তীব্র প্রেমের নেশা পর্ব ২১

0
1069

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (২১)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________

পলির কথায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তীব্রের গু’লি লেগেছে মানে! পুরো কথাটা বার বার মাথায় ঘুরপাক করতে থাকে। চোখ পিটপিট করে কয়েকবার পলির মুখের দিকে তাকিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম ফ্লোরে। ফারদিন ভাই হাত ছেড়ে দিয়েছে। পলি দ্রুত কাছে এগিয়ে এসে আগলে নিয়ে বলে,

‘আপু! ঠিক আছো তুমি? এই আপু!’

আমি ওভাবেই বসে রইলাম। তীব্রর কিছু হবে না তো! মাথায় তখন এই একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। পলি বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘এই আপু! এভাবে চুপ করে আছো কেনো? তীব্র ভাইয়ের কাছে যাবে না? হসপিটালে আছে ভাইয়া। জীবন-মৃ’ত্যুর মাঝে লড়ছে!’

আমার দৃষ্টি দ্রুত হলো। চোখের পাতা কয়েকবার ঝাপ্টে কিছু বলার আগেই ফারদিন ভাই আমার হাত টেনে ধরে বললো, ‘তীব্র ম’রুক আর না ম’রুক তোর এই বাচ্চা ম’রবেই। ওঠ! তোকে এবোরশন করাতে হবে।’

‘ভাইয়া আপুকে ছাড়ো! ব্যাথা পাবে আপু। দেখো ভাইয়া বেশি বেশি করো না। প্রানেশা আপুকে ছাড়ো। আমরা তীব্র ভাইয়ার কাছে যাবো।’

ফারদিন ভাই পলিকে চোখ রাঙিয়ে বলে, ‘আর একটা কথা বললে তোর গাল ফা’টিয়ে দেবো আমি। তুই সর!’

ফারদিন ভাই টানতে শুরু করলে শান্ত গলায় বললাম, ‘হাত ছাড়ুন!’

ফারদিন ভাই না ছেড়ে আরো শক্ত করে ধরলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘তোর এই বাচ্চা এবোরশন না করানো পর্যন্ত আমার হাত থেকে নিস্তার নাই।’

আমি আরো একবার শান্ত ভাবে বললাম হাত ছাড়ার কথা। কিন্তু ফারদিন ভাই না শুনে টানতে শুরু করলে আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘হাত ছাড়ুন!’

ফারদিন ভাই আর পলি ২ পা পিছিয়ে যায়। আমি কোনোমতে ফ্লোর থেকে উঠে আঙুল উচু করে ফারদিন ভাইয়ের দিকে তাক করে বললাম, ‘অনেক সহ্য করেছি আমি। আর না! কি পেয়েছেন আপনি আমাকে? আপনাদের বাড়িতে থাকতাম বলে আপনার সব অ’ত্যা’চা’র আমি সহ্য করে নিয়েছি বলে আমার বেবির কোনো ক্ষতি করতে চাইলেও আমি সহ্য করে নিবো! কান খুলে শুনে রাখেন এটা তাশজিদ শেখ তীব্রর সন্তান। তাকে যেমন কোনোদিন আপনি হা’রাতে পারেননি তেমনই তার সন্তানেরও টিকি টাও নড়াতে পারবেন না।’

ফারদিন ভাই অবাক চোখে চেয়ে রইলেন। আমি শাড়ির কুঁচি ধরে কোনোরকমে রুম থেকে বের হলাম। পেছন পেছন পলিও আসলো। গেইট দিয়ে বাইরে বের হতেই পলি ছুটে এসে হাত ধরে। আমার তখনো মাথা কাজ করছে না। মাথায় বার বার ‘তীব্রর কিছু হয়ে গেলে’ আসতেই আমার পাগল পাগল লাগছে। চোখ থেকে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। পলি একটা সিএনজি ডাকলে দুজনে সেইটা করেই হসপিটাল পৌঁছালাম। ছুটে রিসিপশন থেকে তীব্রর খোঁজ নিয়ে ছুটলাম অপারেশন থিয়েটারের সামনে। সেখানে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে আজাদ আঙ্কেল। তিহা আর আন্টি কান্না করছে। আমি ধীর পায়ে আসলাম তিহার কাছে। তিহা আমাকে দেখেই চমকে তাকালো। পলি এসে আমাকে ধরলো। আমি তিহার কাছে গিয়ে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,

‘তীব্র কোথায় তিহা?’

তিহা আমার প্রশ্নে মুখ অন্যদিকে নিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। আমি তিহার মুখ সোজা করে আবারও একই প্রশ্ন করলাম। তিহার উত্তর না পেয়ে রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

‘আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি তিহা!’

তিহা কাঁপা কাঁপা হাতে ওটির দিকে ঈশারা করলো। আমি তিহাকে ছেড়ে ওটির দিকে এগোতে নিলে হাতে টান পড়ে। ব্যস্ত চোখে পেছনে তাকাতেই দেখি আন্টি হাত টেনে ধরে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ পিটপিট করে তাকাতেই উনি বললেন,

‘তুমি এক্ষুণি এখান থেকে যাও!’

আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম, ‘আমি তীব্রর কাছে যাবো। হাত ছাড়ুন আন্টি!’

আন্টি ছাড়লেন না। বরং টান দিয়ে দুরে সরিয়ে রাগ ঢেলে বললেন, ‘আমার ছেলের জীবনটা খে’য়ে এখন আসছো দরদ দেখাইতে! এক্ষুণি এখান থেকে বের হও তুমি।’

আজাদ আঙ্কেল দৌড়ে আসলেন। আন্টিকে আগলে নিয়ে বললেন, ‘তাফিয়া! পাগল হয়েছো নাকি? কি বলছো এসব!’

আন্টি ঝটকা মে’রে দুরে সরে গেলেন। পাগলের মতো কান্না করতে করতে চিৎকার করে বললো, ‘তোমার জন্য সব হয়েছে। তোমাদের জন্য! কতবার বলেছি এই মেয়েটা অ’পয়া। ওকে বাড়ির বউ করো না। নিজের বাবা-মা’কে খে’য়েছে ছোট বেলাতেই। এখন আমাদের জীবনটা দুর্বিষহ করে তুলবে। করেছেও তো তাই। এই মেয়েকে দু কথা শুনিয়েছিলাম বলে আমার ছেলে আমার সাথে কতদিন ঠিক করে কথা বলে না! তোমরা বাবা-মেয়েও তো আমাকে কথা শোনাতে ছাড়োনি! এই মেয়ের জন্য আমার বাপের বাড়িতেও সম্পর্ক খারাপ হলো। এখন! এখন এই মেয়ের জন্যই তো আমার ছেলের এই অবস্থা!’

আন্টি কান্না করছে। আমি অবাক চোখেই তাকিয়ে আছি। চোখ থেকে পানি পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ওখানেই ফ্লোরে বসে পড়লাম। তিহা আন্টিকে সামলে বললো, ‘এটা হসপিটাল আম্মু। চেচামেচি করো না। তারপর ওটির সামনে এসব চেচামেচি করলে নার্সরা রেগে যাবে।’

আন্টি চুপ করে বসে রইলেন। পলি আমাকে তুলে বেঞ্চে বসিয়ে দিলো। তারপর আন্টির সামনে গিয়ে বললো,

‘ঠিকই বলেছো আন্টি। মেয়েটা আসলেই অ’পয়া জানো তো! নয়তো কি কেবল ৬ মাস বয়সে বাবা-মায়ের খু’নের সাক্ষী হয়! এরপর ফুপির কাছে বড় হলো। নিজের সব আহ্লাদ, সব স্বপ্ন ত্যাগ করে সবার বলা পুতুলের মতো চলতে পারতো! ফুফাতো ভাইয়ের কাছে দিনের পর দিন অমানবিক অ’ত্যা’চা’র সহ্য করতে পারতো! নিজের বেষ্ট ফ্রেন্ডের বেই’মানি সহ্য করতে পারতো! আপনার ছেলেকে এতো ভালোবাসার পরও, আপনার ছেলে ছেড়ে যাওয়ায় গত ২ মাস নিজেকে একটা ঘরবন্দী করে রাখতে পারতো! রোবটের মতো থাকতে পারতো! আজ যখন জানলো মেয়েটা মা হবে তখন জানলো তীব্র ভাইয়ের এই অবস্থা। নিজের দিক না ভেবেই এভাবে পাগলের মতো ছুটে আসতে পারতো যদি না মেয়েটা অ’পয়া হতো! অ’পয়া বলেই তো সারাজীবনই মেয়েটাকে কষ্টের পাহাড়ে ডুবতে হলো। তাই না আন্টি?’

আমি চুপ করে বসে রইলাম। অনুভব করলাম সেখানকার সবার অবাক দৃষ্টি। তিহা ছুটে এসে আমার সামনে বসে অবাক হয়ে বললো, ‘ভাবী তুমি সত্যিই…’

আমি কোনো জবাব দিলাম না। পলিই এগিয়ে এসে বললো, ‘আজই ডক্টর জানিয়েছে। কাল সব টেস্ট করতে হবে।’

এমন অবস্থায় এই সুসংবাদটাও যেনো সবার কাছেই শুধুই একটা সংবাদ। আমার দৃষ্টি তখন ওটির দিকে। আন্টি চোখ মুখ কুঁচকে বললেন, ‘এই মেয়ের মতো ওর সন্তানটাও অ’পয়া।’

এবার আজাদ আঙ্কেল রেগে গেলেন। ঠা’স করে থা’প্পড় বসালেন আন্টির গালে। থা’প্পড়ের শব্দে চমকে উঠলাম। আন্টি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। আঙ্কেল রেগে গিয়ে বললেন,

‘তোমার মতো নি’কৃষ্ট মেয়ে মানুষ আমি আসলেই দেখিনি। একটা মেয়ের সাথে এতোটা খারাপ ব্যবহার কোনো মা করতে পারে! আজ প্রানেশার জায়গায় তোমার মেয়ে থাকলে ওকেও এভাবেই বলতে! ভুলে যেও না প্রানেশার গর্ভে কিন্তু তোমার ছেলেরই অংশ। যদি সেই সন্তান অ’পয়া হয় তাহলে তোমার ছেলে নিজেও অ’পয়া। প্রানেশাকে নিয়ে আর একটাও বাজে কথা বলবে না।’

আন্টি ধপ করে বসে পড়লেন। কে কি করছে আমার এদিকে বিন্দুমাত্রও ভ্রুক্ষেপ নেই। আমার শুধু তীব্রর ব্যাপারে জানা লাগবে। আমি তিহার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ডক্টর কখন বের হবে তিহা?’

তিহা আমার গালে হাত রেখে বললো, ‘একটু পরই হয়তো। চিন্তা করো না ভাবী। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

আমি মাথা নাড়ালাম। ডক্টর বের হলেন তারও প্রায় আধাঘন্টা পর। আমি ছুটে গেলাম উনার কাছে। ব্যস্ত গলায় বললাম, ‘আম-আমার হাজবেন্ড! কেমন আছে ডক্টর? উনি ঠিক আছে তো? সুস্থ হয়ে যাবে তো? কোথায় উনি?’

ডক্টর দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত থেকে গ্লাভস খুলে মাথায় হাত রাখলেন। আমি তখনো চঞ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। ডক্টর ধীর কন্ঠে বললেন, ‘আমরা ৪৮ ঘন্টার আগে আর কিছু বলতে পারবো না মা। যদি ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সেন্স না আসে তাহলে যা কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। এমনকি মা’রাও যেতে পারে।’

আমি থমকে গেলাম। আন্টি, তিহা শব্দ করে কাঁদতে থাকলেন। ডক্টরের কথা শুনে আমি একবার ওটির দিকে তাকালাম। সবকিছু ছাপিয়ে ওটির দিকে ছুট লাগালাম। পিছন পিছন পলি আটকানোর চেষ্টা করতে শুরু করলো। ওটির ভেতরে ঢুকতে নিলে দুজন নার্স আটকে দিলেন। আমি বার বার একটাই কথা বলছিলাম, ‘তীব্রর কাছে যাবো আমি৷ ছাড়ুন আমাকে!’

কেউ কোনো কথা শুনলো না। আমার উন্মাদনা বাড়লো৷ পাগলের মতো শুরু করলাম। পলি ততক্ষণে আমাকে আটকাতে আটকাতেই কেঁদে ফেলেছে। তিহা, আঙ্কেল সবাই আটকানোর চেষ্টা করছে। এতো চাপ নিতে না পেরে ওখানেই সেন্স হারালাম।
_______

সেন্স ফিরতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম হসপিটালের কেবিনে। আমি চোখ মেলে আশে পাশে তাকাতেই নজরে পড়লো হাতের স্যালাইন। পুরো রুম ফাঁকা। সাথে আমার মস্তিষ্কের চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। কি হয়েছে কাল তা মাথায় আসতেই প্রথমে হাত গেলো পেটে। এরপর চট করে উঠে স্যালাইনের সূচ টেনে বের করলাম। খোলা চুলে কোনোরকমে শাড়িটা ঠিক করেই কেবিনের বাহিরে আসলাম। পড়নে সুতির একটা শাড়ি। আমি বাহিরে এসে নজরে পড়লো না কাউকে। আমি হসপিটালের কোন তালায় আছি বা কোন কেবিনে আছি এসবের কিছুই জানা নেই৷ আশে পাশের একটা কেবিনে ঢুকেই নার্সকে চেপে ধরলাম। নার্স আমাকে দেখে ভয় পেয়ে বললো,

‘আরেহ ম্যাম কি করছেন! আপনার হাতে এতো র’ক্ত কেনো?’

আমি কোনো প্রকার জবাব দিলাম না। শুধু কোনোরকমে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওটি কোনদিকে?’

‘আরেহ ম্যাম ওটিতে যাবেন পরে। আগে আপনার হাতটা তো ব্যান্ডেড করুন!’

‘আপনি বলুন ওটি কোনদিকে! আমি করে নিবো ব্যান্ডেড।’

নার্স কিছুক্ষণ আমার হাতে ব্যান্ডেড করতে চেয়েও ব্যর্থ হলেন। শেষে হার মেনে বললেন, ‘২ তালায় ওটি।’

‘এটা কয় তালা?’

‘৩ তালা।’

আমি আর কিছু না বলেই বের হয়ে আসলাম। ছুট লাগালাম নিচে। শাড়িটা ভালো মতো ধরে ২ তালায় আসতেই এক ভদ্র মহিলার কন্ঠ কানে এলো,

‘আজ তো ওপারেশনের পর একটা ছেলে মা’রা গেছে। আহারে ছেলেটার বয়সই আর কত হবে! বাঁচতে পারলো না।’

থেমে গেলো পা দুটো। অজান্তেই শরীরের ভার ছেড়ে দিলাম। আজ তো তীব্রর অপারেশন ছিলো! তাহলে কি! মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিলাম। মহিলার কথা শুনে আর এগোনোর সাহস বা শক্তি কোনোটাই পেলাম না। চারদিকে ফিনাইলের তীব্র গন্ধ আর প্রিয়জন হারানোর হাহাকার শোনা যাচ্ছে। এ হাহাকার আমার তীব্রর জন্য নয় তো! এই হাহাকার গুলো আমার আপন মানুষদের নয় তো!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here