অমানিশার চাঁদ পর্ব ৬

0
1239

#অমানিশার_চাঁদ
#মেঘলা_আহমেদ

[ ৬ ]

বিছানার উপরে বিধ্বস্ত হয়ে বসে আছে নীলা। চোখের পানি পড়তে পড়তে শুকিয়ে গেছে। সে একধ্যানে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। মস্ত বড় জানালাটা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে আসছে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা কিছুতেই মানতে পারছেনা সে। কিছুক্ষণ আগে-

সন্ধ্যার আযান পড়ে যাওয়ায় তাড়াতাড়ি ওযু করে ওঠে নীলা। ঢিল টা কে ছুঁড়েছিল জানা নেই। তাড়াতাড়ি করে ভবনে ঢুকতেই সামনে এসে দাঁড়ায় করিমন। নীলা মাথা নিচু করে ছিলো। করিমন কঠিন চোখে নীলা কে পর্যবেক্ষন বলেন-

-” ঐ মাইয়া, এতক্ষন কই আছিলি? ওযু করতে কি এহন গেছোস? তরে কইছিনা আমগো বাড়ির বউরা সন্ধ্যায় ঘরের বাইরে থাহে না। কথা কি কানে ঢুহে নাই? জিনাত রে কি দেখছোস তর মতো ধেইধেই করতে? এতক্ষন কি করতাছিলি? ঐদিক থেইক্কা এক ব্যাডা আইলো। ছিহ ছিহ ছিহ বড় বইন তো না”গরের লগে ভাইগ্গা গেছে। এখন তুই রঙলীলা করতাছোস। বাড়ির ভিতরে থাকতে কিছু করতে পারোস না তাই, না*গর রে ঘাটপাড়ে ডাইকা আইনা পিরিতি করোস‌। তর মায় ও কি এমন বে*শ্যা? জানতাম না তো সিকদার বাড়ির বউ ছেড়িরা এমন!

নীলার কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে শ্বাশুড়ির কথায়। অবাক চোখে শ্বাশুড়ির দিকে তাকায় সে। তার বোনকে নিয়ে আসছে থেকে কটু কথা শোনাচ্ছে‌। এখন তার মা কে নিয়েও কথা শোনাচ্ছে। এই তবে মানুষের মুখে মুখে প্রশংসা শোনা সৈয়দ বাড়ির অবস্থা। নীলা অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে-

-” আম্মিজান এসব আপনি কি বলছেন? আপনি আমার মা কে কেন গালি দিচ্ছেন?

করিমনের কন্ঠস্বর শুনে, কিছু দাসী এসে ভীড় জমিয়েছে। তারা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখছে। নীলার চোখে মুখে অবিশ্বাসের আভাস। করিমন আরো চেঁচিয়ে বলে-

-” তো কি করবো‌। নাগর নিয়া ঘাটপাড়ে আকাম করছো এতক্ষন। এখন আমি কইবার পারুম না।

নীলার সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে আহত বাঘিনীর মত চেঁচিয়ে বলে-

-” থামুন দোহাই আম্মিজান। আপনি আমাকে যা বলছেন কিন্তু আমার পরিবার কে কেন করি শোনাচ্ছেন? আর ঘাটপাড়ে আমি একাই ছিলাম। কোন পুরুষ কে আমি দেখিনি। আমি ওযু করতে গিয়েছিলাম। আপনি এভাবে আমাকে অপবাদ দিচ্ছেন কেন? আমাকে আপনার পছন্দ না তাই বলে মিথ্যা অপবাদ দেবেন? আম্মিজান আপনি নিজেও তো মেয়ে, একজন মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়ে কে এভাবে বলছেন কি করে?

করিমন রেগে নীলার চুলের মুঠি চেপে ধরে। নীলা ব্যাথায় কঁকিয়ে ওঠে। দুই গালে সপাটে দুটো চ*ড় পড়ে। আরেকটা চ*ড় দেয়ার জন্য করিমন হাত উঁচু করতেই,

-” আম্মিজান!

ফাবিহানের কন্ঠে থেমে যায় করিমন। এখনো ফুঁসছে সে। ফাবিহান দৌড়ে এসে মায়ের হাত থেকে নীলার চুল ছাড়িয়ে নেয়। নীলাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। নীলা ফুঁপিয়ে ওঠে ফাবিহানের ছোঁয়ায়। ছোটবেলায় মায়ের মা*র খেয়েছে। কিন্তু বড় হওয়ার পর কবে কেউ গায়ে হাত দিয়েছে মনে নেই। ফাবিহান মায়ের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য কন্ঠে প্রশ্ন করে-

-” আম্মিজান। আপনি ওকে মা*রছেন কেন? নতুন বউকে এভাবে কেউ মা*রে?

করিমন খেপে উঠে বলে-

-” মারতাম না তো কি করতাম? তর বউ ঘাটপাড়ে ব্যাডা আইনা রঙলীলা করছে এতক্ষন। আমি জিগাইতেই মুহে মুহে তর্ক করছে। এত সাহস কেন?

-” আম্মিজান আপনি কি বলছেন এসব। নীলা ঘাটপাড়ে একাই তো গিয়েছিলো‌।

-” ঐ তর কি মনে হয় আমি মিথ্যা কইতাছি? আমি ঐ জানলাডা দিয়া চাইয়া আছিলাম। তহন ঘাটপাড়ের দিগ দিয়া এক ব্যাডা দৌড়াইয়া আইছে। পড়নে কালা কাপড় আছিলো। তারপরেই তর বউ আইসা তাড়াতাড়ি কইরা বাড়িত ঢুকতাছে। এহন তর বউরে কি আমি কোলে লইয়া বইসা থাহুম?

নীলার কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। সে ফাবিহানের বুক থেকে মুখ তুলে বলে-

-” আপনি বিশ্বাস করুন আমি ঘাটপাড়ে ওযু করতে গিয়েছিলাম। আমি ওযু করছিলাম তখন কে যেন ঢিল ছুড়ে পানিতে। আমি চমকে সেদিকে তাকাতেই দেখি কালো কাপড় পড়া একটা লোক। আমি জিজ্ঞেস করলাম কে ওখানে। কোন কথা না বলেই দৌড়ে চলে যায়। তারপর আমি ওযু করে তাড়াতাড়ি চলে আসি।

ফাবিহানের ভ্রু কুঁচকে যায় নীলার কথায়। তাদের বাড়ির সীমানার মধ্যে কেউ এসে পুকুরে ঢিল ছুড়ে চলে গেলো। কে হতে পারে। করিমন তাও নিভলো না। সে তেতে উঠে বলল-

-” মিথ্যা কথা এই মাইয়া মিথ্যা কইতাছে। ঐ ব্যাডায় কেন হুদাই ঢিল মা*রবো? ভালোই গল্প কইতে পারে। কায়েস বাপ আমার এই বউরে তালাক দে। তরে কেডায় সিকদার বাড়ির থেইক্কা মাইয়া আনতে কইছে। এই মাইয়া পিশাচীনি, সব শেষ কইরা ফেলবো।

ফাবিহান নীলার মুখের দিকে তাকায়। ওর চোখেমুখ দেখে মনে হচ্ছে না মিথ্যা বলছে। ভাগ্যিস আর সবাই অন্য ভবনে। নাহলে তার মায়ের এই বানোয়াট কথায় নীলার সম্মান যেতো। ফাবিহান মায়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে-

-” আম্মিজান লোকটা দৌড়ে এসেছে। হতেও পারে সে অন্য কোথাও ছিলো। এই জানালা দিয়ে পুকুর পাড়ের থেকে আসা মানুষ ও দেখা যায়। আর পেছনের রাস্তা থেকে আসা মানুষ ও দেখা যায়। আপনি নিজের চোখে নীলাকে কোন খারাপ কাজ করতে দেখেন নি। তাহলে শুধু চেঁচামেচি করছেন কেন? আর ওর গায়ে হাত দিলেন কেন?

করিমন ছেলের কথায় দমে গিয়ে বলেন-

-” তোর বউ আমার মুহে মুহে তর্ক করছে তাই মারছি।

ফাবিহান বিরক্ত হয় মায়ের কথায়। নীলা কে নিজের কাছে টেনে নিয়ে মা কে বলে-

-” দেখুন আম্মিজান ও আমার বউ। ওর গায়ে আমি ছাড়া কেউ হাত দিবে না। কেউ না‌। ও এই বাড়ির বউ, ভালো হয় ওকে মেনে নিন। এতেই মঙ্গল। নীলা উপরে যাও।

ফাবিহানের এই কথাটার যেন অপেক্ষা করছিলো। নীলা ছুটে উপড়ে চলে আসে।

__

-” কি ভাবছো?

নীলার ঘোর ভাঙে কারো কথায়। চোখ তুলে তাকিয়ে ফাবিহান কে দেখে লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয়। এই লজ্জাজনক ঘটনার পর সে আর ঘর থেকে বেরোয় নি। এশারের আযান পড়ে গেছে অনেকক্ষন আগেই। একজন দাসী এসে খাবার রেখে গেছে। খাবে না বলেছিল তাও রেখে গেছে। ফাবিহান জবাব না পেয়ে নীলার দিকে তাকায়। হারিকেনের আলো, আর চাঁদের আবছা আলোতে নীলার মুখটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ফর্সা গাল দুটোতে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। ফাবিহান চোখ বন্ধ করে বলে-

-” তখন তোমাকে মায়ের কাছ থেকে রক্ষা করেছি বলে ভেবো না, আমি তোমাকে বউ বলে মেনে নিয়েছি। মায়ের থেকে তোমাকে রক্ষা করার জন্যই বউ বলেছি। আমি বিয়ে করতে চাইনি। আমাকে জোড় করা হয়েছে। আমি অন্য একজন কে ভালোবাসি। তাই আমার আশেপাশেও আসবেনা।

নীলা এবার চোখ তুলে তাকায়। অবাক হয়ে বলে-

-” আমি কি আপনার বউ হতে চেয়েছি। জোড় করে বাবা বিয়ে দিয়েছে। পালিয়েই তো গিয়েছিলাম। ধরে এনে বিয়ে দিয়েছে। আপনিও ধেই ধেই করতে করতে কবুল বলে দিলেন। এত বিয়ে করার শখ না থাকলে, কেউ কনের নাম ঠিকমত না শুনেই কবুল বলে দেয়? বিয়ে করার তাড়া আপনারই ছিলো। যখন শুনলেন কন্যাবদল হয়েছে, তখন ভেঙে দিতেন বিয়েটা। তা না করে আমি বউ নিয়ে যাবো। এখন বলছে আমাকে জোড় করা হয়েছে। কাপুরুষ!

ফাবিহান এতক্ষন শান্ত থাকলেও নীলার শেষের কথাটায় রেগে যায়। তেড়ে এসে নীলার চোয়াল চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে-

-” এই মেয়ে শোন দুই বংশের শ*ত্রুতা শেষ করার জন্য বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। নাহলে আমার বিয়ে করার শখ ছিলোনা‌। আর তোমাকে কেন এনেছি? সেটা সময় হলেই জানতে পারবে। আর শোন করুনা করেছি তোমার বাবার ওপর। সমাজের চুনকালি থেকে তোমার মত বিবাহিতা মেয়েকে বাঁচিয়েছি। সিকদার বংশের সম্মান বাঁচিয়েছি। চুপ করে থাকবে। নাহলে নর্দমায় ছুঁ/ড়ে ফেলবো।

#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here