#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_৫৩
____________________________
–‘এহতেশাম আহমেদ,নুরাইয়া আহমেদ তাদের দুই সন্তান প্রণয় আহমেদ আর ইরা আহমেদ। চারজনের হাসি খুশী এক পরিবার ছিল।কিন্তু সেই সুখের ইতি ঘটলো যখন প্রণয় অর্থাৎ আমার বয়স ১১ বছর।আম্মু আর তার স্বামীর মধ্যে তৃতীয় জনের আগমন ঘটে। পরকীয়া যাকে বলে, এহতেশাম আহমেদ ওনার অফিসের পি.এস এর সাথে সম্পর্কে জড়ান।তারপর থেকে রাত করে বাড়ি ফেরা,ড্রাংক করা, আম্মুকে কথায় কথায় বা জে কথা শোনানো,আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা, অবহেলা করা। এসব নিত্যদিনের কাজ হয়ে গিয়েছিল তার।অবহেলা,অবজ্ঞায় এক বছর পার হলো।২০০৫ সাল ৩০ শে ডিসেম্বর,আমার জন্মদিন, ১১ থেকে ১২ বছরে পা দিব।সেদিন সকালে আম্মু অনুনয়-বিনয় করে তাকে বলেছিলেন –
–‘আজ ওর জন্মদিন একটু তাড়াতাড়ি আসবেন।
উনি জবাব দিলেন না,চলে গেলেন।
তিন ভাই ছিলেন ওনারা,উনিই ছিলেন সবার বড়।দুই চাচার ঘরে পাচ সন্তান, তাদের মধ্যে তন্ময়, মিহু আর পিহু। পিহু তখন ছিল না অবশ্য।তাদেরকে দাওয়াত করেছিলেন আম্মু।তারা আসলেন, রাতে খেলেন,ওনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে,শেষে কেক ই কা টা হলো না।মেহমান রা সবাই চলে গেলেন,উনি আসলেন না তখনও।আম্মু জোড় করে আমাকে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিলেন,ইরাকে সেদিন নিজের সাথে রাখেননি,আমার রুমে পাঠিয়ে দেন।আম্মুর সো কলড স্বামী আসলেন রাত দেড়টার পরে।ড্রাংকড অবস্থায়,সেদিন আম্মু খুব রে গে গিয়েছিলেন,এতদিনের সব রা গ ক্ষোভ ঝাড়লেন তার ওপর।উনিও রে গে গেলেন, প্রথম বারের মতো আম্মুর গায়ে হাত তুললেন,আম্মু অবাক হয়েছিলেন চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।পরমুহূর্তেই ঝাঁঝালো কণ্ঠে তাকে বললেন-
–‘অনেক হয়েছে, আর না।একটা বছর সহ্য করেছি,আর না। আপনার বাড়িতে আর এক মুহূর্ত ও না।আজই চলে যাব আমার সন্তানদের নিয়ে। ডিভোর্স পেপার তাড়াতাড়ি ই পেয়ে যাবেন।’
কথাগুলো বলে আম্মু দরজার দিকে পা বাড়াতে নিলেই থমকে গেলেন,মাথায় হাত দিয়ে বি কট শব্দে চিৎকার দিয়ে উঠলেন।মাথা চেপে ধরেই ধপ করে নিচে পড়ে গেলেন।সামনে তাকিয়ে দেখলাম হাতে ভারি একটা ফ্লাওয়ার ভাস নিয়ে দাড়িয়ে আছেন উনি।ছোট্ট মস্তিষ্ক জানান দিল তখন ঔটা দিয়েই বারি দিয়েছেন আম্মুকে আর এজন্যই আম্মু…আম্মুর চোখ জোড়া বন্ধ হতে বেশি সময় লাগলো না।ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলাম জানালার আড়ালে দাড়িয়ে থাকা প্রণয় নামের সেই ভীতু ছেলেটা। ছোটবেলা থেকেই বড় ভীতু, গম্ভীর আর চুপচাপ স্বভাবের ছিলাম।চোখের সামনে এমন ঘটনা দেখার পরে ভেতরটা একেবারে পাথর হয়ে গিয়েছিল আমার, সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম।আম্মুর নিথর দেহটার মাথার কাছে বসে উনি গাল জোড়ায় থাপ্পড় দিচ্ছিলেন,কয়েকবার ডাকার পরেও যখন সাড়া পেলেন না, তখন মাথায় বাজ পড়লো ওনার।নেশা উবে গেল বোধহয়, কী করবেন না করবেন ভাবতে ভাবতে হঠাৎ উঠে দাড়ালেন।কাবার্ড থেকে আম্মুর একটা ওড়না নিয়ে ফ্যানের সাথে বাধলেন, আম্মুর নিষ্প্রাণ শরীরটাকে টেনে হিচড়ে উঠালেন,ফ্যানের সাথে ঝু লিয়ে দিলেন।পুরো নিখুঁত ভাবে কাজটা সাড়লেন উনি।দেখে মনেই হবে এটা আ ত্ম হ ত্যা। কয়েকজনকে কল করলেন,একজনকে খুলে বললেন পুরো কাহিনি।কথা শেষ করে বেডে বসতেই বোধহয় ওনার খেয়াল হলো যে এই বাসায় ওনার দুজন ছাড়া ও কেউ আছে।উনি দরজার দিকে ঘুরতেই জানালার কাছ থেকে সরে ভারি শরীরটাকে নিয়ে এক দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলাম।১ বছর বয়সী ছোট্ট প্রাণটা, বিছানায় ঘুমাচ্ছে নিশ্চিন্তে।তার দিক এক পলক তাকিয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর ভান ধরলাম।একটু পরই দরজা ঠেলে কেউ রুমে প্রবেশ করলো,ভালো করে পরখ করে চলে গেলেন।সেদিনই সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে আসলাম ইরাকে নিয়ে।ঠাই হয়েছিল আম্মুর ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবীর বাড়ি তে।উনি নিজের কাছে লুকিয়ে না রাখলে হয়ত বাচা হতোনা।সেদিন রাতেই টিভিতে নিউজ হলো-
–‘ শহরের অন্যতম ব্যবসায়ী এহতেশাম আহমেদ এর স্ত্রী সুইসাইড করেছেন,রাত দেড়টার পর অফিস থেকে বাসায় ফেরার পড়ে নিজের রুমে যেয়ে স্ত্রীর ঝু লন্ত লাশ দেখতে পান খোদ এহতেশাম আহমেদ।ওনার দুই সন্তান ও নিখোজ সেই ঘটনার পর থেকে।’
কত সুন্দর করে একটা খু ন কে সুইসা ইড বলে চালিয়ে দিলেন।স্ত্রী হারানো আর সন্তানদের নিখোঁজ এর সংবাদে নাকি ভেঙে পড়েছেন উনি।হাসি পেল খুব ওনার এসব মিথ্যায়।আম্মু মা রা গিয়েছেন তার জন্য বিন্দু মাত্র কান্না আসতো না আমার।একটা দিন আন্টি অনেক কষ্টে ইরাকে সামলে ছিলেন।এহতেশাম সাহেব খুজে নিতেন হয়তো আমাদের কিন্তু সেই সুযোগ পাননি।তার পরের দিন রাতে টিভিতে নিউজ হলো –
–‘শহরের অন্যতম ব্যবসায়ী এহতেশাম আহমেদ এর মৃত্যু হয়েছে কার এক্সিডেন্টে।
কেউ বলছিল বিজনেসে দ্রুত উন্নতির কারণে ওনার নিজের বিজনেস পার্টনার রাই ওনার দুঃসময়ের ফায়দা নিয়ে ওনাকে আ ঘাত করেছেন।মে রেই ফেলেছেন হা হা হা হা। আবার কেউ বলছিল মানসিক অবস্থা খারাপ ছিল তাই ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিতে পারেননি আর মনোযোগ ক্ষুণ্ণ হয়ে এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। কিন্তু ঔ যে বলে না ‘রিভেন্জ অফ নেচার’ ওনার সাথে ওটাই হয়েছে তবে উনি ওনার পাপের শাস্তি টা একটু বেশি তাড়াতাড়ি ই পেয়ে গেছেন।তবে মারা যাওয়ার আগে উনি টাকা দিয়ে যাদের কিনে রেখে গিয়েছিলেন তারা তাদের কাজ ঠিকই করেছে।আম্মুর মা র্ডার কেসটাকে সু ইসা ইড কেস বলে চালিয়ে দিয়েছেন।আম্মুর পোস্টমর্টেম এর ফেক রিপোর্ট বানিয়েছেন **** হসপিটালের ডাক্তার.আনান সিদ্দিকী আর কেস সামলেছেন অফিসার আদনান হাসান। কিছু দিন আগেই সা সপেন্ড করা হয়েছে ওনাকে। ঘুষ নিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছেন।কে ধরিয়ে দিয়েছে জিজ্ঞেস করবে না?
আমি ই বলছি – মুগ্ধ..মুগ্ধ খুলেছে তার মুখোশ, বুদ্ধি ছিল আমার তাই ক্রেডিট তো আমার ও আছে।হা হা।আর ঔ যে ডাক্তার.আনান সিদ্দিকী উনিও তো মা রা গিয়েছেন কিছুদিন আগে।উনি নাকি কয় তলা থেকে লাফ দিয়েছে..হাহ সুইসাইড নাকি মার্ডার নাকি কোনো এক্সিডেন্ট এখনও বের করেতো পারেনি কেউ।আর তার বুঝদার ভাগ্নে বলছে তাকে মা র্ডার করা হয়েছে।সে কী বলেছে জানো?তার মামাকে নাকি আমি মে রে ফেলেছি।বাই দা ওয়ে মিহু আমার চাচাতো বোন।আর সেটা তোমাকে বলতে না করেছিলাম আমি ই।তন্ময় যে আমার চাচাতো ভাই সেটা খুব কম মানুষ ই জানে।মিহু আর তন্ময় শুরু থেকেই আমার পাশে ছিল আর আছে। কিন্তু এহতেশাম আহমেদ এর দুই ভাই, তাদের স্ত্রী তারা কখনোই আমাদের পাশে ছিলেন না।এহতেশাম আহমেদের মারা যাওয়া নিয়ে ও কারো মাথা ব্যথা ছিল না। আমরা দুইটা ছেলে মেয়ে আমাদের কী হবে সেটা নিয়ে ও এক মুহূর্ত ভাবেননি তারা।একদিন জিজ্ঞেস ও করেনি কেউ আমরা কোথায় আছি?কীভাবে আছি?মামা মামীর কাছে বড় হচ্ছিলাম দুজন।দিনা নিজের বোনের মতো করে ইরাকে স্নেহ করেছে।ইরা জানে না সবটা, শুধু জানে যে আমার বার্থডের দিন আম্মু আর এহতেশাম সাহেবের কার এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়েছিল।আর তাই আমি আমার বার্থডে সেলিব্রেট করি না। আম্মুর সেই বান্ধবী উনি আর ওনার স্বামী, তারা দুজনও নিজের সবটা দিয়ে আমাদের সাহায্য করেছেন।তারা এখনো নিজের ছেলের মতো আদর করেন আমায়।মিহুর আম্মু আব্বু কেউ খোজ না নিলেও মিহু আর তন্ময়ের সাথে সবসময় যোগাযোগ থাকতো।আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখার কারণে মিহু আর তন্ময়ের সাথে তাদের বাবা মা র মনোমালিন্য হওয়ায় নিষেধ করেছিলাম যেন যোগাযোগ না রাখে।কিন্তু ওরা শোনেনি।মিহুর সাথে তার মায়ের সম্পর্ক ভালো না,কেন জানো?আমাদের জন্য, আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখাটা ওনার পছন্দ না।কিন্তু ওরা দুজন স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে -‘সম্পর্ক নষ্ট করবেনা। তারা আছে এখনও পাশে।আর..
কথা থামিয়ে দিল প্রণয়,পকেট থেকে রিং হতে থাকা ফোনটা বের করলো।তন্ময়ের কল এসেছে,ফোন রিসিভ করতেই বা কা হাসলো প্রণয়।শুধু বললো-
–‘ঠিক আছে পাঠা।
একটু পরই মেসেজের টুং শব্দ হলো।প্রণয় কি যেন দেখলো ফোনে।তারপর সূচনার দিকে তাকিয়ে বললো-
–‘দুইটা গুড নিউজ আছে দেখবে?
সূচনা থেমে থেমে জিজ্ঞেস করলো-
–‘ক..কীসের.. গুড নি..উজ?
–‘সি।
ফোনটা সূচনার সামনে ধরে বললো প্রণয়।ভিডিও একটা,যেটা দেখে স্বাভাবিকের চেয়ে চোখ জোড়া বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেছে সূচনার। ঘাম ছুটছে তার,কাঁপা কাপা কণ্ঠে শুধু জিজ্ঞেস করলো-
–‘রি..রিয়াদ। ও ও..কে পু..পুলিশে ধ..ধরেছে কেন?
–‘হ্যা রিয়াদ।আনান সিদ্দিকীর সেই বুঝদার ভাগ্নে। যে আমার ওপর খু নের আরোপ লাগিয়েছে।ডু ইউ বিলিভ ইট?আচ্ছা তুমি জিজ্ঞেস করলে না আম্মুর সেই বান্ধবীর ব্যাপারে?ওনার নাম কী জানো?
সূচনা প্রশ্নসূচক চোখ জোড়া প্রণয়ের দিকে তাক করলো।প্রণয় মিহি হাসি দিয়ে বললো-
–‘মিসেস দিশা,দিশা আন্টি আর এখন দিশা মা।
সূচনা বিস্মায়াবিষ্ট চোখে তাকিয়ে রইলো। সব গুলিয়ে ফেলছে সে।দিশা মা মানে তার মা?মানে তার আম্মু আব্বু আগে থেকেই প্রণয়ের সাথে পরিচিত?শুরু থেকেই তাদের সম্পর্কে সব জানে ওনারা?সূচনা মাথা চেপে ধরে ফ্লোরে বসে পড়তে নিলেই প্রণয় দুবাহু ধরে দাড় করালো।তার দুই গালে হাত রেখে বললো-
–‘ রিয়াদ তোমার সাথে যা করেছে সেটা জানার পরে আমি তাকে ছেড়ে দিব সেটা ভাবলে কী করে?তারওপর তার সাথে আমারও কিছু হিসেব নিকাশ বাকি,তার স্ত্রী আর তোমার বান্ধবী স্নেহা।তারা ও তো রিয়াদের শাস্তি চায়।এতগুলো মানুষের সাথে অন্যায় করার পর তাকে শাস্তি না দিয়ে কী পারা যায় বলো?মে রে ফেলতে তো পারি না,যতই হোক সে মানুষ।তাকে হত্যা করার অধিকার নেই।তাই ছোট্ট শা স্তি দিলাম।
সূচনা আগের থেকেও বেশি অবাক বনে গেল। রিয়াদের নিজের স্ত্রী ও তার শাস্তি চায় কিন্তু কেন?স্ত্রী হয়ে সে নিজের স্বামীর শাস্তি চাচ্ছে?আর স্নেহা..স্নেহা কীসের শাস্তি চাইবে?কেন চাইবে?আগা গোড়া কিছু বুঝল না সূচনা।প্রণয় ভালো করে ই বুঝতে পারলো তার অবস্থা। তাই নরম স্বরে বললো-
–‘আমি জানি তুমি কী ভাবছো কিন্তু তার উত্তর পাওয়ার জন্য আরও কিছু ঘন্টার অপেক্ষা সহ্য করতে হবে তোমায়।কারণ তোমার প্রশ্নের উত্তর কালকে পাবে।একেবারে পাই টু পাই, প্রতি টা প্রশ্নের উত্তর, হেডলাইন হবে পেপারে,টিভিতে নিউজ হবে।তারপর আমার কাছে এসো কিছু না বুঝলে বুঝিয়ে দিব।
তার কথার পৃষ্ঠে সূচনা শুধু এতটুকু বললো-
–‘আমি আম্মুর কাছে যাব প্রণয়। নিয়ে চলুন, বারণ শুনব না আমি।
#চলবে