#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩০ (২য় খণ্ড)
[অন্তিম পর্বের মধ্যমাংশ]
অভিরূপ ঘুমিয়েছে। বলতে গেলে জোর করে ঔষধ দিয়ে ঘুমিয়ে রেখেছে নোমান। অভিরূপের গায়ে সুন্দর করে চাদর জড়িয়ে দিয়ে তার পাশে বসল নোমান। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা এতটুকু সময়ের মধ্যে এতকিছু হয়ে গেল। মস্তিষ্ক এখনো বিষয়গুলোকে মেনে নিতে পারছে না। ফোনের ভাইব্রেশন অনুভব করল সে। পকেট থেকে ফোন বের করে উর্মিলার নম্বর দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে রুমের দরজা লাগিয়ে বাহিরে এসে কল রিসিভ করল।
“হ্যাঁ বলো।”
“আমি কী বলব? আপনি বলুন। কী অবস্থা ওইদিকে? সব ঠিকঠাক আছে?”
উর্মিলার চটপটে কণ্ঠ। নোমানের কণ্ঠে বিষণ্নতা। ভার গলায় নোমান বলল,
“আর ঠিকঠাক! সবকিছু ততটাই বিগড়ে গিয়েছে যতটা ঠিকঠাক ছিল তার চেয়ে দ্বিগুণ। বুঝতে পারছি না কী করব।”
উর্মিলা দ্বিধান্বিত হয়ে শুধাল,
“কেন? কারো কোনো ক্ষতি হয়েছে নাকি? রাগিনী ঠিক আছে? আর কোহিনূর জিজু? আমি রাগিনীকে কলেই পাচ্ছিনা।”
“সবাই ঠিক আছে উর্মিলা। ঠিক নেই শুধু অভি। অন্যদিকে, মেহরাজও মা/রা গিয়েছে।”
চিন্তা আরো বেশি হলো উর্মিলার। তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
“কী বলছেন! আর অভিরূপ ভাইয়ার কী হয়েছে?”
“রূপাঞ্জনা মানে রাগিনীর মতো যেই মেয়েটা ছিল! অভি তো তাকে ভালোবাসত। সে মা;রা গিয়েছে। আর অভিরূপ পাগলামি করছে। মারাত্মক ভালোবাসত মেয়েটাকে।”
উর্মিলা নীরব রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর নম্র সুরে বলল,
“এখনো কী পাগলামি করছেন উনি?”
নোমান দরজা খুলে একবার দেখে নিলো অভিরূপকে। ভাবলেশহীন হয়ে বলল,
‘না ঘুমাচ্ছে। আমি ওকে একটা মিথ্যা আশা দিয়েছি যে রূপা ফিরে আসবে।”
উর্মিলা এবার কিছুটা গম্ভীর হলো। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“দেখুন বাস্তবতাকে তো বদলাতে পারব না আমরা। আমরা যেটা করতে পারি সেটা হলো বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া।”
নোমান অপরাধীর মতো অনুতাপের সাথে বলল,
“কী বলব আমি তাহলে? মেয়েটা গেল তো গেল আমার বন্ধুটাকেও ভেতর থেকে মৃ/ত বানিয়ে দিয়ে গেল।”
“মৃ/ত্যু তো সবসময় অছিলা খোঁজে নোমান। মানুষ পৃথিবীতে আসবে যাবে এটাই নিয়ম। কিন্তু অভিরূপ ভাইয়াকে তো বাঁচতে হবে তাই না?”
নোমান এবার অধৈর্য হয়ে উত্তরে বলল,
“কিন্তু কী করে উর্মিলা? আজকেই তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলে এলাম। উনি বাবাকে নিয়ে যেতে বলছেন কথা বলতে। বিয়ের তারিখ ঠিক করতে হবে।”
উর্মিলা নোমানকে আশ্বস্ত করে বলে,
“সেসব পরে হবে ক্ষণ। আমি মাকে বুঝিয়ে বলব। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয় এদেশে থাকলে উনি আরো ভেঙে পড়বেন। আপনি উনাকে নিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যান।”
“দেখি কী করা যায়। থ্যাংক ইউ, উর্মিলা। আমার পাশে থাকার জন্য।”
নোমানের কথায় মৃদু হাসে উর্মিলা। বড়ো শ্বাস নিয়ে বলে,
“থ্যাংক ইউ বলার কী আছে? আপনার সমস্যা মানে আমারও সমস্যা।”
“তাই তো! রাখছি এখন।”
নোমান কল কেটে দেয়। মনে প্রশ্ন জাগল, আসলে এখন কী করলে সব স্বাভাবিক হবে পুনরায়? তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু যার মুখে কিনা হাসি সবসময় লেগে থাকত তার এমন দশা মানতে পারছে না নোমান।
সোজা হয়ে বসে রয়েছে কোহিনূর। মুখে নেই কোনো কথা। গোধূলি বেলায় আকাশটা রঙ দেখাতে শুরু করেছে। তবে পুরো শহর এখনো ভিজে। কিছুটা বৃষ্টির জলে আবার কিছুটা প্রিয়জন হারানোর যাতনায়। কোহিনূরের হঠাৎ অনুভূত হলো তার কাঁধের দিকের শার্ট ভিজে যাচ্ছে। ঘাড় বাঁকিয়ে নিতেই নাকে এসে ঠেকল সুগন্ধি অগোছালো কৃষ্ণ বর্ণের কেশ। রাগিনী নাক টানতেই কোহিনূর বুঝল মেয়েটা অঝোরে নীরবে কাঁদছে। কোহিনূর তার একহাতে রাগিনীর চুলের ভেতর হাত বুলিয়ে আদুরে সুরে জিজ্ঞেস করে,
“এই বোকা মেয়ে! এখনো কাঁদছ কেন? আমি তো তোমাকে বললাম রূপার মৃ/ত্যুর কারণ। তুমি তার জন্য দায়ী নও।”
রাগিনী কোহিনূরের একহাতে জড়িয়ে কান্নারত সুরে জবাব দিলো,
“এতক্ষণ যে আমি শুধু আত্মগ্লানির জন্য কাঁদছিলাম সেটা নয়, কোহিনূর। রূপা বোন হয় আমার। আর সবচেয়ে বেশি মনে আ/ঘাত লাগছে এই কথা ভেবে যে আমার বাবা যে আমাকে এত যত্নে বড়ো করতে পেরেছে কিন্তু অন্য মেয়েটাকে ছুঁ/ড়ে ফেলে দিয়েছে। বাবা আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বাবা। কিন্তু অন্যদিকে আরেক মেয়ের কাছে তিনি সবচেয়ে নি/কৃষ্ট বাবা। শুধু নিকৃ/ষ্ট বাবা নন উনি দুনিয়ার সবচেয়ে জ/ঘন্য স্বামী।”
কোহিনূর মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে চাইল। তার আগে রাগিনী আবার বলতে লাগল,
“জানেন! রূপা বাঁচতে চেয়েছিল। ওকে যখন আমার বাড়িতে রেখেছিলাম গোপনে ও আমায় বলেছিল ও পালিয়ে এসেছে। ও বাঁচতে চায়। ওকে আমি নিজহাতে খাইয়েছিলাম সেদিন। তখন আমার অদ্ভুত ভালো লেগেছিল। বড়ো বোন হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল ওকে বাঁচানো। আমি ব্যর্থ হয়েছি।”
“তুমিই তো আমাকে বলেছিলে, মৃ/ত্যু শুধু বাহানা খোঁজে। তুমি যদি প্রাণপণ চেষ্টাও করতে ওকে বাঁচাতে পারতে না, রাগিনী।”
রাগিনী সোজা হয়ে বসল। একরাশ ঘৃণা নিয়ে বলল,
“সব ওই মানুষটার জন্য হয়েছে। যে কিনা সম্পর্কে আমার বাবা হয়। এতদিন যাবত মানুষটাকে ভালোবেসেছি, উনাকে দেখলেই শ্রদ্ধায় মন ভরে যেত। তবে এখন থেকে আজীবন উনাকে আমি ঘৃণা করে যাব। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত শুধু ঘৃণা পাবেন উনি।”
কোহিনূর এবার খানিকটা নড়েচড়ে বসল। গলা খাঁকারি দিয়ে গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল,
“সত্যি বলতে তোমার বাবা তোমাকে আসলেই অনেক ভালোবাসেন। তোমাকে নিয়েই উনার দুনিয়া। সব চিন্তা তোমায় ঘিরে। সেদিন রায়ান যখন উনাকে জেরা করছিল তখন উনি যখন মুখ খুলতে চাইছিলেন না রায়ান তোমার কথা উল্লেখ করতে গেলেই উনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন আর নির্দ্বিধায় সব স্বীকার করেছিলেন। আর যাই হোক তোমার প্রতি উনার ভালোবাসা শুদ্ধ।”
টাগিনী উসখুস করে শুকনো গলায় বলল,
“রূপা তাহলে সেই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলো কেন? শুদ্ধ ভালোবাসা না হোক নিজের বাবা হওয়ার দৌলতে সামান্য কর্তব্য তো পালন করতে পারত।”
“তা তো আমি জানি না রাগিনী।”
হাফ ছেড়ে উত্তর দিলো কোহিনূর। রাগিনীও মুখ ভার করে বলল,
“আমি আর উনার কথা শুনতে চাই না। বাদ দিন। আমি এই দিন ভুলে যেতে চাই। এই হৃদয় বিদারক মুহূর্তগুলো মনে রাখতে চাই না। একটু ভালো থাকতে চাই।”
রাগিনীর দিকে ফিরে তার গালে হাত আলতো করে স্পর্শ করে কোহিনূর। আশ্বাস দিয়ে বলে,
“তোমার সুখের কারণ আমি হতে চাই। তোমায় নিজের সবটা দিয়ে খুশি রাখতে চাই। সময় দাও আমাকে। আমি বিশ্বাস করি, সময় সবটা ঠিক করে দিতে পারে!”
রাগিনী অশ্রুসিক্ত নয়নে কোহিনূরের সেই হাতের তালুতে চুমু খেয়ে সম্মতি জানাল। তারপর কিছুটা বিচলিত হয়ে কোহিনূরের হাতে, বুকে স্পর্শ করে বলল,
“কোথায় কোথায় লেগেছিল আপনার? ব্যথা করছে?”
কোহিনূর মলিন হাসে। নিজের বুকে হাত রেখে বলে,
“সবচেয়ে বেশি ব্যথা লেগেছিল এখানে। যখন রূপার লা/শ তোমার ভেবেছিলাম। ওই মুহূর্ত এখনো মনে পড়লে দম আঁটকে আসে আমার। রূপার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব এই কারণে যে সে নিজের কথা চিন্তা না করেই আমার অর্ধাঙ্গিনীকে রক্ষা করেছে।”
কোহিনূরের বুকে সাবধানে মাথা রাখল রাগিনী। মনটা বিষণ্ণ তার। তাকাল গোধূলিতে অস্ত যাওয়া সূর্যের দিকে। মনে পড়ল অতীতের কিছু কথা। ফট করেই খানিকটা হেসে ফেলল সে। কোহিনূর শুধাল,
“কী ব্যাপার?”
“আমার মনে পড়ছে সেই গোধূলি বেলার কথা। আপনি এসেছিলেন। আমায় বন্দি করতে। আমি বন্দি হয়েছি। তবে আপনার বক্ষপিঞ্জরে।”
কোহিনূর ঠোঁট টিপে হেসে একহাতে রাগিনীর পৃষ্ঠদেশের এলোমেলো চুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“জেলে বন্দি করলে একসময় ঠিক ছাড় পেয়ে যেতে। কিন্তু সরি রাগের রানি। আমার হৃদয়কোণের অভ্যন্তর থেকে তুমি কখনোই ছাড় পাবে না।”
রাগিনী কিছু বলল না। চোখ বুঁজল নির্বিঘ্নে। গোধূলির আলোমাখা আকাশপটের পানে তাকিয়ে রইল কোহিনূর। উড়ে গেল কয়েক ঝাঁক পাখি। বইতে লাগল শীতল হাওয়া।
কাটল মৌসুম। স্রোতের ন্যায় বইতে লাগল সময়। বাস্তবতাকে মেনে নিতে বাধ্য হলো নির্বিশেষে। জায়গাটা চট্টগ্রাম। সৌন্দর্যের এক শহর। ঘুরতে পছন্দ করা মানুষদের কাছে বেশ পরিচিত জায়গা। পতেঙ্গা সমুদ্রের কথা শোনা যায় মুখে মুখে। আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দরের অবস্থানও এখানে। ব্যস্ত শহরের মানুষও ব্যস্ত। বিকেলের মুহূর্ত। যানবাহনে ছুটে চলেছে অনেক জনগণ। সেখানকার এক হাসপাতালে ভীষণ ভিড়। সবাই নিজেদের সমস্যা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। সেখানকার ৩০৪ নম্বর কক্ষের উপরে বড়ো বড়ো করে লেখা, ‘সাইকোলজিস্ট রাগিনী তাজরীন আহমেদ’।
সেখানকার সেই কক্ষের ভেতরে তড়িঘড়ি করে প্রবেশ করল ওয়ার্ডবয় দুলাল। কাঁচের টেবিলের সামনে গিয়ে বিনয়ের সাথে বলল,
‘ম্যাম, আজকের মতো সব পেশেন্ট দেখা শেষ। শুধু একজন বাকি আছেন। পাঠিয়ে দেব?”
সোজা হয়ে বসে চোখ তুলে তাকাল চেয়ারে বসে থাকা সাদা এপ্রনে আবৃত হাস্যোজ্জ্বল নারীটি। বলল,
“হ্যাঁ অবশ্যই। এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হবে?”
“না মানে ম্যাম ওই আরকি!”
ভ্রু কুঁচকে গেল রাগিনীর। দুলাল আমতা আমতা করছে। কানে নিজের অগোছালো চুল গুঁজে বলল,
“কী ওই আরকি? এনি প্রবলেম?”
দুলাল মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“না ম্যাম। আমি এখনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল দুলাল। রাগিনী গালে হাত দিয়ে দুলালের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“অদ্ভুত!”
দুলালের ব্যবহার মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজের কিছু পেশেন্টের ফাইল চেক করতে মনোযোগী হলো রাগিনী। কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর দরজা খোলার শব্দ কানে এলো তার। সেদিকে না তাকিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,
“প্লিজ সিট!”
ফাইলের পাতা উল্টাতে উল্টাতে রাগিনী অনুভূত করল লোকটি চেয়ারে এসে নীরবে বসেছে। রাগিনী প্রশ্ন করল,
“বলতে শুরু করুন আপনার সমস্যা।”
“আমার সমস্যা বড়োই গুরুতর সাইকোলজিস্ট ম্যাডাম! আপনি আমার দিকে না তাকালে আমি বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে পারছি না। প্লিজ লুক ইনটু মাই আইস, ম্যাডাম!”
চমকে তাকাল রাগিনী। সামনে থাকা মানুষটিকে দেখে চোখজোড়া সরু হয়ে এলো তার। চোখেমুখে ছড়াল উচ্ছ্বাস। তবুও রেগে যাওয়ার ভান করে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল,
“আপনি তো খুব… ”
কালো কোট পরিহিত কোহিনূর অসহায় মুখ করে মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আমার প্রবলেম শুনবেন না ম্যাডাম? আমি আমার মনের অসুখ থেকে মুক্তি চাই প্লিজ!”
রাগিনী এবার উৎসুক হয়ে জানতে চাইল,
“শুনি কী সেই অসুখ? কী সেই সমস্যা?”
“আমি একটা নারীর প্রতি প্রবল আসক্ত হয়ে পড়েছি। মন থেকে মস্তিষ্ক আর মস্তিষ্ক থেকে সারা শরীরে সেই নারীর প্রেমের শেকড় গজিয়েছে। মন চায় সারাদিন তাকে নিজের সংলগ্নে রেখে দিতে। কিন্তু তার এত কাজ থাকে যে সে আমাকে দেখার সময়ই পায় না। আমার থেকে নিজের কাজকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছে সে। এটা কিন্তু আমার সাথে অন্যায় হচ্ছে।”
রাগিনী কী প্রতিক্রিয়া করবে বুঝতে পারল না। কখনো রাগ হচ্ছে তো কখনো হাসি। হাসিটা চাপিয়ে রাগই দেখিয়ে সে বলল,
“মানেটা কী! আমি আপনাকে কম ভালোবাসছি? আপনি এবার বেশি বেশি বলে ফেলেছেন।”
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় রাগিনী। কোহিনূরের দিকে তেড়ে যেতেই কোহিনূর সাবধানে ধরে নিলো তাকে। জোর করে নিজের কোলের উপর বসিয়ে রাগিনীর পেটে আস্তে করে হাত রেখে বলল,
“আস্তে আস্তে! আমার ওয়াইফ আর বেবির ব্যথা লাগবে তো।”
“আপনি এমনিতেই আপনার ওয়াইফকে মানসিক ব্যথা দিয়েছেন। আপনাকে আমি কম ভালোবাসি?”
রাগিনীর অভিমানী কণ্ঠ। কোহিনূর রাগিনীর গাল টেনে বলল,
“তাকে একটু রাগাতে বলেছি কথাগুলো। তাছাড়া আমি তো বলেছিলাম আমি ব্যতীত আমার স্ত্রী যেসব কাজে মনোযোগী হবে সেই প্রত্যেকটা কাজকে আমি হিংসে করব।”
রাগিনী মুখ ফুলিয়ে কোহিনূরের গাল চেপে ধরে বলল,
“বাবা হতে যাচ্ছেন অফিসার কোহিনূর! তবুও একটুও বদলালেন না।”
“বুড়ো বয়সেও এই কোহিনূর একই রকম রয়ে যাবে। কাজ শেষ তোমার? বাড়ি যাই চলো। অনেকক্ষণ বসে থেকে কাজ করেছ। রেস্ট নিতে হবে তোমার। আমার আজ তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হয়েছে। তাই ভাবলাম নিতে চলে আসি।”
“এখনি বাসায় যেতে হবে?”
উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে রাগিনী। কোহিনূর মৃদু হেসে রাগিনীর কানের পিঠে চুল গুঁজে দিয়ে বলে,
“কেন যেতে মন চাইছে না?”
“না মানে অনেকদিন ধরে সমুদ্রের পাড়ে যাইনি। আজ যেতে মন চাইছে।”
ছোটোদের ন্যায় বায়না ধরে বলল রাগিনী। কোহিনূরের কণ্ঠ শক্ত হলো এবার। জোরালো গলায় বলল,
“নেভার এভার! সারাদিন ডিউটি করো। তোমার উপর পরিশ্রম যায়। বেবির উপর পরিশ্রম যায়। এখন বাড়িতে গিয়ে রেস্ট না নিলে দুর্বল হয়ে যাবে রাগিনী।”
রাগিনী তৎক্ষনাৎ উল্টো বুঝ দিয়ে বলল,
“শরীর ঠিক রাখার সাথে সাথে মন ঠিক রাখাও জরুরি। এখন যদি সমুদ্রে না যাই আমার মন খারাপ হবে। আমার মন খারাপ হলে বেবিও বিষণ্ণ হয়ে যাবে। এটা তো ঠিক না তাই না?”
কোহিনূর এবার রাগিনীর দুটো গাল চেপে ধরে কড়া সুরে বলল,
“ঠিক না হোক। তাও আমার সঙ্গে বাড়ি যাচ্ছো এখনি।”
রাগিনী বেশ কাঁদো কাঁদো দৃষ্টিতে তাকাল কোহিনূরের মন গলানোর জন্য। তবে লাভের লাভ কিছুই হলো না। কোহিনূর দাঁড়িয়ে রাগিনীকে চেয়ারে বসিয়ে পায়ের সাধারণ স্লিপার হাত দিয়ে খুলে দিয়ে বেশ যত্ন করে রাগিনীর জুতো পড়িয়ে দেয়। মাঝখানে বাঁধা দেয় রাগিনী।
“কেন এসব করেন আপনি? আমি নিজে জুতো পড়তে পারি তো!”
“তুমি বেশ ভালো করে জানো রাগের রানি আমি তোমার এসব কথা কর্ণপাত করব না। অযথা এসব বলে নিজের মুখের বুলি নষ্ট করো কেন?”
কথা শেষ হতে না হতেই রাগিনীর হাতটা ধরে বাহিরে নিয়ে এলো কোহিনূর। বেশ সাবধানে একধাপ একধাপ করে সিঁড়ি দিয়ে নামাতে লাগলে রাগিনী ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমি ঠিক আছি। এখনো একাই হাঁটতে পারি। আরো কয়েকমাস যাক। বেবি বড়ো হয়ে নেক তারপর হয়ত হাঁটতে কষ্ট হবে।”
“তখন না হয় কোলে করে নিয়ে হাঁটব। প্রবলেম আছে কোনো?”
কোহিনূরের নির্লিপ্তে সাবলীলভাবে বলা কথায় আশেপাশের নার্স সহ অনেকেই চোখ গোল গোল করে তাকালে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে রাগিনী। মনে মনে বলে, লোকটা জীবনেও বদলাবে না। বেশরমই রয়ে যাবে!
সময় বয়ে গিয়েছে প্রায় আড়াই বছর। অনেক কিছু পাল্টে গিয়েছে এই সময়ে। পরিবর্তন ঘটেছে জায়গারও। কোহিনূর চট্টগ্রামে ট্রান্সফার নিয়েছে রাগিনীর সঙ্গে রাগিনীর পড়ালেখার জন্য। এখন রাগিনী প্র্যাক্টিস করার লাইসেন্স পেয়েছে। সে নিজেও নিজের কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকে। তাদের ছোট্ট টোনাটুনির সংসারে এক নতুন সদস্যের আগমনও ঘটতে চলেছে। তিন মাসের গর্ভবতী রাগিনী। প্রথম মা-বাবা হওয়ার আকাশসম উচ্ছ্বাস রয়েছে কোহিনূর আর রাগিনীর মাঝে। রয়েছে এক পৃথিবী আনন্দ! নয়নতাঁরার স্টাডি শেষ করার জন্য লন্ডন পাঠিয়েছে কোহিনূর। তবে তার আগে মিসেস. রমিলা রায়ানের সঙ্গে নয়নের বিয়ে ঠিক করেও রেখেছেন। নয়ন দেশে ফিরলে রায়ান আর নয়নতাঁরার বিয়ে সম্পন্ন হবে।
সকালটা আজকে অন্যরকম। জায়গাটা দার্জিলিং। পাহাড়ি রাস্তা। পাহাড়ের গা ঘেঁষে রিসোর্ট। আঁকাবাঁকা পথ। কুয়াশায় ঘোলাটে পরিবেশ। ভরাট চা বাগান। সঙ্গে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য। আর কী চাই! নানানরকম মুগ্ধকর প্রকৃতি প্রদত্ত সুর যেন কর্ণকুহরে ভেসে আসে হরহামেশাই। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ছোটো ছোটো ঘরবাড়ি দেখে যেন মনে হয় প্রকৃতির আরেক মাধুর্য। সবসময় সচল ঝর্ণা মনকে নাড়িয়ে তোলে। সেখানকারই এক নামি-দামি রিসোর্টে অবস্থান করছে এখনকার টিনএজারদের এবং খ্যাতিমান গায়ক। গানেরই কিছু শুটিং চলছে তার। সেকারণেই মূলত এখানে আসা। সকাল সকাল খোলা বারান্দায় পায়ে পা তুলে বেতের চেয়ারে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘার সুন্দরতম দৃশ্য দেখতে দেখতে নিজের নম্র ঠোঁট তুলসীপাতার চায়ের কাপে ছোঁয়ায় অভিরূপ। নিজের অবিন্যস্ত ভাবে কপালে হেলে থাকা চুলগুলো উপরে তুলে বাহিরের দৃশ্যে মনোনিবেশ করে সে। তার ফোনটা বেজে ওঠে নিজ ছন্দে। কিছুক্ষণ ফোনটার দিকে আপনমনে চেয়ে থাকতে থাকতে কল কেটে গেল কিয়ৎক্ষণেই। আবারও বাজল রিংটোন। শব্দহীন হেঁসে ফোনটা তুলে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে চিল্লানি ভেসে আসতেই ফোনটা কান থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে সরিয়ে নিলো সে।
“হোয়াটস ইউর প্রবলেম অভি? সাথে সাথে কল পিক আপ করতে কী হয় তোর?”
ওপাশের আওয়াজ কমতেই কানটার কাছে ফোন ধরে অভিরূপ প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বলল,
“একবারেই কল পিকআপ করলে তোর এই ক্যাঁচক্যাঁচি গলাটা শুনতে পেতাম না। আর তুই জানিস, তোকে টেনশনে দেখতে আমি কতো ভালোবাসি!”
নোমান রাগ নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ জানি আমাকে টেনশন না দিলে তোর একবেলার খাবার হজম হবে না। ওখানকার ওয়েদার কেমন?”
“ইটস অওসাম। ইয়াহাপার ঠান্ডে ঠান্ডে পানি ছে নাহানা চাহিয়ে!”
“যেটা বলতে তোকে কল করেছিলাম সেটা শোন!”
অভিরূপ মনোযোগী হয়ে বলল,
“ইয়েস স্যার, বলিয়ে!”
নোমান কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“কাল কোহিনূরের বোনের দেশে ফেরার কথা। সো মি. রায়ান কিছু এরেঞ্জ করেছে। আমাদের ইনভাইটেশনও দিয়েছে। তোকে কল করেছিল ধরিস নি তুই।”
“ওহ ইয়েস! শুটিং বিজি ছিলাম। পরে দেখলাম কল করেছিল।”
দায়সারা হয়ে জবাবে বলল অভিরূপ। তৎক্ষনাৎ নোমান আগুনশিখার ন্যায় জ্বলে উঠে বলল,
“কলব্যাক করতেও পারিস নি? তোর কেয়ারলেস ভাব কখনো যাবে না?”
“মনে হয় না!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল নোমান। সে জানে এই ছেলেকে কোনোমতেই সে শুধরাতে পারবে না। তাই চেষ্টাও করতে চাইছে না। অপরদিকে ঠোঁট কামড়ে হাসি নিবারণ করতে গিয়ে শব্দ করে হাসে নোমানের পরিস্থিতি উপলব্ধি করে। নোমান তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলে,
“তুই কি যেতে চাস ওখানে?”
অভিরূপ নীরব থাকে। স্মরণে আসে অতীতের কিছু কথা। মনে নাড়া দেয় মাটিচাপা দিয়ে রাখা কিছু যাতনা। নোমান তার উত্তর না পেয়ে বলে,
“তোকে ছাড়া আমার ওখানে গিয়ে ভালো লাগবে না। সো আমি তোকে নিতে আসছি আজই।”
অভিরূপ তাড়াহুড়ো করে বলল,
“এই না না। তুই তোর বউকে ছেড়ে আমাকে নিতে আসবি! মাথা ঠিকঠাক আছে তো তোর? বিয়ে করেছিস বউয়ের দিকে নজর দে। নয়ত তোর বউ আমাকে সতিন ভেবে বসবে। আমি কিন্তু এসব চাই না।”
“আরে না। উর্মিলাই বলছিল তোকে নিতে যাওয়ার কথা।”
অভিরূপ গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,
“যাই বলুক। আমি ওসব রিস্ক নিতে পারব না। আমার এত কেয়ার নেওয়ায় তোর বউ আমাদের ইয়ে না ভেবে বসে!”
নোমান ভ্রু কুঁচকাল। ব্যগ্র হয়ে বলে উঠল,
“হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ইয়ে?”
অভিরূপ ইতস্ততবোধ করে বলল,
“ইয়ে মানে গে…”
নোমান বিস্ফো/রিত কণ্ঠে বলল,
“হোয়াট দ্যা…! রাখ তুই ফোন রাখ।”
নোমান আর দেরিই করল না। কেটে দিলো কল। অতঃপর বড়ো একটা শ্বাস নিলো সে। কাপড় গোছাতে গোছাতে উর্মিলা নোমানের পাশে এসে নরম কণ্ঠে শুধাল,
“কী হয়েছে? রেগে গেলেন কেন ওভাবে!”
নোমান নিজেকে সংযত করে বলল,
“তুমি জানো তো আমাকে রাগাতে কতটা পছন্দ করে সে। কীসব বলছে জানো?”
“কী বলছে?”
“বলছে যে আমি ওর বেশি কেয়ার করলে নাকি তুমি আমাদের ইয়ে ভাববে।”
উর্মিলার ভ্রুদ্বয় সংকুচিত হলো। নিজের চিকন ফ্রেমের চশমাটা ঠিকঠাক করে চোখে লাগিয়ে বলল,
“ইয়ে মানে?”
নোমান গলা খাঁকারি দিয়ে সোজা হয়ে বসল। বলতে অস্বস্তি লাগছে তার।
“আরে ইয়ে!”
“কী ইয়ে?”
নোমানের রাগ লাগল এবার। ঠোঁট ভিজিয়ে জোর গলায় বলল,
“তুমি নাকি আমাদের গে ভাববে!”
উর্মিলা থতমত খেল। বিষম উঠে গেল তার। কিছুক্ষণ পিটপিট করে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে চলে গেল সে। নোমান বসে রইল গালে হাত দিয়ে। কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর বেড থেকে নেমে বারান্দায় গেল নোমান। উর্মিলা তখন কাপড় মেলে দিতে ব্যস্ত। নোমানকে দেখে উর্মিলা আনমনে বলল,
“তাহলে অভিরূপ ভাইয়া ভালোই আছেন তাই না? আগের মতো প্রাণোচ্ছল হয়েছেন।”
নোমান কিছুটা ভেবে উত্তর দিলো,
“আমার সেটা মনে হয় না উর্মিলা। সে যেটা দেখাচ্ছে ভেতরে সে ততটাই বিধ্বস্ত হয়ে আছে। সে ভালো আছে রূপার জন্য। রূপা ওকে ভালো থাকতে তাই সে চেষ্টা করছে ভালো থাকার।”
“তাও ভাগ্য সহায় ছিল। সেকারণে উনার মেন্টাল কন্ডিশন নরমাল হয়েছে। তাও পুরো ছয়মাস ট্রিটমেন্ট করার পর।”
নোমানের খারাপ লাগে ভীষণ। বুকটা ভার হয়ে আসে। আফসোস করে বলে,
“যদি ওর মস্তিষ্ক থেকে সেসব স্মৃতি মুছে ফেলা যেত তাহলে সবচেয়ে বেশি খুশি আমি হতাম।”
উর্মিলা কাপড় বালতিতে রেখে দিয়ে নোমানের সংলগ্নে এসে স্থির হলো। নোমানের বাহুতে হাত রেখে মলিন সুরে বলল,
“যেটা সম্ভব নয় সেটা ভাবতে নেই। আফসোস আরো দৃঢ় হয়।”
নোমান আর একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। দুহাতে জড়িয়ে তার ভরসার মানুষটার কাঁধে নিজের থুঁতনি ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। উর্মিলাও নির্বিঘ্নে তার প্রিয় মানুষটির পিঠে হাত বুলিয়ে শান্তনা দিতে লাগল।
চলবে…