প্রিয়দর্শিনীর খোঁজে পর্ব ১৮

0
569

#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ১৮ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

প্রথম বর্ষের রেজাল্ট না দিতেই দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হয়ে গেল রাইশাদের। আজ সে কলেজে এসেছে। বোরকা আর হিজাব পড়েই এসেছে। তাহনা সুন্দর করে তাকে হিজাব বেঁধে দিয়েছে তাকে।

কলেজে সবার সাথে মন দিয়ে ক্লাস করে রাইশা। তারপর বান্ধবীরা আবদার করে ফুসকা খাওয়ানোর জন্য। রাইশার শরীর তেমন ভালো লাগছে না। কিন্তু রাইশা তাদের কথা ফেলতে পারেনি। তাই তাদের নিয়ে কলেজ গেইটের বাইরে চলে আসে ফুসকা খাওয়ার জন্য।

ফুসকা ওয়ালা মামা খুব সুন্দর করে ফুসকা বানিয়ে তাদের দিল। সবাই মজা করে খাচ্ছিল। সাথে খোস গল্প তো আছেই। খাওয়া শেষে রাইশা যখন টাকা দিতে লাগলো তখন রাইশার পাশে কেউ এসে দাঁড়ালো। রাইশা পাশে তাকিয়ে দেখে রাফি দাঁড়িয়ে আছে। রাইশা দ্রুত টাকা দিয়ে ওখান থেকে চলে আসে। রাইশার পিছনে রাফি আসতে থাকে। রাফি অনেকবার রাইশাকে ডাকতে থাকে। কিন্তু রাইশা পা চালিয়ে যাচ্ছে। থামার নাম নিচ্ছেনা।

হঠাৎ করেই রাফি দৌড়ে এসে রাইশার সামনে এসে থামে৷ রাইশা আর পা চালাতে পারলো না। ওখানেই থেমে গেল। রাফি বিরক্তি নিয়ে বললো,

‘আপনার সমস্যা কি? ডাকছি শুনতে পাননি? না শোনার ভান করছেন কেন? পালিয়ে যাচ্ছেন কেন? আমি কি বাঘ?’

রাইশা শক্ত মুখ করে চুপ করে আছে। রাফি ভ্রু কুচকে আবার জিজ্ঞেস করলো।

‘কি হয়েছে আপনার? মুখ ভার কেন?’

‘সেই কৈফিয়ত কি আপনাকে দিতে হবে? পথ ছাড়ুন আমি বাসায় যাবো।’

রাইশার কঠোর গলায় বলা কথাগুলো রাফির মনে আঘাত হানে। রাফি নরম সূরে বলে,

‘আমি সেদিনের জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। দেখুন, আমার জন্যই আপনার বাবা আপনাকে চড় মেরেছেন। সত্যিই বুঝতে পারিনি আমার বাইকে উঠার অপরাধে আপনাকে এতো কথা শুনতে হবে।’

‘আর ক্ষমা চাইতে হবে না। আপনি আর আমার সামনেই আসবেন না। প্লিজ আমায় একটু শান্তিতে থাকতে দিন।’

‘স্যরি মিস। আর আসব না। কথা দিচ্ছি সত্যিই আর আসব না আপনার সামনে।’

রাফি কথাগুলো বলেই হনহন করে ওখান থেকে চলে গেল। রাইশা রাফির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

‘ছেলেটার কথাগুলো এমন শোনালো কেন? মনে হচ্ছে খুব কষ্ট পেয়েই বলল এসব।’

রাইশা মনে মনে এসব ভাবতে লাগলো। তারপর একটা রিক্সা নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

*
রুমের মধ্যে পায়চারী করছে তাহনা। আজ তার রেজাল্ট দিবে। রিদ ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে তাহনার রেজাল্ট ইন্টারনেটে দেখবে বলে। তাহনার খুব ভয় হচ্ছে। যা পরিক্ষা দিল সেই অনুযায়ী যদি রেজাল্ট না আসে? যদি ভিন্ন কিছু হয়? সে কিভাবে সবাইকে মুখ দেখাবে? রিদ তাহনার পায়চারী দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।

‘আপনি কিছু বের করতে পারলেন?’

‘এতো অধৈর্য্য কেন তুমি? অপেক্ষা করো দেখছি আমি।’

তাহনা কিছু না বলে চুপ করে থাকে। রিদ কিছুক্ষণের মধ্যেই তাহনার রেজাল্ট বের করে ফেলে৷ রেজাল্ট দেখার পর সে একবার তাহনার দিকে তাকায়৷ তাহনা রিদের তাকানো দেখে ঢোক গিলছে। রিদ এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? রেজাল্ট কি খারাপ হয়েছে?

‘এভাবে কি দেখছেন? বলুন না কি এসেছে?’

‘এসএসসি তে কত পেয়েছিলে?’

‘৪.৮৮।’

‘আর এখন কত পেয়েছ জানো?’

‘কত? খারাপ হয়েছে কি?’

‘তুমি কি এ প্লাস এর আশা করো?’

‘মোটেও না। পরিক্ষা ভালো হয়েছে কিন্তু এ প্লাস পাবো ওরকম মনে হয়না।’

‘কংগ্রাচুলেশনস। ৪.৯৩ পেয়েছো।’

‘কিইই? আলহামদুলিল্লাহ৷ ধন্যবাদ আমি আরও খারাপ ভেবেছিলাম যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন।’

রিদ অট্টহাসি হেসে উঠে। তাহনা কাচুমাচু হয়ে বলে,

‘এতো হাসার কি আছে শুনি?’

‘হাসার মতোই পরিস্থিতি হলে তো হাসবোই।’

তাহনা ভেংচি কাটে। রিদ বাঁকা হেসে বলে,

‘কি চাই তোমার?’

তাহনা চুপ করে আছে। রিদ আবার জিজ্ঞেস করে,

‘বলো কি চাই?’

‘কি চাই মানে?’

‘তুমি এতো ভালো রেজাল্ট করেছ আমার উচিৎ না তোমাকে একটা গিফট দেওয়া?’

‘আমি কি এ প্লাস পেয়েছি?’

‘বোকার মতো কথা বলো কেন? এ প্লাস পেতেই হবে এটা কোথায় লেখা আছে? আর এ প্লাস পেলেই গিফট দিব না পেলে দিব না এটাও বা কোথায় লেখা আছে?’

‘আমার কিচ্ছু লাগবে না। আপনি শুধু আমার পাশে থাকুন সবসময়। এটাই চাই। কখনো হাত ছাড়বেন না।’

‘বর কখনো হাত ছেড়ে চলে যায় নাকি? আচ্ছা শোনো। মেডিকেল এ অ্যাপ্লাই করার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নাও।’

‘পারবো?’

‘পারবে না কে বললো? দেখো না চেষ্টা করে।’

রাইশা হন্নি হয়ে রিদের ঘরে ঢুকে৷ তাহনার কাছে গিয়ে বলে,

‘তোমার রেজাল্ট কি ভাবি?’

‘৪.৯৩।’

‘মাশআল্লাহ। অনেক ভালো করেছ। কংগ্রাচুলেশনস।’

‘ধন্যবাদ আপু।’

রিদ ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘রাইশা আজ একটা বারবিকিউ পার্টি হয়ে যাক?’

রাইশা খুশিতে লাফিয়ে উঠে।

‘এই ভাইয়ু তুমি আমার মনের কথা কিভাবে বললে? আজ অনেক মজা করবো। সন্ধ্যার পর থেকে সবাই ছাদে থেকো।’।

রাইশা চলে গেল৷ তাহনা রিদের কাছে এসে বলে,

‘কি দরকার এসবের?’

‘ছোট ছোট আনন্দগুলো উপভোগ করতে শিখ।’

*

রাতের দিকে ওরা মিলে ছাদে বারবিকিউ পার্টি করে। এদিকে তাহনার রেজাল্টের খবর শুনে তাহনার বাবা মিষ্টি নিয়ে আসে রিদের বাড়িতে। তাহনা তার বাবাকে দেখে খুব খুশি হয়। সবাই মিলে একসাথে অনেকক্ষণ আড্ডা দেয়। তারপর নিচে এসে সবাই খাবার খেয়ে যে যার রুমে চলে যায়। তাহনার বাবা আজ এখানেই থেকে যান।

রিদ একটু বাইরে গিয়েছিল। একটা ফার্মেসিতে। গায়ে জ্বর জ্বর লাগছে। তাই ঔষধ আনতে গিয়েছিল। বাসায় ফিরে এসে দেখে তাহনা রুমে নেই। ঔষধগুলো টেবিলের উপর রেখে তাহনাকে খুঁজতে থাকে। তারপর বারান্দায় গিয়ে দেখে তাহনা ওখানেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিরবে চোখের পানি ফেলছে। রিদ স্তব্দ হয়ে যায়। তাহনা কাঁদছে কেন হঠাৎ শুধু এই প্রশ্নটাই ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সে তাহনাকে জিজ্ঞেস করে,

‘তুমি কাঁদছো কেন?’

তাহনা কিছু বলে না। চুপ করে কেঁদে যাচ্ছে। রিদ আবারও জিজ্ঞেস করে,

‘এই তুমি বলবে তোমার কি হয়েছে? কাঁদছো কেন বলবে তো!’

তাহনা আস্তে করে বলে,

‘মা, মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে আমার।’

‘তাই বলে এভাবে কাঁদে কেউ? মন খারাপ করোনা তাহনা। তোমার মা নেই তো কি হয়েছে। আমার মা আছেন না।’

‘আপনি বুঝবেন না রিদ ভাইয়া।’

‘এই তুমি আমায় ভাইয়া ডাকছ কেন? আমি কি তোমার ভাইয়া লাগি এখনো?’

তাহনা আবারও চুপ। রিদের চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। এতো নাক কাঁদা মানুষ রিদের পছন্দ না। কিন্তু তাহনা কেঁদেই যাচ্ছে বারংবার। রিদ কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। সে তাহনার এক হাত ধরে তাকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তাহনা জড়োসড়ো হয়ে রইলো। রিদ তাহনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কিচ্ছু বললো না। এভাবে অনেক্ক্ষণ যাওয়ার পর তাহনার কাঁন্না থেমে যায়। কাঁদতে কাঁদতে সে যে কখন রিদের বুকে ঘুমিয়ে পড়ে রিদ বুঝতেই পারেনি। রিদ যখন দেখলো তাহনা ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন সে তাহনাকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর একটা কম্বল তাহনার গায়ে জড়িয়ে দিল। ঔষধগুলো খেয়ে সেও আস্তে করে শুয়ে পড়লো। রিদ তাহনার দিকে এক নজর তাকালো। কি নিষ্পাপ মুখশ্রী তাহনার। এই মেয়েটার মনে অনেক কষ্ট লুকিয়ে আছে, কিন্তু সে তা প্রকাশ করে না। নিজের মতো করে কষ্টগুলোকেও আড়ালে রাখে। রিদ নিজেকে প্রমিস করে। তাহনাকে সে ভালো রাখবে। নিজের কাছে আগলে রাখবে সবসময়। এক সময় রিদের চোখেও ঘুম নেমে এলো। এবং সেও ঘুমিয়ে পড়লো।

*
রাইশা পড়তে বসছিল। কিন্তু সে কিছুতেই পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। তার চোখের সামনে আজকের ঘটনাগুলো ভাসছে। বিশেষ করে কলেজে রাফির সাথে দেখা হওয়ার কথা কিছুতেই মাথা থেকে বের করতে পারছে না রাইশা।

‘আশ্চর্য! কেন ওই ছেলেটাকে দেখছি এতো৷ আচ্ছা, আজ কি একটু বেশিই বলে ফেললাম ছেলেটাকে?’

রাইশা বই বন্ধ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে আছে সে। অল্প অল্প শীতল বাতাস বইছে। রাইশা চোখ বন্ধ করে শীতল বাতাশ গায়ে মেখে অনুভব করতে লাগলো। হুট করেই রাইশার ভাবনার রাফি চলে আসে। রাইশা চোখ বন্ধ করতেই রাফির সেদিনের ঠোঁটের কোণে ঝুলানো মুচকি হাসির মুখশ্রী দেখতে পায়। রাইশা ধুম করেই চোখ খুলে নেয়। তারপর রেগে রুমে চলে আসে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here