নতুন টিউশনিতে এসেই আমার চক্ষু চড়কগাছ! দেখি এক যুবক শুধু তোয়ালে গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে পানি পান করছে। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হলো না আমার। সাতসকালে এ কি দেখলাম আমি? বোকার মতো হা করে দাঁড়িয়ে আছি। পানি পান করার ফাঁকে ছেলেটাও আমার দিকে আড়চোখে একবার তাকালো। আর আমাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাতের পানিটুকু ছুড়ে মারলো ঠিক আমার মুখ বরাবর। পানির ঝাপটা সামলাতে না পেরে মুখটা কুঁচকে ফেললাম। ছেলেটা দু’হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে তড়িৎ প্রস্থান করলো। পরক্ষণেই কি থেকে কি হয়ে গেল তার মাথামুণ্ডু বুঝলাম না! শুধু ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি। প্রথম টিউশনিতে এসে কেউ এমন পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছে কখনো? নিজের কপালটা নিজেরই চাপড়াতে মন চাইছে। এ কেমন ভাগ্য দিলে খোদা?
হিজাবটা ভালোমতো ঝেড়ে নিলাম। মুখটা মুছে নিলাম রুমাল দিয়ে! আজকের দিনটা ঠিক কেমন হতে যাচ্ছে আমি জানি না। তবে সকালবেলা এমন একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর মনটা ভালো কিছু হওয়ার সায় দিলো না। ভাবনার মাঝপথে ছাত্র আমায় তার পড়ার রুমে নিয়ে গেল। টেবিলে তার ঠিক মুখোমুখি ফ্যানের নিচে বসলাম, যাতে ভেজাভাবটা জলদি চলে যায়। ছাত্র আমার ঠোঁট টিপে হাসছে। ঈষৎ রাগ হলো আমার। আমার নাজেহাল অবস্থা দেখে এতো হাসার কি আছে? তবে তাকে প্রথম পড়াতে এসেছি বলে মুখে একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললাম,
‘হাসছো কেন?’
ছাত্রের তড়িৎ জবাব,
‘আপনাকে দেখতে পুরো ভেজা বেড়াল লাগছে, ম্যাম!’
দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছি। এর প্রত্যুত্তরে কি বলবো বুঝতে পারছি না! রাগে মস্তিষ্কটাই যেন শূন্যে নেমে এলো। এ কি দুঃসাহস? প্রথমদিনই শিক্ষিকাকে এমন ধারা অপমান? এ কি সহ্য করা যায়? মন মধ্যে ছেলেটাকে উত্তম মধ্যম দিয়ে দিলাম কিছুটা। তবে বাইরে ভদ্রতা রক্ষা করাটা জরুরি। তাই আমিও ছেলের উত্তরে নকল এক অট্টহাসি দিলাম। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘তা বাবা, তোমার নাম কি?’
‘মুগ্ধ! নাম তো সুনা হি হোগা, হাহাহা।’
স্পষ্ট হিন্দিতে আমার ছাত্র তার নামটা জানালো। আমি ক্ষীণ হাসলাম। দশ বছরের ছেলেটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই ছেলেটা কেমন? খুব বেশি দুষ্টু না খুব বেশি শান্ত! তার সাথে এমন আরও টুকটাক কিছু কথাবার্তা বললাম। যা বুঝলাম তা হলো ছেলেটা বেশ দুষ্টু। আর হিন্দিতে বেশ পটু। শাহরুখ খানের অনেক বড় একজন ফ্যান সে। ব্যাপারটা আমার বেশ পছন্দ হলো। কথাবার্তার এক ফাঁকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কিছুক্ষণ আগে যার সাথে আমার দেখা হলো সে তোমার কি হয়?’
মুগ্ধ মুচকি হাসলো। এরপর জানালো,
‘ঐ চিকনা ছেলেটা আমার বড় ভাইয়া। তার নাম মুখর।’
এরপর মুগ্ধ খানিক আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,
‘আসলে কিছুদিন আগে সে ছ্যাকা খেয়েছে। এক মেয়ে তাকে বলেছে, ‘তুমি একদম হ্যান্ডসাম না, মুখর।’ এই কথাটা তার গায়ে লেগেছে বলে সবার সামনে এমন তোয়ালে পড়ে ঘুরে বেড়ায়। নিজের সিক্স প্যাক দেখানোর জন্য!’
বলে মুগ্ধ হো হো করে হেসে উঠলো। আমি তো প্রায় বোকা বলে গেলাম। এইটুকুনি একটা ছেলের মুখে এসব শুনে কেই বা ঠিক থাকবে বলুন? আর ঐ মুখর ছেলেটাও কেমন? তার কি বিন্দুমাত্র কমনসেন্স নেই নাকি? এক মেয়ে তাকে কি না কি বললো! তাতেই এমন খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতে হবে!
মুগ্ধ এবার কিছুটা নড়েচড়ে বসলো। আমার দিকে তাকিয়ে বেশ একটা বড় ভাব নিয়ে বললো,
‘আজকের ঘটনার জন্য কিছু মনে করবেন না ম্যাম! আসলে ইন ছোটে ছোটে শেহের মে এ্যাসি বারি বারি বাত হোতি রেহতি হে!’
সে এবার দু’বাহু প্রসারিত করে ‘এহেহেহেই’ করে অবিকল শাহরুখ খানের মতো হাসলো। আমি তার এই কান্ড দেখে হাসবো না কাঁদবো বুঝলাম না। এ ছাত্র তো দেখি আমি মাথা চিবিয়ে খাবে। টিউশনিটা নেওয়ার আগে যদি জানতাম এ ঘরে দুই দুইটা পাগল ছেলে আছে তবে কখনোই এ টিউশনি আমি নিতাম না! কক্ষনোই না!
.
আজ এক সপ্তাহ হলো মুগ্ধকে পড়াচ্ছি। ছেলেটা দুষ্টু হলেও পড়ালেখায় বেশ ভালো। ব্রেইনটাও খুব শার্প! এমন ছাত্রকে পড়ানোর মজা-ই আলাদা। রোজ রোজ তার অদ্ভুত সব কৌতুহল দেখে আমার বেশ মজা লাগে।
গতকাল তার সাথে তুষারপাত নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সে অবাক হয়ে বলেছিলো,
‘তুষারপাত দেখতে খুব মজা তাই না? আমিও দেখতে চাই তুষারপাত কি করে হয়!’
তখন আমি দুঃখের সাথে বলেছিলাম,
‘আমাদের দেশটা নাতিশীতোষ্ণ হওয়ায় এখানে তুষারপাত হয় না। তুমি বরং ফোন থেকেই দেখে নিতে পারো!’
তার মনটাই কেমন খারাপ হয়ে গেল। যাওয়ার আগ মুহুর্তেও আমাকে প্রশ্ন করেছিলো আবার,
‘ম্যাম, সত্যিকারের তুষারপাত দেখার কি কোনো উপায় নেই?’
আমি মাথা দুলিয়ে বুঝিয়েছিলাম এমন কোনো উপায় নেই। বিপরীতে তার মলিন মুখশ্রী আমার দেখতে হয়েছে আরও একবার।
কিন্তু আজ মুগ্ধের মুখের ভাবভঙ্গি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। আমি বুঝতে পারছি না একরাতের মাঝে ঠিক কি এমন হলো যে তার মনটা আজ এতো উৎফুল্ল!
মুগ্ধ আমার হাত ধরে আমাকে বললো,
‘ম্যাম, আসুন আপনাকে তুষারপাত দেখাই!’
আমি অনেক অবাক হলাম। তুষারপাত? আর এই গরমে? কিভাবে সম্ভব? পরক্ষণেই আবার ভাবলাম সে হয়তো ফোন থেকেই আমাকে দেখাতে চাইছে। আমিও গেলাম তার পিছুপিছু। কিন্তু সে আমাকে তাদের বাড়ির পেছনের বাগানে নিয়ে এলো। আমি কিছুই বুঝলাম না! কি করছে এই ছেলে? কিছুক্ষণ পর সে তার মুখর ভাইকেও ঢেকে আনলো। মুখর ছেলেটাকে দেখেই বুঝলাম সে অনেক বিরক্ত। আমার দিকে তাকিয়ে হয়তো আরও এক দফা বিরক্ত হলো সে। মনে মনে তাকে হাজার বকলাম সেদিনের পানি ছোড়ার কারণে। ব্যাটা একটা সরিও বললো না উল্টো বিরক্ত হওয়া হচ্ছে তার! মুগ্ধ তার ভাইকে কিছু একটা বলে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এমন সময় দেখলাম উপর হতে তুষার পড়ছে। আমি অনেক অবাক হলাম! চোখটা একবার ঢলে নিলাম। আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো? চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম আসলেই তুষার পড়ছে। এরপর উপরে তাকিয়ে দেখি মুখর ছাদ থেকে দাঁড়িয়ে বাগানে ‘স্নো স্প্রে’ দিয়ে নকল তুষার বানিয়েছে। আমি এবার মুগ্ধের দিকে তাকালাম। সে কি আনন্দের সাথেই না এই তুষার উপভোগ করছে! আমার হাত ধরে লাফিয়ে উঠে মুগ্ধ বলে,
‘ম্যাম দেখেছেন? কি সুন্দর তুষার! ভাইয়াকে বলে স্নো স্প্রে আনিয়েছি এমন সত্যিকারের তুষার দেখার জন্য। কি মজা, তাই না?’
আমিও একগাল হেসে সম্মতি জানালাম। বাহ! কি বুদ্ধি আমার ছাত্রের! যার প্রশংসা না করলেই যে নয়।
বেশ খানিকক্ষণ তুষারপাত উপভোগ করার পর মুখর সাহেব নিচে নেমে এলেন। সে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে। এরপর মুগ্ধের মাথায় হালকা চাপড় মেরে বললো,
‘এই মিনি ডেভিল, অনেক মজা করা হয়েছে। এবার পড়তে যা!’
‘মিনি ডেভিল’ নামটা শুনে হালকা হেসে দিলাম আমি। তারপর দেখলাম মুখর আমার দিকে আবারো সেই বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সাথে সাথেই হাসি থামিয়ে ফেললাম আমি। পড়ানোর জন্য পেছন ফিরলাম। তখনি শুনি কেউ একজন আমায় বলছে,
‘সরি!’
আমি চকিতে সামনে ফিরি। আরেহ! সামনে তো মুখর ছাড়া আর কেউ নেই। তাহলে কি মুখরই আমাকে সরি বলেছে! কথাটা যেন বিশ্বাস হলো না। আমি না বুঝে আবারো জিজ্ঞেস করলাম,
‘জ্বি?’
সে এবার অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
‘সেদিনের ঘটনার জন্য সরি, মিস.তিথিয়া!’
(চলবে)
#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_০১
#তাশরিন_মোহেরা