#হারানো_সুর-৯ম পর্ব
©শাহরিয়ার
— প্রেমার চোখ কেমন জানি ঝাপসা হয়ে আসছে পাশেই মিহি আর বাবা বসা। কোন রকমে হাতের উল্টো সাইড দিয়ে নিজের চোখের পানি মুছে নিলো। হৃদয় গাড়ি চলে যাবার পথে অনেকটা সময় চেয়ে রইলো। তারপর আস্তে করে আবার বাড়ির ভিতর ঢুকে পরলো। রুমে এসে অফিসে যাবার জন্য জামা পরে কোটটা পরতে যেয়েই প্রেমার কথা মনে পরে গেলো। গতকালকেই মেয়েটা নিজের হাতে কত যত্ন করে কোট পরিয়ে দিয়েছিলো। কেমন জানি একটা শূন্যতা ঘিরে ধরলো হৃদয়কে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কোট পরে বাড়ি থেকে বের হয়ে পরলো হৃদয়।
— দুপুরের আগে আগেই গাড়ি চলে আসলো গাজিপুর প্রেমাদের বাড়িতে। ছোট বোন দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে প্রেমাকে জড়িয়ে ধরলো। মনে হচ্ছে আজ কত বছর পর এ বাড়িতে প্রেমা এসেছে। রিমি গভীর মনোযোগ দিয়ে প্রেমাকে দেখছে প্রেমাকে দেখা শেষে এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে কিছু একটা খুঁজে চলছে রিমি।
প্রেমা:- কিরে কি খুঁজছিস আমাকে বল যদি আমি খুঁজে দিতে পারি।
রিমি:- না মানে আপু তুমি আগে থেকে অনেক সুন্দরি হয়ে গেছো। যার স্পর্শে তোমার এই পরিবর্তন আমি তাকে খুঁজতাছি সে কোথায় আসেনি?
প্রেমা:- একটা হাতে রিমির কান টেনে ধরে বেশী পণ্ডিত হয়ে গেছিস তাই না? আমি আগেও যেমন ছিলাম এখনো তেমনি আছি। যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিস সে আসেনি। আর আসবে কিনা তার ও কোন গ্যারান্টি নেই।
রিমি:- কানের উপর থেকে প্রেমার হাত সরিয়ে কেন দুলাভাই আসবে না কেন?
প্রেমা:- আমি কি করে বলো আসবে না কেন? হয়তো আমার স্পর্শ তার ভালো লাগে না, নয়তো পুরো এই আমিটাই তার সম্পূর্ণ অপছন্দ।
— কথাটা বলেই প্রেমা হাসতে শুরু করলো। রিমি ছোট হলেও অতোটা ছোট না মাত্রই দু বছরের ছোট প্রেমার চেয়ে। তাই বড় বোনের এমন কথাতে হৃদয়ে ঠিকই লেগেছে তারও। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে বোনের মন ভালো নেই, নয়তো বোন সে বাড়িতে সুখি নয়। প্রেমা হঠাৎ করে রিমির কাঁধে মাথা রাখতে রিমি চমকে প্রেমার দিকে তাকায়।
প্রেমা:- চল আমার খুব খুদা লেগেছে আজ দুই বোন এক সাথে লাঞ্চ করবো। তারপর দুই বোন বসে বসে গল্প করবো।
— রিমি প্রেমার হাত ধরে টেনে রওনা হলো ডাইনিং এর দিকে, ফ্রেস হয়ে মা, বাবা আর মিহিকে সঙে নিয়ে লাঞ্চ করতে বসলো। মিহিকে কোলে তুলে নিয়ে রিমি খায়িয়ে দিচ্ছে যাতে করে প্রেমা একা শান্তি মত খেতে পারে। খাবার টেবিলে প্রেমার বার বার হৃদয়ের কথা মনে পরছিলো। কি করছে না করছে খাচ্ছে কিনা ঠিক মত। নানান রকম প্রশ্ন প্রেমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রেমার মতে হতে থাকে যে হৃদয় তার অনুপস্থিতিতে আবার আগের মতই অগোছালো হয়ে পরবে। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে কোন রকমে প্লেটে নেয়া খাবার গুলো শেষ করে নিলো প্রেমা। তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেস হয়ে সোজা নিজের রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলো। রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে মোবািল ফোনটা বের করে হৃদয়ের নাম্বারে ফোন করলো। হৃদয় যেন ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিলো, সে জানতো এখন প্রেমার ফোন আসবে। রিং বাজার সাথে সাথেই হৃদয় ফোনটা রিসিভ করে নিলো।
হৃদয়:- হ্যালো ঠিক মত পৌঁছেছো?
প্রেমা:- আমি ফোন না দিলে নিশ্চই ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন না?
হৃদয়:- ইহু তোমাকে ফোন দিবো বলেই ফোনটা হাতে নিয়েছি।
প্রেমা:- মিথ্যা কেন বলেন?
হৃদয়:- সত্যি বলছি তোমাকে মিথ্যা কেন বলবো আমি বলো?
প্রেমা:- দুপুরে খেয়েছেন?
হৃদয়:- না খাবো একটু পর।
প্রেমা:- একটু পর খাবেন মানে এখুনি খেয়ে নিন। কোন রকম অনিয়ম করা চলবে না। নয়তো অসুস্থ হয়ে যাবেন।
হৃদয়:- আচ্ছা ঠিক আছে খেয়ে নিবো তুমি, মিহি তোমরা খেয়েছো?
প্রেমা:- হ্যাঁ এইতো আমি মাত্রই খেয়ে এসে আপনাকে ফোন দিলাম। মিহি রিমির সাথে খাচ্ছে। এখন চটজলদি আপনিও খেয়ে নেন।
হৃদয়:- হ্যাঁ খাবো, আর মিহিকে দেখে রেখ ও কিন্তু অনেক দুষ্টমি করে কোথাও বেড়াতে গেলে, একটু ফাঁকা পেলেই ছুটাছুটি করে।
প্রেমা:- এসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না, ওর মা আছে সাথে এসব দেখভাল করার জন্য।
হৃদয়:- হ্যাঁ তাইতো ভরসা পাই।
প্রেমা:- আচ্ছা রাখছি এখন পরে আবার কথা হবে।
হৃদয়:- হুম।
— ফোনটা কেটে দিয়েও অনেকটা সময় দু’জন ফোন কানে লাগিয়েই রাখলো, হয়তো এখনো কিছু কথা বলার বাকি আছে, হয়তো এখনো কিছু কথা শোনার বাকি আছি। কেমন জানি চোখ গুলোতে পানি জমতে শুরু করে প্রেমার খুব অল্পতেই এখন কেমন চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে। আগের মত শক্ত মনটা আর নেই। কেমন জানি নরম হয়ে গেছে, আর এই নরম হবার কারণ হচ্ছে হৃদয়কে প্রেমা অনেক বেশী ভালোবেসে ফেলেছে।
— হঠাৎ মিহি আর রিমি এসে ঘরের দরজায় টোকা দিতেই, প্রেমা বা হাতের উল্টো সাইড দিয়ে চোখের পানি মুছে দরজা খুলে দিলো। মিহি ছুটে এসে তার মাকে জড়িয়ে ধরলো। চোখ মেলে এদিক সেদিক তাকিয়ে মিহি প্রেমাকে বললো তোমার ঘরটা কত সুন্দর মামুনি। তোমার কত সুন্দর সুন্দর ছবি লাগানো। প্রেমা মেয়ে কোলে তুলে নিয়ে, রিমিকে সাথে নিয়ে নানান ভঙ্গিমায় ফটো তুলতে শুরু করলো। সেই সাথে মেয়েকে বলতে থাকলো এখন থেকে আমার ছবির সাথে তোমার ছবিও থাকবে কেমন। মিহি আনন্দে মায়ের গলা জড়িয়ে কপালো চুমু খায়। কখনো প্রেমার কোলে কখনো রিমির কোলে এভাবেই দুষ্টমিতে মেতে থাকলো তিনজন।
এক সময় দুষ্টমা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে মিহি ঘুমিয়ে পরলো প্রেমার কোলে। মেয়েকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে দুবোন গল্পে মেতে উঠলো। গল্প করতে করতে হঠাৎ করেই রিমি বলে উঠলো আপু তুই কি ভাইয়ার সাথে সুখি না?
প্রেমা:- রিমির এমন প্রশ্নে কিছুটা চমকে গেলো, নিজেকে সামলে নিয়ে এমনটা কেন বলছিস? আমি খুব ভালো আছি আর সুখেই আছি। তাছাড়া উনি আমাকে খুব পছন্দ করেন।
রিমি:- তুমি কি মিথ্যা কথা বলছো না আপু?
প্রেমা:- মিথ্যা কেন বলবো?
রিমি:- না মানে ভাইয়া যদি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসতো তাহলে নিশ্চই আমাদের এখানে আসতো। নাকি আমরা গরীব তাই তার এখানে আসতে খারাপ লাগবে বলে আসেনি।
প্রেমা:- কোনটাই না, উনি আসলে অনেক দিন অফিস করেনি, নিজের অফিস সব কিছু এলোমেলো হয়ে আছে, নতুন করে সব গুছিয়ে নিতে একটু ব্যস্ত তাই সাথে আসতে পারেনি আর কিছুই নয়। সময় পেলেই চলে আসবে, আমাকে বলেছে।
— কথাটা বলার পর পর মাথাটা নিচু করে রাখলো প্রেমা, কারণ সে মিথ্যা বলেছে, হৃদয় কোন দিন আসবে কিনা তা সে জানে না। জানেনা তার জন্য হৃদয়ের মনে কোথাও জায়গা সৃষ্টি হয়েছে কিনা।
রিমি:- আচ্ছা বসো আমি চা করে নিয়ে আসি।
— রিমি রুম থেকে বের হতেই গভীর চিন্তায় পরে গেলো প্রেমা। সে নিজে না হয় অভিনয় করে যাবে কিন্তু তার পরিবারের লোকজন খুব সহজেই এই অভিনয় ধরে ফেলবে। সবাইকে সহজে বুঝাতে পারলেও রিমিকে এতো সহজে কোন কিছুই বুঝানো যাবে না। ছোট বেলা থেকেই রিমি প্রেমার মনের সব কথা কেমন করে জানি বুঝে ফেলে। চা রেডি, দরজা ঠেঁলে ঢুকতে ঢুকতে বললো রিমি। প্রেমা মুখে হাসি ফুটিয়ে ইস কতদিন তোর হাতের চা খাইনা।
রিমি:- আপু চল ছাদে বসে চা খাবো দু’জন, কতদিন তোর সাথে পরন্ত বিকেল পার করি না।
প্রেমা:- কিন্তু মিহি জেগে উঠলে?
রিমি:- চিন্তা করিস না আমি মাকে বলে দিচ্ছি ও উঠে পরলে ওকে ছাঁদে আমাদের কাছে দিয়ে আসবে।
— দুই বোন ছাঁদের দোলনাটার উপর বসে দোল খাচ্ছে সাথে চায়ের মগে চুমুক দিচ্ছে। ওদের দুই বোনের মিল দেখে একটা সময় এলাকার মানুষ বলতো ওদের চেয়ে ভালো সম্পর্ক বন্ধুদের মাঝে হতেই পারে না। আসলেই ওদের সম্পর্কটা এতোই মজবুত যে কোন দিন কাউকে একটা টোকাও পর্যন্ত দেয়নি। বোনে বোনে এক সাথে থাকলে কত রকম খুনছুঁটি হয়, কিন্তু ওদের মাঝে ভালোবাসা ছাড়া ঝগড়া কখনোই লাগেনি।
রিমি:- বাবা মা মনে তোমার বিয়ের ডিসিশনটা একটু তাড়াহুরো করেই নিয়ে ফেলেছে।
প্রেমা:- এমন করে বলছিস কেন?
রিমি:- এক সন্তানের বাবার সাথে বিয়ে দিতে হবে কেন তোমাকে? তোমার কি কোন অংশে কম আছে? যেমন শিক্ষিত তুমি তেমনি দেখতে রূপবতী। একবার যদি মুখ দিয়ে বলো বিয়ে করবে তাহলে কত ভালো ভালো ছেলেরা এসে সিরিয়ালে দাঁড়াবে আর বাবা কি করলো। মধ্যবয়স্ক এক সন্তানের বাবাকে পছন্দ করলো।
প্রেমা:- ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে লোকটা অনেক ভালো। হয়তো অল্প বয়সী কোন ছেলের সাথে বিয়ে হলে সেও আমাকে এতো টুকু বুঝতো না।
— রিমির চোখ ছলছল করছে পানিতে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। মাথাটা নিচু করে রেখেছে। সন্ধ্যা শেষে চারিদিক অন্ধকার করে এসেছে। আকাশ গোমট বেঁধেছে হয়তো বৃষ্টি নামবে। দু,বোন নিচে নেমে গেলো। রিমি নিজের রুমে আর প্রেমা মিহিকে নিয়ে শুয়ে রইলো তার রুমে। হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠতে সেদিকে তাকাতেই দেখতে পেলো হৃদয় কল করেছে। ফোনটা রিসিভ করতেই,
#চলবে..