#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২৩
#তাশরিন_মোহেরা
‘আব্বা, আমি আসলে একজনকে ভালোবাসি!’
কথাটুকু বলার পরই চোখ খিঁচে বসে আছি। কেননা আমি জানি কথাটা শুনতেই আব্বা আমাকে এই মুহুর্তেই ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেবেন গালে। চোখটা হালকা খুলে দেখলাম আব্বার অবস্থা। তিনি হাতটা উঁচালেন। এখনি বোধহয় মারবেন। তাই আবারো চোখ খিঁচে ফেললাম। কিন্তু মাথায় হাতের স্পর্শ পেলাম। অবাক হয়ে চোখটা খুলতেই দেখলাম আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমাকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে তিনি এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘আমি জানি মা, তুই কাউকে ভালোবেসেছিস। আর যাই হোক, আমি তো তোর বাবা! আর এটাও জানি তুই কাকে ভালোবাসিস!’
আমি আরো অবাক হলাম। সেকি? আব্বা কি করে জানলো আমি মুখরকে ভালোবাসি? আমি তো কখনো বলিনি আব্বাকে! তবে? আবারো মাথাটা খাটিয়ে মনে করতে লাগলাম। আমি ভুলে নামটা বলে দেইনি তো! কিন্তু কবে বললাম তা মনে করতে পারলাম না। আব্বা আমার ভাবনার মাঝে বলে উঠলো,
‘তুই নিশ্চয়ই ঐ রূপক ছেলেটাকে ভালোবাসিস, তাই না তিথি? আমি এতো না করার পরও ছেলেটাকে ভালোবাসতে গেলি, মা! আমি একজন খারাপ বাবা হতে চাইছিনা বলেই রাগটা সামলে রেখেছি এতোদিন। ভেবেছি তুই ছেলেটাকে ছেড়ে দিবি, কিন্তু এখন তো দেখছি আমার সামনেই বড় মুখে বলছিস তুই ছেলেটাকে ভালোবাসিস!’
আমি তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম। রাগে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। আব্বা এসব কি যা তা বলছে! মাথা থেকে এখনো রূপক ভাইয়ের ভুতটা তবে চাপেনি! রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললাম,
‘আপনি কি বলছেন এসব, আব্বা? রূপক ভাইকে কেন আমি ভালোবাসতে যাবো?’
আব্বা বললেন,
‘শান্ত হ, মা! আমি তোর হাবভাব বুঝে গেছি বলে তোর রাগ করাটা স্বাভাবিক। আর তুই মিথ্যা বললেও আমি বুঝি তোর অনুভূতি!’
‘কচু বোঝো তুমি! রূপক ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক শুধুমাত্র ভার্সিটির চার দেয়ালের মাঝেই বন্দী। আমি মুখরকে ভালোবাসি। মুখর শিকদারকে ভালোবাসি আমি!’
আব্বা আমার এমন রাগত ভাব বোধহয় আশা করেননি। তিনি এবার আমার সামনে এগিয়ে বললেন,
‘মুখর শিকদার? কে সে? যার জন্য আমার মেয়েটা এভাবে তার বাবার সাথে বেয়াদবি করছে? এজন্যই তো বলি, এসব ভালোবাসা মানুষকে অন্ধত্ব এনে দেয়! ধ্বংস ডেকে আনে, শুধুই ধ্বংস!’
আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়! আব্বার সাথে একটু বেশিই উঁচু গলায় কথা বলে ফেলেছি! তা মানছি আমি! কিন্তু তাই বলে আব্বা সরাসরি মুখরকে টেনে আনবেন এতে? আমার সহ্য না হওয়া সত্ত্বেও চুপচাপ দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছি। না হয় আবারো আমার নিখোঁজ ভালোবাসা নিয়ে আব্বা যা নয় তা বলবেন।
বড় বড় শ্বাস ছেড়ে শান্ত হলাম। আব্বাকে বললাম,
‘ভুল হয়ে গেছে, আব্বা! আর কখনো বেয়াদবি করবো না। তবে আমি সত্যিই মানুষটাকে ভালোবাসি!’
আব্বা আমার কল্পনাটাকে সত্যি করে এবার সামনে এসে কষে একটা চড় লাগিয়ে দিলেন গালে। চড়টা কষে দেওয়া হলেও আমার তেমন একটা ব্যথা অনুভূত হলো না। কারণ আমি যে আগে থেকেই এটাই আশা করছিলাম। আব্বা কপট রাগ নিয়ে বললেন,
‘কখন থেকে “ভালোবাসি, ভালোবাসি” করছিস! এই ভালোবাসা আমায় অন্ধকারে ডুবিয়েছে, তোকেও ডুবিয়ে মারবে। ঠিক কতোবার তোকে সতর্ক করবো আমি? আর কখনোই বলবি না তুই কোনো ছেলেকে ভালোবাসিস। ভুলে যা এসব!’
এটুকু বলেই তিনি হনহনিয়ে চলে গেলেন। গালে হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লাম। মনটা অনেকটা হালকা লাগছে এখন! এই কথাটা এতোদিন লুকিয়ে রাখাতে মনের উপর যেন একটা শক্ত পাথর দেবেছিল। সে পাথরটা এখন সরে গেছে। কিন্তু তাতেও আমার বিন্দুমাত্র ভালো লাগছে না। কেননা যাকে ভালোবাসি সে-ই তো আমার ভালোবাসাকে সামান্যতম তোয়াক্কা না করে চলে গেছে। যেন তার কোনো পিছুটান নেই!
.
ভার্সিটিতে পরীক্ষা থাকায় আজ বাসা থেকে একটু তাড়াতাড়িই বের হতে হয়েছে। পরীক্ষার জন্য বেরিয়েছি ঠিকই তবে পরীক্ষা সম্পর্কিত কিছুই আমি পড়িনি এতোদিন! এমনকি এটুকুও জানা নেই যে আজ আসলে ঠিক কি পরীক্ষা! তবুও নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য ভার্সিটি প্রদর্শন করতে যাচ্ছি! বাসের জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। এমন সময় পাশ দিয়ে চাদর মোড়ানো একটা সুঠামদেহী লোক গেল। তার দেওয়া পারফিউমের ঘ্রাণটা সম্পূর্ণ মুখরের ব্যবহৃত পারফিউমের ঘ্রাণের মতোই। আর এই ঘ্রাণটা একটু অন্যরকমই! অনেকের সংস্পর্শে-ই আমি প্রায় গিয়ে থাকি, কিন্তু কখনো এই ঘ্রাণের পারফিউমটা মুখর ছাড়া কারো কাছ থেকে পাইনি। অন্যমনস্ক থাকায় লোকটার মুখটাও দেখতে পেলাম না। ক্ষণিকের জন্য মনটা উতলা হয়ে উঠলো। মানুষটা নিশ্চয়ই মুখর! আমার মন বলছে ছেলেটা মুখর! তাই সাতপাঁচ না ভেবেই আমি লোকটার পিছু দৌঁড়ালাম। তার কাছাকাছি এসেই কাঁধ ধরেই তড়িৎ সামনে ফেরালাম। মুখটা দেখার আগেই উচ্ছ্বাসে ভরে গিয়েছে আমার মন। তাকে ফিরিয়েই অস্পষ্ট স্বরে বললাম,
‘মুখর সাহেব!’
কিন্তু! মুখটা দেখেই মনটা চুপসে গেল মুহুর্তেই। ছেলেটা মুখর নয়! সাথে সাথেই আমার উচ্ছ্বাস উড়ে গেল। মনটা তবে ভুল বললো আমায়! ছেলেটা আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আমি জোরপূর্বক হেসে ধীরভাবে বললাম,
‘দুঃখিত!’
ছেলেটা বিড়বিড় করে বললো,
‘চোখ কি হাতে নিয়ে হাঁটেন নাকি? আজব!’
আমি নিঃশব্দে মাথা নিচু করে পিছু হটলাম। মুখরের জন্য আজ কতো কিছুর সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমায়!
‘ছেলেটা আর ফিরবে না, তিথি! নিজেকে মানিয়ে নে!’
আমার বিবেকটা জাগ্রত হলো। মনকে বললাম যদি বিবেকের কথা শুনে ছেলেটাকে ভালো না বাসতাম তবে আজ হয়তো এতো কষ্ট পেতে হতো না!
ভার্সিটি গেইট থেকে বেরোতেই রূপক ভাই ডাক দিলো,
‘তিথু! তিথু!’
আমি পেছন ফিরে দেখলাম রূপক ভাই দৌঁড়ে আমার দিকেই আসছে। কাছে এসে বললো,
‘কিরে এক্সাম দিয়েই চলে যাচ্ছিস! আমার সাথে একটু দেখাও করলি না! এই কদিনে ভুলে গেলি রে!’
আমি হালকা হাসলাম। সেই হাসিটা বোধহয় দৃশ্যমান নয়। রূপক ভাই আমাকে নিয়ে একটা বটের পাশে বসলো। একপ্রকার জোর করেই বসালো সে আমায়! খানিকক্ষণ বকবক করার পর ক্লান্ত হয়ে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘কিরে? আজ একদম বোবা হয়ে গেছিস যে? কি হয়েছে?’
আমি দু’দিকে মাথা দুলিয়ে বললাম,
‘নাহ! কিছু না!’
রূপক ভাই নিঃশব্দে আমাকে খানিক পর্যবেক্ষণ করলো। তাকে এভাবে দেখে থাকতে দেখে আমি হাসলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি হয়েছে, রূপক ভাই?’
সে প্রত্যুত্তরে বললো,
‘তুই হাসছিস অথচ তোর চোখ ছলছল করছে। কি হয়েছে আমায় বলবি, তিথু?’
তার কথাটা শুনে আমি আর হাসিটা মুখে রাখতে পারলাম না। আপনাআপনি ঠোঁট ভেঙে কান্না এলো। শুধু কান্না আসেইনি বরং বাধভাঙ্গা অশ্রু ঝরতে লাগলো আমার চোখ বেয়ে। নিজের কান্নাটা ঢাকার বৃথা চেষ্টা করে ব্যাগটা মুখের সাথে চেপে ধরলাম। এই থেকে আমার মনে পড়লো আমি কাঁদছি বলে মুখর একসময় আমায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। আমার দিকে না দেখেই আমায় শান্তিতে কাঁদতে দিয়েছে।
কি আশ্চর্য! আমি এই সময়েও লোকটার কথা ভাবছি! কেন ভাবছি? অন্য চিন্তা বাদ দিয়ে আমি কেনই বা শুধু মুখরের কথা ভাবছি? বে’হা’য়া মনটা বারবার মুখরকেই বা কেন চাইছে?
ভাঙা গলায় বলতে লাগলাম আমি,
‘মুখর সাহেব এখনো ফেরেনি, রূপক ভাই! সে আমাকে একা রেখে চলে গেছে! আমার ভেঙে যাওয়া মনটা আর সহ্য করতে পারছে না কিছু। তার অনুপস্থিতি আমি আর নিতে পারছি না, পারছি না আমি, রূপক ভাই!’
(চলবে)