#অমানিশার_চাঁদ
#মেঘলা_আহমেদ
[ ৪ ]
সকালটা খুবই বাজে ভয়ংকর পরিস্থিতির মাধ্যমে শুরু হলো ফুরাতের। বামপাশের দোতলা ভবনটার সামনে কার যেনো লা শ পাওয়া গেছে। শুনেই ভয়ে মুখ র/ক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল ফুরাতের। ঘুম থেকে উঠে ফাবিহান কে দেখতে পায়নি সে। গতকাল রাতে সে বিছানায় এক কোণায় শুয়ে পড়েছিলো। ফাবিহান কে বিছানায় বসে থাকতে দেখেছিলো। তাহলে মানুষ টা গেলো কই? সকালে হয়তো ঐ ঘটনা শুনে উঠে গিয়েছে। নিজের মনে উত্তর সাজিয়ে নিলো ফুরাত। পরক্ষনেই নিজেকে গালি দিয়ে বলল, এত কি দরকার ওনার খবর রাখার। উনি তো তোকে স্ত্রী হিসেবে মানেই না। মরিয়ম হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে ঢোকে। ফুরাত ওনাকে দেখে মাথায় কাপড় টেনে নেয়। মিষ্টি হাসি দিয়ে সালাম দেয়-
-” আসসালামুয়ালাইকুম মেঝ আম্মা।
মরিয়ম হেসে সালামের জবাব দেয়-
-” ওয়ালাইকুমুস সালাম। হুন এহনো গোসুল দেস নাই কেরে? ওহ আমার মনেই নাই। তুই আমার লগে আয় আমি গোসুল করার জায়গা দেহাইয়া দেই। নীল শাড়িডা নিয়া আয়। তোরে ফাবিহান ঐডা পড়বার কইছে।
ফুরাত বেশ অবাকই হয় মরিয়মের কথায়। ফাবিহান তাকে নীল শাড়ি কেন পড়তে বলবে? সে তো ভালোমতো কথাই বলেনি আমার সঙ্গে। ফুরাত কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মরিয়ম তাড়া দিয়ে বলে-
-” কি রে মাইয়া? আবার কি চিন্তা করস। তাড়াতাড়ি আয়। বেলা বাড়তাছে এহনো, নতুন বউ গোসুল দেয় নাই। মানষে শুনলে কানাকানি করবো।
ফুরাত আর কিছু বলতে পারলোনা মরিয়ম কে। সব ভাবনা এক পাশে ফেলে সে নীল শাড়ি টা নিলো। তারপর মরিয়মের পিছু পিছু পেছনের বারান্দা দিয়ে বের হলো কক্ষ থেকে।
______
গোসল সেরে নিজের কক্ষে প্রবেশ করে ফুরাত। মরিয়ম তাকে তাড়াতাড়ি করে নিচে নামতে বলেছে। সূর্য উঠে গেছে অনেকক্ষন হয়েছে। নতুন বউ এখনো ঘর থেকে বেরোয় নি, কথাটা কেমন খারাপ শোনায়। বিছানার উপর ফাবিহানের দিকে চোখ গেলো তার। লোকটা কেমন জানি। ফুলশয্যার রাতে কি কেউ বউকে বলে তোমাকে আমার পছন্দ হয়নি! পছন্দ না হলেই ভালো। ফাবিহান কপালের উপর হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। ছেলেটা বাড়াবাড়ি রকমের ফর্সা। তার সাথে হয়তো ফাবিহা আপুর সাথেই ভালো মানাতো। আমি তো অত ফর্সা না। ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যায় ফুরাতের।
-” নীলা!
আচমকা নীলা নামটা শুনে কেঁপে ওঠে ফুরাত। ফুরাতের কেঁপে ওঠা দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ফাবিহান বলে-
-” কেঁপে উঠলে যে? কেউ কি নীলা নামে ডাকে না?
ফুরাত নিজেকে ধাতস্থ করে বলে-
-” জ্বী না। ছোটবেলা থেকেই সবাই ফুরাত বলে ডাকে।
ফাবিহান আদেশের স্বরেই বলে-
-” আজ থেকে তোমার নাম নীলা ঠিক আছে? ফুরাত নাম ভুলে যাও। ওটা তো তোমার বাবার বাড়ির সবাই ডাকতো। ওই নামটা ওখানেই সীমাবদ্ধ থাকুক। এই বাড়িতে সবাই তোমাকে নীলা বলে ডাকবে। মনে থাকবে!
নীলা দুদিকে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। ফাবিহান নীলার দিকে তাকাতেই খেয়াল করে নীলা নীল শাড়ি পড়েছে। তবে চুলের দিকে তাকাতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ফাবিহান ধমক দিয়ে বলে-
-” এই তোমার সমস্যা টা কি? চুল ঠিকমতো মোছো নি কেন? এটা কোন ধরনের স্বভাব? শোন চুল ঠিকমত মুছবে। নাহলে কদিন পর ঠান্ডা লাগলে সবাই বলবে- সৈয়দ বাড়ির নতুন বউয়ের কাজ করতে করতে ঠান্ডা লেগে গেছে। যাও চুল ঠিকমতো মুছে নিচে যাও।
ফাবিহানের কড়া ধমক খেয়ে নীলা চুপসে যায়। চোখ মেলে পিটপিট করে তাকিয়ে ফাবিহান কে বলে-
-” আপনি তো আমাকে স্ত্রী বলে মানেন না। তাহলে এত শাসন করছেন কেন? ঠান্ডা আমার লাগলে আমি বুঝে নেবো।
নীলা আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় চলে যায়। ফাবিহান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়ের তেজ তো কম না। ভাবতেই ফাবিহানের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাঁসি ফুটে ওঠে। এই হাসি ফুটেছিলো আরো আগেও। ভেতরের চাপা আর্তনাদ কেউ সুনলো না। সবাই কেবল প্রতিশোধের নেশায় আসক্ত। নীলা কক্ষে এসে ফাবিহান কে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে। এই হুলো বেড়ালের আবার কিসের ভাবনা। তখন জিনাত কক্ষে প্রবেশ করে। নীলা কে এভাবে ফাবিহানের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখ টিপে হেসে বলে-
-” কি গো সই? তুমি আমার দেবরের দিকে এমনে কইরা চাইয়া আছো কেন?
নীলা জিনাতের কথায় উল্টো ঘুরে যায়। ফাবিহান চমকে তাকায়। নীলা তার দিকে তাকিয়ে ছিলো? এদিকে লজ্জায় নীলার মরি মরি অবস্থা। এভাবে ধরা খেয়ে গেলো। নীলার অবস্থা বুঝতে পেরে ফাবিহান মুচকি হেসে বলে-
-” আরে আমার বউ আমার দিকেই তো তাকিয়ে থাকবে বউমনি। দশটা না পাঁচটা না একমাত্র জামাই আমি তার। একটু দেখলো দোষ কোথায়।
জিনাত ফাবিহানের কথায় ফিক করে হেসে দেয়। নীলা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। কি মিথ্যুক ছেলে রে বাবা। মানুষের সামনে বউ বউ করছে আর একা পেলেই বলে তোমাকে আমি মানি না। জিনাত নিজের হাসি থামিয়ে বলে-
-” যাও ভাই আর মশকরা কইরো না। এই সই তুমি এহনো তৈরি হও নাই কেন? নিচে সবাই বউ দেখবার লাইগা বইসা আছে।
নীলা জিভ কাটে। তাকে মরিয়ম সেই কখন যেতে বলেছে। এদিকে কক্ষে এসে ফাবিহানের কথার প্যাচে পড়ে দেরি হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। নীলা ক্ষুব্ধ চোখে ফাবিহানের দিকে তাকিয়ে জিনাত কে বলে-
-” চলুন আপু। আমি তৈরি।
জিনাত আর ফাবিহান দুজনেই ভ্রু কুঁচকে তাকায়। জিনাত কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে-
-” হায় রে সই। তুমি এই বেশে নিচে গেলে ছোটমা আমারে বকবো। তুমি নতুন বউ মানুষ কোন গয়নাই তো পড়োনি। এই বাড়িতে সবাই গয়না পড়ে থাকে দেহো নাই? সৈয়দ বাড়ির বউদের এইভাবে মানষের সামনে যাওয়া নিষেধ। গয়নাগুলা বাইর করো তাড়াতাড়ি। আমি তোমারে তৈরি কইরা দেই।
ফাবিহান মাঝে মাঝে আড়চোখে নীলার দিকে তাকাচ্ছে। নিজেই বিরবির করে বলে- এই নীল শাড়িতেই তো সুন্দর লাগছে। আমার এই লোহা, দস্তার ( গয়নার) কি দরকার? বুঝিনা মেয়েদের এতো প্রসাধনী বাবা রে। জিনাত গয়না গুলো পড়াতে পড়াতে ফাবিহান কে বলে-
-” ছোট ভাই কি বিরবির করতাছো। তো কালকে রাইতে ঘুম কেমন হইছে? এত সুন্দর চান্দের লাহান বউ তোমার।
ফাবিহান কেশে ওঠে জিনাতের কথায়। লজ্জায় আজকে নীলা মনে হয় অজ্ঞান হয়েই যাবে। ফাবিহান বিছানা থেকে উঠে বলে-
-” বউমনি তুমি ওকে সাজাও কেমন। আমার একটু কাজ আছে আমি বরং যাই।
ফাবিহান কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাড়াতাড়ি কক্ষ থেকে চলে যায়। আনমনে ভাবে জিনাতের বলা কথাগুলো। আসলেই কি তাদের মধ্যে কিছু সম্ভব হবে। হাঁটতে হাঁটতে দোতলা ভবনের বাগানে এসে বসে সে। জিনাত নীলা কে নিয়ে নিচে নামে। মরিয়ম, জহুরা, করিমন একসাথে রাজকীয় আসনে বসে আছে। করিমন আর জহুরা পান চিবোচ্ছে। জিনাত নীলা কে নিয়ে তাদের পাশে বসায়। মরিয়ম দেখে মিষ্টি হেসে বলে-
-” বাহ মাশাআল্লাহ তোরে খুব সুন্দর লাগতাছে মা। বিয়ার পর রূপ খুলছে মনে হইতাছে।
মরিয়মের কথায় আরচোখে নীলার দিকে তাকায় করিমন। মুখ ভেংচি কে টে চোখ সরিয়ে নেয়।
__
ফাবিহান কে বসে থাকতে দেখে জিনাতের স্বামী রুহুল এসে তার পাশে বসে। ফাবিহান চমকে রুহুলের দিকে তাকায়। রুহুল কে দেখে এক চিলতে হাসি উপহার দেয়। রুহুল গলা খাঁকারি দিয়ে পরিষ্কার করে। সামনে ফুল বাগানের দিকে তাকিয়ে বলে-
-” ভাই একটা কথা শোন। আমাদের বাড়িত যে লা শটা পাওয়া গেছে আজকে ওই লোকের খোঁজ পাইছি। লোকটার বাড়ি শিবপুর গ্রামে। ঘরে বউ, আর দুইটা পোলা আছে অল্প বয়সী। বউটায় গড়াগড়ি দিয়া কাঁদছে। ছেলে দুইটারে কি খাওয়াবে সেই চিন্তায়।
ফাবিহানের চোখ জোড়া চকচক করে ওঠে। সে এতদিন কাজের জন্য মানুষ খুঁজছিলো। স্বাভাবিক মুখে রুহুলের দিকে তাকিয়ে বলে-
-” ওদের ছেলেরা যদি কাজ করতে চায় তাহলে আমার কাছে নিয়ে এসো। ভালো পারিশ্রমিক এ কাজ দেবো। ওদের অভাব ঘুচে যাবে।
রুহুল অবাকই হয়। কারন ফাবিহান কে সারাদিন বাড়ির আঙিনায়ই থাকতে দেখে। এর মধ্যেও কয়েকবার লোক চেয়েছিলো। এই বাড়িতে থেকে কি কাজ দিবে?
#চলবে