#শ্রেয়সী
#পর্ব_৩১
#লেখনীতে_নাদিয়া_সিনহা
-“কি হলো বাবা? বলছো না কেনো?”
আদনান শেখ অনুভূতিহীন তাকিয়ে আছে আদ্রিশীর পানে। আদ্রিশী কিয়ৎ পর পর বাবা-মায়ের পানে তাকাচ্ছে। শোহা শেখ আদনান শেখের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইশারায় কিছু বলেন। আদনান শেখ তাকে চোখের ইশারায় দমিয়ে দেন। আর এই সব আদ্রিশীর চোখে এড়ায়নি। বাবা-মায়ের ইশারা করে বলা কথা আদ্রিশী বেশ বুঝতে পারছে। আদ্রিশী নীরবতা ভেঙ্গে বলে,
-“দেখো বাবা-মা ইশারায় কথা বলা বন্ধ করো৷ আমি জানি তোমরা কিছু লুকিয়ে যাচ্ছো।”
আদনান শেখ ধাতস্থ হয়ে বলেন,
-“তেমন কিছু না আদ্রি। তুমি এত রাতে না ঘুমিয়ে এখানে কি করছো?”
-“একা একা ঘুম আসছিলো না তাই ভাবলাম তোমাদের সাথে ঘুমাই।”
শোহা শেখ মেকি হেসে বলেন,
-“দাড়িয়ে আছো কেনো? চলো ঘুমাবে।”
-“তার আগে বলো আপু কোথায় চলে গেছে?”
-“কোথাও যায়নি৷ ঘুমাবে চলো।”
-“আমাকে উল্টাপাল্টা বোঝানোর চেষ্টা করবে না বলে দিচ্ছি। আজকে সব রহস্য ভেদ না করে আমি ক্ষান্ত হবো না।”
শোহা শেখ খানিক রাগি স্বরে বলেন,
-“এটা কি ধরনের জেদ? আর রহস্য কিসের হবে?”
-“জানি না আমি কিছু। একবার যখন বলেছি জানব৷ তার মানে জেনেই ছাড়ব।”
শোহা শেখ কোনো মতেই আদ্রিশী কে বোঝাতে পারছে না। রহস্য জানবে জানবে করে পাগল করে দিয়েছে। আদনান শেখ চুপ করে দাড়িয়ে মেয়ের কান্ড দেখছেন। শোহা শেখ মেয়েকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে অস্থির হয়ে গেছেন৷ মেয়ের পাগলামি দেখে শোহা শেখ বলেন,
-“ওকে ফাইন! তোমকে সব বলছি। আনুশী…..”
-“আনুশীর এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম আমি।”
শোহা শেখের বলার পূর্বে তাকে থামিয়ে আদনান শেখ বলেন। শোহা শেখ একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে আবার আদ্রিশীর পানে তাকায়। আদ্রিশী লাফিয়ে উঠে বলে,
-“কিহ? আপু এ্যাক্সিডেন্ট করেছে? আমাকে আগে বলোনি কেনো?”
শোহা শেখ আদ্রিশীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
-“তুমি চিন্তা করবে তাই বলিনি।”
-“আচ্ছা এখন তো বললে। এখন আপুর সাথে আমার কথা বলিয়ে দেও।”
শোহা শেখ চুপসে যান। আদনান শেখ এগিয়ে এসে বলেন,
-“অনেক রাত হয়েছে আনুশী এখন ঘুমোচ্ছে। পরে কথা বলে নিও।”
-“কি বাবা? সব সময় তোমরা এমন করো। কখনও আপুর সাথে আমার কথা বলাও না। যতবারই বলি ততোবারই কোনো না কোনো বাহানা দেও। কেনো?”
শোহা শেখ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
-“আনুশী হোস্টেলে থাকে মা। যখন তখন কথা বলা যায় না দেখা করা যায় না।”
আদ্রিশী মন খারাপ করে বলে,
-“এ কেমন হোস্টেল মা? আপু বাড়ি থেকে যাওয়ার পর আর কখনও কথা হয়নি আমার সাথে। বাড়িও আসে না। খুব মিস করি। আচ্ছা মা আপু কি আমাকে মিস করে না? আমার কথা জিজ্ঞেস করে না?”
শোহা শেখ টলমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদনান শেখের পানে। আদনান শেখ স্ত্রীর অবস্থা বুঝতে পেরে বলেন,
-“খুব মিস করে।”
-“আই হেট দিস হোস্টেল। আমি কখনও যাব না ওখানে।”
নিজের মতো বিরবির করতে করতে ঘুমিয়ে পরে আদ্রিশী। আদনান শেখ উঠে পূর্বের ন্যায় বেলকনিতে চলে যায়। কিয়ৎ বাদে শোহা শেখ বেলকনিতে এসে আদনান শেখের পাশে দাঁড়ায়। আদনান শেখ সম্মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন,
-“ঘুমিয়েছে?”
দীর্ঘশ্বাস টেনে শোহা শেখ বলেন,
-“হ্যাঁ!”
-“সত্যটা না বললেও পারো।”
-“কতদিন চেপে রাখবে?”
-“জানি না।”
খানি মুচকি হেসে শোহা শেখ বলেন,
-“এই এক সত্য জানতে পেরে আমার এক মেয়ে দূরে চলে গেছে। আর আমার আরেক মেয়ে সেই সত্যির পেছনে ম’রি’য়া হয়ে ছুটছে।”
আদনান শেখ তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
-“পারিনি আগলে রাখতে। কি বলব? এটা আমার ব্যর্থতা নাকি অক্ষমতা?”
-“আদ্রিকে সব সত্যি বলি দেওয়া যায় না?”
-“এই ভুলটা কল্পনায়ও করো না।”
ওষ্ঠদ্বয় বাঁকিয়ে শোহা শেখ বলেন,
-“সত্যি বলিনি বলে আনুশী চলে গেছে। কারণ সে নিজেই সত্যি জানতে পেরেছিলো। আর আদ্রিকে সত্যি বলে দেওয়াটাই কি শ্রেয় নয়?”
আদনান শেখ চুপ করে দাড়িয়ে আছেন। হয়তো ভাবছেন। সত্যি বলা এবং না বলার মধ্যে আটকা পরে গেছেন। শোহা শেখের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে। আদনান শেখ এক হাতে শোহা শেখ কে জড়িয়ে ধরে। সযত্নে চোখের জল মুছে দেন। শোহা শেখ করুন কন্ঠে আদনান শেখ কে বলে,
-“আমার মেয়েটা কে কি আর কোনো দিন ফিরে পাব না?”
___________________
লাইব্রেরিতে বসে আছে আদ্রিশী। তার সম্মুখে টেবিলের উপর ছড়িয়ে আছে বেশ কয়েক বই। সব গুলো বই আদ্রিশী নিজে খুঁজে খুঁজে এনে পড়ছে। আদ্রিশীর পাশে বসে নীরব দর্শনের ভূমিকা পালন করছে ইনেসা। ইনেসা আদ্রিশীর বেস্টফ্রেন্ড। আদ্রি সব কিছু ইনেসার সাথে সেয়ার করে। ইনেসা গ্রিসের নাগরিক। আদ্রিশীর প্রতিবেশীও সে। আদ্রিশীর হঠাৎ এহেন কান্ডে বেশ বিরক্ত ইনেসা৷ কেননা আদ্রিশী পড়াশোনায় ভীষণ ফাঁকিবাজ। বই পড়া আদ্রিশীর কাছে সবচেয়ে অপছন্দের কাজ। কিন্তু আজ আদ্রিশী নিজেই লাইব্রেরিতে এসে কি সব বই নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। একটা বইও সে পড়ছে কেবল পাতা উল্টে উল্টে কি যেনো খুজচ্ছে। ইনেসা বিরক্ত হয়ে ফিসফিস করে বলে,
-“আদ্রি, হোয়াট আ’র ইউ ডুয়িং?”
-“হোয়াই? ইউ কান্ট সি?”
-“স্টপ দিস।”
আদ্রিশী বিরক্ত হয়ে আবার নিজের কাজে মন দেয়। ইনেসা কথা না বাড়িয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসে। ইনেসা বেরিয়ে আসায় আদ্রিশীও তার পিছু পিছু বেরিয়ে আসে৷ দৌড়ে ইনেসার পাশে এসে বলে,
-“আমাকে একা রেখে চলে এলে কেনো?”
-“ওখানে আমার বোরিং লাগছিলো।”
-“আমার জন্য এই টুকু সহ্য করতে পারবে না?”
-“পারতাম যদি বলতে কেনো সেসব করছিলে।”
-“আমি একটা স্টোরি খুজচ্ছিলাম।”
-“কি স্টোরি?”
আদ্রিশী শর্টকাটে আরাবী-শ্রেয়সীর পুরো কথা ইনেসাকে বলে৷ ইনেসাও যথেষ্ট অবাক হয়েছে। আদ্রিশী হাত নাড়িয়ে অভিনয় করে করে পুরো কাহিনী ইনেসা কে বলে। পুরো কথা শুনে ইনেসা বলে,
-“বুঝলাম। কিন্তু এই বইয়ের মধ্যে কি খুঁজচ্ছিলে?”
-“আরে দেখছিলাম এরা আবার কোনো ফ্যামাস গল্পের চরিত্র কি না।”
-“তোমার যদি মনে হয় এটা কাল্পনিক এবং বইয়ের চরিত্র তাহলে গুগলে সার্চ দেও নিশ্চয়ই কিছু না কিছু পাবে।”
-“আর যদি সত্যি হয়?”
-“তাহলে পাবে না সিম্পল।”
-“দাঁড়াও এখনই দিচ্ছি।”
আদ্রিশী ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করে গুগলে সার্চ করে। ডায়েরিতে থাকা প্রতিটি চরিত্রের নাম লিখে সার্চে করে তবে সে ব্যর্থ। কারো কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। কেবল ওয়ালিদ তাজওয়ার সম্পর্কে জানতে পেরেছে। তার ভাবনাই সত্যি আরাবী-শ্রেয়সী সত্যি আছে কাল্পনিক নয়। আদ্রিশী উত্তেজিত হয়ে ইনেসাকে বলে,
-“এটা সত্যি। কাল্পনিক নয়। তারা আছে।”
-“কিন্তু কোথায় আছে? খুঁজে পাবে কোথায়?”
-“জানি না কোথায় তবে এটা শিওর ওরা আমার দেশ আছে।”
-“তাহলে এক কাজ করো তুমি দেশে গিয়ে ওদের খোঁজ করো।”
আদ্রিশী অসহায় ভঙ্গিতে বলে,
-“আমি কি করে যাব? আমি এখনও ছোট।”
-“তাহলে এদের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।”
-“এত সহজে আদ্রি এটা ছেড়ে দিবে না একদম না।”
____________________
সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ আগে বাড়ি প্রবেশ করে আদ্রিশী। ক্লান্ত থাকায় দৌড়ে নিজের ঘরে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে লিভিং রুমে বসে শোহা শেখ রান্না ঘরে কাজ করছিলেন। কিয়ৎক্ষন পর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“খুব বেশি টায়ার্ড আজ?”
কাঁধ বাকিয়ে পেছনে ফিরে মায়ের দিকে তাকায় আদ্রিশী। মাথা নাড়িয়ে না বলে পূর্বের ন্যায় বসে পরে। শেহা শেখ কাজ করতে করতে জিজ্ঞেস করেন,
-“খাবে কখন?”
আদ্রিশী চুপ করে আছে। শোহা শেখ একবার আদ্রিশীর দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে মন দেন। আদ্রিশী আচমকা লাফিয়ে উঠে উত্তেজিত কন্ঠে বলে,
-“জানো মা আমি আজ লাইব্রেরিতে গিয়ে ইনভেস্টিগেশন করেছি।”
-“তা কি নিয়ে ইনভেস্টিগেট করলেন?”
-“আরাবী – শ্রেয়সী কে নিয়ে।”
আদ্রিশীর বলা বাক্যে থমকে যায় শোহা শেখ। কপট রাখ দেখিয়ে বলেন,
-“তোমাকে আমি বলেছিলাম এসব ইউজলেস বিষয়ে মাথা না ঘামাতে। তবুও তুমি এটার পেছনে ছুটছো। কেনো?”
-“কোথায় ছুটলাম? আমি তো শুধু দেখছিলাম কোনো ফ্যামাস গল্পের চরিত্র কি না এরা তা।”
-“সে যাই হোক এসব চিন্তা মাথা থেকে নামাও।”
শোহা শেখ নিজের ঘরে চলে যান। আদ্রিশী মুখ বাকিয়ে বিরবির করে কিছু বলতে থাকে। শোহা শেখ ঘরে থেকে বেড়িয়ে আদ্রিশীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“আমি ইনেসার বাসায় যাচ্ছি তুমি খেয়ে নিও।”
আদ্রিশী মাথায় নাড়িয়ে হ্যাঁ সম্মতি দেয়। শোহা শেখ মেয়ের সম্মতি পেয়ে বেরিয়ে যান। আদ্রিশী একা বসে কার্টুন দেখছে। যদিও এখন কার্টুন তার কাছে একদম বোরিং লাগছে। কেননা তার সমগ্র মস্তিষ্ক জুড়ে কেবল শ্রেয়সী আর আরাবীর বিচরণ। মস্তিষ্কে কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে শ্রেয়সী কে কোথায় খুঁজবে? সহসা ফোনের ককর্শ ধ্বনিতে ধ্যান ভেঙে যায় আদ্রিশীর। ফোন কোথায় বাজচ্ছে সেই রহস্য উদ্ধার করতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আওয়াজটা রান্না ঘর থেকে আসছে। আদ্রিশী রান্না ঘরে যেতেই তার মায়ের ফোন দেখতে পায়। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে আননোন নম্বর থেকে কল আসছে। নম্বরটা গ্রিসের নয়। তবে কোথাকার তাও তার জানা নেই। আদ্রিশী সাত-পাঁচ না ভেবে কলটা রিসিভ করে কর্ণধারে ধরে। আদ্রিশী কথা বলার পূর্বেই ফোনের ওপাশ থেকে কেউ বলে,
-“কেমন আছিস শ্রেয়ু? ওখানে পৌছে কল দিসনি কেনো? দুদিন অপেক্ষা করে আমিই তোকে কল দিলাম। আচ্ছা ওসব ছাড় আগে বল আরাবী, আদ্রিশী কেমন আছে?”
~চলবে…