#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ৭ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
সিআরবি তে ঘুরতে এসেছে রিদ,তাহনা আর রাইশা। তাহনা এই প্রথম এলো। নিজ শহরের জায়গাগুলো এত সুন্দর তা কল্পনাও করেনি তাহনা। আসলে সে তেমন ঘোরাঘুরির সুযোগ পায়নি। ঘুরতে যাবার নাম নিলেই বাবার কড়া নিষেধ। আসার সময় নিজের সাথে রাইশা কেও বোরকা হিজাব পড়িয়ে এনেছে তাহনা। একজন বোরকা হিজাব পড়বে, আর একজন পড়বে না। ব্যাপারটা কেমন দেখায়? তাছাড়া নারীদের পর্দাতেই বেশী সুন্দর মানায়।
রিদ একটা ফুসকার দোকানে ওদের নিয়ে যায়। দু প্লেট ফুসকা অর্ডার করে রাইশা আর তাহনার জন্য। তাহনা এত লোক দেখে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে গেছে।
‘ভাইয়া, এখানে অনেক লোক৷ আমি অন্য কোথাও যাবো৷’
রিদ তাহনা আর রাইশাকে নিয়ে অন্য একটা জায়গায় চলে যায়। সেখানে ওদের পাহারা দেয় রিদ। তাহনা অনেক জোর করে রিদকে তাদের সাথে খাওয়ার জন্য। কিন্তু রিদ বলে, এসব ভালো লাগে না। তাহনা আর কথা বাড়ায় না। অনেক্ক্ষণ ঘুরে তারা বাড়ি ফিরে।
.
সন্ধ্যায় সবে পড়তে বসেছিল তাহনা। বইয়ের ভাজে একটা চিরকুট দেখে সে নিজেই বিস্মিত। তারপর সেই চিরকুট খুলে দেখে ওটা তারই লেখা। তানভির কে নিয়ে লিখেছিল কয়েকটা লাইন। তানভিরের কথা মনে পড়তেই তাহনার বিরক্তি লেগে উঠল। তবে আজকাল তানভিরের কথা তার একদমই মনে পড়েনা। যে মানুষটাকে সে ভালোবেসেছিল এখন তার কথাই সে এ ক’দিনে ভুলে গেছে। ব্যাপারটা বড্ড অদ্ভুত লাগল তাহনার কাছে। আচ্ছা তানভিরকে কি সত্যি তাহনা ভালোবেসেছিল? তাহলে ছেড়ে যাওয়ার পর এত কেন তাকে মনে পড়ে না?
তাহনা মাথা থেকে এই চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ায় মন দিল। কাল রিদ চলে যাবে খুলনায়। কবে আসবে তার ঠিক নেই। অফিসিয়াল কাজের জন্য তাকে খুলনা যেতে হচ্ছে। তাহনার সাথে আর দেখা নাও হতে পারে। তাই তাহনা ভাবল, রিদকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া দরকার৷ তার জন্য অনেক কিছুই সে করেছে। তাহনা আবার পড়ায় মনোযোগ দিল।
.
রিদ নিজের রুমে বসে ব্যাগে কাপড় ভরছে। সকাল সকাল রিদকে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। প্রয়োজনীয় সব জিনিস, কাগজ পত্র ব্যাগে গুছিয়ে নিল সে। প্রচন্ড মাথা ব্যথাও উঠেছে তার। শরীরটাও ভালো লাগছে না। আবার কাল তাকে যেতেই হবে।
রিদ নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে নিচে ড্রয়িংরুমে এলো। তার মাকে রান্নাঘরে দেখে সে বলল,
‘মা এক কাপ কফি বানিয়ে দাও প্লিজ।’
ছেলের কথায় মিসেস ফাবিহা চট জলদি কফি বানিয়ে দিলেন। রিদ সোফায় বসে মাথায় হাত দিয়ে ছিল৷ তার মা কফি হাতে কাছে এসে তাকে বলল,
‘এই নে! তোর কফি’
রিদ তার মায়ের হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে খেতে শুরু করল। এক চুমুক দিয়ে বলল,
‘খুব মিস করব তোমায় মা। সবদিক সামলে রেখো। বিশেষ করে তোমার মেয়ে আর তাহনাকে একটু দেখো।’
রিদের মা রিদের মাথায় হাত রেখে বলল,
‘কদিনের জন্য যাচ্ছিস রে? ফিরতে কি দেরি হবে?’
রিদ বলল,
‘হুম। দেরি হবে।’
‘নিজের খেয়াল রাখিস।’
এটা বলেই মিসেস ফাবিহা ওখান থেকে প্রস্থান করলেন।
.
রাত এগারোটা বেজে চার মিনিট। খাওয়া দাওয়া সেড়ে রিদ, রাইশা আর তাহনা মিলে ছাদে গল্প করছিল। রাইশার কলেজে নতুন টিচার এসেছে। অনেক গরম স্যার। একদিনেই ক্লাসের ছেলেদের অবস্থা খারাপ করে দিয়েছে। এসব বলেই হাসলো রাইশা। সেই সাথে তাহনা আর রিদও হাসলো। রাইশার এক বান্ধবী কল দেওয়ায় সে নিচে চলে গেল। তাহনা যায়নি। রিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা দেখছে।
তাহনা রিদকে এই ফাঁকে বলল,
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’
রিদ অবাক হয়ে তাহনার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ধন্যবাদ! হঠাৎ?’
তাহনা মিষ্টি হেসে বলে,
‘আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। যার প্রতিদান আমি কখনোই দিতে পারব না।’
রিদ ঠোঁট চেপে ধরে বিরক্তি প্রকাশ করল। তারপর বলল,
‘তোমার জন্য আমি কিছুই করিনি। এত বেশি ভেবো না।’
‘জানেন ভাইয়া, তানভিরের কথা আমার একটুও মনে পড়ে না।’
তাহনার কথায় তাজ্জব বনে গেল রিদ। সে তাহনাকে প্রশ্ন করল,
‘মনে না পড়াই ভালো। ভুলে যাও অতীত। বর্তমানকে সময় দাও। সামনে তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।’
‘আচ্ছা, তানভিরকে কি আমি সত্যি ভালোবেসেছিলাম?’
আনমনে বলে উঠে তাহনা। রিদ সোজাসুজি ভাবে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,
‘তোমাদের সম্পর্কটা কেমন ছিল তাহনা?’
তাহনা অবাক হয়ে বলে,
‘মানে! বুঝিনি ভাইয়া।’
‘শুরু থেকে বল তোমাদের কাহিনীটা। কিভাবে দেখা হলো।’
তাহনা নিচু হয়ে বলতে থাকে,
‘খুব বেশি নয়, ছ’মাস ছিল আমাদের রিলেশনটা। আমি তখন সবে দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছি। একদিন! কলেজে যাওয়ার পথে হুট করেই একটা ছেলে আমাকে প্রপোজ করে বসে। আমি সহ আমার বান্ধবীরা সবাই অবাক হয়ে গেছি। কিন্তু আমি তখন তাকে কিছুই বলিনি। কিন্তু পরে দেখতাম সে রোজ রোজ আমার পিছে পিছে আসতো। এসবে এক প্রকার বিরক্তই হয়ে গিয়েছিলাম। একদিন তো একটা থাপ্পড়ও দিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও তার শিক্ষা হয়নি। ঝড়ের গতিতে সামনে আসত, আর বলত আমায় ভালোবাসে। তখন বান্ধবীরা সবাই বলেছে, এতবার যখন বলছে তখন সে সত্যিই আমাকে ভালোবাসে। আমি যেন তাকে হ্যাঁ বলে দেই। আমিও পরে এটাই ভাবতে লাগলাম। পরে সেই ছেলেটার কাছে মানে তানভিরের কাছে গিয়ে তার সাথে রিলেশনে যাওয়ার জন্য রাজি হই। দু’বার দেখা করি ঐ নদীর ধারে। ফোনে কথা বলতাম,মেসেজ চলতো। এইতো ব্যাস এসবই।’
রিদ সব শুনে তাহনাকে প্রশ্ন করে,
‘তানভির তোমাকে খারাপ কিছু বলতো কি?’
তাহনা ঘাবড়ে যায়। সে বলে,
‘মা..মানে?’
‘আরে, ভয় পাচ্ছ কেন? মানে ও তোমার কাছে আসতে চাইতো? গায়ের সাথে মিশতে চাইতো কি? চরিত্র সম্পর্কে জানতে চাইছি।’
তাহনা একটু দূরে সরে বলে,
‘না না ভাইয়া। ও খুব ভালো ছেলে ছিল। কখনোই দেখিনি ওকে বাজে মন্তব্য করতে। আমার খুব কেয়ার করতো ও। এসব দেখেই তো ওকে ভালো লাগত আমার। কিন্তু আমার সাথে এমনটা করবে শেষে আমি সত্যিই ভাবিনি। বিয়ে বাবা হুট করেই ঠিক করেন। আর আমি যখন তানভিরকে জানাই সে বলে পালিয়ে আসতে। আমি পালিয়েই তো এসেছিলাম ওর জন্য। কিন্তু ও…’
এইটুকু বলেই চুপ হয়ে যায় তাহনা। তানভিরের জন্য নিজের বাবার মান সম্মানের কথাও ভাবেনি সে। কিন্তু তানভির খেলেছে তার সরল মন নিয়ে।
রিদ তাহনাকে বলে,
‘বাদ দাও তাহনা। যে ছেড়ে গেছে, তাকে নিয়ে আর ভেবো না। আচ্ছা, ওকে নিয়ে তোমার অনুভূতি কি?’
তাহনা ভেবে বলে,
‘আমি ঠিক বুঝিনা ভাইয়া। ওকে নিয়ে কি আদৌ আমি কিছু অনুভব করেছি কিনা। তবে বিশ্বাস করেছিলাম।’
তাহনা আর ওখানে থাকেনা। সে নিচে চলে যায় রাইশার কাছে। রিদ কিছুক্ষণ থেকে সেও চলে যায় তার রুমে। কাল তাকে সকালে রওনা দিতে হবে।
.
পরদিন সকালবেলা রিদ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বাড়ির সবার মন খারাপ লাগছে রিদ চলে যাওয়ায়। ছেলে চলে যাওয়ায় নিজের রুমে কান্না করছেন মিসেস ফাবিহা। এদিকে তাহনা ঠিক করেছে, সে আজ রান্না করবে। চুপচাপ কাউকে না বলেই রান্নাঘরে ঢুকে কাটা*কুটি করে রান্না বসিয়ে দিয়েছে সে। রাইশা কলেজে গিয়েছিল রিদ যাওয়ার পরেই। কলেজ থেকে এসে দেখে রান্নাঘরে ঘোমটা দিয়ে তাহনা রান্না করছে। রাইশা চিৎকার করে তার মাকে ডাকে।
‘মা। নিচে এসো তাড়াতাড়ি।’
তাহনা বুঝলো না চিৎকার দিল কেন রাইশা। সে পাত্তা না দিয়ে রান্নায় মন দিল।
মিসেস ফাবিহা তাড়াতাড়ি নিচে আসেন। রাইশা ইশারায় তাহনাকে দেখিয়ে দিল। রিদের মা অবাক হয়েই তাহনার কাছে গিয়ে বলেন,
‘একি তাহনা। তুমি রান্না করছ? বাড়িতে তো লোক আছে।’
তাহনা মুচকি হেসে বলে,
‘কেন আন্টি? আমি কি একদিন আপনাদের রান্না করে খাওয়াতে পারিনা?’
‘তা নয়। তোমার সামনে পরিক্ষা। এসব তো পরেও একদিন করা যাবে।’
‘আজ আমার ইচ্ছে হয়েছে। অন্য একদিন কবে পাবো? আদৌও পাবো কিনা! তাই ভেবে আজই সেড়ে ফেললাম।’
রাইশা তার মাকে নিয়ে দূরে সরে এলো। তারপর বলল,
‘কি মা? তোমার ছেলের বউকে কেমন লাগছে বলো।’
‘ছেলের বউ মানে?’
‘এই যুগে পাবে তুমি ওর মতো মেয়ে? সুযোগ কাজে লাগাও। তোমারই লাভ।’
রাইশা একথা বলেই উপরে চলে গেল। রিদের মা ভাবতে লাগলেন, সত্যি কি রিদের জন্য তাহনাকে নির্বাচন করবেন উনি?
.
বিকালবেলা! একজন প্রতিবেশী মহিলা এসেছেন রিদদের বাসায়। রিদের মা তার সাথে কথা বলছেন,
তাহনা ঘোমটা দিয়ে তাদের সামনে নাশতা দিল। রিদের মা বলেন,
‘নিন ভাবি নাশতা খান।’
প্রতিবেশী মহিলাটি বার বার তাহনার দিকে তাকাচ্ছেন। তাহনা চলে যাওয়ার পর উনি রিদের মাকে বলেন,
‘বাহ ভাবি। রিদ বিয়েও করে ফেলেছে? কই আমাদের জানাননি তো। কি সুন্দর বউ রিদ বাবার।’
রিদের মা পড়লেন মহাবিপদে।
‘আরে না ভাবি। রিদের বিয়ে হয়নি। এ আমার ভাইয়ের মেয়ে। পরিক্ষার জন্য আমাদের এখানে থাকে। ও এভাবেই চলে।’
প্রতিবেশী মহিলাটি বললেন,
‘যাই বলেন ভাবি। দিনকাল যা পড়েছে। ঘরে আপনার জোয়ান ছেলে, তারউপর এই মেয়েও অবিবাহিত। দেইখেন আবার।’
রিদের মায়ের খারাপ লাগলো, তাহনাও এসব শুনেছে। নিজের কাছেও খারাপ লাগলো। মানুষ কি বাজে মন্তব্য করা ছাড়া আর কিছু পারেনা?
রিদের মা বললেন,
‘কি বলছেন ভাবি। আমার ছেলে খুব ভালো। সে আজ খুলনায়ও চলে গেছে। আর তাহনাও কয়দিন পর চলে যাবে। তাহনার মতো মেয়ে হয়না।’
‘আমি শুধু আপনাকে সাবধান করলাম ভাবি। আজ উঠি।’
প্রতিবেশীটা চলে গেলেন। রিদের মা এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। তাহনাও সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল। সে আর এ বাড়িতে থাকবে না। রিদ আর রিদের পরিবারের কারোই অসম্মান সে হতে দিবে না। পরিক্ষা যা বাকি আছে নিজের বাড়ি থেকেই দিবে। মানুষের মন মানসিকতা কত নিচ হয়।
এদিকে রিদের মা তাহনাকে দেখে ফেললেন। তাহলে কি তাহনা সব শুনেছে?
চলবে…