#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ১২ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
আয়মান পিছন দিয়েই পিয়াসাকে খুঁজতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। দেখল পিয়াসা নাক চোখ লাল করে ওয়াশরুম থেকে বের হলো।
নাটক,সিনেমা ও বাস্তব দুনিয়ায় মেয়েরা কাঁদার জন্য কেন যে ওই এক ওয়াশরুমকেই বেছে নেয়? মেয়েরা হয়তো অনেক কিছুই লুকিয়ে প্রকাশ করতে পছন্দ করে। আচ্ছা নাকি আমার প্রপোজাল করা ঠিকভাবে হয়নি। আমি আসলেই মায়ের ক্যাবলাকান্ত। আমি নাকি আবার ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছি।
কতভাবেই তো ইমপ্রেস করা যেত। কি করলাম এটা। হুট করে বলে দিলাম মা বউ বানাতে চায়। আমিও বা আর কিভাবে বলতে পারি। যতবারই একটু কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করেছি। উল্টো কাহীনি ঘটে যায়। অমনি সে আমাকে ভুল বুঝে। আয়মান এসব ভাবতে ভাবতে ফের নিজের রুমে চলে গেল। নিজের উপর এক পাহাড় বিরক্তি নিয়ে মাথার পিছনে ঘুষি দিল হাত মুঠি করে।
বিয়ে নিয়ে বাসায় আর কেউ কোন প্রসঙ্গই তুললনা। আয়মান মা বোনকে না করে দিয়েছে তাই। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাউকে রাজী করিয়ে বিয়ে সে করতে চায়না। তখন পিয়াসার মন ছাড়া দেহটাকে ভারী বস্তু ছাড়া আর কিছুই মনে হবেনা। তাই শেষ চেষ্টাটুকু করে দেখবে পিয়াসা যেন নিজ থেকেই তাকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চায়।
আজ পিয়াসার রেজাল্ট দিয়েছে। অপত্যাশিতভাবে রেজাল্ট ভালো হওয়ায় মন খুব ভালো তার। গত রাতে টেনশনে ঘুম হয়নি বললেই চলে। আকস্মিকভাবে বাবাকে হারিয়ে ভালো প্রস্তুতি নিতে পারেনি পরিক্ষার জন্য। তাই খুব শংকায় কেটেছে তার প্রতিটি মুহুর্ত। বুকের ভিতর টিপটিপ করছিল সকাল থেকেই। আয়মান সকালে বের হয়ে যেতেই পিয়াসার রোল নাম্বার নিয়ে গিয়েছে। সে নিজেও মোবাইলে মেসেজ দিয়ে রেখেছে রেজাল্টের জন্য। বাবাকে মনে করে অঝোরে কেঁদেছে।
বিকেলে আয়মান বাসায় ফিরলো। হাতে মিষ্টির বড় একটি প্যাকেট।
ভাইয়া পিয়াসাপুর রেজাল্ট ভালো হয়েছে। তাই বুঝি মিষ্টি আনলে?
ভালো করেছিস বাবা। আজ যদি মেয়েটার বাবা মা বেঁচে থাকতো। অবশ্যই তাকে মিঠাই খাওয়াতো।
মিষ্টি আনার আরেকটি উপলক্ষ রয়েছে। আমার প্রমোশন হয়েছে মা। আমি আর স্কুলে ক্লাস নিবনা। কলেজেই সব ক্লাস নিব। অর্থাৎ তোমার ছেলে এখন থেকে কলেজের অধ্যাপক।
ওয়াও। কংগ্রাচুলেশন ভাইয়া। যাই পিয়াসাপুকে জানাই গিয়ে। আয়মান নিজের রুমে চলে গেল। ফ্রেস হয়ে এসে ভাত খেল। পিয়াসাকে ডাকতে বলল আয়মানের মা। পিয়াসা মিষ্টি হাসি দিয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো।
কংগ্রাচুলেশন পিয়াসা।
থ্যাংক ইউ স্যার। আপনাকেও অভিনন্দন প্রমোশন হওয়ার জন্য।
আয়মানের মা টেবিলে উপরে থাকা মিষ্টির প্যাকেটটি খুললেন।
পিয়াসা ধরো মিষ্টি মুখ করো।
আন্টি আমি সাদা মিষ্টি কম খাই। কালো জাম পছন্দ করি।
ওহ আচ্ছা। নাও কালো জাম আছেইতো। তোমার স্যার তিনপদ মিলিয়ে এনেছে।
আমিও খাওয়াবো আপুকে। বলে আলিশা পিয়াসাকে মিষ্টিমুখ করালো।
মা আমাকে খাওয়াবেনা তোমার হাতে মিষ্টি? বলল আয়মান।
দিচ্ছিতো বাবা। এই নে হা কর।
মা তোমাকেও একটা খাওয়াই বলে আয়মান মায়ের পছন্দের মিষ্টি মায়ের গালে পুরে দিলো। সবাই সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালো আয়মান পিয়াসা ছাড়া।
ভাইয়া আপুকে মিষ্টি মুখ করাবানা?
হুম দিচ্ছি।
আলিশা ও তার মা চলে গেল নিজেদের রুমে কাজের বাহানায়।
আয়মান একটা মিষ্টি কাঁটা চামচে গেঁথে নিলো। পিয়াসার ঠোঁটের সামনে ধরলো। পিয়াসা খেতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। আয়মান বুঝতে পেরে শক্তমুখে বলল,
আমি মাকে জানিয়েছি তুমি রাজী নয়। মা বুঝতে পেরেছে। সমস্যা নেই পিয়াসা। তুমি তোমার মতই থাকো। এবার হা করো। পিয়াসা স্মিত হেসে মিষ্টি খেয়ে নিল। চলে গেল আলিশার রুমে। আয়মান ব্যথিত মনে পিয়াসার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো নিঃষ্পলক চাহনিতে। সে খুব চেয়েছে পিয়াসার হাতে একটু মিষ্টি খেতে।
ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সময় হয়ে গেল। পিয়াসা পছন্দমতো ভার্সিটিতে চান্স পেলনা। জগন্নাথেই ভর্তি হতে হলো অবশেষে। পিয়াসাকে নিয়ে এসব দৌড়ঝাঁপ আয়মানই করেছে। পড়াশোনার যাবতীয় কিছু আয়মান একে একে এনে দিল।
রায়হান শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে দিয়েছে। দেশের বাইরে চলে যাবে। সেখানে একটি কোম্পানিতে তার ভালো বেতনের চাকরি হয়েছে।
আজ রায়হানের গায়ে হলুদ। কাল বিয়ে। আয়মানদের সাথে তাদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠতাও রয়েছে। তাই আয়মানের সাথে আলিশা ও পিয়াসাও গায়ে হলুদের দিন রাতে তাদের বাসায় উপস্থিত রয়েছে।
বাসার ছাদে হলুদ সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছে। সবাই ছাদে যার যার মতো করে হৈ হুল্লোড়ে মেতে আছে।
রায়হানদের পুরো বাসা খালি। পিয়াসা ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য বাসায় এলো। বাসার গেইট খোলা। যেহেতু একটু পরপর নানা কারণে এ ও আসছে তাই। ওয়াশ রুমে থেকে বের হতেই দেখে পুরো বাসা অন্ধকার।
দেয়াল হাতড়াচ্ছে পিয়াসা। মোবাইলের আলো ফেলল। সামনে অচেনা একটি ছেলেকে দেখে পিয়াসা চমকে উঠলো।
কে আপনি ভাইয়া?
চিনবেনা তুমি। একটু এদিকে আসতো বলে পিয়াসার হাত ধরে টেনে বিছানায় নিয়ে চিৎ করে শুইয়ে দিল। ছেলেটির বলিষ্ঠ বাহুড়োরে পিয়াসা আটকে গেল পেরেকের মতো। হলুদ শাড়িতে হলুদ সাজে হলদে রানী সেজে বসে আছ কার জন্য?
ছাড়েন বলছি। বেয়াদব। আমি চিৎকার দিব কিন্তু।
ওহ নো। তাই নাকি বলে ছেলেটা পিয়াসার ব্লাউজের রশি টেনে খুলে ফেলল। পেটের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে নাভিতে মুখ ডুবিয়ে দিলো।
পিয়াসা ছেলেটির চুল খামচি দিয়ে সরিয়ে দিল। ছেলেটি পিয়াসার দুই কাঁধ থেকে ব্লাউজের হাতা সরিয়ে উদাম করে দিল। অধরের মৃদু ছোঁয়া দিতে দিতে ঘাড়ের একপাশ থেকে আরেকপাশে গেল।
বুকের উপর থেকে শাড়ির আঁচল সরিয়ে নিলো। ব্লাউজের বোতাম একটা খুলে ফেলতেই তার কানে এলো আয়মানের কন্ঠস্বর। তীব্রগতিতে উঠে পালিয়ে চলে গেল ছেলেটি।
এদিকে আয়মান পিয়াসাকে ছাদে না দেখে নিচে খুঁজতে এলো। আলিশা হলুদ ডালা সাজানো নিয়ে ব্যস্ত বলে আসতে পারেনি।
পিয়াসা কোথায় তুমি? কি ব্যাপার বাসা অন্ধকার কেন? কারেন্ট তো যায়নি বলেই আয়মান রায়হানদের বাসার সব লাইট জ্বালিয়ে দিলো।
একি তুমি বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বিছানায়? ঘাড়ের রগ ফুলে গেল আয়মানের। সমস্ত শিরা উপশিরা ছুটাছুটি করতে লাগল।
পিয়াসা নিরব বাসায় আয়মানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যেন আয়মান তার এক পৃথিবী নির্ভরতা ও আশ্রয় । উদভ্রান্তের মতো কাঁদতে লাগলো।
আড়ভাঙা ভেজা গলায় বলল,
স্যার আপনি অনেক ভালো। অনেক অনেক। অনেক পছন্দ করি আপনাকে। আপনি এখন না এলে আমার সব শেষ হয়ে যেত স্যার। আয়মানের বুকে পিয়াসা মুখ ঢলতে লাগল।
আয়মান স্তব্দ হয়ে রইলো। পিয়াসার মাথায় হাত দিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। ব্লাউজের ফিতা লাগিয়ে দিল। দুই হাতা টেনে উদাম কাঁধ ঢেকে দিল। বলল উপরের বোতামটা লাগাও।
ছেলেটাকে দেখলে চিনবে?
হুম চিনব। পিয়াসার হাত ধরে ছাদে নিয়ে গেল। শিকারী চোখের মতো অনেক খুঁজেও সেই ছেলেকে আর খুঁজে পেলনা।
স্যার আমি বাসায় চলে যাব। খুব খারাপ লাগছে।
আচ্ছা আসো তাহলে।
আয়মান রিকসাযোগে পিয়াসাকে বাসার নিচে দিয়ে আবার রায়হানদের বাসায় চলে গেল।
পিয়াসা সব চেঞ্জ করে নিল। নিজেকে ধাতস্থ করল সময় নিয়ে। পড়ার টেবিলে বসে মাথা নিচু করে ঝিম হয়ে রইলো। মার্কার পেন খুঁজতে আয়মানের রুমে গেল পিয়াসা।
আয়মানের টেবিলে বেখেয়ালবশত চোখ গেল একটি ডায়রির উপরে। আজ পিয়াসা এমনিতেই আয়মানের উপর ভীষণ প্রসন্ন। বাহব্বা! স্যার ডায়েরি ও লিখে আজকাল। দেখিতো বলে পিয়াসা আয়মানের ডায়রিটা একের পর এক পাতা উল্টিয়ে পড়তে লাগলো। বিস্ময়ে পাগল পাগল দশা পিয়াসার।
সে পড়তে শুরু করল,
” আমিতো আজন্ম অন্তর্মুখী মানুষ। নিজের অনুভূতিটুকুও প্রকাশ করতে পারিনা তোমার কাছে। সেদিন ফুল পা দিয়ে চেপে ধরেছি কারণ আমি চাইনি আমি ছাড়া অন্য কারো ভালোবাসার ফুল হাতে নাও তুমি । যেদিন তোমাকে হাতে মেরেছি। ঠিক সেদিনই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার টকটকে লাল হওয়া সরু হাতের তালু, তোমার আঁখিকোন বেয়ে গড়িয়ে পড়া অভিমানী অশ্রু, তোমার প্রতিবাদহীন আহত চোখের নিরব ভাষা আমার হৃদয়টাকে নিংড়ে দিয়েছে কেশবতী।
সেদিন যখন তুমি আমার লেপ গায়ে দিয়েছিলে। কি যে ভালো লেগেছে বোঝাতে পারবোনা। কারণ সেই লেপের প্রতি ভাঁজে ভাঁজে তোমার শরীরের প্রতি ভাঁজের স্পর্শ আর গন্ধ মিশেছিল। কিন্তু তুমি উল্টো বুঝলে।
কলমের ভাষা ছাড়া আমার অনুভূতি প্রকাশ করার আর উপায় যে নেই। তুমি আমার সাত জনমের কেশবতী। তুমি আমার গহন বনের স্বপন। তুমি আমার প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে।
” রুহে রুহ মেশে,গন্ধ তোলে ঢেউ
হৃদয়ে কাঁপন তোলে তোমার মতো কেউ।”
ডায়েরির প্রতিটি লেখার উপরে পিয়াসা বেহুঁশ হয়ে চুমু খেতে লাগল। আস্তে করে উচ্চারণ করল,
আয়মান স্যার আমাকে ভালোবাসে? রায়হানের আগে থেকেই?
আমিওতো স্যারকে সেই কবে থেকে গোপনে ভালোবাসি। ডুবে ডুবে ভালোবাসি।
চলবেঃ ১২