মনমোহিণী পর্ব ৫

0
672

#মনমোহিণী
#Part_05
#Writer_NOVA

‘তন্বী, নদীতে গোসল করতে যাবি?’

সবেমাত্র তন্বী একটা আস্ত রসগোল্লায় মুখভর্তি করেছিলো। আমার কথা শুনে চোখ দুটো বড় বড় করে ফেললো।হাত দিয়ে থামিয়ে দ্রুত মুখে থাকা মিষ্টি চিবিয়ে গোলার চেষ্টা করলো। আমি ওকে থামিয়ে বললাম,

‘আস্তে আস্তে, ম’রিস না।’

খাওয়া শেষ করে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
‘ভাইয়া জানতে পারলে দুটোকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিবে।’

‘জানতে পারলে তো। ভাইয়া আজ বাসায় নেই। তুই আমি কেউ না বললেই তো হলো।’

‘আম্মু বলে দিবে।’

‘খালামণির চিন্তা করিস না। তাকে আমি ম্যানেজ করে নিবো।তুই যাবি কিনা তাই বল।’

‘নদীতে গোসল করতে ভাইয়া মানা করছে।’

‘কেন? কুমিরে টেনে নিয়ে যাবে? চিন্তা করিস না কুমিরের সাথে যুদ্ধ করে তোকে নিয়ে আসবো।’

ভাব নিয়ে কথাটা বলতেই তন্বী ভাবের মধ্যে এক গামলা জল ঢেলে বললো,

‘ডায়লগ মেরো না। নদীতে এখন অনেক স্রোত।আমাদের গ্রামের একজনকে স্রোতে টেনে নিয়ে গেছে।’

‘আরে কিছু হবে না চল তো।’

‘তুমি আম্মুকে রাজী করাও। তাহলে যাবো।’

তন্বী পণ করে বসে রইলো খালামণি অনুমতি না দিলে সে কিছুতেই যাবে না। আমারো তাই বাধ্য হয়ে খালামণির কাছে যেতে হলো। খালামণি উবু হয়ে বড় রুমের খাটের নিচ ঝাড়ু দিচ্ছে। আমি গিয়ে হাসফাস করতে লাগলাম। আসলে কি করে কথা শুরু করবো বুঝতে পারছি না।

‘এভাবে দাড়িয়ে আছিস যে কিছু বলবি?’

‘হু!’

‘কি?’

‘নদীতে গোসল করতে যাবো।’

‘কোন নদীতে গোসল করতে যাওয়া-যায়ি নাই।’

‘প্লিজ খালামণি।’

‘মাস দুই আগে এক লোক নদীতে ডুবে মারা গেছে।’

‘যার মৃত্যু যেভাবে লেখা আছে সে তো সেভাবেই মারা যাবে।’

‘তানভীর জানতে পারলে আমাকে বকবে।’

‘ভাইয়াকে তুমি না বললে তো জানতে পারবে না।’

‘নদীতে গোসল করতে হবে না। ডিপকলে গোসল কর।খোলামেলা জায়গা। রাস্তা দিয়ে কত মানুষ যাওয়া-আসা করে।লোকদের সামনে ঘরের মেয়েরা সেখানে গোসল করবে। এটা তানভীরের পছন্দ না। তাই তানভীর আমাদের কড়াকড়ি নিষেধ করে দিছে।নদীতে গোসল করা যাবে না।’

‘আমরা আড়ালের দিকে থাকবো। কারো সামনে গোসল করবো এতোটা পাগল হয়নি।’

‘না করছি মানে নাই। কথা বাড়াস না।’

আমি ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ খালামণি রাজী হচ্ছে না। রাজী না হওয়ার একটাই কারণ তায়াং ভাইয়া। সে যদি জানতে পারে তাহলে বাসায় কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিবে। প্রায় মিনিট দশ ঘ্যান ঘ্যান করে খালামণিকে রাজী করে ফেললাম। খালামণি কড়া গলায় বলে দিলো,

‘যা খুশি কর। কোন অঘটন ঘটলে আমাকে দোষারোপ করতে পারবি না।’

খালামণির সম্মতি পেয়ে নাচতে নাচতে তন্বীকে গিয়ে খবর দিলাম। এরপর জামা-কাপড়, শ্যাম্পু, সাবান নিয়ে নদীতে গোসল করতে চলে গেলাম।

পাক্কা এক ঘন্টা পর গোসল সেরে বাসায় ফিরলাম।ইচ্ছে মতো দুই বোন ডুবিয়ে চোখ, মুখ লাল করে ফেলেছি। নদীর পাশের এক বাড়িতে জামা-কাপড় পাল্টিয়েছি। বাসায় এসে হাঁচি দিতে দিতে অবস্থা খারাপ। খালামণি রুমে এসে দুই বোনকে শাসাতে লাগলো,

‘ঠান্ডাটা শুধু একবার লাগুক। তারপর নদীতে ডুবানো ছুটাবোনি।’

আমি দাঁত বের করে হাসি দিয়ে খালামণির মন জয় করতে চেয়েছিলাম। তার আগেই আবার হাঁচি শুরু।

‘তানভীর জানতে পারলে আমাকেসহো বকবে।’

তন্বী খালামণিকে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘প্লিজ আম্মু তুমি কিছু বলো না ভাইয়াকে।’

আমি চুলগুলো ঝাড়া মেরে ভাব নিয়ে বললাম,
‘এতটুকু পুঁচকে একটা ছেলেকে তোমরা যে কেনো এতো ভয় পাও তাই বুঝি না।’

তায়াং ভাইয়ার নাম তানভীর রহমান। সে গুণে গুণে আমার থেকে সাত বছরের বড়। তন্বী আমার থেকে দেড় বছরের ছোট।ভাইয়ার তায়াং নামের একটা ইতিহাস আছে।ছোট বেলায় যখন কেউ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করতো তোমার নাম কি? তখন ভাইয়া আধো আধো সুরে বলতো তায়ান।এই নামটা সে কোথা থেকে পেয়েছে কে জানে! তানভীর নামে ডাকলে সে নাকি রেগে যেতো। তাই তাকে তায়ান নামে ডাকতে হতো।সেই তায়ান থেকে উৎপত্তি তায়াং। যার অর্থ আসলে কি আমরা কেউ জানি না। তায়াং নামে ডাকতে ডাকতে এটাই ডাকনাম হয়ে গেছে। খালামণি, খালু, আমার আম্মু, মামা-মামী অনেকে তানভীর নামে ডাকে।

দুপুরের একটু পরে তায়াং ভাইয়া তার বন্ধুদের নিয়ে ফিরলো। সকাল সকাল তিন বন্ধু মিলে রায়হান ভাইয়ার শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিলো। আজ রায়হান ভাইয়ার শ্বশুর বাড়িতে জামাই বাজার। গতকাল রাত থেকে রায়হান ভাইয়া কল দিয়ে ওদের তিনজনকে অস্থির বানিয়ে ফেলেছে। আসলে বেচারা জীবনের প্রথম বিয়ে করেছে তো তাই কোন বিষয় ধারণা নেই। সকল ঝামেলা থেকে বাঁচতে বন্ধুদেরকে জরুরি তলব করেছে। আর সে না থাকার সুযোগ আমরা দুই বোন কাজে লাগিয়েছি।

নাগ বারান্দায় বসে কানে ইয়ারফোন গুঁজে পা দুলিয়ে দুলিয়ে গান শুনছিলাম। ভাইয়া মাথায় ঠাস করে এক থাপ্পড় মেরে বললো,

‘কিরে শাঁকচুন্নি কি করিস?এখানে পা না দুলিয়ে শেওড়া গাছে যা।’

মাথায় থাপ্পড় দিলে এমনি রাগ উঠে যায়। সেখানে আবার বলছে শাঁকচুন্নি। মোটামুটি আমার মেজাজ এখন তুঙ্গে। ওর পেটের মধ্যে এক ঘুষি বসিয়ে দিলাম।
ভাইয়া চেচিয়ে উঠলো,

‘ওরে বাবা রে!’

‘কি কেমন লাগে?’

‘একটু আগে খেয়ে আসছি।’

‘কমও তো খাসনি। পেটটা প্রেগন্যান্ট মহিলাদের মতো হয়ে আছে।’

ভাইয়া কথা না বাড়িয়ে আমার পাশে বসলো। দরজা দিয়ে ভেতরের দিকে তাকিয়ে গলা ফাটিয়ে ইমরান, শাহেদ ভাইয়া ও এনাজকে ডাকলো। এনাজ ভেতর থেকে উত্তর দিলো,

‘আসছি।’

মিনিটের মধ্যে সে হাজির। তায়াং ভাইয়া এনাজকে জিজ্ঞেস করলো,

‘ইমরান,শাহেদ কই?’

‘ওরা শুয়ে আছে। আসবে না।’

ভেতর দিকে একবার উঁকি দিয়ে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘শাহেদ ভাইয়া আসছে?’

‘হুম।’

এনাজ আমার বরাবরি অপর পাশের বেদীতে বসলো। আমি তাদের দিকে নজর না দিয়ে আশেপাশে চোখ বুলাতে লাগলাম। উঠে যেতে নিলে ভাইয়া ধমকে বলে,

‘চুপ করে বসে থাক।’

আমিও হুকুম মোতাবেক চুপ করে বসে রইলাম। তায়াং ভাইয়া বললো,

‘তোরা কথা বল আমি আসছি।’

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ভাইয়া হনহন করে ভেতরে চলে গেলো। আমি ঠিক বুঝলাম না কাহিনি কি! ভাইয়া কি আমাদের স্পেস দিয়ে গেলো। কে জানে! তবে এমনটাই মনে হচ্ছে আমার। আমি এনাজের দিকে তাকাতেই দেখলাম সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকেই লক্ষ্য করছে। মনে মনে বললাম,

‘উনি এভাবে তাকাচ্ছে কেন? মানুষখেকো নাকি? আমাকে কি খেয়ে টেয়ে ফেলবে?’

এভাবে চুপ করে থাকাটা বেমানান দেখায়। তাই আমি কথা বলার উপায় খুজছিলাম। একসময় পেয়ে গেলাম।

‘এনাজ ভাইয়া, কেমন হলো বন্ধুর জামাই বাজারের ভুড়িভোজ?’

আমার কথা শুনে সে এমন ভাবে তাকালো মনে হলো এখুনি আমায় চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। এই ছেলে আসলেই মানুষখেকো৷ আমি আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কি হয়েছে ভাইয়া?’

উনি অনেকটা ধমকে উঠলেন,
‘কাকে ভাইয়া বলছো?’

‘আপনি ছাড়া তো এখানে কেউ নেই।’

‘আমাকে ভাইয়া বলবা না।’

ওমা, কেমন কথা! উনাকে ভাইয়া বলবো না তো কি বলবো? জামাই!

‘কেন বলবো না?’

‘ভাইয়া বললে বাবার সম্পত্তির ভাগ দিতে হবে।’

বাপরে, কি শখ! ভাইয়া বললে বাবার সম্পত্তির ভাগ দিতে হবে৷ মগের মুল্লুক পেয়েছে উনি৷ আমাকে ভাইয়া বলতে মানা করছে না। আমি বেশি করে বলবো। দেখি কি করে আটকায়। শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম,

‘আচ্ছা ভাইয়া আর ভাইয়া বলবো না।’

‘আবারো?’

ঠোঁট উল্টে ইনোসেন্ট ফেস করে বললাম,
‘ওকে সরি ভাইয়া।’

‘এই মেয়ে চুপ করবে।’

চোখ গরম করে বললেন তিনি। আমি মনে মনে হেসে নিজেকে বললাম,’এই তো চান্দু পাইছি তোমারে রাগানোর উপায়। এতো সহজে কি আমি চুপ হয়ে যাবো?’ উনি নিজেকে কিছুটা সংযত করে বললো,

‘আমাকে ভাইয়া বলবে না।’

‘তাহলে কি বলবো?’

‘নাম ধরে ডাকবে।’

আমি বেদী থেকে উঠে তার এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস গলায় বললাম,

‘আমি নাম ধরে ডাকবো না।’

সে চমকে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেনো?’

‘আমি আপনাকে কি বলে ডাকবো জানেন?’

‘কি?’

‘একশবার ভাইয়া বলে ডাকবো।’

‘পাঁজি মেয়ে।’

এনাজ চেচিয়ে বললো। আমি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে আবারো রুমের দিকে দৌড়। তুমি কেনো আমাকে ভাইয়া বলতে মানা করো তা কি আমি বুঝি না? বুঝি, বুঝি সব বুঝি।মেয়ে মানুষ এমনি আগে আগে সব টের পেয়ে যায়।তাছাড়া ছোটবেলায় খাইছি সুজি, একটু হলেও কিছু বুঝি।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here