প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ২৬

0
835

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ২৬ #লেখিকা_রেহানা_পুতুল
তার মানে শুভ স্যার যেহেতু ভাবির এলাকার ছেলে। তাদের প্রেম ছিল?

হতেই পারে। তা না হলে এটা গোপন কেন আমার ও আম্মুর কাছে ?

এজন্যইতো শুভ স্যারকে আমার দিকে ফেরাতে এত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।

একমাত্র বড় ভাইয়ের হাতে চড় খাওয়ার ব্যথাটা আলিশার মৌনাকাশে বাতাসার মতন মিলিয়ে গেল। সেই স্থান আরো পাকাপোক্ত করে দখল করে নিল,
শুভ পিয়াসাকে বিয়ে করতে চেয়েছে এই বিষয়টা।

আয়মানের মা উদ্ধিগ্ন কন্ঠে,
হায় আল্লাহ কি বলিস এসব? এই ছেলেরতো আসলেই মন্দ স্বভাব। অংক করানোর ছলে দেখি আলিশার মাথাটাই খেয়ে ফেলছে ও।

আয়মান বোনের দিকে ক্ষিপ্ত নজরে চেয়ে,
আমি তোর একাউন্টিং সাবজেক্ট ধরবো। দেখব কতটা আয়ত্তে নিয়েছিস বলেই বেরিয়ে যায় রুম থেকে। তার মা ও বের হয়ে গেল ছেলের সাথে সাথে।

আয়মানকে নিজের রুমে ডেকে নিল তিনি। গলার স্বর নিচু করে জিজ্ঞেস করলো,
পিয়াসাকে বিয়ে করতে চাইলো শুভ? কই বললিনাতো আমাকে?

আয়মান মায়ের পিঠে ভালোবাসার হাত রাখল। শীতল মেজাজে শুভ পিয়াসার বিষয়টা বিস্তারিত জানাল। আরো বলল,এবার বল এটা জানানোর মতো বিষয়?

একদম নাহ। তার বাবা কথা দিয়েছে। শুভ চেয়েছে। পিয়াসা চায়নি। ব্যাস।

আর পিয়াসা আমাকেই ভালোবাসতো মনে মনে। বুঝ এবার। আরেহ আম্মু। আলিশার সামনে পরিক্ষা। তাই ফাঁফরে রাখতে হবে। আর শুভর বিষয়ে আমি খোঁজ খবর নিব সামনে।

হুম বুঝলাম হারামজাদা। যা ভয় পাইয়ে দিলি। এবার আলিশা পিয়াসাকে ভুল বুঝলে? ননদ ভাবির মিষ্টি সম্পর্কটা না জানি তেতো হয়ে যায়?

কিছুই হবেনা। বরং মিষ্টির পরিমাণ বেড়ে সুগার হাই হয়ে যাবে।

তাই যেন হয় বলে, আয়মানের মা মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করলেন।

তুমি থাকো আম্মু। আমি গেলাম বলে আয়মান চলে গেল তার রুমে।
পিয়াসা পড়ছে তার পড়ার টেবিলে বসে। টুং করে মেসেজ টোন বেজে উঠল।

” ভাবি প্লিজ একটু আমার রুমে আস। জরুরি দরকার। ”

পিয়াসা তড়িঘড়ি করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আয়মান রুমে ঢুকতেই পিয়াসাকে বের হয়ে যেতে দেখে,
কই যাচ্ছো?

আসছি বলে পিয়াসা বের হয়ে গেল। আয়মান উঁকি দিয়ে দেখল আলিশার রুমে ঢুকল পিয়াসা। ধরে নিলো ভাবির কাছে কোন হেল্প চাইবে হয়তো আলিশা নিজের প্রেমের বিষয়ে।

ল্যাপটপ অন করে নিজের কলেজের কাজে মন দিল ।

কি হয়েছে আলিশা? কোন পার্সোনাল সমস্যা? পড়তেছিলাম আমি । তোমার মেসেজ পেয়েই ছুটে এলাম। সৌহার্দপূর্ণ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো পিয়াসা।

শুভ’র কাছে বিয়ে না বসে আমার ভাইয়ের গলায় ঝুলে পড়লে যে? রায়হান ভাইয়াও তোমাকে বিয়ে করতে চাইলো? কাহীনি কি?
রূঢ় কন্ঠে জানতে চাইলো আলিশা।

শুনে পিয়াসা আকাশ থেকে পড়লো । বোয়াল মাছের মতো হা হয়ে রইলো তার দুই ঠোঁট। হতভম্ব হয়ে আলিশার দিকে চেয়ে রইলো। মুখ দিয়ে তার কোন শব্দই বের হচ্ছেনা।

আলিশা পুনরায় বলে উঠল, কিহ ? সত্যি কথাটা হজম হচ্ছেনা। নাহ? যখন আমি তোমার কাছে শেয়ার করলাম, শুভ স্যারকে ইমপ্রেস করা যাচ্ছেনা। তখন মনে মনে নিশ্চয়ই বলেছিলে, শুভর মনে কেবলই পিয়াসা নামটা। নিবিড় প্রশান্তি লাভ করেছিলে তখন নাহ?

পিয়াসা আলিশার সাথে পাল্টা তর্কবাণে জড়ালোনা। রুম থেকে বেরিয়ে এলো। গটগট পায়ে নিজের রুমে চলে গেল। তার মাথার ভিতরে যেন একশো পোকা কিলবিল করছে৷ ঘূনেপোকার মতো সেই পোকাগুলো পিয়াসার মাথার সমস্ত মগজ যেন কুটকুট করে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে।

আলিশা নিজের ক্ষোভ কিছুটা হলেও পশমিত করতে পারলো বলে একটু স্বস্তি অনুভব করছে। রাতের ভাত না খেয়েই দরজা বন্ধ করে শুয়ে গেল। তার মা বহুবার বাইরে থেকে ডাকল। আর সে ভিতর থেকে চেঁচানো গলায় জানিয়ে দিল খাবেনা। ক্ষুধা নেই।

ধাপুসধুপুস করে পিয়াসা তার বইপত্র গুছিয়ে ফেলল। এখন কোন পড়াই ব্রেনে ধরবেনা। আয়মান মাথা ঘুরিয়ে পিয়াসাকে দেখল। জিজ্ঞেস করলো, আর পড়বেনা?

পিয়াসা চুপ হয়ে রইলো।

বয়রা হলো কবে থেকে আমার প্রেমাঙ্গিনী?

পিয়াসা ভার মুখে আয়মানের দিকে এক ঝলক নেত্রপল্লব মেলে ধরলো। আয়মান পিয়াসার চোখের ভাষা পড়ে নিল। কুচ গড়বড় হোতাহে।

রুম থেকে বের হয়ে গেল। আবার একটু পরেই এসে বলল,

সবাই কি অনশন করল নাকি? কেউ রাতে ভাত খাবেনা? আমার ক্ষুধা পেয়েছে।

পিয়াসা বের হয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। ডাইনিংয়ে সব খাবার বেড়ে আনল রোজকার মতো। শ্বাশুড়ির রুমে গিয়ে,
মা ভাত খেতে আসেন। ঘুমিয়ে গেলেন নাকি?

আয়মানের মা তসবিহ হাতে নিয়েই বিছানা ছাড়লেন। বললেন, নারে মা ঘুমাইনি। আয়মান পিয়াসাকে বকাবকি করল। পিয়াসাও না খেয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তাই মনটা একটু খারাপ।

মন খারাপ করবেন না মা। এটা আবেগের বয়স৷ ভুলের বয়স৷ ঠিক হয়ে যাবে।

বৌমা তুমি গিয়ে একটু ডাক দাওনা মেয়েটাকে ভাত খাওয়ার জন্য।

শ্বাশুড়ির আদেশ অমান্য করলনা পিয়াসা। তাই সে এখন আবার আলিশার রুমের সামনে গেল। দরজা ধাক্কাছে। আলিশা খুলছেনা৷

পিয়াসা গলা তুলে ডাকল এবার,
আলিশা ভাত খেতে আস বলছি। মা নইলে ভাত খাবেনা কিন্তু। প্লিজ ভাত খেতে আস।

আলিশা ভিতর থেকে গলাকে চড়ায় এনে বলল,
তুমিতো দেখি জন্মের বেহায়া মেয়ে। তখন এত কথা শুনালাম। তাও আবার আমার সাথে কথা বলতে আসছ। তুমি আমার সাথে আর কোন কথা বলবেনা বলছি।

পিয়াসা পা ঘুরিয়ে নিতেই দেখে আয়মান পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে আয়মান আলিশার কথাগুলো শুনতে পেয়েছে।

আয়মান রাগে ফেটে যাচ্ছে। তার ইচ্ছে করছে আলিশার পিঠের চামড়া তুলে ফেলতে। কিন্তু এই রাতে সে আর কোন ঝামেলা বাড়াতে চায়না। পিয়াসার থেকে শুনতে হবে তখন কি বলছে। তারপর ।

পিয়াসা ডাইনিং এ চলে এলো। তাদের তিনজনের জন্য ভাত বেড়ে নিল। তার ও খেতে ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু না খেয়ে ঘুমালে রাতে পেটে মোচড়ামুচড়ি শুরু হবে। আয়মান ও এসে খেতে বসে গেল। তিনজনেই বিষন্ন মন নিয়ে শেষ করলো নৈশভোজ।

আয়মান রুমে গিয়ে বারান্দায় চলে গেল। সিগারেট জ্বালিয়ে নিল। রাগ উঠে গেলে সে একটা সিগারেটের ধোঁয়া না ছাড়লে মনে অস্থিরতা প্রকট আকার ধারণ করে।

পিয়াসা হাতের কাজ ঝটপট শেষ করে শ্বাশুড়ির থেকে বিদায় নিয়ে ঘুমাতে চলে গেল। বিছানায় আয়মানকে না দেখে বারান্দায় উঁকি মারল।

সিগারেটের গন্ধ রুমে থেকেই সে টের পেয়েছে। আয়মানকে দেখেই আবার রুমে ঢুকে গেল। কোন বিশেষ হেলদোল দেখালনা।

আয়মান অবাক হয়ে গেল। যেখানে পিয়াসা সিগারেট খাওয়া দেখলেই তেতে যায়। সেজন্য সে টুকটাক যা খেত মাঝেমধ্যে। তাও ছেড়ে দিয়েছে পিয়াসার জন্য। আর সেই পিয়াসা তাকে সিগারেট খাওয়া দেখেও নিঃশ্চুপ রইলো। আয়মান আধ খাওয়া সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে দিল। জুতোর নিচে ফেলে পিষে জলন্ত সিগারেটটি নিভিয়ে দিল। রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে গেল। পিয়াসা কাত হয়ে আছে৷

এইই? বলে পিয়াসার পিঠের উপর হাত রাখল আয়মান। আলিশা তোমাকে তখন ডেকে নিয়ে কি বলল?

কিছু বলেনি।

সমস্যা কি বলতে?

বলার প্রয়োজন মনে করিনা আমি।

আপনি জানেন না কি বলতে পারে? শুভ ভাই আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে এটা আলিশা কিভাবে জানল?

ওহ হো। খুউব খুউব স্যরি হানি। এই বলে, কেন বলল সেই কথা, তা আয়মান পিয়াসাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিল।

আর তুমি মন খারাপ করে থেকোনা প্লিইজ । ওই অসভ্য ফাজিলকে দেখনা রাত পোহালেই কি করি? বড় ভাবির সাথে সে যাচ্ছেতাই বিহেভিয়ার করলো। রাগত স্বরে বলল আয়মান।

পিয়াসা এবার মাথা ঘুরে আয়মানের দিকে ফিরল।

নিরস ভঙ্গিতে বলল,
আপনি কিছুই বলবেন না আলিশাকে প্লিজ। ওর উপরে আমার আর কোন কমপ্লেইন নেই। আপনি যেভাবে বলছেন সেভাবে রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এমন সময় অনিয়ন্ত্রিত আবেগের বশে মানুষ ভুলভাল আচরণ করে কাছের মানুষদের সাথে। তা কিছুদিন পরে আবার ঠিক হয়ে যাবে।

পিয়াসার প্রতি আয়মানের মুগ্ধতা অতিমাত্রায় বেড়ে গেল। বিমুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো। বলল, বুকের ওমে আস। পিয়াসা মেটাও। পথিকের তপ্ত মরুভূমিতে ঘন বর্ষন ঢালো। জুড়াও এ প্রান।

পিয়াসা ঘুষি দিল আয়মানের বুকে হালকা জোরে।

পিয়াসাকে নিজের শরীরের সাথে ভিড়িয়ে নিল আয়মান । শাড়ির নিচে দিয়ে পেটে হাত দিল। সুড়সুড়ি দিতে লাগল পুরো পেটজুড়ে। পিয়াসা কুচিমুচি করে হেসেই খুন হয়ে যাচ্ছে কাচভাঙা হাসিতে।

” কন্যা তোমার হাসিতে
মন চায় শুধু ভাসিতে। ”

সুড়সুড়ি থামান না বলছি। পারছিনা আর নিতে। সত্যিই বলছি। আহু!

তার একদিন পর বিকেলে শুভ পড়াতে এলো। খাতায় লিখে জিজ্ঞেস করলো আলিশাকে,

এনিথিং রং? নিউ কোন প্রবলেম? গাল হুতোম পেঁচা হয়ে আছে কেন?

ভাবিকে খুব পছন্দ করতেন?

আচ্ছা এই কাহিনী? কে কি বলছে?

কে কি বলছে এটা মূখ্য নয়। আমার প্রশ্নের উত্তর দেন।

হ্যাঁ করতাম।

ভালোবাসতেন?

একদম নাহ বলে শুভ বিষয়টার সারসংক্ষেপ লিখে দিল খাতায়। এবং শেষে লিখলো,
আশাকরি এতটুকু কমনসেন্স তোমার রয়েছে। এরপরেও ভুল বুঝলে আর কিছুই করার নেই।

আলিশা তবুও মুখ গোঁজ করে রইলো। কোন রিপ্লাই লিখলনা।

শুভ আবার ও লিখে দিল। শুনো,
সন্দেহ আর অবিশ্বাস হলো বিষধর সাপের চেয়েও ভয়ংকর। জীবনটাকে তিলে তিলে বিষময় করে তোলে কার্বলিক এসিডের মতো।

তুমি চাইলে একে মনের ভিতর পুষতে পার। চাইলেই ধোঁয়ার মতো উড়িয়ে দিতে পারো। এটা একান্তই নিজের ব্যাপার। তবে কোন কিছু আগে পরে বিস্তারিত না জেনে কাউকে এভাবে ভুল বোঝা একদম অনুচিত। অতি ঠুনকো একটা বিষয়কে তুমি বিশাল করে তুললে৷ মশা মারতে কামান দাগানোর মতো।

আলিশা চুপ হয়ে রইলো। লিখে দিল স্যার, আজ আর অংক করতে ইচ্ছে করছেনা।

শুভ কোন রিপ্লাই দিলনা। দুই চুমুক চা খেয়েই উঠে চলে গেল।

আলিশা মুচকি হেসে শুভ’র খাওয়া অবশিষ্ট চা খেয়ে নিলো। গুনগুনিয়ে গাইতে লাগলো,
” টিপ টিপ বরষা পানিইই..
পানি নে আগ লাগায়ী..
আগ লাগি দিল মেয়নে তু..
দিল তো তেরি ইয়াদ আয়ী।”

চলবেঃ ২৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here