যখন আমি থাকবোনা পর্ব ৭

0
1007

#যখন_আমি_থাকবোনা
#পর্ব_৭
#লেখক_দিগন্ত
মুক্তি বাকের চৌধুরীকে বলে,
-“আর কত নাটক করবেন আপনি? আমি জানি আপনিই মতিয়া মান্নানের খু*নি। আপনি ছাড়া এই কাজ কেউ করতে পারে না। আপনি, আমার বাবা আব্দুল মান্নান, আব্দুল্লাহ হক আর মিরাজ হোসেন মিলে আমার মাকে মে*রে ফেলেছিলেন। আপনাদের শাস্তি দেওয়াই আমার মূল উদ্দ্যেশ্য। যেটা আমি অবশ্যই পূরণ করব।”

বাকের মুক্তির উদ্দ্যেশ্যে বলে,
-“আমি জানি তুমি মতিয়ার মেয়ে নেহা।”

মুক্তি অবাক হয়ে যায় কথাটা শুনে। বাকের চৌধুরী কিভাবে এই কথাটা জানল? তার তো এটা জানার কথা না।

মুক্তিকে গভীর চিন্তায় মগ্ন দেখে বাকের চৌধুরী বলে,
-“তুমি আগে আমার কাছে অতীতের ব্যাপারে শোন। তাহলেই সবকিছু বুঝলাম পারবে।”

অতীত~~~
মুশফিক রহিম তার একমাত্র মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু করেন। কিন্তু তিনি তার মেয়ের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। তাই তো মতিয়াকে জিজ্ঞাসা করে,
-“তোমার কি কাউকে পছন্দ? আমি তোমার বিয়ের কথা ভাবছি।”

মতিয়া তার বাবার কাছে কিছু লুকায় না। ভার্সিটির মাঠে সেইদিন যেই ছেলেকে সে ভালোবেসেছিল তার নাম বলে দেয়। মতিয়া বলে,
-“হ্যাঁ আব্দুল মান্নান নামের একজনকে। সে আমাদের কলেজ লাগোয়া ভার্সিটিতেই পড়ে।”

মুশফিক রহিম খুব খুশি হয়ে যায় মতিয়ার কথা শুনে। বলে,
-“ঐ ভার্সিটিতে যেই আব্দুল মান্নান আছে সে তো আমার বন্ধু আসাদ মান্নানের ছেলে। বাহ্ বেশ ভালো আমি তাহলে বিয়ের কথাবার্তা শুরু করে দেই। তুমি এখন ভেতরে যাও।”

মতিয়া খুশিমনে নিজের রুমের ভেতরে যায়। পরের দিন কলেজে যাওয়ার পথে আবার নিজের পছন্দের মানুষটাকে দেখতে পায় মতিয়া। দূর থেকে বাকের চৌধুরীও তাকে দেখে। আসলে মতিয়া যাকে পছন্দ করেছিল সে বাকের চৌধুরীই। বাকের চৌধুরী ও আব্দুল মান্নান একে অপরের খুব ভালো বন্ধু। যাকে বলে গলায় গলায় ভাব। সেদিন অনুষ্ঠানে একে অপরের ব্যাজ পরিবর্তন করে নিয়েছিল তারা। যার কারণে মতিয়া বাকের চৌধুরীকে দেখে ভেবেছে সে আব্দুল মান্নান।

বাকের নিজের চুলের স্টাইল ঠিক করে মতিয়ার সামনে আসতে চায়। কিন্তু তার আগেই মতিয়া কলেজে ঢুকে যায়। কলেজে বাইরের লোকদের প্রবেশের অনুমতি ছিল না তাই বাকের কিছু করতেও পারে না। অপেক্ষা করতে থাকে ছুটি হওয়ার।

কিন্তু কিছু জরুরি কাজে বাকেরকে চলে যেতে হয়। টানা এক সপ্তাহ কাজের জন্য বাইরে থাকতে হয়েছিল তাকে। এই এক সপ্তাহে রাজনৈতিক দলের হয়ে অনেক কাজ করে সে নেতাদের নজরে আসে। বিশেষ করে মুশফিক রহিমের নজরে আসে সে।

মুশফিক রহিম এরমধ্যে তার বন্ধু আসাদ মান্নানের সাথে মতিয়া আব্দুলের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলে নিয়েছি। এক মাসের মধ্যে বিয়ের কথা ঠিক হয়। তবে আপাতত কথাটা গোপন রাখা হয়।

আসাদ মান্নান যেন হাতে চাঁদ পেয়ে যান। অবশেষে তার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। মুশফিক রহিম বর্তমানে দলের প্রধান নেতা। অনেক সম্পত্তি আর ক্ষমতা তার। তার মেয়েকে ছেলের বউ বানাতে পারলে সোনায় সোহাগা।
__________
বাকের কাজ সেরে ফিরে এসে আবার মতিয়ার সাথে দেখা করে। এবার ফুল দিয়ে তাকে নিজের মনের কথাও বলে। সাথে এও বলে,
-“আমি আজ তোমার কাছে উত্তর চাইব না। কাল দুপুরে এই সময়ে আমাকে উত্তর দেবে।”

পরেরদিন যথাসময়ে মতিয়া এসে জানায় সেও বাকেরকে ভালোবাসে। বাকের খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়৷ মতিয়া লজ্জায় চলে যায়। তখনো অব্দি মতিয়া জানতে পারে না বাকেরের আসল নাম। এরপর রোজই তাদের দেখা সাক্ষাৎ কথাবার্তা হতো।কিন্তু মতিয়া বাকেরের নাম জানতে চায়না আর বাকেরও নিজের নাম বলে না। তাই তাদের মধ্যে সবকিছু ধোঁয়াশা থেকে যায়।

এরমধ্যে একদিন মুশফিক রহিম সবার সামনে নিজের মেয়ের সাথে আব্দুল মান্নানের বিয়ের ঘোষণা দেন। খবরটা রাজনৈতিক মঞ্চে বেশ সাড়া ফেলে, পেপার পত্রিকার হেড লাইনের প্রধান খবরে পরিণত হয়।

বিয়ের কথা প্রকাশ্যে আসার পর মতিয়াকে আর বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হয়না। মতিয়াও খুশি ছিল কারণ সে জানত মুশফিক রহিম তার সাথে তার ভালোবাসার মানুষটার বিয়েই ঠিক করেছে। অন্যদিকে বাকের যখন সংবাদটা পায় তখন সে কষ্টে,দুঃখে পাগলপ্রায় হয়ে যায়। মতিয়ার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে কারণ তার বাড়ি থেকে বের হওয়া নিষেধ। দুইদিন পরই তার বিয়ে।

বাকেরের একবার মনে হলো মুশফিক রহিমের সাথে কথা বলবে। কিন্তু সেটাও সম্ভব ছিল না। কারণ মুশফিক রহিমের সাথে এত সহজে দেখা করা যায়না। তার সাথে দেখা করার জন্য অনেক আগে থেকে তার সেক্রেটারির সাথে কথা বলতে হয়।

শেষে অনেক কষ্ট করে মতিয়ার বিয়ের একদিন আগে গোপনে তার রুমে যায় বাকের। রুমে গিয়ে মতিয়াকে নিয়ে পালিয়ে আসতে চায়। এই প্রথম মতিয়া তার ভুলটা আবিস্কার করে। সে যাকে আব্দুল মান্নান ভাবত সে আসলে বাকের। মতিয়ার চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে। নিজের করা ভুলের জন্য আফসোস হয়। কিন্তু নিজের বাবার মান সম্মানের কথা চিন্তা করে মতিয়া বাকেরকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়।

বাকের এবার আব্দুল মান্নানের কাছে যায়। যেহেতু আব্দুল মান্নান তার বন্ধু তাই তাকে বিশ্বাস করে সব কথা বলে। আব্দুল মান্নান সব শুনে বাকেরকে আশ্বাস দেয় যে সে সব ঠিক করে দেবে।

আব্দুল মান্নানের সাথে দেখা করে ফেরার পথে বাকেরের একটি এক্সিডেন্ট হয়। তারপর বাকেরের আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর বাকের জানতে পারে এক সপ্তাহ ধরে সে অসুস্থ ছিল। এরমধ্যে আব্দুল মান্নানের সাথে মতিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। সবটা শুনে অনেক কষ্ট হয় তার। কিন্তু বাকের নিয়তি মনে করে সবকিছু মেনে নেয়।

এসব ঘটনার পর রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বাকের। ধীরে ধীরে রাজনীতিতে নিজের নাম বৃদ্ধি করে। মুশফিক রহিমের সবথেকে ভরসার পাত্র হয়ে ওঠেন।

মুশফিক রহিম আচমকা একদিন স্টোক করেন। তার কেন জানি মনে হয় তার হাতে আর বেশি সময় নেই। নিজের মেয়েকে তো বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন তাই তার একমাত্র চিন্তা নিজের বোনের মেয়ে আলেয়াকে নিয়ে। আলেয়াকে সুপাত্রে দান করতে পারলেই তার শান্তি৷

তাই মুশফিক রহিম একদিন আলেয়া ও বাকেরকে একসাথে ডেকে বলে,
-“আমি বুঝতে পারছি আমার হাতে আর বেশি সমন নেই৷ আমার একটা শেষ ইচ্ছে আছে, আলেয়াকে বাকেরের সাথে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিতে ম*রতে চাই।”

আলেয়া ও বাকের দুজনেই হতবাক হয়। আলেয়া কখনো নিজের মামাকে তার আর আব্দুল্লাহর ব্যাপারে বলেনি। এবার বাকের বলতে চাইলেও তাকে বাধা দিয়ে বলে,
-“মামার কাছে আমি ঋণী। তিনি নিজের মেয়ের মতোই আমাকে মানুষ করেছেন। তাই তার এই শেষ ইচ্ছে আমি পূরণ করতে চাই।”

এভাবে আরেকটি ভালোবাসা ধ্বংস হয়ে যায়। আব্দুল্লাহকে কষ্ট দিয়ে তার সামনেই তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু ও প্রেমিকার বিয়ে হয়।

এর কিছুদিন পরেই মুশফিক রহিম মারা যান।
____________
সময় বহমান, দেখতে দেখতে ১২ বছর অতিবাহিত হয়৷ বাকের ও আলেয়ার কোলজুড়ে তখন ১০ বছর বয়সী আশরাফ ও ৮ বছর বয়সী বিপ্লব।

অন্যদিকে, আব্দুল মান্নান ও মতিয়ার দুই মেয়ে স্নেহা ও নেহা। যাদের বয়স যথাক্রমে ৭ ও ৫। দুই পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকায় তাদের বাচ্চাদের মধ্যেও বেশ ভাব। বিশেষ করে নেহা ও বিপ্লবের একে অপরের সাথে খুব ভাব। সবসময় তারা বর বউ খেলে।

সবকিছু আপাতদৃষ্টিতে সুন্দর মনে হলেও ভিতরের রহস্যগুলো ধীরে ধীরগতির সামনে আসতে থাকে। মতিয়া আবিষ্কার করে কিছু তিক্ত সত্য। তার বাবা স্বাভাবিক ভাবে মারা যায়নি। তাকে মে*রে ফেলা হয়েছিল। এর পেছনে কার কার হাত আছে এটারই অনুসন্ধানে নামে সে।

এই অনুসন্ধানে যেটা বেরিয়ে আসে সেটা আরো বেশি ভয়ানক ছিল। মতিয়া জানতে পারে তার বাবার মৃত্যুর পেছনে তার স্বামী আব্দুল মান্নানের হাত রয়েছে। ক্ষমতার লোভে আব্দুল মান্নান সহ তার বন্ধু মিরাজ হোসেন এবং আব্দুল্লাহ হক রয়েছে এর পেছনে। আব্দুল্লাহ মূলত আলেয়াকে হারানোর ক্ষোভ থেকেই কাজটা করেছিল।

মতিয়া সবটা জানার পর প্রমাণ সংগ্রহে নেমে পড়ে। একসময় সব প্রমাণও সংগ্রহ করে ফেলে। কিন্তু আব্দুল মান্নান জেনে যায় সবকিছু। তিনি মতিয়াকে মে-রে ফেলার জন্য তার পেছনে লোক লাগায়। স্নেহা স্কুলে ছিল তাই মতিয়া তার ছোট মেয়ে নেহাকে নিয়ে পালিয়ে আসে বাড়ি থেকে।

এই পরিস্থিতিতে ভরসা করার মতো একজনকেই পায় মতিয়া। আর সে হলো বাকের চৌধুরী। তাই তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তার ফোনে কল করে। অন্যদিকে বাকেরের মন মেজাজও ভালো নেই। আজ সে অনেক বড় একটা সত্য জানতে পেরেছে। যে ১২ বছর আগে আব্দুল মান্নান ও মতিয়ার বিয়ের আগে তাদের যে এক্সিডেন্ট হয়েছিল তার পেছনে আব্দুল মান্নানের বাবা আসাদ মান্নানের হাত ছিল। কয়েক বছর আগে লোকটা মা*রা গেছে। তাই আজ কিছু করতে পারছে না। তা নাহলে ঠিকই তার মুখোমুখি হয়ে প্রশ্ন কর‍ত।

অন্যদিকে আব্দুল মান্নান তার বন্ধু মিরাজ হোসেনকে বলে,
-“মতিয়াকে মে*রে ফেলবি কিন্তু আমার মেয়ে নেহার যেন কোন ক্ষতি না হয়।”

মিরাজ তাই করে। মতিয়া সবেমাত্র বাকেরকে ফোন করে। বাকের ফোন রিসিভ করতেই বলে,
-“তোমাকে অনেক বড় একটা সত্য..”

কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগে মিরাজ এসে ফোনটা কেড়ে নিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে। নেহাকে টেনে হিচড়ে বের করে নিয়ে তারপর মতিয়াকে গাড়িতে লক করে দেয়। কিছুক্ষণ পর একটি ট্রাক এসে,গাড়িটিকে ধাক্কা দেয়।

নেহা চিৎকার করে বলছিল,
-“আমি সবকিছু জানি। আব্বু, মিরাজ আঙ্কেল মিলে নানাকে মে*রে ফেলেছে। আম্মু আমায় বলেছে। এখন আম্মুকেই মা*রা হলো।”

মিরাজ নেহার মুখ চেপে ধরে আব্দুল মান্নানকে সব জানায়। আব্দুল মান্নান বলে,
-“আমার মেয়ের কোন ক্ষতি করবে না। প্রয়োজনে ওকে দূরে পাঠিয়ে দাও, আটকে রাখো তাও ওর যেন কোন ক্ষতি না হয়।”

মিরাজ হোসেন তাই করে। প্রথমে নেহাকে আটকে করে পরে সুযোগ বুঝে নিজের বোনের কাছে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়। এসব কিছুর বিনিময়ে আব্দুল মান্নানকে ভয় দেখিয়ে একসময় প্রাইম মিনিস্টার হয়ে যায়।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here