#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_০৮
#তাশরিন_মোহেরা
মুগ্ধের স্কুলের এসে প্রধান শিক্ষকের জন্য দাঁড়িয়ে আছি আমি আর মুখর। স্কুলের ছোট বাচ্চারা এভাবে অন্যদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করবে আর তা মেনে নেওয়া হবে এ তো ঠিক না! আজ দুজন মুগ্ধের সাথেই স্কুলে এসেছি। মুখর আমাকে আসতে বারণ করলেও আমি এসেছি। আর যা-ই হোক, মুগ্ধ আমার আদরের ছাত্র। তার সাথে স্কুলে এমন অপ্রীতিকর ঘটনার পরও আমি চুপ করে বসে থাকতে পারিনা। মুগ্ধের ক্লাসে গিয়ে ছেলেগুলো সম্বন্ধে জেনেছি। এই ছেলেগুলো নাকি ক্লাসের অনেকের সাথেই এমনটা করে। অকারণে মারামারি, ক্লাসে মজা করার নামে ক্লাস নোংরা করা, গালাগাল দেওয়া এসব তাদের নিত্যদিনের অভ্যাস। শুনে ভীষণ খারাপ লাগলো আমাদের। এরা এমন একটা পরিবেশ তৈরি করেছে ক্লাসে যে এদের জন্য অন্যদের উপরও একটা খারাপ প্রভাব পড়ছে। উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ খুবই দরকার। নয়তো এরা বিভিন্ন ভাবে খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ে যা থেকে পরবর্তীতে মুক্ত হওয়া অসম্ভব।
ছেলেগুলোর কাছ থেকে তাদের অভিভাবকের ফোন নাম্বার নিয়ে তাদের আসতে বললাম। অভিভাবক ছাড়া এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ হবে না।
বেশ খানিকক্ষণ পর, প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা করার সুযোগ মিললো আমাদের। আমি আর মুখর রুমে ঢুকেই দেখলাম একজন আধবুড়ো লোক বসে আছেন তার চেয়ারে। চেহারাতে বেশ একটা সুশীল ভাব ফুটে উঠেছে। মুখে আছে একগুচ্ছ সাদা দাড়ি। আমাদের ঢুকতে দেখেই তিনি লম্বা একটা হাসি দিলেন। বেশ প্রাণবন্ত সেই হাসি, যা দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল দুজনের। আমরা একটা সালাম দিয়ে তার ইশারায় সামনে বসলাম। মুখর হাত বাড়িয়ে বললো,
‘হ্যালো, আমি মুখর শিকদার।’
প্রধান শিক্ষকও কুশল বিনিময় করে বললেন,
‘আমি আজিজুর ইসলাম।’
এরপর তিনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন,
‘হ্যালো, মিসেস.মুখর!’
আজিজুর সাহেবের মুখে ‘মিসেস.মুখর’ শব্দটি শুনেই ক্ষীণ চমকালাম আমি। তড়িৎ পাশ ফিরি, দেখি মুখরও একই ভাবে চমকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।মানুষটা আমাদের বিবাহিত দম্পতি ভাবছেন। আমি বুঝতে পারলাম না আজিজুর সাহেবকে তার ভুলটা সংশোধন করে দেওয়া উচিৎ কি না! মুখরকে দেখেও বুঝলাম সেও একই ঘূর্ণিপাকে ঘুরছে। ব্যাপারটা আর না ঘেটে আমি অপ্রস্তুত এক হাসি হাসলাম। তাকে বুঝালাম আমরা আসলেই দম্পতি। ব্যাপারটা ভীষণ অস্বস্তিকর হলেও এই পরিস্থিতিটা মোটেও ভুল শোধরানোর মতো নয়! আজিজুর সাহেব এবার সরাসরি কাজের কথায় চলে গেলেন। ব্যাপারটা তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার পর তিনি বেশ আহত হলেন বলে মনে হলো। আহত সুরেই বললেন,
‘আমি স্কুলটাকে ভীষণ ভালোবাসি। স্কুলের সকল শিক্ষার্থীদের ভালোবাসি। আমি কখনোই চাই না কচি এসব ফুলগুলো অকালেই ঝরে যাক। কিন্তু দিনশেষে আমি হয়তো ব্যর্থ।’
এরপরই তিনি আশ্বাসের সুরে বললেন,
‘আপনারা চিন্তা করবেন না মি. এন্ড মিসেস.মুখর। আমরা এখন থেকে আরও সতর্কতার সহিত ব্যাপারগুলো দেখবো। আমাদের উপর একটু আস্থা রাখবেন।’
আমরাও টুকটাক কথা বলে বেরিয়ে পড়লাম। তবে বেরিয়েই মুখর এবং আমি দুজনেই দুজনের দিকে অস্বস্তির চাহনিতে চেয়ে রইলাম। চোখাচোখি হতেই অস্বস্তিটা আরও গাঢ়তর হলো। মুখর ঈষৎ রাগ দেখিয়ে বললো,
‘বলেছিলামই তো না আসতে। তাও আসতে গেলেন কেন?’
আমি চুপচাপ মুখরের পাশে হাটছি। বাইরে হিমেল হাওয়া বইছে। সে হাওয়ায় বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠেছে পরিবেশ। আমার মনটাও হুট করে ফুরফুরে হয়ে উঠলো। আমি মনে মনে বললাম,
‘বেশ করেছি এসেছি, মুখর সাহেব। এসেছি বলেই তো আপনার পাশে এভাবে হাঁটতে পারছি। পরিবেশটা সুন্দর নাহ? হ্যাঁ! পরিবেশটা ভীষণ সুন্দর, সাথে আপনিও!’
.
পড়ার টেবিলে বই খুলে বসে আছি। একগাদা প্র্যাক্টিক্যাল পড়ে আছে। কিন্তু হাত চলছে না কিছুতেই। মনটা অন্য কোথাও পাড়ি জমিয়েছে। অদ্ভুত এক কল্পনায় সে উড়ে বেড়াচ্ছে ইদানীং। কল্পনার আনাচে কানাচে শুধু মুখরই বিরাজ করছে। মুহুর্তেই লজ্জা লাগছে আবার মুহুর্তেই রাগ! মুখরকে নিয়ে এলোপাতাড়ি ভাবনারা আমায় বারবার জানান দিচ্ছে যে আমার তার প্রতি একটা মোহ জন্মেছে। আর এ মোহ কতদূর যায়, তা-ই দেখার বিষয়। কিন্তু আমি কিছুতেই মানুষটার মুখশ্রী আমার চোখ থেকে সরাতে পারছি না। এদিকে আমার কানে একটাই শব্দ বেজে যাচ্ছে কিছুদিন ধরে, ‘মিসেস.মুখর!’
ইশ! কি লজ্জার কথা! বিবেকটা হঠাৎ সচল হলো। বললো, ‘এসব কি আজেবাজে চিন্তা করছিস, তিথিয়া! ছেলেটা তোর ছাত্রের ভাই। আর তার বয়স দেখেছিস? তোদের মধ্যাকার ব্যবধান পাক্কা সাত বছর! অথচ, তুই কিনা তোর সমবয়সী কাউকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখেছিলি! ওসব কই গেল, হ্যাঁ? বল!’
আমি সাথে সাথেই বিড়বিড় করলাম,
‘সে অনেক কাল আগের কথা। এখন আমার এই সাত বছরের বুড়ো পেঁচাকেই চাই!’
কথাটা বলে আপনাআপনি লজ্জায় ডুব দিলাম। পড়ার টেবিল থেকে উঠে বিছানায় শুয়ে লজ্জায় গড়াগড়ি করলাম কিছুক্ষণ। ক্ষণেই আবার জানালার ধারে গিয়ে আকাশ কুসুম ভাবতে লাগলাম। তবুও কোথাও মন টিকলো না। লোকে বলে, প্রথম প্রেমানুভূতির লগ্নে কিছুই যেন ভালো লাগে না। হাঁসফাঁস লাগে, অস্থির লাগে। কথাটা হারে হারে টের পাচ্ছি আমি। মাথায় চাপড় মেরে নিজেকে বললাম, ‘তুই গেছিস, তিথি! গঙ্গায় ভেসেছিস তুই!’
.
কিছুদিন পর,
মুগ্ধকে পড়ানো শেষ করে বসে আছি। সে স্কুলের জন্য তৈরি হচ্ছে। এখন থেকে প্রতিদিনই সে আমার সাথে স্কুলে যায়। বেশ একটা সময় কাটে রাস্তায় আমার মুগ্ধের সাথে। কতো শত আবদার আর প্রশ্নবিদ্ধ যে হতে হয় ঐটুকু একটা ছেলে হতে। এখন আর দুষ্টু ছেলেগুলো আমার ছাত্রকে ডিস্টার্ব করে না। এমন এক শিক্ষা পেয়েছে, সাত জন্মে আর এসব করার সাধ্যি নেই এদের!
তখনি দেখলাম, মুখর পড়ার রুমের সামনে অদ্ভুতভাবে পায়চারি করছে। আমাকে যেন কিছু বলতে চায়! আমিও অধীর আগ্রহে বসে আছি মুখরের কথা শোনার জন্য। কিন্তু সে একবার রুমের সামনে আসছে পরক্ষণেই আবার পেছন ফেরে নিজের রুমে চলে যাচ্ছে। বারকয়েক সে এরকমই করলো। আমি এবার আর বসে থাকতে না পেরে বললাম,
‘মুখর সাহেব, কিছু বলবেন?’
মুখর খানিকক্ষণ ইতস্তত করার পর আমার সামনে আসলো। হাতে আছে একটা টাই আর তার ফোন। আমি উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছি। আমি ভ্রুকুটি করে বললাম, ‘কি হয়েছে?’
সে দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে বললো,
‘টাই বাঁধতে পারছি না। ইউটিউব দেখে কয়েকবার চেষ্টা করলাম তাও হলো না।’
আমি তার দিকে চেয়ে বললাম,
‘আপনি এইটুকু একটা ব্যাপার আমাকে আগে বলতে পারলেন না?’
সে ঈষৎ লজ্জা পেল। আমিও কাঁপা হাতে তার টাইটা নিলাম। কাছে গিয়ে টাইটা মুখরের কাঁধে জড়িয়ে দিলাম। আমার হাতখানা খানিক কাঁপছে। এই ক’টা মাসে মুখরের এতো কাছে আমি কখনো যায়নি। শুধু মুখর কেন? আমার একুশ বছরের জীবনে কোনো ছেলের এতো কাছে যাওয়ার সুযোগই কখনো হয়নি। আর এখন? নিজের পছন্দের মানুষের ঠিক মুখোমুখি, খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবতেই সর্বাঙ্গে শিউরে উঠলো। মুখরও আমার মতোই খানিক ইতস্তত করতে লাগলো। তার নিশ্বাস আমার চুলে পড়ছে। তাতেও আমি ক্ষীন কেঁপে উঠলাম। ছেলেটাকে দেখতে অতোটা লম্বা না লাগলেও সে আমার থেকে বেশ খানিকটা লম্বা! আমি টাইটা ঠিক করেই মাথাটা উপরে তুলতে গিয়ে মুখরের থুতনিতে হালকা বারি খেলাম। ক্ষীণ ‘উহুঃ’ শব্দ করলাম। তখনই মাথায় কারো আলতো স্পর্শ অনুভব হলো। পাশে তাকিয়ে দেখি মুখর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বেশ সাবধানে। আলতো করে বললো,
‘বেশি ব্যাথা পেয়েছেন?’
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়েই খেই হারিয়ে ফেলি। মানুষটা বারবার আমাকে এতো অবাক করছে কেন? মুখরকে কখনো তো এমন কোমল হতে দেখিনি আমার প্রতি! তবে আজকে এ কেমন চাহনি তার? আমি লোভে পড়ে মাথা দুলিয়ে বুঝালাম ব্যাথা পেয়েছি। এতে সে মাথাটা আরো আলতো করে বুলিয়ে দিলো। কাঁপা গলায় বললো,
‘সরি!’
তার দুঃখিত বলাটা আমার যেন বহু আকাঙ্ক্ষিত কিছু মনে হলো। মাথা নিচু করে তার আদরটুকু নিয়ে নিলাম সন্তপর্ণে। কখনো কিছু নিয়ে লোভ হয়নি আমার। তবে ছেলেটার হাতে পাওয়া ভালোবাসার লোভ আমায় চেপে ধরেছে এখন! আমি এখন একজন লোভী মানুষ। ভীষণ লোভী!
এমন সময় পেছন থেকে কারও আওয়াজে চমকে উঠলাম দুজনেই। কিছুটা চিৎকার করে বললো আগন্তুক,
‘মুখর, কি করছো তুমি?’
(চলবে)