিও। আমার বাবু পেটে থাকাকালীন সময়ে আজাদ আঙ্কেলই সব টাকা দিতেন। আমি তিহাকে এখানেই একটা ভার্সিটিতে এডমিট করিয়েছি। সবটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিচেনের দিকে এগোলাম। পাশের রুম থেকে তিহা তুরকে নিয়ে খেলছে। দুই ফুপি, ভাতিজির হাসির খিলখিল ধ্বনিতে পুরো রুম মেতেছে। মেয়েটার বয়স ২ বছর আড়াই মাস। যখন আধো আধো বুলিতে তীব্রর মাথার কাছে বসে ‘বাব্বা বাব্বা’ করে কিন্তু বাবার কোনো উত্তর পায় না তখন আমি শুধু অপলক চেয়ে রয়। মেয়েটাও হয়েছে! বাবা কথা বলুক বা না বলুক বাবার বুকের ওপর গিয়ে শুয়ে থাকে প্রায় সময়ই। আমি মুচকি হেঁসে রান্না বসালাম। রুম থেকে তিহা চেচিয়ে বললো,

‘ভাবী! তোমার মেয়েকে কিন্তু মা’ইর দিবো আমি। দেখো এসে কি করছে!’

আমি কপাল চাপড়ালাম। যেমন ফুপি তেমন ভাতিজি। একটাও একটার চেয়ে কম না। চুলার আচ কমিয়ে শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজতে গুজতে বললাম,

‘দুজন কি একটুও শান্ত থাকতে পারো না? এতো ছোটাছুটি করো কেনো তোমরা?’

রুমে ঢুকেই খেয়াল করলাম পুরো রুম লন্ডভন্ড। একপাশে দুই ফুপি ভাতিজি কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি পুরো রুমে একবার নজর বুলিয়ে রাগী চোখে তাকালাম দুজনের দিকে। সাথে সাথেই দুজনে কান ধরে একসাথে বলে উঠলো,

‘তলি তলি!’

আমি দুজনেরই কান টেনে সামনে এনে বললাম, ‘এগুলো কি করেছো তোমরা? এখন দুজনকে দিয়ে রুম গোছাতে দিবো! বলো বলো!’

দুজনেই ঠোঁট উল্টালো। আমি কান ছেড়ে দিয়ে বললাম, ‘এক্ষুণি গিয়ে গোসল করে আসো। আর তুর আম্মা! আপনি এখনই গিয়ে ফুপিমনির কাছে গোসল করবেন। একদম কোনো দুষ্টুমি না। মনে থাকবে?’

তুর মাথা নাড়িয়ে ভাঙা ভাঙা ভাবে বলে, ‘আত্তা আত্তা।’

দুজনে নাচতে নাচতে রুমে থেকে বের হলো। আমি হেঁসে ঘরটা কোনো রকমে ফেলে রেখেই কিচেনে ছুটলাম। এই যে আমার সংসার! বিছানায় শায়িত তীব্র, আমার ছোট্ট মেয়ে তুর আর আমার ননদ কম বোন তিহা। তীব্রর কোমায় থাকাটা কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা আমরা জানি৷ তবে তুর আসার পর সে যন্ত্রণা এখন হাজারো দীর্ঘশ্বাস। তুরের জন্মের আগে দেখতাম প্রায়ই তিহা রাতে না ঘুমিয়ে তীব্রর হাত ধরে বসে কান্না করতো। বারংবার ডাকতো। যদি একটাবার তার ভাই তার ডাকে সাড়া দেয়! তখন আমার প্রেগন্যান্সির জন্য আমাকে তেমন কাজও করতে দিতো না তিহা। সব টুকটাক নিজে করতো। আমাদের খাওয়ার খরচ, তীব্রর ট্রিটমেন্টের খরচ সবটাই আজাদ আঙ্কেল পাঠাতেন। আমার এখনও মনে আছে আমার ডেলিভারি পেইনের সেই দিন। সন্ধ্যা রাতেই আমার পেইন হচ্ছিলো। ফোনের ওপাশে আজাদ আঙ্কেলের অসহায় কান্না এদিকে কাউকে না পেয়ে তিহা পাগলের মতো কাঁদছিলো। সেদিন নিজেকে শক্ত রাখার ভীষণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলাম। হাজার হলেও এই দিনে মেয়েরা নিজেদের শক্ত রাখতে পারে না। তিহা সেদিন পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিলো আশে পাশে ফ্ল্যাটের। তারাই আমাকে হসপিটালে নিয়ে গেছিলো। আমি তিহাকে আসতে মানা করেছিলাম। তবে হসপিটালে আজাদ আঙ্কেল এসেছিলো। সেদিন আমি ভীষণ করে তীব্রর অনুপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম। আমার সব স্বপ্ন তো উনার কোমায় যাওয়ার সাথে সাথে শেষ হয়ে গেছিলো। তিহা আর তুরের জন্য নিজেকে শক্ত করলাম। এখনো নিজেকে শক্তই রেখেছি। অপেক্ষায় আছি কবে আমার তীব্রর সেন্স ফিরবে! কবে শ’ত্রুদের একেকটা কীটকে দুনিয়া থেকে সরানো যাবে। সেদিন হসপিটালে লাগা আগুনটা যে স্বাভাবিক কোনো আগুন ছিলো না তা আমি বুঝেছিলাম। ওই আগুন টা কেউ ইচ্ছে করে লাগিয়েছিলো যাতে করে তীব্র বাঁচতে না পারে। তারা জানতো তীব্রর বেঁচে থাকা মানেই তাদের মৃ’ত্যু একটু একটু করে এগোবে। আমি নিজের রান্নায় মন দিয়ে বাঁকা হাসলাম। আজ শুক্রবার। যত দ্রুত সম্ভব রান্না শেষ করে সব গুছিয়ে নিলাম। ততক্ষণে তিহা আর তুর গোসল সেড়ে বেড়িয়েও এসেছে। একে অপরের চুল টানছে তো চিমটি কাটছে। আমি দুজনকে ধমক দিয়ে বললাম,

‘সারাদিন মা’রা’মা’রি কিসের? তুর আসো তোমাকে জামা পড়িয়ে দেই।’

তুর ঠোটের কোণে হাসি ফুটিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি হেসে ওকে কোলে তুলে নিলাম। নিজেদের রুমে এসে ওকে একটা টপ পড়িয়ে হাত পায়ে লোশন মাখিয়ে পর পর দুটো চুমু খেলাম গালে। তুর খিলখিল করে হেঁসে আমার গালেও চুমু দিলো। তারপর ছোট ছোট পায়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। আমি ওয়াশরুমে ঢুকলাম। গোসল সেড়ে এসে নামাজ পড়ে তিহাকে খেতে বসতে বললাম। তিহা আমাকে তুরকে দিয়ে বললো,

‘তুমি ওকে খাইয়ে দাও আমি ততক্ষণে নামাজ পড়ে আসি।’

আমি মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম। তারপর তুরকে গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে খাইয়ে ঘুমও পাড়িয়ে দিলাম। ততক্ষণে তিহাও চলে এসেছে। তুরকে শুইয়ে দিয়ে এসে আমি আর তিহাও খেতে বসলাম। তিহা খাওয়ার মাঝে একবার তীব্রর রুমের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘আজ ভাইয়া সুস্থ থাকলে তুরকে নিয়ে কত খুশি থাকতো তাই না ভাবী!’

আমি জবাব দিলাম না। শুধু খাবারে হাত নাড়াতে থাকলাম। অনেকক্ষণ নীরবতার পর তিহা বললো, ‘আচ্ছা ভাবী তোমার জানতে ইচ্ছে করে না ভাইয়া তোমাকে এতো ভালোবাসার পরও সেদিন বিচ্ছেদ কেনো চেয়েছিলো? কেনো তোমাকে তোমার ফুপির বাড়িতে রেখে একা চলে এসেছিলো?’

আমি চমকে তাকালাম। আনমনে মাথা নাড়িয়ে আস্তে করে বললাম, ‘জানতে তো ভীষণ ইচ্ছে করে তিহা। তবে যে জানাবে সে যে…’

‘আমি যদি বলি আমি সবটা জানি!’

তিহার কথায় যেনো আকাশ থেকে পড়লাম। তিহা সব জানে! মানে? কি জানে? কতটুকু জানে? তিহা হেঁসে বলে, ‘তোমাদের বিষয়ে সবটা জানি আমি। জানো ছোট বেলা থেকে ভাইয়া আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। সবচেয়ে বেশি আদর ভাইয়া করতো। সবার সাথে গম্ভীর হয়ে থাকলেও আমাকে সবসময় আগলে রাখতো, হাসিখুশি থাকতো। ভাইয়া যখন প্রথম প্রণয়ের আভাস পেয়েছিলো তখনও আমাকে এসে আনমনে বলেছিলো, ‘জানিস তিহু আমি না এক সপ্তদশী কন্যার প্রেমে পড়েছি। তার প্রেম আমাকে পু’ড়িয়ে দিচ্ছে ভেতর থেকে। আমার না ভীষণ হাসফাস লাগে রে! আচ্ছা বল তো! এই সপ্তদশী কন্যার প্রেমে পড়াতে জাতি কি আমাকে মেনে নিবে?’ আমি শেষের কথায় ফিক করল হেঁসে দিয়েছিলাম। পরে জেনেছিলাম সেই সপ্তদশী কন্যা ছিলে তুমি। তোমাকে আমার ভাইয়া ভীষণ ভাবে ভালোবেসেছিলো। যখন তুমি ঘৃ’ণা করতে ভাইয়াকে তখন ভাইয়া গুমড়ে গুমড়ে ম’রতো। জানো ভাইয়ার একেকটা হাহাকার দেখলে আমার ভেতরও কেঁপে উঠতো। মনে হতো একটা মানুষ কাউকে এতোটাও ভালো বাসতে পারে! হুম পারে। তুমি ঘৃ’ণা করার পরও ভাইয়া তোমাকে নীরবে ভালোবেসে গেছে। শেষে তোমাকে পাওয়ার জন্য কি কি-ই না করলো! তুমি জানতে না তোমাদের বিয়ে একটা ডিল ছিলো! আসলেই ছিলো। কিন্তু ডিলটা শুধুই তোমাকে পাওয়ার জন্য করেছিলো ছাড়ার জন্য না। শেষ মুহুর্তে ভাইয়া তোমাকে বাধ্য হয়ে ছেড়েছিলো। কেনো ছেড়েছিলো আর কার সাথে ডিল ছিলো এগুলো আমি জানি আর ভাইয়া সুস্থ হলেই তুমিও জানতে পারবে। তবে তোমাকে ছেড়ে আমার ভাইয়া ভালো ছিলো না। ভাইয়ার চোখ মুখের দিকে তাকানো যেতো না। সারাদিন নিজেকে রুমের মধ্যে আটকে রাখতো। অনেক সাহস নিয়ে একদিন ভাইয়ার কাছে বসেছিলাম। ভাইয়া তখন তোমার ফ্রেমে বাঁধানো ছবি বুকে জড়িয়ে বসেছিলো। খেয়ালই করেনি আমাকে। যখন আমার উপস্থিতি টের পায় তখন তোমার ছবিটা দুরে সরিয়ে দেয়। আমি যখন তাকে চেপে ধরলাম তখন তার বাঁধ ভেঙে গেলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলো। ছেলেরা কখনো এভাবে কাঁদতে পারে! এতো সহজে! সেদিন শেখ বাড়ির একেকটা ইট, পাথরও যেনো কেঁদেছিলো। ভাইয়ার হাহাকার দেখে সেদিন আমিও কেঁদেছিলাম। ভাইয়াকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এতো ভালোবাসো যখন তাহলে ছেড়ে কেনো দিচ্ছো?’ তখন ভাইয়া একটাই কথা বলেছিলো, ‘ভালোবেসেছি ছাড়ার জন্য না। আমাদের এই সাময়িক বিচ্ছেদই আমাদের আজীবন একসাথে থাকার কারণ হবে।’

খাবার প্লেটেই বোধহয় দুজনের চোখের পানি টপটপ করে পড়লো। দুজনের কারোরই গলা দিয়ে খাবার আর নামলো না। আমি জানি সেদিনের সেই সাময়িক বিচ্ছেদটা কি কারণে ছিলো তবে তা আমি তীব্রর মুখেই শুনবো। তিহা হাত ধুয়ে উঠে চলে যায়। আমি নিজেও সব খাবার তুলে রেখে নিজের রুমে আসলাম। মেয়েটাকে বুকে আঁকড়ে নিয়ে শুয়ে থাকলাম। চোখের কোণ দিয়ে আপনাআপনিই পানি পড়ছিলো। চোখ বন্ধ করেই তা অনুভব করতে থাকলাম। মুছার প্রয়োজনও মনে করলাম না। চুপচাপ ওভাবেই শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছি।
______

রাত ১০ টার দিকে আমি তুরকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছি আর তিহা পাশের রুমে পড়ছে। আমি, তিহা, তুর একসাথেই ঘুমাই। এতো বড় বেড তারওপর তুর হওয়ার পর থেকেই জ্বালাতো রাতে। এজন্য তিহা আমার সাথেই ঘুমাতো। এতো এতো স্ট্রাগল এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাপ্তি ছিলো তিহা আর তুর। তিহা কোনো অভিযোগ ছাড়াই থেকে গেছে আমাদের সাথে। আমার সাথে জেগে জেগে কতরাত তুরকে নিয়ে থেকেছে। আমি মুচকি হাসলাম। তুরকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে আমার নিজেরও চোখ লেগে এসেছিলো এমন সময় কাচ ভাঙার শব্দে চমকে উঠলাম। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম সবই ঠিকঠাক। উঠে তিহার পড়ার রুমে উঁকি দিতে যাবো তখন ‘ও’ নিজেই উঠে এসেছে। আমাকে বললো,

‘ভাবী শব্দ পেয়েছো?’

‘হ্যাঁ পেলাম তো। তুমি কি কাচ ভেঙেছো?’

‘নাহ তো। রান্নাঘরে কি বিড়াল ঢুকলো নাকি! চলো তো দেখি!’

দুজনে রান্নাঘরে এসে দেখলাম সব ঠিকঠাক। মুহুর্তেই তীব্রর রুমে ছুটে আসলাম দুজনেই। ওর রুমের মেঝেতে গ্লাস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে। দুজনেই অবাক চোখে একবার সেদিকে তাকিয়ে আরেকবার তীব্রর দিকে তাকালাম। তীব্র জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। তিহা দ্রুত তীব্রর কাছে বসলো। বার বার তীব্রর গালে হাত দিয়ে চাপড় দিয়ে ডাকছে। আমি ছুটে রুমে এসে ডক্টর আঙ্কেলকে কল করলাম। আঙ্কেলের আসতে আসতে বেশি না ৫ মিনিট লাগবে। তার বাসা কাছেই। আমি আর তিহা তীব্রকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে করতেই ডক্টর আঙ্কেল আসলেন। উনি দ্রুত তীব্রকে চেক করে ইনজেকশন পুশ করে দিলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে হেঁসে বললেন,

‘আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো। তীব্র রেসপন্স করছে। কালকের মধ্যে মোটামুটি ওর প্রতিটি অঙ্গই রেসপন্স করা শুরু করবে। আলহামদুলিল্লাহ তীব্র এখন সুস্থ হয়ে যাবে।’

আঙ্কেলের কথার কি উত্তর দিবো সত্যিই বুঝলাম না। চোখ পিটপিট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বসে পড়লাম ফ্লোরে। তিহা ততক্ষণে তীব্রকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করেছে। আজ হয়তো আমাদের খুশির দিন। খুশির সময়।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here