#তুমি_আসবে_বলেছে_হৃদয়
#পর্ব-০৫
#মেঘলা_আহমেদ(লেখিকা)
❌ কার্টেসি ব্যতিত কপি নিষিদ্ধ ❌
-” শোয়াইব!
আরিশার ডাকে ঘোর ভাঙলো শোয়াইবের। ফিরে তার দিকে তাকালো। শোয়াইব লক্ষ করলো আরিশা ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শোয়াইব তাড়াতাড়ি উঠে আরিশার কাছে গেলো। দুহাতে আরিশার চোখের জল মুখে, হাতের মধ্যে নিলো ছোট মুখটা। পরম সৌহার্দ্যে ছোট ছোট চুমু খেলো আরিশার মুখে। তবুও আরিশার কান্না থামছেনা। শোয়াইব আরিশাকে বুকে চেপে ধরলো। আরিশা শোয়াইবের হার্টবিট শুনতে পারছে। বুকের ভেতর তুফানের মতো ঝড় বইছে মনে হচ্ছে। শোয়াইব শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
-” কাঁদছো কেন তুমি?
আরিশা নিরুত্তর। সে দুহাতে শোয়াইবের শার্ট খামচে ধরে কেঁদেই চলেছে নিঃশব্দে। শোয়াইব উত্তর না পেয়ে আবারো শুধালো-
-” কি হলো মা কি আবার কিছু বলেছে?
আরিশা হু হু করে কেঁদে দেয়। ভেতরের কান্নারা দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসে শোয়াইবের কথায়। কাঁদতে কাঁদতে শোয়াইব কে ছেড়ে দিয়ে বলে-
-” মা বলেছে তোমাকে নাকি আবার বিয়ে করাবে। শোয়াইব একটা বাচ্চার জন্য তুমি আমায় ভুলে যাবে? বাচ্চা বারবার মিসক্যারেজ হয়ে যায়। এখানে আমার কি করার আছে বলো। তাহলে মা কেন আমার উপর দোষারোপ করছে। সে বারবার বলছে রিদিশা আপুই তোমার জন্য ভালো ছিলো। আসলে আমি মনে হয় অপয়া। নাহলে তিন বছর হয়ে গেলো এখনো মাতৃত্বের স্বাদ নিতে পারলাম না। বারবার আশার আলো জ্ব|লে উঠেও নিভে যায়। রিদিশা আপুই তোমার জন্য বেষ্ট ছিলো। সেদিন যদি আপুকে কষ্ট না দিতাম।
আরিশা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে। শোয়াইব ও বা কি বলবে। তার কি ইচ্ছে করেনা বাবা ডাক শুনতে? কিন্তু আরিশা এই নিয়ে পাঁচবার কনসিভ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত প্রতিবারই মিসক্যারেজ হয়ে যায়। শোয়াইব নিজেও হাঁপিয়ে উঠেছে এই ঘটনায়। তার মায়ের ও বা দোষ কিসে? বুড়ো হয়েছে, তাঁরও তো শখ আহ্লাদ আছে। তার কি ইচ্ছে করেনা অন্যদের মত নাতি নাতনি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। শোয়াইব আরিশার উপর বিরক্ত হয়ে বলে-
-” তোমার এই ন্যাকা কান্না বন্ধ করবে? বিরক্ত হয়ে গেছি এসব শুনতে শুনতে। এক গান আমার আর ভালো লাগেনা।
শোয়াইব হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আরিশা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে চোখের অশ্রু বর্ষণ করতে থাকে। আচ্ছা একটা সন্তানই কি সবকিছু?
_____
রিদিশা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। এই বিকেলে ঘুমটা জেঁকে বসেছে। তখন মিসেস ময়ূরী তাহসান মানে বাড়ির মালিক উনি রিদিশার রুমে আসে। রিদিশাকে ঘুমোতে দেখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মেয়েটা কে দেখলে তার বড্ড মায়া লাগে। কত কষ্টই না সহ্য করেছে ছোট থেকে। শেষে কিনা নিজের বোনের জন্য ভালোবাসার মানুষটাকেও ছেড়ে দিলো! গ্র্যান্ডমার হাত বুলানো তে রিদিশা আরাম পেয়ে নড়েচড়ে ঘুমিয়ে পড়ে। নিচ থেকে একটা ভরাট পুরুষালি কন্ঠের ডাক আসে- কেউ আছে বাড়িতে? ময়ূরী কপায় কুঁচকায়। এই সময় কে এলো। তিনি রিদিশা কে রেখে উঠে পড়ে। আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে নিচে আসে। নিচে আসতেই চোখে মুখে আনন্দ বয়ে যায়। এত খুশি হয়তো সে গত দশ বছরেও হয়নি। তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। সামনের মানুষটা হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ময়ূরীর দিকে। সে দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরলো ছেলেকে। মা বাবা আর ছেলে মিলে অনেকক্ষন গল্প করলো। তারপর ইয়াসিন তার মা-বাবার দিকে একটা গিফট প্যাকেট এগিয়ে দিলো। হাসিমুখে তাদের উইশ করলো-
-” হ্যাপি এনিভার্সারি বাবা-মা! আজ তোমাদের ৫৬ তম বিবাহ বার্ষিকী। আমি তো ভুলেই গেছিলাম। তোমার নাতি মনে করিয়ে দিয়েছে।
ময়ূরী তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে ফোকলা দাঁতে হাসলেন। একটু তৃপ্তির হাসি। ৫৫ টা বছর একসাথে কিভাবে কে|টে গেলো! কিছুক্ষণ পড়ে রিদিশা চোখ ডলতে ডলতে উপর থেকে নামলো। ঘুম ঘুম কন্ঠে ডেকে উঠলো-
-” গ্র্যান্ডমা গ্র্যান্ডমা!
কিন্তু কোথাও কাউকে পেলো না। ব্যাপার কি সব গেলো কই?
_______
সকালবেলা রিদিশা নিজের অফিসের জন্য বেরিয়ে যায়। কেবিনে ঢুকেতেই রিদিশা অবাক হয়।
মন আজো পথ চেয়ে রয়
তুমি আসবে বলেছে হৃদয়
গানটি বাজছে এরিকের ফোনে। এরিক গানটি শুনছে। রিদিশা গানটা শুনে বেশ অবাক হয়! এরিক তো বাংলা বোঝেনা তাহলে এই বাংলা গান কেন শুনছে? এরিক চোখ বন্ধ করেই বলে-
-” মিস আজকেও পারমিশন নিয়ে ঢোকনি তুমি!
রিদিশা হা করে তাকিয়ে আছে। চোখ বন্ধ করেই কিভাবে এরিক তার অনুপস্থিতি বুঝতে পারলো? রিদিশা আমতা আমতা করে বলে-
-” সরি খেয়াল ছিল না।
এরিক গানটা অফ করে বলল-
-” ওকে তোমার সিটে গিয়ে বসো।
রিদিশা নিজের সিটে গিয়ে বসে। কিন্তু কৌতুহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল –
-” আচ্ছা তুমি তো বাংলা জানো না। তাহলে বাংলা গান শুনছিলে যে?
রিদিশার কথায় এরিক মুচকি হেসে বলে-
-” গানটা আমার গ্র্যান্ডমার ফেভোরেট এবং গানটার দুইটা লাইন আমারো প্রিয়। আমার গ্র্যান্ডমাকে লাইন দুটোর মিনিং জিজ্ঞেস করতাম। পরে সে আমাকে এটা ইংরেজি তে বলেছে। সেই দুটো লাইনের ইংরেজি পারি তুমি শুনবে?
রিদিশা মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। এরিক চোখ বন্ধ করে বলে-
The mind is still looking for a way, the heart says you will come. (মন আজও পথ চেয়ে রয়, তুমি আসবে বলেছে হৃদয়)
রিদিশার অবাক মুখশ্রী ধীরে ধীরে মুগ্ধতায় পরিণত হয়। এত সুন্দর করে গেয়েছে এরিক। যে কেউ শুনলে মুগ্ধ হবে। এরিক চোখ খুলে রিদিশা কে বলে-
-” আজ কাজ করতে ইচ্ছে করছেনা। চলো নিউ কিছু ট্রাই করি!
রিদিশা মুখ টিপে হেসে বলে-
-” চলো তোমার এই ছাগলের মতো বড় বড় চুলগুলো কেটে ছোট করে দেই। তাহলে আরো হ্যান্ডসাম লাগবে!
এরিক তেতে উঠে বলে-
-” হোয়াট! ছাগলের সাথে তুলনা করলে আমাকে! তুমি জানো আমার এই চুলের জন্যেও কতো মেয়ে আমার উপর ফিদা।
বিদিশা ভেংচি কে|টে বলে-
-” হ বুঝেছি। তবে হেয়ার স্টাইল টা চেঞ্জ করা দরকার চলো নতুন একটা কা|ট দিয়ে আসবে।
এরিক হাই তুলতে তুলতে বলে-
-” ওটা নাহয় যাওয়ার সময় করবো। চলো অন্য কিছু ট্রায় করি। আমাকে কিছু প্রশ্ন করো, আমি তোমাকে প্রশ্ন করবো। চলো এটাই করি। আগে তুমি প্রশ্ন করো।
রিদিশা কিছুক্ষন ভেবে প্রশ্ন করে-
-” আচ্ছা তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কি জুনিয়র?
এরিক রেগে বলে-
-” এই তুমি আবার জুনিয়র সিনিয়র প্রসঙ্গ টানছো কেন? বলেছি না এসব টানবে না। উই আর ফ্রেন্ডস ওকে।
রিদিশা মুখ ভেংচি কা|টে। ফ্রেন্ড তাও তোমার মতো জুনিয়র কে কখনো না। তবুও এরিক কে দেখানোর জন্য হেসে বলে-
-” ওকে। এখন বলো তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কি?
এরিক মনযোগ দিয়ে ভাবে। তারপর চোখ বন্ধ করে অনুভব করার মত করে বলে-
-“ভালোবাসা হলো দাঁত ব্রাশের মতো! আমরা আমাদের প্রয়োজনেই দাঁত ব্রাশ করি। কাউকে দেখানোর জন্য নয়!
এরিকের উদাহরণ শুনে রিদিশা বলদের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এটা কেমন উদাহরণ দাঁত ব্রাশ দিয়ে ভালোবাসার উদাহরণ! এরিক নিজেই হেসে কু|টিকু|টি হয়ে বলে-
-” নিশ্চয়ই অবাক হয়েছো তাই না!
রিদিশা মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। এরিক তখন বলে-
-” এবার আমার প্রশ্ন করার পালা। তুমি কি কাউকে ভালোবাসো বা ভালোবাসতে?
রিদিশার হাসিখুশি মুখটা গুমোট হয়ে যায়। মুহূর্তেই মুখে আঁধার নেমে আসে। এরিকের বড্ড মায়া হয় মেয়েটার প্রতি। রিদিশা নিজেকে ধাতস্থ করতে বলে-
-” ভালোবাসতাম একজনকে খুব। তার সাথে আমার বিয়েও ঠিক হয়েছিল। কিন্তু সে আমার ভাগ্যে ছিল না।
এরিকের একটু মন খারাপ হলেও পরক্ষনে খুশি হয়ে বলে-
-” থাক যা হয় ভালোর জন্যই হয়। একটা কথা মনে রাখবে আল্লাহ যেটা তোমার থেকে কেড়ে নেয় সেটা তোমার ভাগ্যে নেই, যা ভাগ্যে আছে তা তোমার কল্পনার থেকেও সুন্দর!
রিদিশা মুগ্ধ হয়ে এরিকের কথা শোনে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে জিজ্ঞেস করে –
-” আচ্ছা তোমার জীবনের লক্ষ্য কি?
এরিক রিদিশার দিকে তাকিয়ে চমৎকার হেঁসে বলে-
-” I was born to love you, I came from heaven to love, I’ll love you even after I die
(আমি জন্মেছি তোমাকে ভালোবাসতে, আমি ভালোবাসতে স্বর্গ থেকে এসেছি, আমি মরার পরেও তোমাকে ভালোবাসবো)
#চলবে