#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ১৯ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
বাসার ভিতর একজন পুলিশ অফিসারকে দেখে তাহনা ভয় পেয়ে যায়। সকালবেলায় বাড়িতে পুলিশ কেন এসেছে সেটাই বুঝতে পারছেনা সে। তাহনা সকালে উঠে সবার জন্য ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছিল। এমন সময় কলিংবেল এর আওয়াজ পেয়ে তাহনা ভরকে যায়। কেউ না থাকায় তাহনা মাথার ঘোমটা টা কপাল পর্যন্ত দিয়ে বাসার দরজা খুলে দেয়। ঠিক তখনই পুলিশের পোশাক পড়া একজনকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। তাহনা বোকার মতো এখনো দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। মধ্যবয়স্ক লোকটা হেসে বলল,
‘কি গো? এখনো বাইরে দাঁড়া করিয়ে রাখবে? ভিতরে আসতে দিবে না?’
‘না মানে আপনি কে?’
লোকটা হেসে বলল,
‘আগে ভিতরে তো ঢুকতে দাও।’
তাহনা দরজার পাশ থেকে সরে দাঁড়ালো। লোকটা ভিতরে ঢুকে মিস্টার আফজাল শেখ এর নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। নিজের নাম কারো মুখ থেকে শোনার পর ঘর থেকে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এলেন মিস্টার আফজাল শেখ। লোকটাকে দেখেই খুশিতে জড়িয়ে ধরলেন উনি। তাহনা রান্নাঘরে গিয়ে সবার জন্য চা করছে। আফজাল শেখ তার স্ত্রীকে নিয়ে লোকটার সাথে কথা বলছেন সোফায় বসে। তাহনা চা করে সবার সামনে দিল।
মিস্টার আফজাল শেখ তাহনাকে বললেন,
‘তাহনা, ইনি হচ্ছেন আমার বন্ধু এস আই নিজাম উদ্দিন। আর নিজাম এ হচ্ছে আমার একমাত্র পুত্রবধূ ও আমার দ্বিতীয় মেয়ে তাহনা।’
এস আই নিজাম একটু হেসে বললেন,
‘তোকে বলতে হবে না আমি চিনতে পেরেছি।’
তাহনা নিজাম উদ্দিন কে সালাম দিলেন। উপর থেকে রাইশা আর রিদ একসাথে নিচে নেমে এলো। মিস্টার আফজাল শেখ ওদের সাথে নিজাম উদ্দিন এর পরিচয় করিয়ে দিলেন।
নিজাম উদ্দিন কিছুক্ষণ থাকার পর ওখান থেকে চলে গেলেন। মিস্টার আফজাল শেখও বেড়িয়ে পড়লেন অফিসে। রিদ তাহনা ও রাইশা মিলে ব্রেকফাস্ট করছে। রিদের শরীর তেমন একটা ভালো নেই। খাবার টেবিলে যে কিনা সবাইকে মাতিয়ে রাখতো আজ সে এতো চুপচাপ। রাইশা পাশ থেকে বলে উঠে।
‘ভাইয়ু? কি হয়েছে তোমার? তুমি এতো আপসেড কেন? একটা কথাও বলছো না আজ।’
রিদ আস্তে করে বললো,
‘কিছুনা। আমার খাওয়া হয়ে গেছে আমি যাচ্ছি।’
খাবার টেবিল থেকে উঠে ধপধপ পা ফেলে রিদ সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। তাহনার রিদকে আজিব লাগছে। মনে হচ্ছে রিদের শরীর ভালো নয়। তাহনাও আর খেলো না। সে সব গুছিয়ে উপরে তার রুমে চলে গেল।
তাহনা রুমে এসে দেখে রিদ লম্বা হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তাহনা রিদের কাছে এসে তার কপালে হাত দিতেই রিদ চমকে উঠে। তাহনা ঘাবড়ে যায়।
‘কি হয়েছে আপনার? কপালে হাত দিয়ে দেখলাম অনেক জ্বর।’
‘আমার কিছু হয়নি তাহনা। ঠিকাছি আমি।’
‘কি বলছেন এসব। এতো জ্বর উঠেছে আর আপনি বলছেন আপনি ঠিক আছেন? আমি আপনার জন্য জলপট্টির ব্যবস্থা করছি দাঁড়ান।’
তাহনা এ কথা বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে গেল৷ রিদের গায়ে জ্বরের পাশাপাশি তার মাথাটাও প্রচন্ড ব্যথা করছে। রিদ তাহনাকে কিছু বলারও সুযোগ পায়নি। শুধু শুধু তাহনাকে খাটানোর ইচ্ছে তার নেই।
দুই মিনিটের মধ্যে তাহনা জল আর গামছা নিয়ে এলো। রিদ শুয়ে আছে। তাহনা গিয়ে রিদের পাশে বসলো। তারপর আস্তে আস্তে রিদের কপালে জলপট্টি দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ এভাবে দেওয়ার পর রিদ হঠাৎ মুখ ফুটে তাহনাকে বলে,
‘আমার মাথাটা একটু টিপে দিবে তাহনা?’
তাহনা জলপট্টি এপাশে রেখে রিদের কপালে হাত দিল। রিদের চুলগুলো আস্তে আস্তে টেনে দিল৷ আস্তে আস্তে কপাল টিপে দিতে লাগলো। তারপর ড্রয়ারে রাখা ঔষধ এনে রিদকে খাইয়ে দিল। তাহনা রিদের পাশে বসে রইলো৷ যদি রিদ কিছু চায় সে যেন দিতে পারে।
দরজার আড়াল থেকে মিসেস ফাবিহা এবং রাইশা তাহনার কার্যকলাপ দেখছে। তাহনার রিদের প্রতি এতো যত্নশীল হওয়াটা ওনাকে ভিষণ ভালো লেগেছে।
.
দুপুরের রান্না শেষ করে তাহনা নিজের ঘরে এসে দেখে রিদ খাটের সাথে বালিশ রেখে তার মধ্যে হেলান দিয়ে আছে। তাহনা রিদের কাছে এসে বলে,
‘আপনি এখন ঠিকাছেন?’
‘হুম। আজ অফিসে যেতে পারলাম না। অনেক চেষ্টা করেছি শোয়া থেকে উঠার। কিন্তু পারলামই না।’
‘একদিন অফিসে না গেলে কিচ্ছু হয়না।’
‘তুমি তো অনেক ঘেমে গেছ। রান্না করেছ নিশ্চয়ই? তাহনা? আমার মা কি তোমাকে বলেছে রান্না করতে? আসতে না আসতেই অন্যসব বউদের মতো কি শুরু করেছ বলোতো?’
‘রান্না করতে আমার ভিষণ ভালো লাগে। মা কয়েকদিন রেস্ট নিক। পরে আবার অ্যাডমিশনের চক্করে পড়ে গেলে আর রান্নাঘরের দিকে যেতেই পারবো না।’
‘ফ্রেশ হয়ে নাও। আজান দিচ্ছে নামাজ পড়তে হবে।’
‘আচ্ছা।’
তাহনা যেতে নিয়েও আবার থেমে যায়৷ রিদের দিকে ফিরে তাকিয়ে তার কপালে হাত দিল।
‘জ্বর অনেক কমেছে, কিন্তু তারপরও ঔষধগুলো খেতে হবে আপনাকে।’
‘ঔষুদ খেতে ইচ্ছে করে না।’
‘ঔষুধ না খেলে সুস্থ হবেন কিভাবে?’
‘আল্লাহ ভরসা।’
তাহনা মুচকি হেসে ওখান থেকে চলে গেল।
.
রাতের দিকে একটু দেরি করেই বাসায় ফিরলেন মিস্টার আফজাল শেখ। এদিকে ওনার জন্য সবাই টেনশন করছেন। হুট করেই একটা কল আসার পর সন্ধ্যায় উনি বের হয়ে যান বাসা থেকে। তারপর থেকে ওনাকে আর ফোনে পাওয়া যাচ্ছেনা।
মিস্টার আফজাল শেখ বাসায় ফেরার পর সবাই যেন প্রাণ ফিরে পেল। রিদ তার বাবাকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলো,
‘কোনো সমস্যা বাবা? কিছু না বলে চলে গেলে আবার এতো রাত করে বাসায় ফিরেছ?’
‘না না। তেমন কিছু না। নিজাম কল দিয়েছিল। তাই ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।’
মিসেস ফাবিহা উঠে বললেন,
‘সকালে না আসলো? আবার ডেকে পাঠালো কেন? আর তুমিই বা কি? কতোগুলো কল দিলাম। একটা কলও রিসিভ করোনি যে?’
মিস্টার আফজাল শেখ সোফায় বসতে বসতে বললেন,
‘আরে, সব কথার উত্তর দিচ্ছি। একটু অপেক্ষা করো।’
এককোণে তাহনা আর রাইশা দাঁড়িয়ে আছে। ওরাও খুব টেনশন করছিল আফজাল শেখকে নিয়ে। মিস্টার আফজাল শেখ বললেন,
‘নিজাম একটা প্রস্তাব দিয়েছে। আমি এখনো কিছু বলিনি। শুধু এইটুকুই বলেছি যে আমার পরিবারের সাথে কথা বলে জানাবো।’
রিদ জিজ্ঞেস করে,
‘কি প্রস্তাব দিয়েছে বাবা?’
‘নিজাম বলছিল তার একটা ছেলে আছে, অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। সে চাইছে তার ছেলের সাথে আমাদের রাইশার বিয়ের সম্মন্ধ করতে।’
রাইশা কথাটা শুনেই দু পা পিছিয়ে গেল। রিদ উত্তেজিত হয়ে বলে,
‘বাবা তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? রাইশার এখনো বিয়ের বয়সই হয়নি। এখনো এইচএসসি পরীক্ষাও দিল না। আর তুমি কিনা ওর বিয়ে নিয়ে ভাবছ?’
মিসেস ফাবিহা বললেন,
‘রিদ তো ঠিকি বলছে, রাইশার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি।’
‘তোমরা এতো উত্তেজিত হচ্ছো কেন? দিনকাল ভালো না। কখন কি হয়ে যায়। রাইশা যদি কোনো ভুল করে বসে। আমার টেনশন বেড়ে যাচ্ছে ওকে নিয়ে সবসময়। তাছাড়া ছেলেও তো পড়ালেখা করে। দরকার পড়লে বিয়ে পড়িয়ে আমার বাসায় রেখে দিব। এরপর ও বিয়ে পড়া শেষ হলেই ওকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিব।’
রাইশার চোখ টলমল করছে। তার বাবা তাকে নিয়ে এতো চিন্তা করে যে তাকে এইচএসসি দেওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছে।
রিদ বলে,
‘তুমি রাজি হয়ে গেছ বাবা?’
‘আমি তোমাদের মতামত চাইছি৷ তাছাড়া রাইশার আর দু মাস পরই তো ১৮ বছর হয়ে যাবে। সমস্যা কি? ওরা কালই আমাদের ওদের বাড়িতে লাঞ্চে ডেকেছে। ছেলেও থাকবে, ছেলেকেও আমরা দেখবো৷ আমাদের ভালো না লাগলে বিয়ে নিয়ে কথা বলবো না।’
রিদ বলে,
‘তুমি যা ভালো জানো করো। কিন্তু পরে কিছু হলে আমাকে বলতে এসো না।’
রিদ এটা বলেই উপরে চলে যায়। অন্যদিকে রাইশা চোখে পানি নিয়ে দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসে। তারপর দরজা বন্ধ করে বিছানায় বালিশ জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে৷ ওর এ বাড়িতে সময় ফুরিয়ে আসছে খুব শিগ্রই।
চলবে…