#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ৭
#লেখিকাঃদিশা মনি
সকাল সকাল আলোদের বাড়িতে আশেপাশের বাড়ির কয়েকজন মহিলা আসে। মালেকা বেগমের সাথে তারা আলোর ব্যাপারে কথা বলছিলেন। তাদের পাশের বাড়ির চম্পা খাতুন বলছিল,
‘শুনলাম আলোর নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে। কি আর বলব তোমাদের পরিবারের কথা। বড় মেয়েটা পর এই মেয়েটারও ডিভোর্স হয়ে গেল৷ এখন আবার দেখ এই সৎ মেয়েগুলোর জন্য তোমার নিজের মেয়ের কি হয়। কেউ কি আর এমন পরিবারের মেয়েকে ঘরে তুলবে যাদের ঘরে দুটো ডিভোর্সি মেয়ে পড়ে আছে।’
মালেকা বেগম খুব বিরক্ত হন তাদের কথায়।
‘আমার মেয়েদের কথা আপনাদের কাউকে ভাবতে হবে না। ওদের দেখার জন্য আমরা আছি।’
চম্পা খাতুন ভেংচি কে’টে বলেন,
‘এমন কথা তো বলবাই। উচিৎ কথা বললে খারাপ লাগবেই। তোমাকে একটা ভালো পরামর্শ দেই আমার ভাইয়ের একটা ছেলে আছে। বয়স একটু বেশি এই ৫০ এর মতো হবে। আগের বউটা ম’রে গেছে। সে এখন বিয়ে করার জন্য মেয়ে খুঁজছে। জোনাকি তো দেখতে শুনতে ভালো নয় তাই ওর আশা বাদ। আলো তো আ’গুন সুন্দরী। এরকম মেয়েকে ঘরে রাখার দরকার নেই। ওকে বিয়ে দিয়ে দাও আমার ভাইয়ের ছেলের সাথে। তোমাদের মানও বাচবে আর মেয়েটার একটা ব্যবস্থাও হবে।’
মালেকা বেগম এবার রেগে যান। চম্পা খাতুনকে সাবধান করে বলেন,
‘আলো আমাদের কাছে এত বোঝা হয়ে যায়নি যে যার তার হাতে ওকে তুলে দেব। আপনাদের ওর কথা এত ভাবতে হবে না।’
‘আচ্ছা দেখব তোমার এই তেজ কতদিন থাকে। সৎমেয়ের প্রতি যে তোমার এত মায়া দয়া কোথা থেকে আসে সেটা আল্লাহই ভালো জানেন।’
চম্পা খাতুনসহ বাকি সবাই ফিরে যাচ্ছিল তখন আলো ঘর থেকে বের হয়। আলোকে দেখে চম্পা খাতুন বলতে থাকেন,
‘কিরে আলো শুনলাম তোরও ডিভোর্স হয়েছে। ভালোই তো দুইবোন এখন বাপ মায়ের ঘাড়ে বসে খা। ভালো মেয়েদের কে তো আর স্বামী ছেড়ে দেয়না।’
চম্পা খাতুনের কথা শুনে আলোর মন বি’ষিয়ে যায়। আলো মলিন হেসে বলে,
‘দোয়া করি আপনার মেয়েটার যেন এমন পরিণতি না হয়। তাকে যেন আপনাদের ঘাড়ে বসে খে’তে না হয়।’
চম্পা খাতুন মুখ বাকিয়ে চলে যান। মালেকা বেগম আলোকে বলে,
‘তুই ওদের কথায় কান দিসনা আলো। আমি আর তোর আব্বু যতদিন বেচে আছি ততদিন তোদের ফেলে দেবোনা আমরা।’
আলো কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে গিয়ে কাদতে থাকে। সামনে হয়তো এরকম অনেক কথা শুনতে হবে তাকে।
১৩.
জোনাকি মুদি দোকান থেকে বাজার করে ফিরছিল। তখন জসিমের সাথে তার হয়ে যায়। জসিম তাদের এলাকার কু’খ্যাত গু’ণ্ডা। জসিম জোনাকিকে দেখে বলে,
‘কোথায় যাচ্ছিস জোনাকি? শুনলাম তোর বোনেরও নাকি তোর মতো ডিভোর্স হয়ে গেছে। শুনে খুব আনন্দ পেলাম। আমার তো ইচ্ছা ছিল তোর বোনকে বিয়ে করার। তোর আব্বুর কাছে প্রস্তাব নিয়েও গিয়েছিলাম। কিন্তু তোর আব্বু এত ব’জ্জাত যে কোথায় না কোথায় আলোকে বিয়ে দিয়ে দিল। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। এবার যখন সুযোগ পেয়েছি তখন আলোকে বউ করে ঘরে তুলব।’
জোনাকি খুব ভয় পেয়ে যায় জসিমের কথায়। জসিমের অনেক আগে থেকেই আলোর উপর নজর ছিল। এখন সে যদি আলোর কোন ক্ষতি করে এই ভয় কাজ করতে থাকে জোনাকির মধ্যে। জোনাকি আর অপেক্ষা না করে দ্রুত বাড়িতে চলে আসে। বাজারের ব্যাগ মালেকা বেগমের হাতে তুলে দিয়ে ছুটে যায় আলোর কাছে।
আলো তখনো কেদেই যাচ্ছিল। জোনাকি আলোকে কাদতে দেখে বলে,
‘এভাবে কাদছিস কেন আলো কি হয়েছে?’
জোনাকিকে দেখে আলো তার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘তুই এতদিন ধরে এতকথা কিভাবে সহ্য করছিস আপু? আমি যে একদিনের ভেঙে পড়েছি।’
জোনাকি বুঝতে পারে ব্যাপারটা। একসময় তো তাকেও এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল।
‘তুই আর কাদিস না আলো। তোর এই কান্নার দাম কেউ দেবে না। আমাদের মতো মেয়েদের কান্না দেখার মতো কেউ নেই। আমাদের নিজেদের নিজেকেই সামলাতে হয়। জানিস আমাকে যখন প্রথম প্রথম মানুষ কথা শোনাতো তখন আমিও এভাবেই কাদতাম। এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আগে প্রতিবাদ করলেও এখন আর করিনা। বুকের মধ্যে কষ্ট জমতে জমতে এত শক্ত হয়ে গেছি যে এসব কথায় আর খারাপ মনে হয়না। লোকে তো বলবেই আমরা কেন শুনব?’
আলোর এখন নিজের থেকেও বেশি কষ্ট হতে থাকে জোনাকির জন্য। না জানি জোনাকিকে আরো কত খারাপ সময় পার করতে হয়েছে। তাকে সামলানোর জন্য তবুও জোনাকি আছে কিন্তু জোনাকিকে সামলানোর জন্য তো কেউ ছিলনা। রাতের পর রাত জোনাকির এরকম কান্নার সাক্ষী হয়তো হয়েছে এই ঘরটা।
মায়া আচমকা তাদের রুমে চলে আসে। বি’স্ফো’রি’ত চোখে তাকায় আলোর দিকে।
‘তোর জন্য আমাদের আর কত কথা শুনতে হবে বলতো? তোর জন্য লোকে আমায় কথা শোনাচ্ছে। বলছে তোর বোনদের মতো তোকেও না ডিভোর্সি হতে হয়।’
জোনাকি মায়ার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়।
‘আলো যে ডিভোর্সি সেটা তো আমাদের বাড়ির বাইরে কারো জানার কথা নয়। আমি দেখলাম আশেপাশের সবাই এই ব্যাপারে জেনে গেছে। সত্যি করে বলতো এসব কথা তুই রটাস নি তো?’
‘আ,,আমি কে,,কেন রটাবো। আমি তো চম্পা চাচির মুখ থেকেই সব জানলাম।’
আলো বলে,
‘ঠিকই তো। কাল যখন আমি এসব ব্যাপারে বললাম তখন তো মায়া ছিলনা। তাহলে এসব কথা বাইরে গেল কিভাবে?’
১৪.
জসিম এসেছে আলোদের বাড়িতে। সোফার উপর পা তুলে বসেছে সে। আসাদুল করীম জসিমকে দেখে খুব রেগে যান,
‘তুমি কেন এসেছ আমাদের বাড়িতে? আর এভাবে অভদ্রের মতো বসে থাকার কারণ কি? বেরিয়ে যাও বলছি।’
জসিম সোজা হয়ে বসে। আসাদুল করীমকে সালাম দিয়ে বলে,
‘আমি এর আগে আপনাকে বলেছিলাম আমি আলোকে বিয়ে করতে চাই কিন্তু আপনি তখন আলোকে অন্যখানে বিয়ে দিলেন। এখন তো আলোর ডিভোর্স হয়ে গেছে। এখন আমি চাই আলোকে বিয়ে করতে।’
‘তোমার মতো একটা গু’ণ্ডার হাতে কখনো আমার আলোকে তুলে দেব না। প্রয়োজনে আজীবন তাকে বসিয়ে খাওয়াবো তাওনা।’
‘বেশি কথা বলবেন না। এতক্ষণ ভদ্র ভাষায় বলেছি তাই কাজ হয়নি। আলো ডিভোর্সি হওয়ার পরেও যে আমি ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি সেটা ওর ভাগ্য।’
‘তুমি যাবে না ঘাড় ধরে তোমাকে বের করে দেব।’
‘ঠিক আছে চলে যাচ্ছি। ভদ্র ভাষায় যখন কাজ হলোনা তখন অভদ্র উপায় কাজে লাগাতে হবে। পরে কিন্তু দোষ দিতে পারবেন না আমায়।’
জসিম উঠে চলে যায়। আসাদুল করীমের মনে ভয় বাসা বাধে। এখন জসিম যদি খারাপ কিছু করে তখন তিনি কি করবেন? আসাদুল করীম মালেকা বেগমকে বলেন,
‘আলোর উপর নজর রাখবে। ও যেন বাইরে না যায়। জসিমের জন্য আমার ভয় হচ্ছে খুব।’
আলো জোনাকির সাথে ঘরে বসেছিল। আলোর এভাবে ঘরে থাকতে ভালো লাগছিল না তাই সে জোনাকিকে বলে,
‘চলো আপু একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।’
‘না এখন বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। জানিস আজ মুদি দোকান থেকে আসার সময় জসিমের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। জসিমের এখনো নজর আছে তোর উপর। এই অবস্থায় তোর বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না।’
আলোর মনটা খারাপ হয়ে যায়। জোনাকির আলোর বিবির্ণ মুখটা দেখে ভালো লাগছিল না। তাই জোনাকি আলোর হাত ধরে বলে,
‘চল আশেপাশে থেকে একটু ঘুরে আসি।’
আলো খুব খুশি হয়। তারা দুইজন বেরিয়ে যাওয়ার সময় মালেকা বেগম তাদের আটকান। তিনি বলেন,
‘তোদের আব্বু বলেছে আলোকে নজরে রাখতে। একটু আগে জসিম এসেছিল আলোকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে। তোদের আব্বু না করে দেওয়ায় সে চলে গেছে। এখন এইরকম পরিস্থিতিতে তোদের বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না।’
‘আমরা তো বেশি দূরে যাবো না আম্মু। তাছাড়া আপু তো আছে আমার সাথে।’
‘ঠিক আছে তাহলে যা। একটু সাবধানে চলাফেরা করিস।’
আলো জোনাকির সাথে বাইরে আসে। একটু হাটাহাটি করার পর সাজিদের সাথে তাদের দেখা হয়। সাজিদ আলোকে বলে,
‘আলো এদিকে আয় তোর সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।’
আলোর কোন ইচ্ছা ছিলনা সাজিদের সাথে কথা বলার। সাজিদ যে আর কিছুদিন পর তার বোনের স্বামী হতে চলেছে তাই সাজিদের থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখতে চায় আলো।
জোনাকি আলো আর সাজিদের কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য দূরে সরে আসে। তখন সাজিদ আলোকে বলে,
‘তুই জানিস আলো তোর আম্মু আমাদের সম্পর্কের কথা জানতো। সব জেনে-বুঝে সে আমাদের আলাদা করেছে।’
কথাটা শুনে আলোর বিশ্বাসই হচ্ছিল না। মালেকা সবসময় নিজের মা মনে করেছে। সেই কিনা আলোকে এত বড় ধোকা দিল। আলো দ্রুত ছুটে যায় বাড়িতে৷ মালেকা বেগমকে গিয়ে প্রশ্ন করে,
‘তুমি নাকি আমার আর সাজিদ ভাইয়ের সম্পর্কের কথা জেনেও আমাদের আলাদা করেছ আম্মু? কিন্তু কেন?’
মালেকা বেগম বুঝে যান এখন আলোকে সব সত্য বলতে হবে,
‘হ্যা আমি সব জানতাম। সব জেনেই তোর বিয়ে দেই। আমি যা করেছি তোর ভালোর জন্যই করেছি।’
চলবে ইনশাআল্লাহ