তীব্র প্রেমের নেশা পর্ব ২২

0
1115

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (২২)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________

ভদ্র মহিলার কথা শুনে মাথা ঘুরে ওঠে। তীব্রর কিছু হয়নি ভেবেই যেনো আমার মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। কোনোরকমে দু পা এগিয়ে যেতেই মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলে পলি আসে। আমাকে ধরে বলে, ‘আপু তুমি এখানে কেন? তুমি কেবিন ছেড়ে আসছো কেন? আর হাতে…হাতে এত রক্ত কেনো?’

আমি ওর প্রশ্নের জবাব দিলাম না। উল্টো ওর বাহুতে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তীব্র কোথায় পলি? উনি ঠিক আছে তো? এই..এই মহিলাগুলো বলছে কে যেনো মা’রা গেছে! তীব্র কোথায় পলি?’

পলি আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। আমি বার বার পাগলের মতো করতে নিলে আমাকে থামিয়ে হাত ধরে একসাইডে নিয়ে আমার রক্তমাখা হাত চেপে ধরে বলে,

‘তোমার কি হুশ জ্ঞান সব গেছে আপু? এমন করে কেউ? আর তীব্র ভাইয়ের কিছু হয়নি৷ সে এখন আইসিইউতে আছে। তুমি চলো আগে হাত ব্যান্ডেড করতে হবে।’

আমি হাত ঝটকা মে’রে সরিয়ে নিয়ে বললাম, ‘আমি আগে তীব্রকে দেখবো। তুই আমাকে নিয়ে চল!’

পলি হতাশ হয়ে আমার হাত টেনে নিয়ে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতো বলে, ‘তোমার জন্যই তোমার বেবির ক্ষতি হয়ে যাবে দেখে নিও তুমি। একে তো গত ১২ ঘন্টা তোমার সেন্স ছিলো না তারওপর এতো প্রেশার নিচ্ছো! কাল রাত থেকে না খেয়ে আছো!’

আমি অবাক হলাম। খেয়াল করলাম রাতের জায়গায় সকাল হয়ে গেছে। আমি এতোটাই পাগল পাগল ছিলাম যে এটুকু বিষয়ও খেয়াল করিনি। আমি কাল রাত থেকে সেন্সলেস ছিলাম! দীর্ঘশ্বাস ফেলে পলির সাথে আইসিইউ এর সামনে আসলাম। তিহা আমাকে দেখে ছুটে এসে বলে, ‘ঠিক আছো ভাবী! তোমার এমন অবস্থা কেনো?’

আমি জবাব দিলাম না। পলি একটা বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে কঠোর স্বরে বললো, ‘এই তিহা! ওর দিকে খেয়াল রাখবি। আর আপু তুমি যদি এখন ব্যান্ডেডনা করাও তাহলে কিন্তু আমরা কেউ তোমাকে তীব্র ভাইয়ের কাছে যেতে দিবো না। মনে রেখো!’

আমি কিছু বলার আগেই পলি চোখ রাঙিয়ে চলে যায়। তিহা আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার হাত আঁকড়ে নিয়ে বললো, ‘আমার ভাইয়া সুস্থ হয়ে যদি দেখে তার প্রাণের এই অবস্থা তখন কি সে ভালো থাকতে পারবে!’

আমি তিহার কথা শুনেও শুনলাম না। বার বার আইসিইউ এর ভেতরে তাকাতে থাকলাম। পলি ততক্ষণে নার্স ডেকে এনে হাতটা ব্যান্ডেড করিয়ে নিলো। আশে পাশে আঙ্কেল আন্টিকে দেখলাম না। হয়তো তারা নেই। নার্স চলে যেতেই আমি আইসিইউ এর কাছে ছুটলাম। সেখানে একজন নার্স ছিলেন। আমাকে দেখে ভীষণ সতর্ক ভাবে বললেন,

‘আরেহ ম্যাম! ভেতরে আসছেন কেনো? এখানে থাকা যাবে না। আপনারা বাহিরে যান।’

‘আমি একটু থাকি না তীব্রর কাছে! একটু থাকবো। সত্যি বলছি। ওর কাছে একটু থাকবো শুধু। একদমই বিরক্ত করবো না। প্রমিজ!’

নার্স কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আচ্ছা যান। তবে বেশি শব্দ করবেন না।’

আমি খুশিতে তীব্রর কেবিনের পাশে টুল এগিয়ে নিয়ে বসলাম। আলগোছে এক হাত আগলে নিয়ে হাতের ওপর পর পর কয়েকটা চুমু খেলাম। সেই হাতের ওপরই আলগোছে মাথা রেখে শুয়ে রইলাম। কতদিন পর আমার তীব্রকে দেখছি, ছুঁয়ে দিতে পারছি। ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে। কতটা সময় ওভাবেই থেকে ধীর কন্ঠে বললাম,

‘তীব্র আপনি কখন চোখ মেলে তাকাবেন? আমরা তো অপেক্ষা করছি আপনার জন্য। জানেন তীব্র আমাদের না একটা রাজকুমারী আসবে। আপনি তাকে ছুঁয়ে দেখবেন না? আপনি তাকে আঙুলে আঙুল রেখে হাঁটা শিখাবেন না? আচ্ছা আপনি যখন জানবেন আপনি বাবা হবেন তখন আপনার অনুভূতি কেমন হবে? আমার ওপর অভিমান কেটে যাবে নাকি অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিবেন? শোনেন এবার যদি আমাদের একা করে দেন না! তাহলে আমি আর আপনার রাজকুমারী অনেক অনেক দুর হারিয়ে যাবো। তখন আপনি অনেক কাঁদলেও কিন্তু আসবো না। তাই চুপচাপ উঠে পড়ুন আর আমাদের বুকে আগলে নিন।’

কথা বলার সাথে সাথে চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো উনার হাত। আচ্ছা আমার কান্নাগুলো কি উনাকে নাড়া দেয় না? উনি বুঝে না উনার প্রাণ আর উনার রাজকুমারীর কষ্ট হচ্ছে! কিছুক্ষণ নাক টেনে দম নিলাম। মাথা হাতের ওপর রেখেই মাথা ঘুরিয়ে উনার মুখের দিকে তাকালাম। কি সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে লোকটা! আমাদের কাঁদিয়ে ঘুমানো হচ্ছে তাই না! আমি কাঁপা কাঁপা হাতে উনার মুখে হাত দিলাম। ঢোক গিলে ফের বললাম,

‘আপনি না ভীষণ পঁচা জানেন! একবার দুরে সরিয়ে দিয়ে আমাকে পুড়ালেন। কত কিছুর পর আশায় ছিলাম আরো একবার আপনাকে নিয়ে সুখে থাকার সেখানেও আপনি এমন করলেন! কেনো এভাবে হসপিটালে শুয়ে আছেন আপনি? এই তীব্র! কথা বলেন না! আপনি কি বুঝতেছেন না আপনার প্রাণ আর আপনার রাজকুমারী কষ্টে আছে! ফারদিন ভাই যে আমাদের রাজকুমারীকে কেড়ে নিতে চায়! এই তীব্র। উঠুন প্লিজ! আমরা ভীষণ ভাবে অপেক্ষা করছি আপনার জন্য। আমাদের একা ফেলে চলে যাবেন না তীব্র। আমাদের যে আপনি ছাড়া পৃথিবী শূণ্য। আপনি উঠুন না তীব্র! এই তীব্র! তাকান আমার দিকে! তাকাচ্ছেন না কেনো?’

কান্নার দমকে কথাগুলো গলায় আটকে যায়। মুহুর্তেই ছুটে আসে তিহা, পলি আর নার্স। তিহা আমাকে সরিয়ে বলে, ‘ভাবী চলো এখান থেকে।’

আমি যাবো না বলে বায়না শুরু করলাম। কোনোরকমে পলি আর তিহা আমাকে বাইরে আনে। তিহা ফের পলিকে বলে, ‘পলি তুই ভাবীকে বাড়িতে নিয়ে যা। একটা শাওয়ার নিইয়ে খাইয়ে দিস। এখন এখানে থাকাটা ঠিক হবে না।’

পলি চিন্তিত সুরে বলে, ‘কিন্তু আমাদের বাড়িতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে রে তিহা? কাল ফারদিন ভাই আপুকে দিয়ে এবোরশন করাতে চেয়েছিলো। ভাগ্যিস আপু কাল তীব্র ভাইয়ার কথা শুনে ছুটে আসলো নয়তো ফারদিন ভাই যেভাবেই হোক আপুর এবোরশন করিয়ে ছাড়তো। এখনো যে করাবে না এটা বুঝতেছি না!”

‘ভাবীকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যা। ওখানে ভাবীর সব কাপড়ও আছে। ভাইয়া যত্ন করে এখনো রেখে দিয়েছে।’

আমি চট করে বললাম, ‘যাবো না আমি তোমাদের বাড়ি। তীব্র আমাকে ফুপির বাড়ি রেখে গেছে এবার তীব্রই আমাকে তোমাদের বাড়িতেও নিয়ে যাবে ব্যস। আমি যাবো না একা তোমাদের বাড়ি।’

‘ভাবী পাগলামি করো না। আচ্ছা বলো তুমি কি চাও না তোমাদের বেবিটা সুস্থ থাকুক? ফারদিন ভাই যদি কোনোভাবে জোড় করে এবোরশন করিয়ে দেয়! তখন কি করবে?’

পিটপিট করে তাকালাম তিহার মুখের দিকে। হাতটা পেটে রেখে নিজের দিকেই তাকালাম। তিহাদের বাড়িতে যাওয়া আদৌও ঠিক হবে কি না আমার জানা নেই। কিন্তু ফারদিন ভাই যে তীব্রর বাড়ি গিয়ে কিছু করার সাহস পাবে না এটাও আমি ভালো ভাবেই জানি৷ সবচেয়ে বড় কথা হলো ফারদিন ভাই চাইলেই কাল হসপিটাল আসতে পারতো কিন্তু আসলো না কেনো! আমার সকল ভাবনার মধ্যেই পলি আমাকে হাত ধরে হসপিটাল থেকে বাইরে আনে। দিনের আলো ভালো ভাবে চোখে মুখে পড়তেই চোখ মুখ কুঁচকে গেলো। পলি আমাকে নিয়ে তীব্রদের বাড়ির গাড়ি করেই আসে। বাড়িতে ঢুকতেই দেখলাম আজাদ আঙ্কেল বসে আছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘আমার বাড়ির বউ আবার বাড়িতে এসেছে এটাই অনেক। এবার সব শ’ত্রুর শেষ হওয়ার পালা। শুধু আমার ছেলেটা সুস্থ হয়ে যাক।’

আমি কিছু না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। পলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে নিয়ে রুমে আসে। বিছানার ওপর বসিয়ে দিয়ে কাবাড থেকে কাপড় বের করে। আমার প্রতিবিম্ব ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যেনো অনুভূতি শূণ্য এক মানুষ। চোখের নীচটা কালচে হয়ে আছে। চোখ দুটোও ফুলে ফেপে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো। কি হাল হয়েছে আমার! পলি শাড়ি আর প্রয়োজনীয় জিনিস এনে বলে,

‘তুমি একা শাওয়ার নিতে পারবা আপু? নাকি আমি হেল্প করবো?’

আমি পলির হাত থেকে শাড়ি নিয়ে বললাম, ‘আমি পারবো।’

ওয়াশরুমে ঢুকে ঝর্ণা ছেড়ে বসে রইলাম ফ্লোরে। তাকিয়ে রইলাম শূণ্যে। ঝর্ণার পানি এসে মুখ বেয়ে পড়ছে। সাথে চোখ থেকে পানি পড়ছে নিজের মতো। কতক্ষণ ওভাবে ছিলাম জানা নেই। পলির ডাকাডাকি তে ধ্যান ভাঙলে চেঞ্জ করে বের হয়ে আসলাম। চুলগুলো পলিই মুছে দেয়। তারপর শুকিয়ে দিয়ে চুলগুলো বেধেও দেয়। তারপর আমাকে নিয়ে নিচে আসে। নিচে আন্টি বসে ছিলো। আমাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমি নিজেও তেমন কথা বাড়ালাম না। পলির জোড়াজুড়িতে দুবার মুখে নিয়ে আবার রুমে আসলাম। পলি ঘুমাতে বললেও আমি ওযু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে বসলাম। এই বিপদের সময় তিনি ছাড়া আর কেউ সাহায্য করার মতো নেই। আমার অনাগত সন্তানকে সে কিছুতেই অনাথ করে দিতে পারে না। মাথার ওপর থেকে বাবার ছায়া সরিয়ে নিতে পারে না। তিনি তো এতোটাও নি’ষ্ঠুর নয়।
_______

হসপিটালের কড়িডোরে বসে ছিলাম। আমাকে ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। তিহা এখান থেকে নড়ছেই না। হুট করেই দেখলাম ছোটাছুটি শুরু হলো। আমার দৃষ্টি চঞ্চল হলো। আমি উঠে একজনকে নার্সকে আটকে ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কি হয়েছে আপু? এমনভাবে ছোটাছুটি করছেন কেনো?’

উনি কোনোরকমে বললেন, ‘আইসিইউ এর পেশেন্ট রেসপন্স করছে কিন্তু অবস্থা বেশি ভালো না। আপনারই তো হাজবেন্ড বোধহয়! কাল তো আপনিই পাগলামি করছিলেন! আল্লাহকে ডাকুন।’

বলেই উনি ছুটে চলে গেলেন। কথাটা হজম করতেই আমার সময় লাগলো বেশ অনেকটা। ততক্ষণে তিহা, পলি, আঙ্কেল, আন্টি আইসিইউ এর সামনে চলে গেছে। আমি কোনোরকমে ছুটে আসলাম। বাহির থেকে ভেতরে তাকাতেই দেখলাম তীব্র ছটফট করছে। আমি ব্যস্ত গলায় বললাম,

‘তীব্র এমন করছে কেনো? তিহা! তোমার ভাইয়া এমন করে কেন? সরো আমি ভেতরে যাবো! ‘

তিহা হাত আঁটকে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বলে, ‘ভাবী ওখানে যাওয়া যাবে না। ডক্টররা ঢুকতে দেবে না। পাগলামী করো না।’

তিহা আমাকে কিছুতেই যেতে দিচ্ছে না। সাথে পলিও আটকে ধরেছে। ওদিকে আন্টি উন্মাদের মতো কান্না করছে। আঙ্কেল সামলাচ্ছে তাকে। আমার আর আন্টির হাহাকার মিশে পুরো হসপিটালটাই যেনো গুমোট ধরে গেলো। আশে পাশের অনেকেই তাকিয়ে দেখছে। একজন স্ত্রী আর একজন মায়ের কান্নায় পরিবেশটাই থমথমে হয়ে গেছে। তিহা আর পলি ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। ওদিকে তীব্রর অক্সিজেন মাস্ক পড়ানো থাকাা স্বত্বেও শ্বাস নিতে পারছে না। আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো। মাথায় একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে ‘তীব্রর কাছে যেতে হবে।’ যখন তীব্র একটু স্বাভাবিক হয়েছে ঠিক তখনই কোথা থেকে যেনো একজন ছুটে এসে বললো,

‘স্যার হসপিটালে আ’গুন লেগেছে।’

মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। সবাই যে যার মতো ছুট লাগালো। তীব্রর এই অবস্থা তার ওপর হসপিটালে আগুন লেগেছে শুনেই কলিজা শুকিয়ে গেলো। একপলক আইসিইউর দিকে তাকিয়ে নিজেকে শক্ত করলাম। নাহ! এবার আমাকেই কিছু করতে হবে। তীব্রকে বাঁচাতে হলে এবার আমাকেই কিছু করতে হবে। কিন্তু কিভাবে কি করবো! একে তো তীব্রর এই অবস্থা তারওপর হসপিটালে আগুন! বিপদের ওপর বিপদ যেনো মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো।

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here