#শ্রেয়সী
#পর্ব_১৫
#লেখনীতে_নাদিয়া_সিনহা
দেখতে দেখতে অনুষ্ঠানে দিনও চলে এসেছে। এরই মাঝে শান ভাইয়া এসে দেখা করে যায় আমার সাথে। শান ভাইয়া সুইজারল্যান্ড চলে যাবে তাই শেষ বারের মতো দেখা করতে এসেছিলো৷ আফসোস করে বলে গেছে,”এবার তোকে বাড়ি ছাড়া করতে পারলাম না রে বুচি। বাট আই প্রমিস নেক্সট টাইম এসে তোকে আজীবনের জন্য বাড়ি ছাড়া করব।” আমি রেগেমেগে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে ভাইয়া কে তাড়িয়ে দেই। যাওয়ার আগেও বার বার বলে গেছে,”তোকে যদি আমি বাড়ি ছাড়া না করেছি আমিও শান রাহমানী নই।” পেয়েছে একটা ডায়লগ। তবে মজার ব্যপার হচ্ছে শান ভাইয়া হলে আসার পর মেয়েরা ক্রাস নামক বাঁশটা খেয়েই ফেলেছে। ভাইয়া যাওয়ার পর অনেকে এসে ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেসও করেছে। আমি অবাকের চূড়ান্ত পর্যায় চলে গেছি। মেয়েদের চয়েস কতটা জ’ঘ’ন্য হলে আমার ভাই কে পছন্দ করে। ভাবতেই অবাক লাগছে।
এর মধ্যেই রোদ্দু আর নুসু এসে তাড়া দেওয়া শুরু করে। আমি আর নুসু কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেইনি। তবে রোদ্দু এখনও বিতর্কে আছে। রোদ্দু তো আজ পণ নিয়েই নিয়েছে যে করেই হোক সাজ্জাদ ভাইদের হারাবেই হারাবে। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে। না জানি বিতর্কের মাঝে রোদ্দু ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়। মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ে রোদ্দুর মাথায় ফু দিয়ে দিলাম।
কলেজে প্রবেশ করার পূর্বেই দূর থেকে দেখি আরাবী আর তার বন্ধুরা বসে আছে কলেজ গেটের সামনে। আমি প্রতিবারই কলেজে এসে ওদের ঠিক এই একই স্থানে দেখি। মনে তো হচ্ছে আমাদের আসার অপেক্ষায় এখানে দাঁড়িয়ে থাকে। কখন আমরা আসব আর এরা ঝগড়া করার সুযোগ পাবে। কাছাকাছি আসতেই আসীফ ভাইয়া উচ্চস্বরে বলে,
-“দোস্ত এক বস্তা টিস্যু আর বালতির ব্যবস্থা কর।”
ওষ্ঠে দুষ্ট হাসি নিয়ে সাজ্জাদ ভাইও উচ্চস্বরে বলে,
-“কেনো বলতো?”
-“আরে ব্যাটা বুঝিস না? এমন হার হারাব যে চোখের জলে নাকের জলে সব একাকার হয়ে যাবে বন্যা হয়ে যাবে। তার জন্য একটা বালতি রেডি রাখব।”
-“আমার বহুত আফসোস হচ্ছে। এত ঝগড়া করে কি লাভ হয় বলতো? যদি সামান্য প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দেই। ঝগড়ার অপমান হবে রে।”
এদিকে রোদ্দু রাগে ফুসছে। দু’কদম সম্মুখে পদার্পণ করতেই আমি রোদ্দুর বাহু চেপে ধরে আটকে দেই। গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে রোদ্দু ওদের শাসানোর স্বরে বলে,
-“রোদ্দু দ্যা রৌদ্রসী কখনও হারে না। ওই এক বস্তা টিস্যু আর বালতির প্রয়োজন আপনাদেরই পরবে আমার না। সামলে রেখে দিন।”
আসীফ ভাই বলে,
-“আমরা কখন বললাম ওগুলো তোমার প্রয়োজন?”
পরিস্থিতি সামলাতে আরাবী বলে,
-“কে হারবে কে জিতবে তা একটু পরই দেখা যাবে। আর প্রতিযোগিতার আগেই আমি বলে দিচ্ছি কে জিতবে।”
সবাই খুব কৌতূহল নিয়ে আরাবী পানে তাকিয়ে আছে। রোদ্দুও জামার হাতা গুটাতে গুটাতে ভাব নিচ্ছে। যেনো আরাবী ওরই নাম বলবে। সাজ্জাদ ভাইকে দেখলাম নুসুর দিকে তাকিয়ে চোখ মারছে। আর আরাবী তাকিয়ে আমার দিকেই। বেশ খানিক পর আরাবী বলে,
-“আজকের প্রতিযোগিতায় সিনিয়র টিম জিতবে।”
রোদ্দু বিষ্ময়কর চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে আরাবী পানে। রোদ্দু বেচারি ভেবে ছিলো আরাবী ওর নাম বলবে কারণ সে আমার বেস্টফ্রেন্ড তাই। কিন্তু হলো উল্টোটাই৷ আরাবী বলার সাথে সাথেই সাজ্জাদ ভাই, আসীফ ভাই সবাই জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে। রোদ্দু ফুসতে ফুসতে বলে,
-“দেখলি শ্রেয়ু? ভেবেছিলাম এই আরাবী একটু ভালো কিন্তু না এ তো দেখছি এদের চেয়েও মহা অ’স’ভ্য।”
-“রোদ্দু তুই চল আমার সাথে। ঝগড়া করে লাভ নেই। তুই-ই জিতবি দেখে নিস।”
আমি রোদ্দু কে টেনে ভিতরে নিয়ে যাই। ওখানে আর কিছুক্ষণ থাকলেই বড়সড় ঝগড়া বেঁধে যেতো। রোদ্দু এক নাগাড়ে ওদের গুষ্টি উদ্ধার করছে। বিরক্তির পরিমানটা এতই বেড়ে গেছে যে রোদ্দু কে ধমক দিয়ে বলি,
-“সব সময় এমন পটর পটর ভাল্লাগে না রোদ্দু। ওরা বললেই তুই হেরে যাবি নাকি? বকবক না করে যক্তি গুলো মনে করার চেষ্টা কর।”
নুসু বলে,
-“ঠিকি তো বলছে শ্রেয়ু। আর ওদের কি দোষ বল? মজা করেই বলেছে। তুই কেনো…..”
নুসুর কথা শেষ না হতেই রোদ্দু তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে,
-“এ্যাহ! মজাই তো করেছে রোদ্দু। সর এখান থেকে। সাজ্জাদের সাথে যে তো ইটিসপিটিস চলে তা কি জানি না নাকি? সাজ্জাদের বিপক্ষে বললে তোর জ্বলে তা বল। না হয় তোকে এত করে বললাম আমার সাথে বিতর্কে অংশ নে। নিলি না তো। এখন আসছে বড় বড় কথা বলতে। আমার সামনে থেকে সর।”
আমি আর নুসু দুজনই রোদ্দু কে একা রেখে চলে আসি। আমার ধৈর্য্য আর সহ্য হচ্ছে না ওর বকবক। মেয়েটা মাত্রাতিরিক্ত কথা বলে। বাইরে আসতেই দেখি আরাবী। আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আরাবী কে আজ অনেকটা অন্যরকম লাগছে। নতুনত্ব দেখা যাচ্ছে। কারণটা বোধ হয় তার পাঞ্জাবীতে। আরাবী কে এই প্রথম আমি পাঞ্জাবী পরিহিত দেখছি। শুভ্ররাঙা হলদেটে শরীরে জাম রঙ্গের পাঞ্জাবীটা বেশ মানিয়েছে। দুই হাতা গোটানো। বাম হাতের বাদামী রঙ্গের ঘরিটাও বেশ চোখে লাগছে। আরাবী দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সে আমার অনেকটা কাছে এসে দাঁড়ায়। আমার মুখশ্রীর সম্মুখে হাতে নাড়িয়ে ইশারা করে। আচমকা এত কাছে এসে ইশারা করায় আমি কিছুটা চমকে পিছনে চলে যাই। আরাবী আমার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
-“কি হলো? হঠাৎ এতটা ভয় পেয়ে গেলে কেনো? ভূত দেখলে নাকি?”
-“না এমনি বুঝতে পারিনি স্যরি।”
-“ইট’স ওকে! স্যরি বলার মতো তেমন কিছুই হয়নি।”
আমি মাথা নাড়িশে ‘হ্যাঁ” বোঝাই। আরাবী আমার আর তার মধ্যবর্তী দূরত্ব আরেকটু কমিয়ে এগিয়ে এসে আলতো করে আমার হাত আঁকড়ে ধরে বলে,
-“রিল্যাক্স! আমি জানি তোমার হার্ট অনেক দূর্বল। অল্পতেই ভয় পেয়ে যাও। আর রিমেম্বার দ্যাট আমি যতক্ষণ তোমার সাথে আছি ভয় পাবে না একদম। গট ইট?”
এবারও আমি মাথা নাড়াই শুধু। ললাট বেয়ে বিন্দু বিন্দু ঘামের শিশি চুইয়ে চুইয়ে গলায় পরছে। আরাবী পকেট থেকে রুমাল বের করে সযত্নে আমার ঘাম মুছে দিয়ে বলে,
-“কখনও ভয় পাবে না। মনে সাহস জুগিয়ে চলবে। যদি ভয় পাও তাহলে মানুষ তোমাকে আরও ভয় দেখাবে। আর অনুষ্ঠানের পুরোটা সময় তুমি আমার সাথে থাকবে কেমন?”
-“আচ্ছা।”
-“এবার চলো অডিটোরিয়ামে। বিতর্ক শুরু হয়ে যাবে একটু পরই।”
আরাবী আমার হাতটা শক্ত করে ধরে অডিটোরিয়ামের দিকে হাঁটা দেয়। এই ছেলেটা যতবার আমার কাছে আসে ততো বার আমার অক্ষিদ্বয় তার পানেই আটকে যায়। অন্য কোথাও দৃষ্টিপাত করাটা এক প্রকার যুদ্ধের ন্যায় ঠেকে। কি আছে তার মাঝে যা আমাকে তার প্রতি এতটা টানে।
অডিটোরিয়ামে বসে আছি। আমাকে এখানে নিয়ে আসা পর্যন্ত নিজের কাছ ছাড়া করেনি আরাবী। এখনও আমার পাশে বসে আছে। কিয়ৎ পরপর আমার দিকে পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। রোদ্দুর টিম আর সাজ্জাদ ভাইদের টিম প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। রোদ্দু আর সাজ্জাদ ভাই দুজন দজনকে ইশারায় ইচ্ছে মতো বকাঝকা করছে। প্রতিযোগিতা শুরুর আগেই এই অবস্থা। না জানি পরে কি হয়? ভয়ার্ত কন্ঠে আরাবী কে বলি,
-“দেখুন ওরা এখনই ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। প্রতিযোগিতার মাঝে তো এরা যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলবে।”
-“চিন্তা করো না সাজ্জাদ সব সামলে নিবে।”
-“ওনিই তো সবচেয়ে বড় আতংক। রোদ্দুর সাথে ঝগড়া করার একটা সুযোগও হাত ছাড়া করে না।”
-“বলেছিলাম আমি পাশে থাকতে ভয় পাবে না কখনও। আমি আছি তো।”
ব্যাস আমার অন্তরালে শিহরণের হাওয়া বইছে। ‘আমি আছি তো’ এই বাক্য একটা জাদু আছে, ভরসা আছে, যত ভয় পাই না কেনো এই একটা কথায় সব ভয় চলে যায়। আর যদি সে হয় আমার প্রিয় মানুষ তবে তো ভয়েরাও ভয় পেয়ে যাবে। আমি আরাবী থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সম্মুখে তাকাই।
রোদ্দুদের প্রতিযোগিতার টপিক সিনিয়ার জুনিয়রের রেগ নিয়ে। এই টপিকটা মূলত সাজ্জাদ ভাই দিয়েছে ইচ্ছে করে। রোদ্দু তো জোড়ালো প্রস্ততি নিয়ে এসেছে।
এক এক করে সবাই নিজেদের মত দিচ্ছি আর বিপরীত পক্ষের প্রতিযোগিরা তার বিরুদ্ধে বলছে। সাজ্জাদ ভাই বিতর্কের সময় রোদ্দু বার কয়েক বসা থেকে দাঁড়ি গেছে সাজ্জাদ ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করার জন্য। আর প্রতিবারই মডারেটর বলেছে,”মিস.রৌদ্রসী বিহেভ ইউর সেল্ফ” বলে আটকে দিয়েছে। রোদ্দু দু’হাতে মুঠো করে সব সহ্য করছে। এত সবের মাঝে কখন যে আরাবী হাত আঁকড়ে ধরেছি টেও পাইনি। বোধ হতেই আরাবী হাতটা ছেড়ে দেই। আরাবী আমার দিকে তাকিয়ে বক্র হাসি ওষ্ঠে ঝুলিয়ে বলে,
-“একবার যে হাত ধরেছো সে হাত তুমি ছেড়ে দিলেও সেই হাতের মালিক তোমাকে ছাড়ছে না।”
আমি লজ্জায় মাথা নত করে ফেলি। তখনই খুব জোড়ে চিৎকার চেচামেচি শুনতে পাই। সম্মুখে তাকাতেই দেখি সাজ্জাদ ভাই আর রোদ্দু একদম স্টেজের মাঝখানে এসে ঝগড়া করছে। একজন অন্য জন কে বলছে,
-“ঝগরুটে মেয়ে একটা। বিতর্ক করতে এসে ঝগড়া করো লজ্জা করে না?”
-“আপনাদের লজ্জা করে না? বিতর্কের নামে আমাদের অপমান করতে। কোন সাহসে বলেন আমরা সিনিয়রদের সম্মান দেই না।”
-“ওহ আচ্ছা! এখন খুব সম্মান দিচ্ছো।”
-“ভদ্র ভাবে কথা বলুন।”
পাশ থেকে স্যার ম্যাম সবাই দূরে এসে দুজন কে থামানোর চেষ্টা করছে। আমি আরাবী হাত আঁকড়ে ধরে বলি,
-“প্লিজ এই ঝগড়া থামান।”
আরাবী মাথায় হাত দিয়ে বলে,
-“সাজ্জাদটা আসলেই বজ্জাত। ভেবেছি গাধাটা সব সামলে নিবে। কিন্তু না সে নিজেও ঝগড়া করছে।”
-“এখন কি করবেন? যান গিয়ে ঝগড়া থামান।”
-“চুপচাপ এখানে বসে মজা দেখো।”
-“মজা দেখব মানে। আরে ওরা ঝগড়া করছে থামাতে হবে চলুন।”
আরাবী আমার হাত ধরে থামিয়ে বলে,
-“এদের ঝগড়া লাগা উচিত। যতো ইচ্ছে ঝগড়া করুক। আমি তুমি এখানে বসে প্রেমালাপ করি।”
না রোদ্দু থামছে না সাজ্জাদ ভাই। কেউ কারো থেকে কম নয়। সমানে কোমড় বেধে লড়াই করছে। আরাবী তো ক্ষণে ক্ষণে হেসে দিচ্ছে। স্যার, ম্যাম সহ কলেজ কর্তৃপক্ষ এসে হাজির হয়েছে ওদের ঝগড়া থামাতে। কিন্তু কিছুতেই থামছে না। স্যার বার বার ফোন হাতে নিয়ে বলছে,”এবার যদি দুজনে চুপ না করো তাহলে বাড়িতে ফোন দিব। আর রাস্টিগেট লেটার দিয়ে দিব।” আরাবী কে বার বার বলছি থামাতে। তবে সে আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। এখন স্যার যদি রোদ্দুকে রাস্টিগেট করে দেয়? তখন কি হবে?……..
~চলবে…..