#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ৩০ – অন্তিম ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
ঠিক ছয় বছর পর নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণ করে আজ তাহনা একজন সফল ডাক্তার হয়েছে। দুমাস হলো একটা সরকারি হাসপাতালে সে ডাক্তারি করছে সে। মাঝখানে কিছু সমস্যাও পোহাতে হয়েছে তাকে। কিন্তু সব বাঁধা অতিক্রম করে সে এখন ডাক্তার হিসেবে পরিচিত। তাহনা একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার।
সারাদিন পরিশ্রম শেষে বাসায় এসে তাহনা দেখে রিদ তাদের মেয়েকে নিয়ে বসে আছে। তাহনা মুচকি হাসি দিয়ে জামা কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হিতে চলে যায়। শাওয়ার শেষে রুমে এসে প্রথমে মেয়ের কাছে যায় সে।
‘আমার দুষ্ট টা কি করে?’
‘দেখতে পাচ্ছো না সে বাবার সাথে খেলছে।’
‘শুধু খেললেই হবে? খাওয়া লাগবে না?’
‘তার বাবা তাকে খাইয়ে দিয়েছে।’
‘বাপরে! তাহলে তো আর আমার প্রয়োজন নেই দেখছি। বাবাই তার মেয়েকে সামলাতে পারবে।’
‘কেন? বাবা মেয়ের মা’কে এতোদিন সামলায়নি?’
‘হ্যাঁ, খুব সামলিয়েছেন।’
‘যাও, খাবার রাখা আছে টেবিলে। খেয়ে নাও।’
‘আগে একটু আমার মেয়েকে আদর করি।’
তাহনা রিদের কাছ থেকে তার মেয়েকে কোলে নেয়। তারপর ইচ্ছেমতো আদর করতে থাকে। তাহনা ও রিদের মেয়ে জান্নাত। মেয়ের বয়স মাত্র দু বছর। বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্তটা তাহনারই ছিল। রিদ চেয়েছিল তাহনা তার পড়ালেখায় ফোকাস করুক। তার স্বপ্ন পূরণ করুক। কিন্তু তাহনার একটা বাচ্চার শখ ছিল বেশি। সে কোর্স চলাকালীনই একটা সুস্থ বাচ্চার মা হয়। তাহনা ও রিদ তাদের মেয়েকে নিয়ে খুব সুখে আছে। মেয়েকে তারা চোখের আড়াল হতে দেয়না।
.
নিচে এসে তাহনা দেখে ডাইনিং টেবিলে তার জন্য খাবার রাখা আছে। সব কিছু রেখে মিসেস ফাবিহা ওনার রুমে চলে গেলেন। তাহনা নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে করে, নইলে মায়ের মতোন একজন শাশুড়ী পায়? যে কিনা তার কাজ নিয়ে কোনোদিনও কথা শুনায়নি। বরং তার স্বপ্ন পূরণে তাকে উৎসাহিত করেছে। বাবার মতো একজন শ্বশুর পেয়েছে। যে কিনা তার বাবার মতোই তার খেয়াল রাখে। মিসেস ফাবিহা এখন আর রান্নাঘরে যান না। আলাদা সার্ভেন্ট রাখা হয়েছে রান্না করার জন্য। তবে রাতের রান্নাটা তাহনাই করে। সব মিলিয়ে একটা সুখী পরিবার হয়েছে তাদের। মিস্টার আফজাল শেখ অনেক দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। এই নিয়ে একটা টেনশন ছিল দবার মাঝে। তার চিকিৎসা চলছে। এখন বেশ ভালোই আছেই। অসুস্থ থাকা অবস্থায় মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন উনি। রাইশাও তার অনার্স শেষ করে। তাই বাবার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি। আর কি ই বা বলবে সে। যাকে ভালোবাসে তাকেই তো বিয়ে করবে। সবাই যখন রাজি। তখন আর বাঁধা কিসের। মিসেস ফাবিহা আর মিস্টার আফজাল শেখ এখন ব্যস্ত থাকেন জান্নাত কে নিয়ে৷ রিদ তাহনা তাদের কাজে চলে গেলে মিসেস ফাবিহা আর মিস্টার আফজাল শেখ তার সাথে খেলা করে। তাকে খাওয়ায়। মিস্টার আফজাল শেখ এখন আর অফিসে তেমন যান না। অফিস দেখার দায়িত্ব এখন তাহনার বাবার উপর পড়েছে। তাহনার বাবা খুব সুন্দর করে অফিস সামলান। কাজের ফাঁকে প্রতিদিনই মেয়ে আর তার পরিবারের সবাইকে দেখতে আসেন। একা থাকতে অসুবিধা হয় বলে সবাই তাকে এখানে চলে আসতে বলেন। এহসান সাহেবও আর দ্বিমত করেননি। এক মাসের মধ্যেই তিনি মেয়ের বাসায় চলে আসবেন বলে জানিয়েছেন। জান্নাত তাদের সবার চোখের মনী।
*
বারান্দায় বসে স্থির চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে রাইশা। সময়গুলো কিভাবে চলে যায় বোঝা মুশকিল। এই যে এতো গুলো বছর পেরেয়ে গেল। মনে হচ্ছে ওই তো সেদিন ই রাফির সাথে দেখা হয়েছিল। রাইশার ভাবনার মাঝেই রাফি সেখানে উপস্থিত হয়। সে রাইশার কাঁধে হাত রেখে বলে,
‘মন খারাপ?’
রাইশা কেমন করে যেন রাফির দিকে তাকিয়ে থাকে৷ রাফির বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। রাইশা এমন করে কেন তাকিয়ে আছে? রাফি আবারও জিগ্যেস করে,
‘শরীর খারাপ তোমার? কি হয়েছে? বলো আমাকে?’
রাইশা কাঁন্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
‘আপনি আমায় অনেক ভালোবাসেন তাইনা?’
‘কি আজব প্রশ্ন! তুমি এই চিনলে আমাকে?’
‘বলুন না।’
‘হ্যাঁ, অনেক ভালোবাসি তোমাকে।’
‘ধরুন, আমি যদি কোথাও চলে যাই তাহলে ভালোবাসবেন?’
রাফির মুখে চিন্তার ছাপ। সে রাইশার হাত ধরে বলে,
‘কি হয়েছে তোমার রাইশা? এসব কি বলছো তুমি? কোথায় যাবে তুমি আমাকে ছাড়া? কেন এমন কথা বলছো তুমি, বলো আমাকে।’
রাইশা হুট করেই রাফিকে জড়িয়ে ধরে হুঁ হুঁ করে কেঁদে দেয়৷ রাফির টেনশনে মাথা কাজ করছে না। রাফি আবারও বলে,
‘রাইশা তুমি বলবে কি হয়েছে? খারাপ স্বপ্ন দেখেছ? না বললে বুঝবো কিভাবে বলোতো।’
‘আমার কেন জানি না মনে হয়, আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না।’
‘এসব কি বলছো তুমি? এ কথা মুখেও এনো না রাইশা৷ আমি পারবো না সহ্য করতে। প্লিজ বন্ধ করো।’
‘আমি কি করবো।’
‘রাইশা ভুলে যেও না তুমি প্রেগন্যান্ট। এখন এসব বলে নিজের ক্ষতি করো না। তোমার সাথে আমাদের বেবি আছে ভুলে যেও না। আমি তোমার কিচ্ছু হতে দেবো না।’
‘আমি চাইনা আপনার ভালোবাসা ছিন্ন করে এতো তাড়াতাড়ি পরপারে চলে যেতে।’
‘রাইশা! কতবার বলবো, এসব আমি শুনতে চাইছিনা।’
‘আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি রাফি।’
‘আমি জানি তো। আমিও তো তোমায় ভালোবাসি বলো। এসব কথা বললে আমার ভালো লাগে বলো? কাঁন্না থামাও প্লিজ। আমাদের বেবির ক্ষতি হবে। অতিরিক্ত টেনশন করো না৷ বাঁচা মরা আল্লাহর হাতে। তোমার এমন কিছুই হয়নি যে, তুমি আগে থেকেই বলতে পারবা তোমার সময় নেই। এসব ভুলভাল চিন্তা বাদ দাও। আমাদের বেবিকে মানুষ করতে হবে না?’
রাইশা আরও শক্ত করে রাফিকে জড়িয়ে ধরে। দুই বছর একসাথে থাকার পর রাফিকে সে যতটুকু চিনেছে রাফি তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তার কিছু হলে রাফি ভেঙে পড়বে। নিজেকেই শেষ করে দিবে।
*
রাতের নিস্তব্ধতায় পূর্ণিমার আলোতে বারান্দায় বসে কফি খাচ্ছিল রিদ আর তাহনা। মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে তাহনা বারান্দায় আসে। সুন্দর সময়টাকে উপভোগ করতে থাকে কিছুক্ষণ বাদে রিদও তাহনার সাথে যোগ দেয়। তাহনা রিদকে জিগ্যেস করে সে কফি খাবে কিনা? রিদ জানায় সে কফি খেতে ইচ্ছুক। ব্যাস, তাহনা চট করে নিচে গিয়ে দুজনের জন্য দু কাপ কফি বানিয়ে আনে। বারান্দায় বসে দুজন গল্প করতে করতে কফি খায়। কফি খাওয়া শেষ করে কাপ দুটি এক পাশে রেখে দেয় তাহনা। তারপর গুটিশুটি হয়ে রিদের বুকে মাথা রাখে। রিদ তাহনাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। রিদের বুকের হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে তাহনা। দ্রুত গতিতে চলছে। দুজন মিলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ রিদ বলে উঠে,
‘হাজার লোকের ভিড়ে আমি আমার প্রিয়দর্শিনীকে খুঁজে পেয়েছি। তাকে আমি হারাতে দেবো না। সবসময় আগলে রাখবো মনের মনিকোঠায়।’
তাহনা হেসে উঠে৷ সেও বলে,
‘ভুল লোকের হাত ধরে যখন ধোকা খেয়েছিলাম। তখন আপনি নামক মানুষটা আমার জীবনে এলেন। তারপর আমার জীবন টাই পাল্টে গেল। আমি বুঝতে পারলাম সত্যিকারের ভালোবাসা কি। আর তা কেমন হয়। ধন্যবাদ রিদ, আমার জীবনে আসার জন্য। আমাকে এতো ভালোবাসা দেওয়ার জন্য।’
‘আমি চাই আমার মেয়ে তোমার মতোই মিষ্টি, সরল ও ভালো মনের মানুষ হোক।’
‘দোয়া করুন রিদ। আল্লাহ যেন আমাদের মেয়েকে ইমানের পথে চলতে সাহায্য করেন। গুনাহ থেকে দূরে রাখেন।’
‘অবশ্যই তাহনা। আমি আমার মেয়ের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি। তাকে যেন কোনো বিপদই ছুতে না পারে।’
রিদ তাহনার এক হাত নিজের হাতের উপর রাখলো। তারপর তাহনার সেই হাতের উল্টোপিঠে একটা চুমু এঁকে দিল। ভালোবাসা অনেক সুন্দর হয়, যদি মানুষ তাকে সম্মান করতে জানে।
[ সমাপ্ত ]
(পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ।😴)