হারানো_সুর- ৪র্থ পর্ব

0
4538

হারানো_সুর- ৪র্থ পর্ব
©শাহরিয়ার

— হঠাৎ দমকা হাওয়ায় প্রেমার চুল গুলো এলোমেলো উড়তে শুরু করলো, বুকের উপর থেকে শাড়ির আঁচল সরে গেলো। চারিদিক আঁধার কালো হয়ে আসলো, এই বুঝি নামলো বৃষ্টি।আষাঢ়ের আকাশের কোন বিশ্বাস নেই কখনো রোদ কখনো বৃষ্টি। এর ভিতর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো।

হৃদয়:- নিজের চোখ প্রেমার দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলো চা খুব ভালো হয়েছে, এমন ঝিরঝির বৃষ্টিতে চা না হলে কি চলে? বলেই দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে চায়ের মগে আরেক বার চুমুক দিলো।

— প্রেমার হৃদয়ের কথার দিকে কোন খেয়াল নেই, সে হৃদয়ের পাশের রেলিংটা ধরে দক্ষিণ দিক থেকে বাতাসের সাথে ছিটে আসা পানির দিকে নিজের মুখ বাড়িয়ে দিলো। হৃদয় কোন উত্তর না পেয়ে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলো প্রেমা ভেজার চেষ্টা করছে, সময়ের সাথে সাথে বৃষ্টির গতিও বাড়তে শুরু করলো। হৃদয় মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রয়েছে প্রেমার দিকে। হঠাৎ বড় বড় পানির ফোটা প্রেমার মুখে পরতেই সে চোখ মেলে তাকালো। হৃদয়কে তাে দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পেয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাবে এমন সময় হৃদয় প্রেমাকে প্রশ্ন করলো বৃষ্টিতে ভিজবে?

— মুহুর্তে প্রেমা সেখানে দাঁড়িয়ে পরলো, আট দশটা সাধারণ মেয়ের মতো প্রেমার ও খুব পছন্দ বৃষ্টিতে ভেজা। বিয়ের আগে কখনো বাড়ির উঠানে কখনো ছাঁদে উঠে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো? সেই দিন গুলো যেন চোখের সামনে উঠতে শুরু করলো প্রেমার। যা এখন কেবল স্মৃতি।

হৃদয়:- এই পিচ্চি কি প্রশ্ন করলাম আমি?

— হৃদয়ের প্রশ্নে মুহুর্তে প্রেমা বাস্তবতায় ফিরে আসলো। নিচের দিকে চোখ নামিয়ে মাথাটা নেড়ে বুঝিয়ে দিলো হ্যাঁ সে ভিজতে চায়।

হৃদয়:- আমার সাথে এসো, বলে হাঁটা শুরু করলো, মনের ভিতর আনন্দ নিয়ে পিছু পিছু প্রেমাও হাঁটা শুরু করলো। দু’জন এক সাথে সিঁড়ি ধরে উপরে ছাঁদে উঠতে শুরু করলো। হৃদয় ছাঁদের শেষ সিঁড়িতে এসে গেট খুলে প্রেমাকে বললো যাও।

— প্রেমা হেঁটে একই বৃত্তে যেয়ে দাঁড়িয়ে হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে আমিতো একা ভিজতে পারবো না আমার ভীষণ ভয় লাগে।

হৃদয়:- কিসের ভয়? আর এখন তোমার সাথে ভেজার জন্য কাকে ডেকে নিয়ে আসবো। তোমাকে একাই ভিজতে হবে যদি তোমার ইচ্ছে থাকে।

— হৃদয়ের কথায় প্রেমা মাথা নিচু করে থাকে। প্রেমা সত্যিই খুব ভয় পায় বিজলি চমকালে। তাই ছোট বেলা থেকে যখনি বৃষ্টিতে ভিজতো কেউ না কেউ সাথে থাকতোই। কখনো ছোট খালা আবার কখনো প্রেমার ছোট বোন। কখনো তিনজন এক সাথে। লাফঝাঁপে মাতিয়ে রাখতো বাড়ি।

হৃদয়:- তাহলে তুমি একা ভিজতে পারবে না?

প্রেমা:- না, চলুন নেমে যাই।

— বলে প্রেমা ঘুরে পা এক সিঁড়ি নিচে বাড়াতেই হৃদয় প্রেমার দিকে হাত বাড়িয়ে একটা হাত ধরে টান দিতেই প্রেমা সোজা হৃদয়ের বুকে এসে ধাক্কা খেলো। মুহুর্তে প্রেমার সমস্ত শরীরের কেমন বিদ্যুৎ
শক খেলে যেমন লাগে ঠিক তেমন লাগলো। শরীরের সমস্ত লোম যেন দাঁড়িয়ে গেলো মুহুর্তেই, নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হবার মত অবস্থানে এসেছে। জীবনে প্রথম কোন পুরুষের বুকে এমন ভাবে লেপ্টে গেছে প্রেমা। ভয়ে সমস্ত শরীর এখনো তার কাঁপছে। কিছু বলার বা কিছু করার মত শক্তি তার ভিতর নেই। সারা জীবন শুনে এসেছে প্রেমা পুরুষ মানুষের শক্তির কাছে নারীরা অসহায়। আজ প্রেমা নিজে অনুভব করছে, কখনো কখনো পুরুষ মানুষকে শক্তি খাটাতে হয়না সামান্য স্পর্শেও মেয়ে মানুষদের কে নিজের মুঠির ভিতর বন্দী করে নেয়া যায়। যেমন এই মুহুর্তে প্রেমা বুঝতে পারছে হৃদয়ের বুক থেকে মাথা তোলার শক্তি টুকুও তার নেই। অথচ হৃদয় প্রেমার হাতটা ধরে শুধু টান দিয়েছে, শুধু হাতটাই স্পর্শ করেছে এর চেয়ে বেশী কিছু নয়। প্রেমা অসহায়ের মত হৃদয়ের বুকে মাথা রেখে দিয়েছে।

হৃদয়:- পিচ্চি এতো জিদ কিসের তোমার? ভিজতে ইচ্ছে হয়েছে ভিজবে এসো আমি তোমার সাথে দাঁড়াচ্ছি বলেই আবার হাত ধরে টানতে শুরু করলো।

— প্রেমা না কিছু বলতে পারছে না বাঁধা দিতে পারছে। মন্ত্রমুগ্ধের মত হেঁটে চলেছে হৃদয়ের হাতের উপর হাত রেখে। এ যেন বহু বছরের অপেক্ষা, এ যেন আজন্ম চাওয়ার আজ পূর্ণতা। মুহুর্তের বৃষ্টিতে সমস্ত শরীর ভিজে একাকার দু’জনের। হৃদয় হাত ধরেই দাঁড়িয়ে আছে প্রেমার প্রেমা চোখ তুলে হৃদয়ের দিকে তাকাতে পারছে না। ভয় নাকি লজ্জা কোনটা প্রেমা বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে না যে মানুষটাকে সে ভালোবাসে না তার কাছে কিসের লজ্জা। কিংবা তার সাথে কি করে মুগ্ধ হয়ে এখানে চলে আসলো সে। অবশ্যই হৃদয়ের কথায় হৃদয়ের চোখে যাদু আছে। হৃদয়ের মুখে মায়া আছে। বিশেষ কোন মায়া যে মায়ায় আবদ্ধ হয়েছে প্রেমা। তা নাহলে যাকে এড়িয়ে চলার প্রয়োজন ছিলো আজ তার হাতে হাত রেখে প্রেমা কি করে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে পারে?

হৃদয়:- শুনেছিলাম তুমি নাকি গান গাইতে পারো?

প্রেমা:- কল্পনার জগৎ থেকে বের হয়ে এক সময় পারতাম। কিন্তু আপনাকে কে বললো?

হৃদয়:- হাসতে হাসতে আচ্ছা তুমি নাকি বৃষ্টির দিনে গানের সাথে নাচতেও খুব পছন্দ করতে?

প্রেমা:- মাথা নিচু করে হ্যাঁ কোন এক সময় করতাম।

হৃদয়:- কোন এক সময় কেন? আর এখন করো না কেন?

প্রেমা:- তখন আমি স্বাধীন ছিলাম, আর এখন অন্যর ঘরণী, তাইতো চাইলেই সব কিছু সম্ভব নয়।

হৃদয়:- কে বললো তুমি পরাধীন? তুমিও স্বাধীন আমি তোমার স্বাধীনতায় কখনোই হস্তক্ষেপ করবো না। একটা মেয়ের যতটা স্বাধীনতা প্রয়োজন তার পুরোটাই তুমি এ বাড়িতে পাবে।

প্রেমা:- আমি গান গাইতে পারি নাচতে পারি এসব আপনাকে কে বলেছে?

হৃদয়:- তোমার ছোট বোন বলেছে।

প্রেমা:- আস্তো একটা ফাজিল মেয়ে ও মিথ্যা বলেছে।

হৃদয়:- ওহ মিথ্যা বলেনি তুমি মিথ্যা বলতাছো। এখন সব বাদ দিয়ে গান শুনাও।

— বৃষ্টি বেড়েই চলেছে, সময়ের সাথে সাথে চারিদিক অন্ধকারে রাতের আঁধারে পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে আকাশে বিজলী চমকাচ্ছে সে আলোয় চারিদিক আলোকিত হচ্ছে। প্রেম দূরে যত দূর চোখ যায় তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। কোথাও কেও নেই। জন মানব বলতে কিছুই দেখা যায় না। যতদূর চোখ যায় প্রতিটা ছাঁদ খালি পরে রয়েছে, সকলেই হয়তো নিজের ঘরে বসে আছে।
হৃদয় চেয়ে রয়েছে প্রেমার দিকে, কপাল বেয়ে বৃষ্টির পানি টপটপিয়ে পরছে তার গালে নাকে, তারপর তা চলে যাচ্ছে চিবুক থেকে নেমে গলা দিয়ে নিমে যাচ্ছে নিচের দিকে। কিছু স্মৃতি ভুলার নয়। হৃদয়ের মনে পড়তে থাকলো অতীতের কথা কতদিন এই ছাঁদে দাঁড়িয়ে রোদেলার ছাদে ভিজেছে দু’জন, অথচ আজ সবই স্মৃতি। যখন কথা গুলো ভাবছিলো, তখন প্রেমা গান গাইতে শুরু করলো।

“এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
এমন দিনে মন খোলা যায়–
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়॥
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার–
জগতে কেহ যেন নাহি আর॥
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব–
আঁধারে মিশে গেছে আর সব॥”

— মন্ত্রমুগ্ধের মত এক দৃষ্টিতে প্রেমার দিকে চেয়ে গান শুনে চলেছে হৃদয়। প্রেমা গেয়ে চলেছে, কখন গান থেমে গেছে সেদিকে হৃদয়ের খেয়াল নেই, প্রেমা কাশ দিয়ে এই যে শুনছেন?

হৃদয়:- প্রেমার ডাকে দ্যান ভেঙে গেলে হ্যাঁ বলো।

প্রেমা:- কোথায় হারিয়েছেন?

হৃদয়:- কই কোথাও নাতো।

প্রেমা:- রোদেলা আপুর কথা মনে পরছে নাকি?

হৃদয়:- কিছুটা সময় একদম নিরব স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মুখ দিয়ে কোন কথা যেন বের হতে চাচ্ছিলো না। অবশেষে হৃদয় বলে উঠলো মন বুঝো নাকি? মনের ভিতর কি আছে সব বুঝতে পারো নাকি?

প্রেমা:- হাসতে হাসতে আরে না, তেমন কিছু না, তবে এমনটা হওয়া কি স্বাভাবিক নয়?

হৃদয়:- কি জানি বলতে পারবো না। গানতো শুনলাম নাচ কবে দেখবো না?

প্রেমা:- ইস কি বলেন আমি নাচতে পারবো না শরম লাগে অনেক।

— হৃদয় অন্য দিকে তাকিয়ে হেসে চলেছে, হঠাৎ করে কেমন জানি ঠাণ্ডা অনুভুতি হতে থাকলো প্রেমার, সমস্ত শরীর হঠাৎ করে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেলো। প্রেমা হৃদয়কে ডাকতে যাবে তখনি প্রচণ্ড শব্দ করে বজ্রপাতের শব্দে হৃদয় প্রেমার দিকে ঘুরে তাকাতেই প্রেমা হৃদয়ের বুকের উপর মাথা রেখে পিঠের উপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করে নিলো। কয়েক মিনিট পার হবার পরেও যখন প্রেমা সরলো না। তখন হৃদয় ডাক দিলো কিন্তু প্রেমার কোন শব্দ নেই দেখে হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে যাবে তখন দেখে প্রেমার সেন্স নেই। সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। হৃদয় ভয় পেয়ে গেলো। উপায় অন্তর না দেখে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো নিচের দিকে

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here