অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৭

0
684

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_০৭
#তাশরিন_মোহেরা

মুগ্ধের স্কুল গেইটের সামনে আসতেই দেখলাম তার গতকালের বন্ধুগুলো আজও দাঁড়িয়ে আছে গেইটের ধারে। আমি একবার মুগ্ধের দিকে তাকালাম। সে এতোটা সময় ধরে একটা কথাও বলেনি। কেমন চুপসে গিয়েছে। মনে মনে প্রচন্ড রাগ হলো মুখরের উপর আমার। সকাল সকাল এমন করে বকতে হয় এটুকু একটা ছেলেকে? বেচারা এখনো কেমন চুপচাপ হয়ে আছে। তার বন্ধুদের দেখেই মুগ্ধ থমকে যায়। এরা সামনে এগিয়ে এসে মুগ্ধের কাঁধ জড়িয়ে ধরে। তিনজনের একজন তার ব্যাগটা খুলে নেয়, অন্যজন তার মাথায় জোরে একটা চাপড় মারে। এরপর বলে,

‘কিরে বন্ধু? আসতে এতো দেরি করেছিস যে?’

মুগ্ধ কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তন্মধ্যে একজন আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘আপু, আপনি এখন যেতে পারেন।’

এই বলেই ছেলেগুলো মুগ্ধসহ ভেতরে প্রবেশ করলো। ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক হলেও আমার কেন যেন ভালো লাগলো না। সেদিনের মতো ব্যাপারটা নিয়ে আমি অতো ঘাটলাম না। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো এর পরের দিন। তাকে পড়াতে গিয়ে দেখলাম চোখের পাশে একটা গভীর ক্ষত। ঠোঁটের কোণেও আঘাত পেয়েছে সে। আমি ব্যস্ত কণ্ঠে বললাম,

‘কি হয়েছে মুগ্ধ? এমন করে ব্যাথা পেলে কিভাবে?’

সে আজও চুপ। তার এমন চুপসে যাওয়াটা আমার ভীষণ সন্দেহজনক লাগলো। এই ছেলে তো এমন চুপ করে থাকে না কোনো সময়! তবে আজ কেন? আমি মুগ্ধকে আবারো জিজ্ঞেস করলাম,

‘কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারো, মুগ্ধ! বলো আমায় এভাবে ব্যাথা পেলে কেন? কেউ মেরেছে তোমায়?’

মুগ্ধ মাথা নিচু করে তার চেয়ারে বসে আছে। ক্ষীণ স্বরে জবাবা দিলো সে,

‘সিড়িতে নামার সময় পড়ে গিয়েছি।’

আমার এই উত্তরে মন ভরলো না। প্রতিদিন ছেলেটার কাপড় আর ব্যাগ নোংরা হওয়া, সাথে তার বন্ধুদের অদ্ভুত আচরণ আর এখন তার এমন আহত হওয়া এ সবকিছুই আমায় ভীষণ ভাবাচ্ছে। মুগ্ধ সত্যি বলছে না এটা তার আচরণ দেখে বেশ বুঝতে পারছি আমি। আমি এবার তার মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে বললাম,

‘স্কুলে কেউ তোমায় ডিস্টার্ব করছে? আমায় নির্দ্বিধায় বলতে পারো, মুগ্ধ! কিছু হলে আমি তোমায় সাহায্য করবো, সত্যি। আমায় একটু খুলে বলো কি হয়েছে তোমার? প্রতিদিন এভাবে চুপসে থাকো কেন ইদানীং? বলো বাবা, কি হয়েছে তোমার?’

মুগ্ধ হঠাৎ আমার হাতটা চট করে সরিয়ে দেয়। রক্তলাল চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়েই চিৎকার করে বলে উঠে,

‘বলেছি তো সিড়িতে পড়ে ব্যাথা পেয়েছি। কিচ্ছু হয়নি আমার, বুঝেছেন?’

তার এমন আচরণে হঠাৎ আমার বুকটা কেঁপে উঠে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে মুগ্ধকে দেখছি। ছেলেটা এই ক’দিনে এমন পাল্টে গেল কি করে? মুগ্ধের চিৎকার শুনে ভেতর হতে মুখর দৌঁড়ে এসে জিজ্ঞেস করে,

‘কি হয়েছে মিস.তিথিয়া? মুগ্ধ! ম্যামের সাথে এ কি বেয়াদবি করছো তুমি? বড়দের সাথে এভাবে কেউ চিল্লায়? এ শিক্ষা দিয়েছি তোমায় আমি?’

মুগ্ধ এবার আগের চেয়ে দ্বিগুণ রাগ নিয়ে বলে,

‘এক কথা বারবার শুনতে আমার ভালো লাগে না! তারপরও কাল থেকে তোমরা এক প্রশ্ন বারবার করে যাচ্ছো আমায়। বললাম তো সিড়িতে পড়ে ব্যাথা পেয়েছি আমি। আমার বন্ধুরা আমাকে মারেনি, ওরা আমার কাপড়ে ময়লা পানি ঢালেনি, আমার ব্যাগ দিয়ে নিজেদের বেঞ্চ মুছেনি। তাও তোমরা আমায় বিশ্বাস করছো না কেন?’

মুগ্ধের কথায় মুখর এবার আমার দিকে ফিরলো। আমিও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে। মুগ্ধ ভুলবশত সত্যি কথাটা বলে দিয়েছে। কথাগুলো বলতে বলতেই সে কেঁদে দিলো। মুখর তার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। সে মুহুর্তে করুণ চোখে মুখর তাকায় আমার দিকে। মুখরের চোখে তখন ধরা দেয় একরাশ কষ্ট আর রাগের মিশ্রণ। মুগ্ধের কষ্ট সে সহ্য করতে পারছে না। অথচ এই ছোট ছেলেটা মনে মনে এতোকিছু সহ্য করে আসছে। স্কুলে তার উপর হওয়া নির্যাতনের কথা কাউকে বলেনি সে। মুগ্ধ শক্ত হতে জড়িয়ে ধরে আছে তার ভাইয়াকে। যেন হাত ফসকালেই দূরে চলে যাবে সে। সেকেন্ড খানেক কাটার পর মুখর বন্ধন ছিন্ন করে মুগ্ধকে চেয়ারে বসালো। আমি তার পাশে গিয়ে হাতে থাকা রুমালটা নিয়ে মুগ্ধের সামনে হাটু গেড়ে বসলাম। রুমালটা দিয়ে ভালো করে তার চোখ মুছে দিলাম। এরপরই তাকে আলতোভাবে জিজ্ঞেস করলাম,

‘স্কুলের ছেলেগুলো তোমায় বেশি ডিস্টার্ব করে, তাই না? ওদের আমরা উচিৎ শিক্ষা দেবো, বাবা! তুমি আর কেঁদো না।’

মুগ্ধের কান্নারা আজ বাধ মানছে না। বাধাহীন গড়িয়ে পড়ছে তার কপোল বেয়ে। তাদের আটকানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে সে নাক টেনে যাচ্ছে। এরপর কাঁপা গলায় বলতে থাকে,

‘ওরা আমাকে অনেক মেরেছে, ম্যাম! অনেক! আমিও ওদের মারতে চেয়েছি কিন্তু ওদের তিনজনের কাছে আমি একজন হেরে গিয়েছি। ওরা প্রতিদিন আমার গায়ে কিছু না কিছু নোংরা জিনিস ফেলে, আমার ব্যাগ দিয়ে ফ্লোর আর নিজেদের ময়লা বেঞ্চ মুছে।’

মুগ্ধ এটুকু বলে আবারো বাধভাঙ্গা কান্নায় ভেঙে পড়লো। বারবার চোখ মুছে যাচ্ছে দু’হাতে কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। আমি মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘তুমি কেন আগে তোমার ভাইয়া বা আমাকে কিছু বলো নি?’

মুগ্ধ এবার বেশ কষ্টে তার কান্না থামিয়ে বললো,

‘ভাইয়া একবার আমাকে বলেছিলো ছেলেদের কখনো নিজের কষ্ট দেখাতে নেই। যা-ই হোক, মনে মনে সব সহ্য করে নেয় ছেলেরা। আমিও চেয়েছিলাম ছেলে হয়ে এমন কিছু করতে। ভেবেছি সবাইকে আমার কষ্ট বলে দিলে সবাই আমাকে লজ্জা দেবে। কিন্তু, ম্যাম জানেন? কষ্টগুলো নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখা অনেক কঠিন। সবার সামনে না কেঁদে হাসাটাও অনেক কঠিন।’

ছেলেটার এমন কথা শুনে নিজের কান্নাদেরও থামাতে পারলাম না আমি। আপনাআপনিই তা চোখ বেয়ে নিচে পড়তে লাগলো। মুখরের দিকে একবার তাকাতেই দেখলাম সে গোপনে চোখ মুছছে। মুগ্ধকে গাট্টা মেরে সে বললো,

‘আমার কথাটা এভাবে মাথায় নিয়ে নিবি জানলে কখনোই এগুলো বলতাম না তোকে আমি। গাধা!’

মুগ্ধ এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। কান্না নিয়েই বললো,

‘দেখলে তুমি এখন আমাকে লজ্জা দিচ্ছো, ভাইয়া! ম্যাম, এখন সবাই আমাকে লজ্জা দেবে।’

এই বলে সে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতেই থাকলো। কান্নার মাঝেও ফিক করে হেসে ফেললাম আমি। মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরে বললাম,

‘আমার ছাত্র খুব সাহসী! প্রাউড অব ইউ, মাই বয়।’

মুগ্ধ আরও কিছুক্ষণ কাঁদলো। একসময় কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়লো সে। এই সকালবেলা ঘুমুতে দেখে ভাবলাম বেচারা হয়তো রাতে ভালো করে ঘুমুতে পারেনি। খুব মায়া হলো আমার! তাকে ঘুমাতে দিয়েই আমি বাগানের দিকে গেলাম। দেখলাম সেখানে আপনমনেই বসে আছে মুখর। আমি তার পাশে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে বসি। সেও আমার আশায় কিছুটা নড়েচড়ে বসলো। কিছুক্ষণ আমাদের মাঝে এক গভীর নিরবতা বিরাজ করে। নিরবতা ভেঙে মুখরই বলে উঠে,

‘আমার কারণে মুগ্ধকে কতোটা কষ্ট পেতে হলো দেখলেন?’

আমি ভ্রু কুঁচকে তার দিকে ফিরলাম। বললাম,

‘আপনার দোষটা কোথায়?’

মুখর প্রত্যুত্তরে বললো,

‘দেখলেন না, আমি তাকে ছেলে নিয়ে সব অদ্ভুত শিক্ষা দিতে গিয়ে সবটা মনের মধ্যেই সহ্য করে নিলো সে। আমি আসলে বড় ভাই হিসেবে ব্যর্থ!’

মুখর দীর্ঘ একটা শ্বাস নিলো। আমি হঠাৎ হেসে দিলাম। হাস্যরসাত্মক কিছু হয়েছে এমন করে বললাম,

‘আপনি এখন বাচ্চার মতো কথা বলছেন, মুখর সাহেব। এখানে আপনার দোষ হতে যাবে কেন বলুন তো!’

মুখর গম্ভীরমুখে বসে আছে। ব্যাপারটা তাকে মানাচ্ছে ভীষণ! সে অনুশোচনায় ভুগছে। নিতান্তই বাড়তি অনুশোচনা! আমি আবারো তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আপনিও মনে মনে অনেক কিছু চেপে রেখেছেন, তাই না মুখর সাহেব? অনেক বেদনা, অনেক কান্না এবং হয়তো অনেক রাগ!’

মুখর আকাশের পানে চেয়ে বললো,

‘এটুকু বয়সের একটা ছেলের কাছে আর কিইবা আশা করছেন আপনি, মিস.তিথিয়া!’

আমি তার কথায় পাশ ফিরলাম। দেখি মুখর পলকহীন চেয়ে আছে ঐ পরিষ্কার আকাশটার দিকে। ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলাম মুখরের সারা মুখজুড়ে ছোট ছোট কিছু কালো দাগ। এতে তার মায়া যেন আরও বেড়েছে। গায়ের রংটা একটু চাপা, কিন্তু সূর্যের ক্ষীণ আলোয় তার এই চাপা রঙটাও অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। কপালের উপর ছড়িয়ে থাকা চুলেরা হালকা উড়ছে। আমিও তার মতো পলকহীন তাকিয়ে আছে তারই পানে। ধরা গলায় হালকা করে বললাম,

‘সুন্দর!’

মুখর এবার চোখ সরিয়ে আমার দিকে চাইলো সরাসরি। সাথে সাথেই যেন শিউরে উঠলাম আমি। সে জিজ্ঞেস করলো,

‘কিছু বলেছেন?’

মুখরের চোখে ভালো করে চোখ রাখতেই দেখলাম আজকের চাহনিটা মোটেও আগেরকার মতো নয়। বরং আজকের চাহনিতে আমি কোথাও যেন একগুচ্ছ কোমলতা খুঁজে পেলাম। তার চোখ দুটো সবসময়ই ঘুমঘুম মনে হয়ে আমার কাছে। যা এতোদিন বেশ বিরক্ত লাগলেও আজ ভীষণ ভালো লাগছে। মন চাইছে সারাটা দিন মুখরের চোখে চোখ রেখে বসে থাকি। মুখরের ডাকে এবার আমার সম্বিৎ ফিরলো,

‘মিস.তিথিয়া! কিছু বলেছিলেন?’

আমি পরক্ষণেই সামনে ফিরে অস্ফুটে বললাম,

‘যা বলেছি তা আপনার আপাতত না জানলেও চলবে, সাহেব!’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here