প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ২৭

0
877

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ২৭ #লেখিকা_রেহানা_পুতুল
সময় তার আপন নিয়মেই বয়ে যায় প্রবাহমান নদীর স্রোতধারার ন্যায়৷ সেই সাথে সমান্তরালে এগিয়ে যায় চলমান মানব জীবন।

আলিশার কলেজ জীবনের ইতি ঘটল। পৌঁছে গেল শিক্ষা জীবনের আরেক ধাপ উঁচু সিঁড়িতে। তার পিতার অগাধ স্বপ্ন ছিল প্রিয় দুই সন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত করে আত্মমর্যাদার সাথে বাঁচতে শেখাবে। বাবার সেই স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে ভাইয়ের মতো আলিশাও বদ্ধপরিকর।

তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের নব দ্বারে পা দিয়েই সে আপ্লুত। উল্লসিত। বাবাকে মনে করে চোখের কোনে চিকচিক করে জড়ো হলো দুফোঁটা নোনাজল। টুপ করে ঝরে পড়ল ভোরের কুয়াশার মতো।

বাবার সাথে তার অমলিন জ্বলজ্বলে স্মৃতি একটাই। এক দুপুরে ভাত খেতে বসেছিল বাবার সাথে আলিশা । মা মুরগী রান্না করেছিল। বাবাকে তার হাতে মুরগীর কলিজা খাইয়ে দিচ্ছিল।

অমনি ভুলক্রমে বাবার কামড় বসে যায় তার কচি আঙ্গুলের ডগায়। সেই আফসোসে বাবার চোখে পানি এসে গিয়েছিলো। সে নিজের আঙুল একহাত দিয়ে চেপে ধরেছিল। আরেক হাতের আঙুল দিয়ে বাবার চোখ মুছে দিয়েছিল। মা বাবাকে খুব বকেছিল। ভাবতেই বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে আলিশার কন্ঠ।

তাকে বাসায় গিয়ে পড়ানোর পালার ইতি ঘটল শুভ’র। তাই তারা এখন বাইরেই খোলা প্রাঙ্গণে দেখা করে। শুভ’র সাথে তার প্রণয় এগিয়ে যাচ্ছে নানা পর্বে। কখনো সংঘাতে। কখনো রঙিন মধুরতায়। কখনো দুষ্ট মিষ্টি খুনসুটিতে। কখনো বিয়ে পরবর্তী দাম্পত্য জীবনের লেনাদেনা নিয়ে।

পিয়াসা আয়মানকে শুভ আর আলিশার বিষয়ে বুঝিয়ে পজেটিভ করলো। শ্বাশুড়িকেও। তারা এক দুপুরে শুভকে ডেকে বলল,
আলিশা শহরে জন্ম। শহরেই বেড়ে উঠা। গ্রামে গিয়ে থাকতে পারবেনা।

শুভ জানাল তার মা বাবা এতে আপত্তি করলেও সে ম্যানেজ করে নিবে তাদের। আলিশাকে ঢাকায় তার সাথেই রাখবে৷

রায়হান ফোন দিল অনেক দিন পর আয়মানকে।

হ্যালো আয়মান। ভুলেই গেলি মনে হয়?

উল্টো ফাঁফর নিচ্ছিস নাকি গা বাঁচানোর জন্য? বলল আয়মান।

নারে দোস্ত। ভোলা যায় তোকে? ও হ্যাঁ। সন্তানের বাবা হতে যাচ্ছি সামনের মাসেই। দোয়া করিস। তুই কবে এমন সুসংবাদ দিবি?

ওয়াও! গ্রেট নিউজ দিলিতো। এমন কিছুইতো ভাবিনিরে। বরং কেয়ারফুল্লি থাকি। কারণ পিয়াসার অনার্স শেষ হোক অন্তত।

তাও ঠিক বলছিস। খালাম্মা, আলিশা কেমন আছে?

আলহামদুলিল্লাহ। আম্মু ভালো আছে। আলিশাও ভালো আছে। দেশে আসবি কবে?

আসবো কিছুদিন পরেই। অনেকক্ষণ মুঠোফোনে দুই বন্ধু নানা স্মৃতি বিজড়িত আলাপনে মেতে রইলো।

সেদিনে রাতেই আয়মান পিয়াসার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলো,
এই শুননা কামাঙিনী, তুমি মা হবে কবে?

পিয়াসা ঝট করেই কাঁথার নিচে নিজেকে আবৃত করে ফেলল। লজ্জায় দুগাল রক্তিম হয়ে গেল। ক্ষানিক পরেই আয়মান ও নিজেকে কাঁথার নিচে আবৃত করে ফেলল।

পিয়াসা কাঠিন্যতার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আয়মানের চোখে, শাণিত ছুরির ফলার মতো।

অদ্ভুত তো। বিয়ে হলো কতকাল হয়ে গেল। তবুও এত লজ্জা তোমার? আজ রায়হান ফোন করেছে। সে বাবা হতে যাচ্ছে। দেখলে কতটা এগিয়ে আছে সে যুগের সাথে। আর আমি পিছিয়ে আছি তোমার জন্য। এখন আর এত মেনেটেনে চলতে পারবোনা। শুধুই উড়াধুড়া খেলাধুলা হবে। কি বল?

আপনি আমার কাঁথার নিচ থেকে বের হন বলছি। বদের হাড্ডি কোথাকার। কটমট চোখে চেয়ে বলল পিয়াসা।

ওকেহ ভ্যানিলা! বের হচ্ছি বলেই আয়মান পিয়াসাকে টেনে নিজের গায়ের উপর তুলে নিল টানটান করে । দুই হাত দিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে ধরল। পিয়াসার মাথাকে বুকের উপর চেপে ধরল। কান পেতে শোন, কিসের ধ্বনি?

স্বরধ্বনির আওয়াজ ধ্বনিত হচ্ছে। কোন ধ্বনির সাহায্য নিচ্ছেনা। চাপা স্বরে হেসে বলল পিয়াসা।

এইনা হলে আমার খাঁটি প্রণয়ীনি। ধরতে পারলে তাহলে । দেখলে ভালোবাসি কতো। আচ্ছা বলনা,
কবে বাবু নিবে? তোমার কোন নিজস্ব প্ল্যান আছে?

আমার একদম ভালো লাগছেনা এসব শুনতে। প্ল্যান করার ও উপযুক্ত সময় এখনো হয়নি। সো এই টপিক বাদ। বেশরম পুরুষ। ছাড়ুন না। পায়ের তালুতে মশা কামড়াচ্ছে কুটকুট করে।

কাঁথার নিচে মশা কিভাবে ঢুকল?

কাঁথা আছে নাকি পায়ের পাতার উপরে ? সরে গিয়েছেনা আপনার জন্য। সিঙ্গেল কাঁথার নিচে ডাবল ঢুকলে এমনিই হবে। নাকি নাকি স্বরে বলল পিয়াসা।

এইই মধুবালা কিসের সিঙ্গেল? ডাবল সব। ডাবল।

আর মশা হলো আমার চোখে দেখা খুব শক্তিশালী একটা প্রাণী। আস্ত একটা মানুষকে সে কিভাবে নাস্তানাবুদ করে ফেলতে পারে। দেখছেন?

তা দেখার প্রয়োজন মনে করিনা। দেখিতো তোমার পায়ে কোথায় মশা কামড়াচ্ছে। আয়মান পিয়াসাকে চিৎ করে শুইয়ে দিল নিজের গায়ের উপর থেকে নামিয়ে।

পায়ের কাছে গিয়ে, আসলেইতো তোমার পা খালি। পিয়াসার পরনের শাড়িও একটু উপরে উঠে গিয়েছে। মশার কামড়ের স্থানে লাল হয়ে আছে। আয়মান উঠে গিয়ে সেভিং লোশন নিলো হাতে। পিয়াসার পায়ের লাল হওয়া স্থানে লোশন লাগিয়ে দিল।

কি করছেন আমার পায়ে?

আরেহ উপকার করছি রাণী।

তা ভালো কথা উপকার করছেন। কিন্তু হাত এদিক ওদিক যাচ্ছে কেন?

মশার বাচ্চা মশা যেন আমার বউয়ের দেহের আর কোন স্থান লাল না করতে পারে। তাই সব স্থানে অগ্রিম লোশন দিচ্ছি। লাল করার দায়িত্ব ওকে দিয়েছি। সেই গুরু দায়িত্ব একান্তই আমার।
এই তোমার পা এত সুন্দর বউ। উফফস! আয়মান গ্রামের পুকুরে ডুবিয়ে থাকা পিয়াসার পা নিয়ে বিষয়টা বলল।

পিয়ায়া আলতো হেসে বলল,
আপনি একটা চোর। লুকিয়ে লুকিয়ে যুবতী মেয়ের পা দেখেছেন।

আয়মান সেই হাসিতে প্রশ্রয় খুঁজে পায়। পিয়াসার হাঁটু অবধি উদাম পা দুটোকে টেনে নিজের কোলের উপর নিয়ে নেয় । দুষ্টমি করতে থাকে দুপা নিয়ে। পিয়াসার পায়ের আঙ্গুলগুলো ফোটাতে থাকে একটা একটা করে।

পিয়াসা একটু ব্যথা পেয়ে,
উহু এত জোরে ফোটায় কেউ?

কেউ না ফোটাক। তোমার বর ফোটাবে। তোমার সকল ব্যথায় যে আমার বিশ্ব সুখ। তোমার শরীরে ব্যথা যত বেশী। আমার মনে স্বর্গসুখ ও বেশী। আচ্ছা যাও। হাতের কাজ শেষ। ঠোঁটের কাজ শুরু করিই?

একদম নাহ বলছি। রোজ রাতে এত কিসের মাখামাখি আমার সাথে?

কোথায় তোমার সাথে কি করি। আমি যা করিই। আমার বউয়ের সাথে করিই। নেশাতুর চোখে আয়মান কথাটা বলেই পিয়াসার পায়ে হাত বোলাতে লাগলো মসৃণ করে।
একটা মজার ছবি দেখ বলে, মোবাইলের গ্যালারি থেকে একটা ছবি জুম করে পিয়াসার নাকের সামনে ধরল।

ওমাগো কি জটিল ভয়াবহ দৃশ্য।

কিসের জটিল? কিসের ভয়াবহ? এক ললনা বধুর পেট থেকে এক রোমান্টিক স্বামী মধু চেটে চেটে খাচ্ছে। বিষয়না দারুণ মনোরঞ্জনের নাহ?

ঘোড়ার ডিম। ফালতু।

মানলাম। অনেক ভালোবাসি তোমাকে পিয়াসা। বলেই পিয়াসার পা নামিয়ে দিল কোল থেকে। শাড়ি টেনে দিল নিচের দিকে গোড়ালি পর্যন্ত। কাঁথা দিয়েও পায়ের দুপাতা ঢেকে দিল ভালো করে৷ পিয়াসাকে কাত করে নিজের দিকে ধরলো।

নিজের শুষ্ক ঠোঁট দুটি পিয়াসার দুই ঠোঁটের উপর বসিয়ে দিল। তার আগে কৌশল করে বলল,
তোমার জিভটা একটু দেখি। বের কর।

কেন?
দরকার আছে জরুরী।

পিয়াসা তার গোলাপি জিভটা সামান্য বের করতেই আয়মান টুপ করে মুখের ভিতর পুরে নিল।

পিয়াসা শব্দ করার ও সুযোগ পেলনা আর। আসামীর রিমান্ডের মতো চুপচাপ হজম করা ছাড়া তার আর কোন গতি রইলোনা। বেশ সময় পর আয়মান নিজের ঠোঁট সরিয়ে নিল।

এটাও আপনার রোমান্টিসিজমের পার্ট?

অফকোর্স৷ আসলে আমার ঠোঁটের চামটা টানটান হয়ে আছে৷ তাই ভাল করে ভিজিয়ে নিলাম।

ভ্যাসলিন দিতে পারেন না তাহলে। পঁচা৷

তোমার কাছেইতো নির্ভেজাল বিশুদ্ধ ভ্যাসলিন রয়েছে। ভেজালযুক্ত নকল টা দিব কেন?

পিয়াসা মনে মনে,
একটা সঠিক মানুষকেই হৃদয় দিয়েছি। লাভ ইউ আয়মান। লাভ ইউ সো মাচ। তোমার এত এত রোমান্টিসিজমে আমি কতটা সুখ পাই গোপনে। কতটা শিহরিত হয় আমার অঙ্গের প্রতিটি ভাঁজ। তা কেবলমাত্র আমিই জানি। উপর দিয়ে তোমাকে যা বলি তা শুধু বলার বলা। আমি তোমায় ভালোবাসি এক দরিয়াসম।

আয়মানের বুকে পিয়াসা ঘাপটি মেরে পড়ে রইলো আদুরে ভঙ্গিতে। গভীর সুখ নিদ্রায় তলিয়ে গেল দুজন।

পরের দিন সকালে আয়মানের মা বিষন্ন মনে আয়মানকে বলল,
বাবা গত রাতে মা খুউব একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। তাই একটা সদকা মানত করেছি।

কি স্বপ্ন আম্মু?

তুই শুনিসনা বাবা। মন খারাপ হবে তোর।

আহ! বলনা প্লিইইজ।

আমাদের কাছের কেউ মারা গিয়েছে।

কে আম্মু? তা দেখনি?

না বাবা। ধর আমিই মরে গিয়েছি।

আয়মান মাকে বুকে চেপে ধরে কেঁদে ফেলে। নাহ আম্মু। ওমন বলোনা। তুমি আলিশা, পিয়াসা আমার বেঁচে থাকার উৎস। ভালো থাকার অবলম্বন। আনন্দে থাকার কেন্দ্রবিন্দু।

আমিই আজই তোমার মানত ছাড়াব।

বল কি করতে হবে আমাকে?

এখানে এতিম খানার বাচ্চাদের শুক্রবার দুপুরের বেলা আমরা খাওয়াবো।

তাই হবে আম্মু। আমি সেই মসজিদে গিয়েই ইমামকে বলে দিব যেন শুক্রবার দুপুরে তারা রান্না না করে। তুমি মন খারাপ করোনা প্লিজ। এই সংসারের প্রাণ প্রদ্বীপ একমাত্র তুমিই। আল্লাহ ভরসা। তুমি অমন ভেঙ্গে পড়না।

শুভ আলিশাকে নিয়ে আজ বোটানিক্যাল গার্ডেনে আসল। আলিশা অনেকদিন ধরেই এখানে আসার বায়না ধরেছে। কখনো আসেনি সে। বন্ধুদের কাছে শুনেছে গাছগাছালিতে ভরা এই নির্জন পার্ক নাকি প্রেম করার জন্য উৎকৃষ্ট লোকেশন।

একটু ভিতরে চলে গেল দুজনে। ঘনিষ্ঠ হলো একে অপরের। শুভ পিয়াসাকে বলল,
কিছুদিন পরই কাবিনটা সেরে ফেলতে চাই। কি বল? তোমার অনার্স শেষ হলে একবারে তুলে নিব। ততদিনে আমিও নিজেকে ভালো করে গুছিয়ে নিই।

আলিশা শুভ’র পাচ আঙ্গুল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,
আমি দুপায়ে রাজী। তাহলে আমরা একান্ত মুহুর্ত কাটাতে পারব। কোন গুনাহ হবেনা তখন।

শুভ হেসে ফেলল। আলিশার নাক টেনে বলল,
কি জামানা। প্রেমিকারাই দেখি এডভান্স প্রেমিকের চেয়ে। চক্ষু শরম নেই।

খবরদার বলছি। নিজে মনে হয় চাননা কিছু। সাধু। আমি বুঝিনা?

তারা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলো।

পিছন দিয়েই দুজন পুলিশ এসে দাঁড়ালো তাদের সামনে। এই যে স্যার ম্যাডাম। একটু মাল ছাড়ুন। নয়তো সোজা থানায় নিয়ে যাব। আপনাদের কাছে ইয়াবা পেয়েছি এই মর্মে।

আলিশা ভয়ার্ত নিষ্পলক চোখে পুলিশের দিকে চেয়ে রইলো। শুভ’র মেজাজাটাই বিগড়ে গেল।

চলবে ঃ২৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here