#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_১০
#তাশরিন_মোহেরা
‘ও গ’ড মুখর, তোমার কি হয়েছে?’
বোতলে কুসুম গরম পানি ঢা’ল’তে গিয়ে একটা মেয়েলি সুরে ভ্রু কুঁচকালাম। মুখরের রুমে উঁকি দিতে গিয়েই বুঝলাম মনের স’ন্দে’হ’টাই সঠিক হয়েছে। রূপন্তী এসেছে। সে দরজা খুলেই সোজা মুখরের রুমে ঢুকে পড়েছে। আর তার সামনে দাঁড়িয়ে বকবক করছে। মুখর কপালে এক হাত দিয়ে ব্যা’থা স’হ্য করে শুয়ে আছে। ইচ্ছে হচ্ছে বোতলের এই গরম পানিগুলো সবটাই মেয়েটার মুখে ছুঁ’ড়ে মারি। বিন্দুমাত্র যদি কান্ডজ্ঞান থাকতো তার! অসুস্থ একটা মানুষের কানের কাছ বকবক করছে, এর কি বুদ্ধিসুদ্ধি নেই?
আমি বোতলটা নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই রূপন্তী চোখমুখ খিঁ’চে বললো,
‘তুমি এখনো এখানেই আছো? আর কি করছোটা কি তুমি? হ্যাঁ? ল’জ্জাবো’ধ কি একদমই নেই?’
আমি তার কথাটুকু সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তাকে কোমড় দিয়ে ঠে’লে বললাম,
‘দেখি, সরুন। এই নিন, মুখর সাহেব। এটা পেটে চে’পে ধরুন, ভালো লাগবে।’
মুখর বোতলটা নিয়েই বললো,
‘ধন্যবাদ।’
আড়চোখে একবার রূপন্তীর দিকে তাকালাম আমি। মেয়েটা রা’গে ফুঁ’স’ছে। এই দেখে আমি মুখরের পাশে গিয়ে তার বালিশটা ঠিক করে দিলাম। কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে দিলাম ভালোভাবে। এরপর রূপন্তীর পাশে এসেই তাকে হালকা ভেংচি কেটে চলে যেতে নিলাম। রূপন্তী তা খেয়াল করতেই আমার পেছন পেছন রুম থেকে বের হলো। এরপর ধমকের সুরে বললো,
‘এই মেয়ে, তুমি এখনো এ ঘর থেকে বেরোচ্ছো না কেন? আজ এক্ষুণি এই মুহুর্তে বেরিয়ে যাও। যাও বলছি!’
আমি কিছু বলার আগেই হঠাৎ মুগ্ধ সামনে এসে বললো,
‘আমার ম্যাম আপনার কথায় কেন বের হবে, হ্যাঁ? এটা আমাদের বাসা। আমরা বলবো কে কখন বের হবে, বুঝেছেন? বের হলে আপনি বের হোন। কাল আমার ভাইয়াকে কি খাইয়েছেন কে জানে! পেট ব্যা’থা’য় কাঁদছে আমার ভাইয়াটা।’
মুগ্ধের এমন প্রতিবাদ শুনে পিঠে হালকা হাত বুলিয়ে বললাম,
‘সাবাশ! এই না হলে আমার স্টুডেন্ট!’
রূপন্তীর রা’গের মাত্রা বোধহয় বাড়লো। সে অ’গ্নি’দৃ’ষ্টি’তে আমার দিকে একবার চাইলো। আমিও গর্ব নিয়ে দু’হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালাম তার সামনে। আর যা-ই হোক, বাড়ির ছোট কর্তা আমার পক্ষে। রূপন্তী রা’গটা সামান্য সংবরণ করে মুগ্ধকে বললো,
‘শোনো মিনি ডেভিল, মেয়েটা আসলে ভালো না। অনেক খারাপ! তোমাকে উল্টা পাল্টা কি শেখাচ্ছে দেখলে!’
মুগ্ধ এবার তে’লে’বে’গু’নে জ্ব’লে উঠলো। সে রূপন্তীকে রাগ নিয়ে বললো,
‘আপনি আমাকে মিনি ডেভিল ডাকছেন কেন? এটা শুধু আমার ভাইয়া আমাকে ডাকবে, আপনি ডাকবেন না। আর আমার ম্যাম খুব ভালো। অন্তত আপনার মতো দুইরকম আচরণ করে না। আপনি মুখর ভাইয়ের সামনে খুব ভালো সাজেন, কিন্তু আমি জানি আপনি এসব নাটক দেখান। অন্য কাউকে বোকা বানালেও আপনি আমাকে বো’কা বানাতে পারবেন না।’
মুগ্ধকে আমি এবার বললাম,
‘মুগ্ধ, বা’ড়া’বা’ড়ি হয়ে যাচ্ছে এখন। রূপন্তী আপু তোমার বড়, এভাবে কথা বলে না বড়দের সাথে, বাবা!’
রূপন্তী বললো,
‘হয়েছে তোমার আর ভালো সাজতে হবে না। ছেলেটাকে একটা বে’য়া’দ’ব বানিয়েছো, ঠিক তোমার মতো।’
এই বলে হনহনিয়ে চলে যেতে গেল। মুগ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘দেখেছেন ম্যাম! আমাকে বে’য়া’দ’ব ডেকেছে মহিলাটা।’
আমি মুগ্ধকে চোখে ইশারায় শান্ত হিতে বললাম। এরপর রূপন্তীকে থামিয়ে বললাম,
‘আচ্ছা দাঁড়ান! এতো কষ্ট করে যখন এসেছেন কিছু খেয়ে যান। মুগ্ধের জন্য নুডলস বানিয়েছি। বসুন, আপনাকেও দিচ্ছি!’
প্রথমে একটু ঘা’ড়’ত্যা’ড়া’মি করলেও পরে ঠিকই বসলো রূপন্তী। মুগ্ধকে ডেকে এনে দুজনকে গরম গরম নুডলস দিলাম। দেখতে খুবই আকর্ষণীয় হওয়ায় তা খুশিমনে মুখে পুরলো দুজনেই। কিন্তু দু’চামচ খাওয়ার পরই রূপন্তী ছটফট করতে লাগলো। জিজ্ঞেস করতেই বললো,
‘এই, তুমি নুডলস এ এতো ঝা’ল দিয়েছো কেন? পুরো মুখ জ্বলে গেল।’
আমি পাশ ফিরে মুগ্ধের কাছে জিজ্ঞেস করলাম,
‘মুগ্ধ, তুমি বলো, নুডলস কি বেশি ঝাল হয়েছে?’
সে দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘কই নাতো! একদমই ঝা’ল হয়নি।’
রূপন্তী চট করে উঠে পড়লো। তর্জনী উঁচিয়ে বললো,
‘তুমি ইচ্ছা করেই, ইচ্ছা করেই আমারটায় ঝাল দিয়েছো তাই না? যাতে আমি খেতে না পারি! তুমি এটা ভালো করলে না, মেয়ে। তোমার মতো ছো’ট’লো’ক’কে শায়েস্তা করতে আমার দু’মিনিটও লাগবে। যাস্ট ওয়েট, ইউ বি*চ!’
এই বলে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল রূপন্তী। আমি বাঁকা হেসে মুগ্ধের সাথে জোরে একটা হাই ফাইভ দিলাম। আর বিড়বিড় করতে করতে বললাম,
‘আমাকে গা”লি দেওয়ার মা’শু’ল ‘ও আপনার দিতে হবে, রূপন্তী আপু।’
.
আজ ক’দিন ধরে রূপন্তী নামক আপদটার দেখা মেলেনি। মনে মনে ভীষণ খুশি হলাম আমি। এই মেয়ে যত এ ঘর থেকে, মুখর থেকে দূরে থাকবে ততই ভালো! মুখরের পেটব্যাথাটাও কমেছে অনেক আগে। তাই সে খুব সাবধানে খাওয়া-দাওয়া করছে এখন! আজ একটু সকাল সকাল ভার্সিটি যেতে হয়েছে বলে ভার্সিটি ছুটি হতেই মুগ্ধকে পড়াতে চলে এসেছি। আসার পথে দেখলাম মুগ্ধের স্কুল ছুটি হয়েছে, তাই একেবারে একসাথেই এলাম দুজন। বাড়িতে ঢুকেই দেখি মুখর এখনো বাড়ি ফেরেনি। আমি মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করতেই সে বললো,
‘ইদানীং ভাইয়া অনেক ব্যস্ত থাকে। আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়।’
আমি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললাম,
‘তাহলে তুমি কি এই সময়টায় একা থাকো, মুগ্ধ?’
মুগ্ধ মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে জানালো,
‘না না, ম্যাম! পাশের বাসায় অর্কের সাথে থাকি। যাওয়ার সময় ভাইয়া বলে যায়, আসতে দেরি হলে আমাকে ওর বাসায় রাখতে।’
আমি ওপর নিচ মাথা দুলিয়ে জানালাম ব্যাপারটা আমি বুঝেছি। প্রায় এক ঘণ্টা পড়ার মাঝপথে হঠাৎ কলিংবেল বাজলো। মুগ্ধ আর আমি দুজনেই চমকে উঠি। পরক্ষণেই মুগ্ধ বললো,
‘হয়তো অর্ক এসেছে।’
এই বলে সে দরজা খুলতে গেল। দরজা খুলতেই ‘ভাইয়া’ বলে চিৎকার করে মুগ্ধ মুখরকে জড়িয়ে ধরলো। আমি তা দেখে মুগ্ধের চাইতেও বেশি অবাক আর খুশি হয়েছি। যাক, আজ আর অর্কের বাসায় যেতে হলো না মুগ্ধের। আর আমিও মুখর সাহেবের দেখা পেয়ে গেলাম। মুখর দুটো প্যাকেট নিয়ে এসেছে সাথে। তা টেবিলে রেখেই মুগ্ধকে ঝাপটে ধরে গালে চুমু খায় মুখর। উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে উঠে,
‘মিনি ডেভিল, আমার চাকরি হয়ে গেছে রে!’
এই বলে মুখর মুগ্ধকে নিয়ে ঘুরতে থাকে। মুগ্ধও দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে ভাইয়ের সাথে ঘুরছে। মুগ্ধ জানে না ‘চাকরি পেয়ে যাওয়া’ শব্দটার মর্ম কি! কিন্তু ভাইয়ের খুশি দেখে সে বেশ বুঝতে পেরেছে ‘চাকরি পাওয়া’ মানে ভালো কিছু, খুব ভালো কিছু!
আমি আড়াল থেকে মুখরের হাসিমাখা মুখটা দেখছি। দুই ভাইয়ের উল্লাসের মাঝে আমি এলাচি হতে চাই না। মুখরের প্রাণখোলা হাসি বোধহয় এই প্রথম দেখলাম আমি। হাসলে ছেলেটার চোখ দুটো ছোট হয়ে যায়। যা দেখতে অন্যদের কেমন লাগে জানি না, তবে আমার অপূর্ব লাগছে এই হাসিটুকু! হাসিতে দু’পাশে পড়া টোল দুটো এই দৃশ্যকে আরও অভূতপূর্ব করে তুলেছে।
ঘোরার মাঝপথে হঠাৎ মুগ্ধ বলে উঠে,
‘দাঁড়াও ভাইয়া, ম্যামকেও জানিয়ে আসি খবরটা।’
সাথে সাথেই মুখর ঘোরা থামিয়ে থমকে দাঁড়ায়। অবাক হয়ে বলে উঠে,
‘মিস.তিথিয়া আছে বাসায়?’
মুগ্ধ রুমে প্রবেশ করতে করতে জানায়,
‘হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগেই এসেছে।’
মুগ্ধের আসার শব্দ পেয়ে আমি নড়েচড়ে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বসি। আমি যে তাদের আড়াল থেকে দেখছিলাম তা তো জানতে দেওয়া যাবে না। দেখলাম মুখর লজ্জা পেয়ে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে এতোক্ষণ টেরই পায়নি আমি এসেছি। আমার খুব হাসি পেল। ছেলেটা লুকিয়ে লুকিয়ে হাসতেও জানে! পরক্ষণেই মুখশ্রীতে আবার সেই আগের গোমড়া ভাবটা নিয়ে এলো মুখর। মুগ্ধ আমাকে খবরটা জানাতেই আমি খুশি হওয়ার ভান করি, যেন আমি তার মুখ থেকেই প্রথম কথাটা শুনেছি। উচ্ছ্বাসের এক পর্বে মুখর মুগ্ধকে ডেকে বলে আমায় নিয়ে ডাইনিং টেবিলে আসতে। মুগ্ধের পিছু পিছু আমি গেলাম। টেবিল বসতেই দেখলাম একটা প্যাকেট হতে মুগ্ধ একটা ছোট কেক বের করছে। তা দুই পিস করে আমাকে দেওয়া হলো এক পিস আর মুগ্ধকে দেওয়া হলো আরেক পিস। আমার ভীষণ লজ্জা পেল! দুই ভাইয়ের মাঝে আমি ঠিকই এলাচি হয়ে গেলাম। ইতস্তত করে তাকিয়ে আছি কেকটার দিকে। মুখর আমার পাশের চেয়ারে বসে আমাকে দেখে বললো,
‘কি হলো? খাচ্ছেন না যে? কেক আপনার পছন্দ না?’
আমি কিছু না বলে চুপচাপ কামড় বসালাম তাতে। কেক আমার খুব পছন্দ! তার উপর চকলেট কেক বলে কথা! কিন্তু বিনা দাওয়াতে খেতে কেমন যেন লাগছে।
মুখরের অপর পাশে বসেছে মুগ্ধ। সে কেকটাতে কামড় বসাতেই ঠোঁটের চারপাশে ক্রিম লাগিয়ে ফেলেছে। তা দেখে ফিক করে হাসলাম আমি। মুখর আমার দিকে একবার চাইলো। আমি হাসি থামালাম আর ভাবলাম, ‘হায়! আমার এই কারণে অকারণে হাসাটা আর গেল না!’
মুখর আলতো হাতে মুগ্ধের ঠোঁটের আশপাশ মুছে দিলো। আদরের সহিত বললো,
‘দেখে শুনে খা, মুগ্ধ!’
আমার এ দেখে খুব লোভ হলো। আমিও চাই মুখর আমাকে এভাবে মুছে দিক। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। আমিও ইচ্ছে করে কেকের ক্রিম লাগিয়ে ফেললাম ঠোঁটের বামপাশে। তখনি মুগ্ধ হেসে বললো,
‘ম্যাম, আপনিও আমার মতো ক্রিম লাগিয়ে ফেলেছেন।’
আমি নিষ্পাপ মুখভঙ্গি করে মুখরের দিকে তাকিয়ে আছি। মুখরও অদ্ভুত এক অস্বস্তিতে পড়লো। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘কোথায় ক্রিম লাগিয়েছি দেখিয়ে দিন না, মুখর সাহেব।’
মুখর অগোছালো চোখে একবার দেখলো আমার ঠোঁটের বামপাশটা। আমি নিজেও বেশ টের পাচ্ছি ক্রিমটা কোথায় লেগেছে। কিন্তু ভান করছি না বোঝার। তবে এ ভান আর সফল হলো না। তাতেই পানি ঢেলে দিলো মুখর। তার ফোনটা আমার হাতে ধরিয়ে বললো,
‘ক্রিনে দেখুন, বুঝতে পারবেন।’
আমি বোকার মতো বসে আছি টেবিলে। তার দেওয়া ফোনটার দিকে আহত চোখে চেয়ে আছি। ভাবছি, ‘আহা! কি কপাল আমার!’
(চলবে)