#রহস্যময়_সারপ্রাইজ
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
#পর্ব-১৪
অধরার কথার জবাব এলো না। নিতিন বলল,
“বাকি কাহিনি বলুন, তুরাগ। ”
তুরাগ ধীর কন্ঠে বলা শুরু করল,
“প্রতিভাকে মারার পর লাশ নামিয়ে চোখ আর গলার দাগের উপর মেকাপ করে হৃদা। তারপর নেকলেস পরায়, ট্রাভেল ব্যাগে রেখে চিরকুট রাখি লাশের উপর। তারপর র্যাপিং পেপার দিয়ে ট্রাভেল ব্যাগ মুড়িয়ে নিই। সবশেষে নেমকার্ড দিয়ে আমরা রওনা হই মিরপুরের উদ্দেশ্যে। বর্ণা চলে যায় মির্জা হাউজে। মৃদুল আর কৌশিক ও চলে যায়। সবার আগে চঞ্চল, ভুঁইয়া ভিলায় যায়। ফরিদ ভিলার ছাদ বেয়ে ভুইয়্যা ভিলায় যায়। দারোয়ানকে কল করে মিথ্যা বাহানা দিয়ে ছাদে ডেকে নেয়। দারোয়ান উপরে গেলে আমি আর হৃদিতা লাশ মোড়ানো প্যাকেট নিয়ে বাসায় চলে যাই। দারোয়ান ছাদে ট্যাপ ঠিক করে নিচে নেমে নিজের রুমে যায়। এই সুযোগে চঞ্চল গিয়ে কন্ট্রোল রুমে গিয়ে ফুটেজ ডিলিট করে। এবং উপরে চলে আসে। ভোরের আগে আমরা লাশ বের করে ফ্ল্যাটের সামনে রাখি। তারপর ঘুমিয়ে যাই। ”
“তারপর সকালে উঠে লাশ দেখে অভিনয় শুরু করেন। কিন্তু অজ্ঞান হলেন কিভাবে?”
ভাবুক স্বরে প্রশ্ন করল নিতিন। তুরাগ উত্তর দিল,
“ক্লোরোফর্ম দিয়ে। শার্টের হাতায় হালকা স্প্রে করা ছিল। আমি যতবার শার্টে নাকে মুছেছি ততবার অজ্ঞান হয়েছি। ”
“অভিলাষের বাসায় পাওয়া রিসিট, কালার পেপার, নেম কার্ড আসলো কিভাবে?”
“খুনের পর চঞ্চল আসার সময় সব কিছু নিয়ে এসেছিল। চিরকুট লিখেছিল বর্ণা। চাপ দিয়ে লেখার কারণে নিচের পৃষ্ঠায় বসে গেছে। সেগুলো নিয়ে আসা হয়েছে। যার দ্বারা অভিলাষকে দোষী সাভ্যস্ত করা যায়। চঞ্চলের ডায়েরিও স্বরূপার লেখা। পুলিশ যা পেয়েছে সব আমাদের সাজানো ছিলো।”
“তারপর অভিলাষকে ভিকটিম বানিয়ে পুলিশের সব মনোযোগ ফেললেন অভিলাষের উপর। এরপর আপনারা পরবর্তী পদক্ষেপ এগুলেন। তাই তো?”
“হ্যাঁ। আমরা যখন নজর বন্দি ছিলাম তখন ডাঃকৌশিককে দিয়ে মর্গে থেকে লাশ চুরি করে। তারপর চঞ্চ আটক হওয়ার পর তার ফেক জবানবন্দি দিয়ে পুলিশকে মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়। রিমান্ড শেষে হাজতে যাবার সময় আমরা ছ’জন মিলে ছদ্মবেশ ধরে চঞ্চলকে কিডন্যাপ করি। তারপর মর্গে থেকে চুরি করা লাশ পুড়িয়ে রেখে আসি ভুঁইয়া ভিলায় অদূরে ঝোপের কাছে। ফরেনসিক ল্যাবের পাঁচ লোভী ডাক্তারকে টাকা দিয়ে নিজের দলে এনেছিলাম আগেই। তাদের মাধ্যমে ফরেনসিন রিপোর্ট বদলে দিই। লাশের সাথে চঞ্চলের কাপড় দিই। যাতে সবাই বিশ্বাস করে এটা চঞ্চলের লাশ। লাশের সাথে চিরকুটে হৃদিতার তৈরি সংখ্যা দেয়া হয় পুলিশের মাইন্ড ডাইভার্ট করার জন্য। ইন্সপেক্টর অধরা যখন চিরকুট নিয়ে পড়ে রইলেন তখন আমরা শিকার ফাঁদ পেতে নিয়েছি। আমার চেকাপের বাহানায় প্রভাত মির্জাকে নিয়ে আমি আর হৃদি বের হই। ড্রপ করার বাহানায় বর্ণাকেও নিয়ে নিই। কিছুপথ গিয়ে সবাই নিজেদের আসল রূপে ফিরে আসি। এবং প্রভাত মির্জাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাই বর্ণার ফ্ল্যাটে। মুখে মাস্ক থাকায় কেউ চিনে নি। এর আগে আমাদের তিনজনের চেহারার সাথে কিছুটা মিলে এমন তিনটি চেহারার তিনটি লাশ বেছে নিয়েছি মর্গে থেকে। লাশ চুরি করে প্লাস্টিক সার্জারি করে আমাদের নাক ঠোঁট এর রূপ দিই। তারপর ধরা না পড়ার জন্য উপরে আমাদের চেহারার মতো ফেস মাস্ক লাগিয়ে দিই। এসব আগেই রেড়ি করা ছিলো। তারপর ফাঁসি দিয়ে গলায় দাগ করি। তারপর শরীরটা এসিড দিয়ে ঝলসে দিয়ে আগের জায়গায় রেখে আসি। এবার আমরা চারজনই মৃত হয়ে গেলাম। ”
“তারপর? ”
“আমাদের তিনজনের কাছে খুনটা প্রতিশোধেরর হলেও বাকি তিনজনের কাছে সম্পত্তির জন্য। তাই জোরপূর্বক প্রভাত মির্জার বিপুল সম্পত্তি নিজেদের নামে করি। আমাদের আসল নামে রেজিস্ট্রি পেপার আগেই বানানো ছিল। শুধু সাক্ষরের দরকার ছিল, যা প্রভাত মির্জা থেকে জোর করে নিয়ে নিলাম। তার একাউন্ট থেকে বিপুল অর্থ ও নিলাম। ”
” প্রভাত মির্জা স্বরূপার ফ্ল্যাট থেকে আপনার ফ্ল্যাটে গেলো কিভাবে?আর কেনো!” প্রশ্ন করল অধরা। তুরাগ উত্তর দিল,
“ওখানে কড়া সিকিউরিটি ছিল। পুলিশের আনাগোনা ছিল বেশ। সেফ ছিল না। আর যেহেতু আমার ফ্ল্যাট পুলিশ থেকে সিলগালা করা তাই ওখানে পুলিশ আসবে না তেমন। আসলেও খবর পাব। তাই সেখানে চলে গেলাম। রাতের আঁধারে ছাদ টপকে ফ্ল্যাটে গেলাম। জোর করে মির্জাকে ও নিয়ে গেলাম । তারপর সেখানে কিছুসময় থাকার পর শ্বাসরোধক করে হত্যা করে জিহ্বা কাটা হল। র্যাপিং পেপার, ট্রাভেল ব্যাগ, নেম কার্ড কাচি টেপ সব রেড়ি ছিলো। বর্ণা প্রভাত মির্জার লেখা কপি করে চিরকুট ও লিখেছে। রাতে লাশ নামিয়ে ট্রাভেল ব্যাগে ভরে, বর্ণার লেখা চিরকুট দিয়ে তার উপর র্যাপি পেপার মুড়িয়ে নেম কার্ড চাপিয়ে পরদিন মির্জা হাউজে দিয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু খুন করার পর টায়ার্ড হয়ে সবাই সিদ্ধান্ত নিই,খেয়ে বাকি কাজ গুছিয়ে নিব। তাই চিরকুট খাতায় আর লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় ওভাবে ফেলে রেখেছিলাম। হৃদিতা পাস্তা বানিয়েছিল আগে। তা গরম করছিল। কিন্তু শেষ হওয়ার আগেই পুলিশ এসে যায়। তাড়াহুড়ো করে হৃদিতা কিচেনে কড়াই লুকিয়ে ওভেনেই পাস্তা লুকিয়ে পালায়। আমরাও সব ওভাবে রেখেই পালিয়ে যাই ফরিদ ভিলা দিয়ে। ”
“আপনারা জানতেন না আমরা যাব?”
“না।”
“যাক, সারপ্রাইজ দিতে পারলাম তবে!” বিজয়ীর হাসি ঠোঁটে টেনে বলল অধরা।
“হ্যাঁ, সেদিন ওভাবে ধরা খেয়ে যাব, ভাবিনি। আর সেদিন থেকেই সব উল্টাপাল্টা হচ্ছিল। সব আমাদের পরিকল্পনার বাইরে হচ্ছিল। তাই মৃদুল আর কৌশিককে মিথ্যা বাহানায় হাসপাতালে পাঠাই। এবং আমরা বিদেশ যাওয়ার পায়তারা করি। কিন্তু আপনারা সেটাও ও ভেস্তে দিলেন। পাকড়াও করে ফেললেন। ”
আফসোসের কন্ঠে বলল তুরাগ।
“মি.তুরাগ, আপনি কি জানতেন না প্রতিভার প্রেগন্যান্সির কথা?”
নিতিনের সন্দিগ্ধ প্রশ্ন। তুরাগ নির্দ্বিধায় উত্তর দিল,
“না।”
“কে জানতো? অভিলাষ আপনি জানতেন?”
অভিলাষ বলল,
“হ্যাঁ, জানতাম। ”
“আর কে জানতো?”
“আমি জানতাম।”
স্বরূপা নির্দ্বিধায় উত্তর দিল। অভিলাষ ছাড়া বাকিরা সবাই অবাক হয়ে স্বরূপার দিকে তাকাল। যার অর্থ তারাও জানতো না যে স্বরূপা জানতো। তুরাগ অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,
“তুমি জানতে? আমাদের বলো নি কেনো!”
“প্রেগন্যান্সি টেস্ট করার পর রেজাল্ট হাতে পেয়েই প্রতিভা আমাকে জানিয়েছিল। আমি তোমাদের জানাইনি কারণ আমার ভয় ছিলো বাচ্চার কথা শুনে তুমি যদি পপরিকল্পনা বদলে দাও? যেহেতু তুমি বাচ্চাদের অনেক পছন্দ করো। আর ওটা তো তোমার বাচ্চা ছিল। তুমি পরিকল্পনা চেঞ্জ করে যদি প্রতিভাকে হত্যা করা বাদ দিতে তবে আমার বাবা মায়ের খুনিকে শাস্তি দিতে পারতাম না, এ ভেবে বলি নি। তা ছাড়া শুধু মাত্র বাবা মায়ের জন্য আমি প্রতিভাকে সহ্য করছিলাম। কিন্তু ওর পেটে তোমার সন্তান আসবে শুনে আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ি। ওর কনসিভ করার ব্যাপারটা তোমার কানে যাবার আগেই আমি ওকে শেষ করে দিতে চাচ্ছিলাম। তাই আমি ওকে বুদ্ধি দিই। তোমাকে যেন এখন না জানায়,জন্মদিনে সারপ্রাইজ দেয়। প্রতিভা তাই করল। এই ফাঁকে আমি তোমাদের প্রলুব্ধ করলাম, প্রতিভাকে খুন করার জন্য। তোমরা সবাই খুন করলে।”
তুরাগ রাগত দৃষ্টিতে স্বরূপার দিকে তাকাল। তারপর কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তখন অধরা থামিয়ে বলল,
“আপনাদের ঝগড়া করার সময় এখন নয় । কখনো সময় পেলে ঝগড়া সেরে নিবেন। এখন থামুন। তারপর স্বরূপা ওরফে বর্ণা বলুন, ভালোবাসার মানুষকে অন্যের হাতে সঁপে দিতে আপনার বিন্দুমাত্র বাধে নি? প্রতিশোধের নেশায় এতটাই অন্ধ হয়ে গেছেন যে সব অনুভূতি অগ্রাহ্য করলেন?”
স্বরূপা একবার তুরাগের দিকে তাকাল। তারপর অসহায় কন্ঠে বলল,
“ভালোবাসার মানুষকে অন্যের সাথে দেখার চেয়ে কষ্টকর অনুভূতি পৃথিবীতে দুটি নেই। আড়াই বছর আমি এই কষ্ট সহ্য করেছি। প্রতিটা মুহুর্তে তিলে তিলে শেষ হয়েছি। হাজারো সময় চিৎকার করে কেঁদেছি। কিন্তু কষ্ট সহ্য করা ছাড়া আমার কিছু করার ছিল না। আমি ও যে চেয়েছিলাম আমার বাবা মায়ের খুনির শাস্তি হোক। তাই নিরবে সয়ে গিয়েছি। এই সবের জন্য আমার প্রতিভার উপর ক্ষোভ ছিল প্রচুর। তাই প্রতিভা খুনের অধিকাংশ কাজ আমি করেছি। এতে আমার এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ হয়েছে। এখনো হচ্ছে। আমার ফাঁসি হোক, সমস্যা নেই। আমি নির্দ্বিধায় মেনে নিবো। কিন্তু বেঁচে থেকে আর কুঞ্জনের সাথে কাউকে দেখতে পারবো না।”
বলে হেসে তার আনন্দ প্রকাশ করলো। নিতিন আন্দাজ করলো এতদিনের জমানো ক্ষোভ প্রকাশ করে আনন্দ হচ্ছে স্বরূপার।
অধরা ভাবছে অন্য কথা। ভাবুক হলো সে। ভাবনা চিন্তা শেষে বলল,
“হৃদিতা জামান ওরফে শিলা,আপনি কেন খুনে অংশ নিলেন। সত্যটা বলবেন না হলে স্প্রে প্রয়োগ করবো।” অধরার গলা কঠোরতায় ঠাসা।
শিলার নির্দ্বিধা মাখানো উত্তর,
” আমার অভাবী পরিবারকে সাহায্য করার জন্য আমার টাকার প্রয়োজন ছিলো, তাই আমি খুনে সামিল হয়েছি। খুনের পিছন যে প্রতিশোধ শব্দটা ছিলো তা আমি এখন জেনেছি। এর আগে জানতাম না।”
“আর ডাঃ কৌশিক? আপনি জানতেন? আপনি কেনো খুনে অংশ নিলেন? তাও আবার নিজের খালাতো বোন আর খালুর খুনে?”
“আমাকে শুধু সম্পত্তির কথাই বলা হয়েছে। আমার খালুর সম্পত্তির উপর আগে থেকেই নজর ছিল। সে উদ্দেশ্যে আমি প্রতিভাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু খালু আমাকে অপমান করে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে। এর ক্ষোভ ছিল কিছুটা। আমি অপমানের শোধ আর সম্পত্তির জন্যই খুনে অংশ নিয়েছিলাম। আমি জানতাম না এরাও যে প্রতিশোধ নিতেই খালু আর প্রতিভাকে খুন করছে। ” অপরাধী গলায় বলল কৌশিক।
নিতিন ভাবুক কন্ঠে বলল,
” প্রভাত মির্জার জিহ্বার কাটা দাগ দেখে আমার মনে একটাই কথা এসেছে তা হলো এই খুনের পিছনে শত্রুতা কিংবা প্রতিশোধমূলক কারণ ছিলো। কোন অপমান কিংবা অন্য কোন অপমানের জেরে করেছে এই খুন। ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে প্রভাত মির্জার জিহ্বার কাটা দাগের পাশে অভিলাষের হাতে ছাপ পাওয়া গিয়েছে। তো মি.অভিলাষ আপনার সাথে প্রভাত মির্জার আলাদা শত্রুতা ছিলো নাকি? তুরাগ স্বরূপা থেকে ও বেশি? কী শত্রুতা ছিলো?”
অভিলাষ নত স্বরে উত্তর দিল,
” বাবা মায়ের খুন হওয়ার মাস কয়েক আগে একদিন প্রভাত মির্জা বাড়ি এসে বাবাকে হুমকি ধমকি দেয়। খুব অপমান করে যায়। বাবা সেদিন কষ্টে কেঁদেছিল। আমি তখন বাবার বাসায় ছিলাম। বাবার চোখে এর আগে কখনো পানি দেখিনি। সেদিনই দেখলাম। বাবার কান্না আমার সহ্য হয়নি। ছোট্ট কন্ঠে তখন বলেছিলাম, একদিন ওই লোকের জিব ছিড়ে বাবার অপমানের প্রতিশোধ নিব। তাছাড়া প্রতিভাকে টিজ করার কারণে প্রভাত মির্জা আমাকে অনেক অপমান করেছেন। বাবার অপমান এবং আমার অপমান দুটোর শোধ নিলাম জিব কেটে।”
হঠাৎ রক্সির কথা স্মরণে এলো অধরার। সে কপাল চুলকে বলল,
” প্রতিভার সাথে রক্সিও ছিলো। সবার কূল কিনারা হলো, রক্সির খোঁজ পাওয়া গেল না কেন?”
“কারণ ওকে খুন করা হয় নি।”
ধীর গলায় বলল তুরাগ। নিতিন ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেনো!”
” রক্সি বর্ণার খুব পছন্দের ছিল। রক্সিকে খুন করার কথা থাকলেও বর্ণার জেদের কারণে খুন করা সম্ভব হয়নি। রক্সিকে মারার কথা আসলেই বর্ণা বাধা দিতো। তার খুব মায়া হতো রক্সির জন্য। বর্ণা ঠিক করেছিলো ইন্ডিয়া যাওয়ার সময় রক্সিকেও নিয়ে যাবে। নিজের কাছে রাখবে। তাছাড়া একি বাসায় থাকার কারণে রক্সির সাথে আমার ও ভালো সখ্যতা ছিলো। তাই ওকে খুন করার ব্যাপার আমার মন ও সায় দিচ্ছিল না, মায়া হচ্ছিলো। তাই ওকে খুন করার পরিকল্পনা বাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সীমান্তে আমাদের পালানোর সময় রক্সিকে হারিয়ে ফেলি আমরা। আর পাইনি।” শেষের কথা বলতে গিয়ে তুরাগের গলা কাঁপল। এতে আন্দাজ করা গেল, রক্সির জন্য তুরাগের ভালোবাসা কতখানি।
ঠোঁট উল্টিয়ে হাত তালি দিল নিতিন। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
” একটা বিড়ালকে মারতে আপনাদের হাত কাঁপছিলো, বিবেকে বাধছিল, অথচ দুই দুইটা মানুষকে মারতে একবারো হাত কাঁপে নি। বাহ্!”
থেমে গম্ভীরমুখে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“একবারো কি বিবেক বাধা দেয় নি? একটা প্রানী ক’দিন থাকতেই তার প্রতি আপনাদের মায়া বসে গেল, অথচ প্রতিভার সাথে তো তুরাগের আড়াই বছরে সম্পর্ক ছিল। তুরাগের ভালোবাসা অভিনয় হলেও প্রতিভার ভালোবাসা তো আর অভিনয় ছিল না তাও কি মায়া জমেনি! আপনারা মানুষ! আমার তো সন্দেহ হয়। মানুষ এত ছলনা কিভাবে করে?”
নিতিনের কথায় সবাই মাথা নিচু করে ফেললো। অধরা রাগভরা গলায় বলল,
” তুরাগ থেকে বেশি সময় প্রতিভা স্বরূপার সাথে কাটিয়েছে। এত ভালোবাসা দেখিয়েছে। রীতিমতো বোন বলেছে। তাও কি মায়া হয়নি? দোষ যা করার প্রভাত মির্জা করেছে, প্রতিভা তো করেনি। তবে ওকে কেনো শাস্তি দিলেন? একটা নির্দোষ জীবন কেড়ে নিলেন। একটু ও বিবেক বাধা দেয় নি?”
“না, প্রতিভার সাথে যা হয়েছে বেশ হয়েছে। ও এসব ওর প্রাপ্য ছিল। ভালো হয়েছে। আরো কষ্ট দিয়ে মারা উচিত ছিল। ওর বাবার জন্য আমি কত কী সহ্য করেছি। ওর বাবা আমাকে পিতৃহারা করেছে, আমিও ওকে সর্বহারা করেছি। বেশ করেছি। ”
রাগত গলায় বললো স্বরূপা। রাগের মাঝে বিজয়ের আভা।
স্বরূপার আচরণ অধরার সহ্য হল না। হুট করেই টেবিল থেকে প্লাইয়ার্স হাতে নিয়ে স্বরূপার বাঁ হাতের অনামিকার নখ এক টানে তুলে ফেলল। আকস্মিক এমন কিছুর জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। নিতিন ও অবাক। সে ভাবেই নি অধরা এমনটা করবে। স্বরূপার নখ তুলার সাথে সাথে স্বরূপা চিৎকার জুড়ে দিল। তাতে সায় জানালো তুরাগ ও। একে অপরের ব্যাথায় ব্যাথিত কি না!
অধরা সিটে বসে বলল,
“আপনার উপর প্রচুর রাগ আমার। কন্ট্রোল করতে পারি নি।”
কী মনে করে নিতিন অধরার হাত থেকে প্লাইয়ার্স নিলো তারপর অভিলাষের একটা নখ তুলে ফেলল। বলল,
“এটা পুলিশকে স্বরূপার লেখা স্ক্রিপ্ট পড়ে শুনিয়ে বোকা বানানোর জন্য।”
অভিলাষ তখন অসহনীয় ব্যাথা নিয়ে ছটফট করতে ব্যস্ত। অভিলাষের কষ্ট দেখে চোখ মুখ খিচে দোয়া পড়ছে হৃদিতা। হৃদ বন্ধন নড়ে উঠছে তার। আর্তনাদ করছে স্বরূপাও। রীতিমতো চিৎকার করে কাঁদছে। তার অস্থিরতায় তুরাগের চোখেও জল ভর করেছে। প্রিয়তমার কষ্ট সহ্য হচ্ছে না তার। এদিকে নিজের হাতে যে ভাঙা নখে ব্যাথা করছে আর রক্ত ছুঁয়ে পড়ছে, সেদিকে কোন খেয়াল নেই তার।
মৃদুলের একটা নখ আগেই তোলা হয়েছে। সেও ব্যাথায় নীল হয়ে আছে। সবার মাঝে এখনো সুস্থ সবল আছে শিলা আর ডাঃকৌশিক।
নিতিন প্লাইয়ার্স রেখে পকেট থেকে টিস্যু বের করে ফিনকি মেরে হাতের তালুতে লেগে থাকা রক্ত মুছতে মুচতে অধরার উদ্দেশ্যে বলল,
“আপনার আর কিছু জানার আছে ওদের থেকে?”
“নাহ,আপনার কিছু জানার না থাকলে জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব, এখানেই সমাপ্ত করা হোক।”
সায় জানাল অধরা। নিতিন সবার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শেষ। তবে যারা এখনো খানিক শাস্তি পায় নি তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করে যাব। শিলা,আর ডাঃকৌশিক বাদে বাকিরা খানিক শাস্তি পেয়েছে। এরা বাদ যাবে কেনো! এদের ও শাস্তি দিব। ”
নিতিনের শীতল স্বরে দেয়া হুমকিতে ভয়ে তটস্থ শিলা আর কৌশিক। তাদের ভীত চেহারার দিকে তাকিয়ে হাসল নিতিন। তার পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে
। হাসিমুখে বলল,
” তবে এক শাস্তি বারবার দিব না। নখ তোলাটা কষ্টকর। এবার হালকা কাজ করি। তা হলো, স্প্রে। এদের স্প্রে করা যায় কি, মিস অধরা?”পরামর্শ চাইল নিতিন।
“এজ ইউর উইশ, মি.নিতিন।”
কাধ নাচিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল অধরা। নিতিন স্প্রে হাতে নিয়ে আবারও ক্যাপ খুলল। তারপর বলল,
“আগে শিলাকে ট্রাই করি। তারপর অর্থোপেডিক্সকে ট্রাই করব।”
বলে শিলার দিকে এগুলো নিতিন। সাথে সাথেই অভিলাষ ব্যাথা ভুলে চিৎকার দিয়ে উঠল,
“স্যার আপনার পায়ে পড়ি, ওকে কিছু করবেন না। যা করার আমাকে করুন। ও প্রেগন্যান্ট। ”
“এমন এক প্রেগন্যান্ট নারীকে এর চেয়েও বেশি কষ্ট দিয়ে মেরেছেন।”
রাগত দৃষ্টিতে তাকিয়ে অধরা বলল। অভিলাষ কাতরাতে কাতরাতে জবাব দিল,
“মেইন কালপ্রিট আমরা। ওর তেমন দোষ নেই। তাই শাস্তি দিলে আমাকে দিন। প্লিজ ওকে ছেড়ে দিন!”
“কী আর হবে, হয়তো মরেই যাবো। সমস্যা নেই। আমাকে শাস্তি দিন। তাও ওকে প্যারালাইজড করবেন না।”
করুণ গলায় বলল শিলা। নিতিন কিছু একটা ভেবে বলল,
“আচ্ছা শিলা বাদ। এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে কষ্ট দেয়ার পক্ষপাতিত্বে আমি নেই। তাহলে কৌশিককে শাস্তি প্রয়োগ করি?”
বলে কৌশিকের দিকে তাকাল নিতিন। কৌশিক ভয়ে ঢোক গিলল। কাঁপা কাঁপা বাঁচার আকুতি জানাল,
“স্যার প্লিজ! আমাকে ছেড়ে দিন!”
” আমি তো মারবোই?” দৃঢ় স্বর নিতিনের। কথা শেষ করে স্প্রে বোতলের ক্যাপ খুলে কৌশিকের ডান হাতের আঙুলের উপর স্প্রে করল। ভয়ে কৌশিক চিৎকার করে উঠল৷ এই বুঝি সব শেষ। সাথে সাথে কৌশিক হাতে জ্বালাপোড়া অনুভব করল। সে ভাবল সত্যিই তার হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে। ভয়ে অনবরত ছটফট করতে লাগল। মিনিট খানেক পরেই জ্বালাপোড়া থেমে গেলো। কৌশিক তখনো চোখ মুখ খিচে আছে। হঠাৎ ব্যাথা অনুভব না করায় ভয়ে ভয়ে চোখ খুলল। হাত অবশ হয়ে গেছে কিনা চেক করতে হাত নাড়ল। নাহ,সব ঠিকঠাকই আছে। কিন্তু স্প্রে করার পর তো হাত অবশ হওয়ার কথা। এমনটাই বলেছিল নিতিন। তবে হলো না কেনো! বুঝতে না পেরে মাথা তুলে অবাক চোখে তাকাল কৌশিক। দেখলো তার সামনে দাঁড়িয়ে নিতিন হাসছে।
কৌশিক ভ্রু কুঁচকাল৷ তা দেখে নিতিন শব্দ করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে বলল,
“মানুষ বোকা বানানো মানুষ গুলো এতটা বোকা হয় জানতাম না।”
“মানে?”
প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল কৌশিক। নিতিন স্প্রে বোতলের উপরের সাদা আবরণটা খুলে ফেলল। তারপর স্প্রেটা কৌশিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“অর্থোপিডিক্স কৌশিক, দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা!”
কৌশিক কৌতুহল চোখে স্প্রের দিকে তাকালো। দেখলো সাদা রঙের বোতলটার গায়ে ‘OPSITE’ লেখা। খানিক তাকিয়ে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। খানিক বাদে বিস্মিত ঠেলে বলল,
“এটা তো ড্রেসিং স্প্রে!”
নিতিন হেসে বলল,
“ধরতে পারলেন অবশেষে! ‘অপসাইট’ স্প্রে হলো এক ধরনের ড্রেসিং স্প্রে। যা বিভিন্ন ধরণের শুকনো ক্ষতের জন্য ব্যবহারের জন্য নির্দেশিত হয়। যেমন, ছোটখাট কাটা, ঘর্ষণ এবং পোড়া শুকনো ক্ষত ক্ষতের উপরে, নিকাশী নলগুলির সীলমোহর এবং স্টেইনম্যান পিনের মতো বহিরাগত অর্থোপেডিক স্থিরকরণের পরে সিউন অপসারণ, টিকা দেওয়ার সাইটগুলির উপর, অক্ষত ফোস্কা এবং ত্বকের গ্রাফ্ট স্থিরকরণের উপরে। কাটাপোড়া স্থানে দিলে প্রথমে বেশ জ্বালা করে। আবার অক্ষত জায়গায় দিলেও জ্বলে। আমার ফার্স্টএইড বক্সে এটা থাকে। আজ ফার্স্টএইড বক্সে স্প্রেটা দেখে মনে মনে বললাম,’ বিশ্বাসঘাতকদের বিশ্বাস নিয়ে খেলা যাক।’সেই ভাবনার উপর অটল থেকে এই ড্রেসিং স্প্রেকে মরণব্যাধি স্প্রে হিসেবে ব্যাবহার করে সবাইকে ভয় লাগালাম। বিশ্বাস করালাম। এবং পেট থেকে কথা বের করলাম। সিক্স ইন্টেলিজেন্স ভিলেন ধরতে পারলো না সেটা। কী দুঃখের কথা!”
আফসোসের সুরে বলল নিতিন। থেমে খোশমেজাজে জিজ্ঞেস বলল,
” তারপর বলুন, কেমন লাগল আমার ট্রিকস? আসলেই বিশ্বাসঘাতকদের বিশ্বাস নিয়ে খেলতে মজা আছে। ”
বাঁকা হাসল নিতিন। এস আই ভির সব সদস্য ব্যাথা ভুলে হা করে নিতিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ড্রেসিং স্প্রে দিয়ে তাদের বোকা বানালো! বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সবাই, কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে রইল।
অধরা হেসে বলল, “ব্রিলিয়ান্ট পারফরম্যান্স। আসামী শকড, আপনি রক।” শেষটা কৌতুকের সুরে বলল অধরা।
নিতিন ঠোঁট কামড়ে হাসল। তখনই রুমে ঢুকল জিহাদ আর আদাবর। এতক্ষণ তারা বাইরে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিল। ভিতরে এসে জিহাদ বললো,
” স্যরি স্যার! নক না করে আসার জন্য।”
“ইটস ওকে জিহাদ।” শান্ত স্বরে বলল অধরা।
“স্যার,ম্যাডাম আপনারা দুজনেই লিজেন্ড। আপনাদের বুদ্ধির জবাব হয় না। আমরা আপনাদের নিয়ে গর্ববোধ করি। আপনারা আইন সমাজের গর্ব। এই মুহুর্তে আপনাদের বুদ্ধিমত্তাকে সম্মান করতে আমরা স্যালুট দিতে চাই। ”
আদাবর গর্বিত গলায় বলল। তারপর জিহাদের দিকে তাকাল। দুজনেই ইশারায় ভাব বিনিময় করে একসাথে স্যালুট করলো নিতিন অধরাকে। জবাবে দুজনেও মুচকি হাসল।
চলবে…
।