তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব ৫

0
533

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ০৫
Writer Taniya Sheikh

বসার ঘরের মুখে এসে দাঁড়ালেন মাদাম ডলি। তাঁর হাত দু’টো কোমরে। অপ্রসন্নতার ছাপ মুখময়। ইসাবেলা কোলের হাত দু’টোর দিকে অনিমেষ চেয়ে আছে। মাদাম গলা ঝেড়ে বললেন,

“সকালের নাস্তা মিস করেছো। তারপর গরম পানিতে গুলিতে যে পথ্য তৈরি করে সামনে দিলাম সেটাও ঠাণ্ডা পড়ে আছে টেবিলে। তুমি কী আমার কথার গুরুত্ব দাও না? গুরুজনের কথা এভাবেই উপেক্ষা করবে?”

“মাদাম__” বিড়বিড় করে এইটুকুই মুখ দিয়ে বের হয় ইসাবেলার। মাদাম শুনেও শোনেন না। রুক্ষ গলায় বলেন,

“শোনো মেয়ে, কতবার বলব আমি অনিয়ম পছন্দ করি না। আমার ঘরে তুমি রোগী তারপর অতিথি। সুতরাং তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে। যখন যা বলি মানতে হবে। এর অন্যথা আমি বরদাস্ত করব না। বুঝেছ?”

ইসাবেলা মাথা নিচু করে রইল। মাদাম বসার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। একটু পর হাতে ট্রে ভরে খাবার এনে ইসাবেলার সামনে রেখে বললেন,

“দ্রুত খেয়ে নাও। অনেক কাজ আমার হাতে। সারাদিন তোমার খাবার সামনে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না।”

“আমার খিদে নেই মাদাম।” অসহায় মুখতুলে বলল ইসাবেলা। মাদাম মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে হতাশ কণ্ঠে বললেন,

“কোনো অজুহাত শুনতে চাই না। চুপচাপ খেয়ে নাও। তাড়াতাড়ি করো।”

বুকের উপর দু’হাত ভাঁজ করে চশমার ভেতর দিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। ইসাবেলা অনিচ্ছায় ব্রেড মুখে দিলো। আঙুল স্যুপের বাটির দিকে তাক করে মাদাম বললেন,

“স্যুপটা খাও।”

মুখটা পানসে করে এক চামচ স্যুপ মুখে তুললো ইসাবেলা। মাদামের ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে। ইসাবেলা লক্ষ্য করার আগেই তা আবার নিভে যায়। মাদাম কিচেনের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন,

“সিস্টার খবর পাঠিয়েছেন আগামী তিনদিন তিনি আসতে পারবেন না।”

“তিনদিন!”

ইসাবেলা ব্রেড হাতে উঠে এসে দাঁড়ায় কিচেনের দরজায়।

“তুমি কি বাচ্চা মেয়ে?” মাদাম জ্বলন্ত চুলার মুখে শুকনো কাঠ দিয়ে কটাক্ষ করে তাকালেন। ইসাবেলা প্রতিবাদের সুরে বলল,

“মোটেও না। আমার বয়স সতেরো।”

“কিন্তু আচরণ তোমার পাঁচ, ছ’বছরের বাচ্চা মেয়ের মতো।”

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মাদামের দিকে অসন্তুষ্টতে চেয়ে রইল। মাদাম কবোষ্ণ পানির গ্লাসটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবার ফিরে গেলেন কাজে। সবজি কাটছেন তিনি। গ্লাসের দিকে চেয়ে মুখ বিকৃত করে ফেলে ইসাবেলা।

“মুখ বিকৃত করে লাভ নেই। চুপচাপ পান করে নাও।”

ইসাবেলা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এই প্রবীণার উপর মাঝেমধ্যেই রাগ হয় ওর। এতটা শাসন ওর নিজের মা’ও করেনি। ইসাবেলা বরাবরই বাধ্য মেয়ে। শাসনের প্রয়োজন পড়েনি। আশৈশবের প্রেমের অপরিণতি, বিয়ে ভেঙে যাওয়া আর সবচেয়ে বড়ো ধাক্কাটা লাগে পিটারের হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যাওয়া। এক মুহূর্তে সব যেন বদলে গেল। ইসাবেলা যেন মানতেই পারছিল না, এখনও যে মেনে নিয়েছে তা নয়। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ব্যথা তাকে হতাশায় নিমজ্জিত করেছে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল সবার থেকে, সব কিছু থেকে। মনের অসুখের চেয়ে বড়ো কোনো অসুখ নেই। আস্তে আস্তে মনের অসুখ দেহকে কাবু করে ফেলে। মস্তিষ্ক দূর্বল হয়ে যায়। তখন মানুষ স্বাভাবিক থাকে না। আপজনদের সাথে করা নিজের ব্যবহারে অনুতপ্ত হয় সে। মা-বাবার দুঃখ ভারাক্রান্ত মুখ মনে করে কষ্ট হলো। এই যে প্রৌঢ়ার আচরণে রাগ করলো তা কিন্তু মনে মনে। বাহিরে সে কখনও তাঁর সাথে রাগ দেখাবে না। কারণ মন জানে, মাদাম যা করছে তাতেই ইসাবেলার মঙ্গল। মাদামের সেবা শুশ্রূষায় সে আগের থেকে অনেকটা সুস্থ। ভ্যালেরিয়া প্রথম প্রথম চিন্তা করলেও এখন সে মাদামের উপর পূর্ণ আস্থা রাখে। ইসাবেলাকে খুব করে অনুরোধ করেছে মাদামের কথা শুনতে। অচেনা, অজানা একজন প্রৌঢ়ার কথা অমান্য করতে পারেনি ইসাবেলা। মাদামের রুক্ষ ব্যবহারের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে তাঁর মমতা। সপ্তাহন্তে ইসাবেলা বেশ চিনেছে মাদামকে। তাই তো যতই রাগ করুক মনে মনে আদপে মাদামের জন্য তার শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই।

“গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে রইলে যে?”

মাদামের কথায় সংবিৎ ফেরে। বা’হাতের বৃদ্ধাঙুলি আর তর্জনীতে নাক চেপে কবোঞ্চ ওষুধ মেশানো পানিতে চুমুক দেয়। এত বিশ্রী এর গন্ধ! তিতকুটে স্বাদ! রোজ এই জিনিস তাকে খেতে বাধ্য করা হয়। অথচ, ডাক্তার বলেছিল জোর করতে না। মাদামকে সেকথা বলতে তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন,

“ওসব ডাক্তারিতে আমার বিশ্বাস নেই। জোর না করলে তুমি তো স্বেচ্ছায় মৃত্যু ডেকে আনতে। আরে বাছা, দুনিয়াটা টিকে আছে জোরের উপর। তোমাকে বলে কী লাভ। দুনিয়াটাকে কতটুকই বা চেনো? তুমি কেবল আবেগ দিয়েই সবটা দেখো।”

মাদাম ওর সম্পর্কে সবাই জানেন। ইসাবেলা যখনই নিজের মতামত রাখতে যায় মাদাম ওর কম বয়সী আবেগকে কটাক্ষ করেন। রাগ হয় তখন ওর। আবেগ বলে যেটাকে সকলে তুচ্ছ করে ইসাবেলার কাছেই ওই তো সব। পিটার, যাকে সে মন-প্রাণ উজাড় করে ভালেবাসে। যাকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন বুনেছিল। সেই স্বপ্ন যখন চোখের নিমেষে ভেঙে গেল ইসাবেলা দিশেহারা হয়ে পড়ে। স্বপ্ন ভাঙার বেদনা কাওকে বুঝানো যায় না। ওর মনটা আর সবার মতো কঠোর, কঠিন না। মন ভাঙার সাথে সাথে সেও ভেঙে পড়েছে। এরা জানেই না ভালোবাসতে, তাই তো বোঝে না ওর কষ্ট, ওর পরিস্থিতি। সস্তা আবেগ বলে ওর অনুভূতিগুলোকে ছোটো করে।
ওর কষ্ট যদি কেউ বোঝে তবে সে ভ্যালেরিয়া। ভ্যালেরিয়ার সান্নিধ্য ইসাবেলার সবচেয়ে প্রিয়। আগামী তিনদিন তাকে দেখতে পাবে না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। রুমে এসে বসল জানালার পাশে। হাঁটু মুড়ে দু’হাতে জড়িয়ে মাথাটা রাখল হাঁটুর উপর। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বন্ধ জানালার বাইরে তাকায়। ওর এই থাকার রুমটা থেকে সামনের বরফে ঢাকা রাস্তাটা দেখা যায়। রাস্তার ওপারে মাঝ বয়সী লোকটা লনে জমা বরফ সরাচ্ছেন। ইসাবেলাকে তিনি দেখতে পাননি। দেখলে অবশ্য একগাল হাসি উপহার দিতেন। বেশ অমায়িক মানুষ। তাঁর স্ত্রী ইসাবেলাকে খুব পছন্দ করে। ভদ্রমহিলা ভালো কেক বানান। ইসাবেলাকে তৈরি করে খাইয়েছেন দু’বার। এই গ্রামের মানুষগুলো অতিথিপরায়ণ। গ্রামটিও সুন্দর। প্রতিবেশীদের কাছে শুনেছে শরৎ, বসন্তে এই গাঁ স্বর্গীয় রূপ ধারণ করে। ভ্যালেরিয়ার সাথে দু’বার ওই সামনের ব্রিজের ওদিকটা ঘুরে এসেছিল। ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে চলা নদীটা শীতের মৌসুমে ছোট্ট নালার মতো মনে হয়। দু’পাশে বরফ জমে সুরু হয়ে যায় নদীটা। নদীর পরেই ঘন ওক গাছের সারি। পাতা ঝরা নগ্ন ডালপালা বরফের আস্তরণ মেখে দাঁড়িয়ে আছে।

“সারাদিন ঘরেই থাকবে?”

মাদামের অনুযোগ শুনতে পেল। ভ্যালেরিয়া সব সময় চায় ইসাবেলা আশপাশে ঘুরে আসুক। সখ্যতা গড়ে তুলুক প্রতিবেশী ছেলে-মেয়েদের সাথে। ইসাবেলা ঘরকুনো এমনিতেই। তাছাড়া সহজে নতুন মানুষের সাথে মিশতে পারে না। ওর কেন যেন মনে হয় মাদামও ভ্যালেরিয়ার মতো চায় ইসাবেলা সকলের সাথে সহজ হোক। জবাব না পেয়ে মাদাম দরজা খুলে দাঁড়ালেন।

“আমি পানি আনতে যাচ্ছি, তুমি যেতে চাও সাথে?”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতে মাদাম বললেন,

“শুকনো কাপড় নিয়ো সাথে করে। একবারে গোসলটা সেড়ে আসবে।”

ষাটোর্ধ বিধবা প্রৌঢ়া কারো সাহায্য ছাড়াই নিত্যকার সকল কাজ একাই করেন। নিজের কোনো জিনিসে কারো হাত লাগা পছন্দ করেন না। ইসাবেলা অবাক হয় যখন তিনি ওকে দিয়ে ঘরের ছোটো ছোটো কাজগুলো করান। ইসাবেলার ভালো লাগে তাঁকে সাহায্য করতে। কিন্তু মাদাম সব কাজে ওর সাহায্য নেন না। বালতি দু’টোর একটা ওর হাতে দিয়ে আরেকটা নিজেই নিয়ে বের হলেন বাইরে। প্রতিবেশী লোকটা ওকে দেখতে পেয়ে হেসে হাই জানায়। ইসাবেলা জবাব দিলো। মাদাম কিন্তু এসব খেয়ালও করলেন না। এই গ্রামের মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্ক রোগী আর বৈদ্যর। প্রতিবেশীদের সাথেও তেমন কথাবার্তা হয় না। কারো বাসায় তিনি যান না। কারণ ছাড়া কেউ তাঁর বাসায় আসে না। সমাজে থেকেও যেন সমাজ বিচ্ছিন্ন তিনি। বিধবা, পুত্রহারা প্রৌঢ়া একরকম নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেন এ বাড়িতে। ইসাবেলাকে তাঁর সাথে দেখলে বিস্মিত হয় লোকে। যেতে যেতে আজও তেমনই কয়েক জোড়া বিস্মৃত দৃষ্টি চোখ পড়ে। মাদামের দৃষ্টি সামনে। বরফের উপর দিয়ে দক্ষিণের জঙ্গলের দিকে যেতে কষ্টই হয় তাঁর।
মিঠা পানির ঝিরি গাঁয়ের দক্ষিণের জঙ্গলের পাশে। এই গাঁয়ের খাবার পানির একমাত্র উৎস এটি। ঝিরির কাছাকাছি আসতে মাদাম থেমে যান। পাশের কাটা গাছের গুঁড়ির উপর থেকে বরফ সরিয়ে বসলেন। এইটুকু আসতে হাত-পা জমে গেছে। ঝিরির পাশের অদূরের ছোটো ঝোপের দিকে আঙুল তুলে বললেন,

“ওদিকটাতে গোসল সেরে এসো। আমি বসলাম ততক্ষণে।”

ইসাবেলা বালতি আর শুকনো কাপড় নিয়ে চলল। ঝিরির ওপাশটাতে ছোট্ট পরিষ্কার নালা। কাপড়গুলো পলিথিনে মুড়িয়ে রেখে একে একে গায়ের কাপড় খোলে। সামনে বন- জঙ্গল। ও দাঁড়ানো ঝোপের আড়ালে। নগ্ন গায়ে ধা করে এসে লাগে জংলি হিম বাতাস। ফর্সা ত্বক লালচে হয়ে ওঠে। লোম দাঁড়িয়ে যায় দেহের। কাঁপতে কাঁপতে ধীর পায়ে পানিতে নামে। পানি বেশ উঞ্চ থাকে সকালে। গলা পানি নেমে এক ডুব দিয়ে উঠে। ঠাণ্ডায় দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার উপক্রম। হঠাৎ কাছাকাছি কোথাও ঘোড়ার আর্ত অশ্বরব শুনে চমকে ওঠে ইসাবেলা। শান্ত প্রকৃতির মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন অনুভব করল সে। নাম না জানা কয়েকটা পাখির ডাক আর ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল। তখনই মাদামের উৎকণ্ঠিত গলা শুনতে পায়,

“ইসাবেলা, তুমি ঠিক আছো?”

“জি, মাদাম।”

তাড়াতাড়ি পানি থেকে উঠে শুকনো কাপড় পরে নিলো। ময়লা কাপড় আর বালতি নিয়ে ছুটল মাদামের কাছে। মাদাম আগের জায়গায় নেই। ভয় পেয়ে গেল ও।

“মাদাম!”

“এদিকে আমি।”

ইসাবেলা দ্রুতপদে গেল গলার স্বর অনুসরণ করে। মাদাম ঝুঁকে বসা ঝিরির পাশে। একটা মানব দেহ পড়ে আছে তাঁর সামনে। মানুষটার পায়ে কালো জুতো, পরনে লম্বা কালো কোট আর হাতে একই রঙের হাত মোজা। মাথা মাদামের কোলে বলে মুখটা দেখা যাচ্ছে না। ইসাবেলা এগিয়ে গেল ত্রস্ত পায়ে। দেখল এক সুদর্শন যুবক অচেতন হয়ে পড়ে আছে মাদামের কোলে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here