#শ্রেয়সী
#পর্ব_২৪
#লেখমীতে_নাদিয়া_সিনহা
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আনমনে ভাবছি। আকাশটা সত্যি সুখী যখন ইচ্ছে রোদের উত্তাপে উত্তপ্ত করে নিজেকে আবার যখন ইচ্ছে আবছা মেঘে বৃষ্টিতে নিজেকে করে শীতল। তবে আমার জীবনটা এমন নয় কেনো? ইশ! বড্ড আফসোস হচ্ছে। আমি যদি আকাশ হতাম তাহলে নিজের খেয়াল খুশীতে রাঙ্গাতে পারতাম। দুটো মাস চলে গেছে। পরিক্ষাও শেষ। বিয়ের সমস্ত প্রস্তুতি চলছে বাড়িতে। এক সপ্তাহ পরই বিয়ে। রোদ্দু বাড়ি এসে আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছে তাকে সবটা জানায়নি কেনো তা নিয়ে। সেদিন বাবার ঘর থেকে আসার পথে মা বলেছিলো রোদ্দু কে বিয়ের ব্যাপারে কিছু না জানাতে। তাই আর বলিনি। বাড়িতে এসে এতটাই উদাসিন ছিলাম যে তনুফ ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি। পরে অবশ্য ভাবি বলেছে ভাইয়া বিদেশে গেছে। হয়তো তিন মাস পর ফিরবে। বড্ড তাচ্ছিল্য হয় নিজের প্রতি। অন্তত তনুফ ভাইয়া থাকলে একটা ব্যবস্থা করতো। কিন্তু এখন সেও নেই। আর রোদ্দু তো কদিন হলো এলো। মায়ের কথাটা রোদ্দুর থেকে চেপে গেলাম। রোদ্দু আমাকে অনেক জোর করেছে আরাবী কে কল দিয়ে সবটা জানাতে। আমি প্রতিবারই ওকে বাঁধা দিয়েছি। কিভাবেই বা কল দিতাম? বাবাকে যে সেদিন প্রমিস করেছি বাবার কথা রাখব। সবাই খুশী তো আমিও খুশী হতে পারবো।
পরিক্ষা চলাকালীন সময়ে মা আমার সাথে থেকেছে। কলেজে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে কলেজ গেট থেকে নিয়ে আসা পর্যন্ত করেছে। পরিক্ষার হলের বাইরে কখনও আরাবী কেও দেখা গেছে। ছেলেটা দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকতো কেবল। হয়তো বুঝতো কাছে এলে আমার সমস্যা হবে। পরিবার থেকে আমাকে চাপ দিবে কষ্ট দিবে তাই সে দূরে দূরে থেকেছে। আমাদের সাথে রোদ্দুও ছিলো। কিন্তু তখনও সে জানতো না আমার বিয়ের কথা। বাবার বন্ধুর বাসায় থেকেছি পুরোটা সময়। দাদাভাইও প্রায় গিয়ে থেকেছে। আমাকে পাহারা দিয়েছে৷
ঘরে বসেই দুমাসের হিসেব কষছি। দুটো মাস এমনি এমনি পার হয়নি। অনেক কিছু দেখতে হয়েছে এই দুমাসে। মায়ের কড়া চোখের চাহনি, বাবার বিষন্ন মুখশ্রী, দাদাভাইয়ের গাম্ভীর্যতা, আর আমার পরিক্ষা নিয়ে যুদ্ধ। পুরোটা সময় মানসিক চাপ ছিলো কেবল। তবুও মানিয়ে নিয়েছি, মেনে নিয়েছি। এই দুটো মাস বোধ হয় আমার জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণার। পুরোনো কথা ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। জানালার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে পেছন ফিরতেই দেখি রোদ্দু দাঁড়িয়ে। আমি রোদ্দুকে উপেক্ষা করে বিছানায় গিয়ে বসি। রোদ্দু আমার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
-“কাজটা কি ঠিক করছিস?”
-“কোন কাজটা?”
-“একজন কে ভালোবেসে অন্য একজন কে বিয়ে করছিস। এটা কি অন্যায় নয়?”
-“জানি না। হয়তো আবার নয়তো।”
-“সবাই কে বলছিস না কেনো? তুই আরাবী ভাইয়া কে ভালোবাসিস।”
-“জানে।”
-“জানে? তাহলে জেনেও তোর বিয়ে অন্য কোথাও দিচ্ছে কেনো? তুই সুখী হবি না তা কি বুঝে না তারা?”
-“বাদ দে ওসব কথা। বলেও তো লাভ নেই।”
-“বলব না কেনো? তুই এভাবে একটা মানুষ কে ঠকাবি আর আমি চুপ থাকব?”
আমি রোদ্দুর দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বলি,
-“ঠকাইনি আমি।”
-“তাহলে কি করেছিস?”
-“ভাগ্য।”
-“এভাবে ভাগ্য বলে ছেড়ে দিস না শ্রেয়ু প্লিজ। টেক অ্যা স্টেপ ফর ইউ।”
-“কোনো দরকার নেই।”
মায়ের গলা শুনে আমি আর রোদ্দু দুজন পেছন ফিরে তাকাই। মা দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনেছে। রোদ্দু মাথা নুইয়ে নিচে তাকিয়ে আছে। মা এগিয়ে এসে রোদ্দু কে বলে,
-“বাড়ির বউ তুমি। শ্রেয়সী তোমার ননদ। আর তোমার ননদের ভালো কোথায় সেটা তোমার শশুড়-শাশুড়ী কে দেখতে দেও। বেঁচে আছি আমরা ভুলে যেও না।”
রোদ্দু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। আমি একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বিছানায় গিয়ে বসি। সত্যি বলতে দুমাসে এসব সয়ে গেছে। এখন আর গায়ে লাগে না। কথায় কথায় চোখ দিয়ে পানি ঝরে না। যেখানে চোখের পানির মূল্য নেই সেখানে চোখের পানি ফেলাও বৃথা৷ তাই চুপ করে থাকি। রোদ্দু ঘর থেকে যাওয়ার সময় মা বলে,
-“শ্রেয়সীর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তুমি ওর আশেপাশেও আসবে না। আসা করি নিজের শশুড় বাড়ি এবং স্বামীর মান সম্মানে আঘাত আসুন তা তুমি চাইবে না।”
রোদ্দু মাথা নাড়িয়ে প্রস্থান করে। মা আমার দিকে এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
-“বিয়ের আগে কোনো ঝামেলা করবে না আসা করি। আর যদি করো তাহলে এর পরিনাম অনেক ভয়াবহ হবে বলে দিলাম।”
মায়ের কথায় আমি কিছুই বলিনি। মা আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে যায়। আমি আবার দীর্ঘশ্বাস টেনে নিজের মন কে শান্ত করার চেষ্টা করি৷
__________________
বউ সেজে নিজের ঘরে আয়নার সামনে বসে আছি। এই সাজ আরাবীর জন্য হওয়ার কথা ছিলো। আজ তা অন্য কারো জন্য। নিজের প্রতি ধিক্কার আসছে। যদি এমনই হতো তাহলে আমার জীবনে ভালোবাসা এলো কেনো? আরাবীর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই। তাকে আমি ধোঁকা দিয়েছি। চোখ দুটো টলমল করে উঠছে। এখনি পানি গড়িয়ে পরবে। ওষ্ঠদ্বয় চেপে অশ্রুপাত আটকানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। কিয়ৎ পর ঘরে বাবা প্রবেশ করে। বাবা কে দেখে আমি দাঁড়িয়ে যাই। মাথা নিচু কর পায়ের নখ চেপে দাঁড়িয়ে আছি। বাবা আমার মাথায় হাত দিয়ে বলে,
-“আমার ছোট রাজকন্যাটা আজ কত বড় হয়ে গেছে। স্বামীর ঘরে যাবে। একা হাতে গোটা একটা পরিবার সামলাবে, সংসারে দ্বায়িত্ব নিবে। জানিস শ্রেয়ু মা? স্বামী, সংসার, বাবা-মা এরাই জীবনের সবচেয়ে বড় পূর্ণতা। এই পূর্ণতা থেকে আর কোনো পূর্ণতা কিছুই হতে পারে না।”
আমি একবারের জন্যও বাবার পানে তাকাইনি। জানি বাবার চোখ দুটো টলমল করছে। আমার সে দৃষ্টি সহ্য হবার নয় তাই সাহস করে তাকাতেও পারছি না। বাবা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে যায় ঘর থেকে। দাদাভাইও এসেছে বাবার সাথে। বাবা চলে যেতে দাদাভাই এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“শ্রেয়ু বাচ্চা অভিমান করেছিস অনেক জানি। তবে বিশ্বাস রাখ আমরা তোর ভালোর জন্যই করেছি। দেখিস তুই খুব সুখী হবি।”
দাদাভাইয়ের কথায়ও আমি কেনো প্রতিক্রিয়া দেখাই না। দাদাভাইও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে যায়। প্রশ্ন জাগছে এ কেমন ভালো? যেখানে আমার খুশী নেই। এ কেমন সুখ যেখানে তৃপ্তি নেই। এ কেমন বিয়ে? যেখানে ভালোবাসা তো দূর ভালো লাগা নেই।
হঠাৎ আমার ফোনটা বেজে উঠে। গতকালই দাদাভাই ফোনটা দিয়ে বলেছিলো,
-“পারলে মাফ করে দিস বাচ্চা। তোর ভালো করতে গিয়ে যদি আমাকে নিচেও নামতে হয় তাহলে তাই করব।”
দাদাভাইয়ের কথা ভাবতে ভাবতেই ফোনে দিকে দৃষ্টিপাত করি। আননোন একটা নম্বর থেকে ফোন আসছে। আমি রিসিভ করি। ওপর পাশের ব্যক্তির বলা কথা গুলো কর্ণপাত হতেই হাত থেকে ফোনটা ফ্লরে পরে যায়। সর্বাঙ্গে কম্পন সৃষ্টি গেছে। দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। নিয়তি এ কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে আমাকে?
_____________________
বর্তমান…
আরাবী ডায়েরির পাতা উল্টোতে আর কোনো লেখা পায়না৷ কৌতূহলে ভ্রু কুঁচকে আসে তার। শ্রেয়সীর জীবনে এত কিছু ঘটে গেছে আর সে তার ভ্রুণাক্ষরেও টের পায়নি৷ সে থমকে যায়। তার মস্তিষ্কে কড়া নাড়ে অতীতের সেই ভয়ংকর রাতের কথা।
আরাবী সেদিন গিয়েছিলো শ্রেয়সী কে নিজের সাথে করে নিয়ে আসতে। তবে পৌঁছাতে বড্ড দেরি করে ফেলেছিলো। কারণটা সাজ্জাদ আর নুসাইবা। নুসাইবার বাবা নুসাইবার বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলো তার বন্ধুর ছেলের সাথে। তা নুসাইবা জানতো না। বাড়ি যেতেই তার বাবা বিয়ের কথা জানায়৷ নুসাইবা সেদিন পাথরের ন্যায় বসে শুনেছিলো কেবল। তার মস্তিষ্ক জুড়ে ছিলে সাজ্জাদের বিচরণ। তাই সময় ব্যায় না করে সাজ্জাদ কে কল দিয়ে সবটা জানায়। সাজ্জাদ সবটা জানার পর মস্তিষ্ক শূন্য উম্মাদের ন্যায় হয়ে উঠে প্রায়। দিকবিদিক না ভেবে কল দেয় আরাবী কে। যেকোনো মূল্যে তার নুসাইবাকে চাই বলে জানায়। আরাবী সাজ্জাদ কে নিয়ে নুসাইবার বাড়িও যায়৷ তবে এতে লাভ না হয়ে উল্টো হয়েছে। নুসাইবার বাবা তার বিয়ে আরও কাছিয়ে দেয়। সাজ্জাদ উপায়ন্তর না পেয়ে সিদ্ধান্ত নেয় পালিয়ে যাওয়া। হয়ও তাই৷ সাজ্জাদ নুসাইবা কে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করে নেয়। আর এই সবটা আরাবী সাজ্জাদের পাশে ছিলো দূরুন শ্রেয়সীর খবর সে পায়নি। অনেকটা দেরি হয়ে গেছিলো সেদিন। তবুও আরাবী গিয়েছে তার প্রেয়সীর কাছে তবে শেষ রক্ষা হয়নি৷ শ্রেয়সী বাবা নিজের মেয়ের কসম দিয়ে বলেছিলো,
-“আমার মেয়ে তোমাকে বিয়ে তো দূর মুখও দেখতে চায় না।”
বিশ্বাস না করেও করেছিলো। কেননা কোনো বাবা তার মেয়ের কসম নিয়ে এত বড় মিথ্যা বলতেই পারে না। আরাবী গর্জে উঠে প্রশ্ন করেছিলো ”কেনো দেখতে চায় না?” শ্রেয়সী বাবাও একই ভঙ্গিতে জবাব দেয়,
-“কারণ তোমার মতো বড়লোক বাবার নষ্ট ছেলেরা মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করতে জানে। বিয়ে করে সম্মান দিতে নয়। যে ছেলে নিজের বাবাকে সম্মান দেয় না সে ছেলে আমার মেয়ে কে কি সম্মান দিবে?”
আরাবী সেদিন এক বুক আসা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো শ্রেয়সীর বাড়ির সম্মুখে। সে আসা কেবল নিরাশায় পরিপূর্ণ হয়েছে। শ্রেয়সী বাবা আরাবী কে মে’রে ছিলো সেদিন।
অতীতের কথা গুলো ভাবতেই চোখ বন্ধ করে প্রসস্থ বুকে শ্বাস টানে। ডায়েরির পানে তাকিয়ে কয়েক পাতা উল্টেপাল্টে দেখে। বেশ কয়েকটি পাতায় লেখা নেই। তার পর থেকে শুরু হয়েছে লেখা। আরাবী ভ্রু কুঁচকে আসে। মাঝখানের পাতা গুলোতে লেখেনি কেনো শ্রেয়সী? উত্তরটা জানতে লেখা পাতা পড়ায় মনোযোগ স্থীর করে। তবে থমকে যায়। তার মন এবং মস্তিষ্ক আটকা পরে যায়। শ্রেয়সীর জীবনে এতটা ভয়াবহতাও নেমে আসতে পারে? তা আরাবী কল্পনাতীত।
~চলবে……