রহস্যময় সারপ্রাইজ পর্ব ১১

0
342

#রহস্যময়_সারপ্রাইজ
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
#পর্ব-১১

“আপনি কি নিশ্চিত, ওই দলে তুরাগ, স্বরূপা, শিলা,অভিলাষ ছাড়া আর কেউ নেই?”
প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে বলল অধরা। নিতিন বলল,
“এই চারজন ছাড়া কারো অস্তিত্ব এখনো পাইনি আমি।”

অধরা মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“চলুন তবে একটা সার্কাস দেখে আসি। ”
“কী সার্কাস?”
ভ্রু কুঁচকে বলল নিতিন। অধরা বাঁকা হেসে বলল,
“গেলেই দেখতে পাবেন। আপাতত সেটা সারপ্রাইজ থাক। দু’একটা শক না হয় আমি ও দিলাম৷ মন্দ কি?”
নিতিন মুচকি হেসে বলল,
“মন্দ নয়, ভালোই হবে। চলুন তবে।”

পুলিশ জিপে বসে আছে সবাই। আদাবর ড্রাইভ করছে। বাকিরা কেস নিয়েই আলোচনা করছে।

“স্যার এই ডায়েরি আর ট্রাভেল ব্যাগ গুলো কি আগে পরীক্ষা করা হয়নি?”
নিতিনের সহকারীর প্রশ্ন। নিতিন উত্তর দিল,
“করা হয়েছে। ফিংঙ্গার প্রিন্ট ব্যুরোর দেয়া রিপোর্ট পাল্টে দিয়েছে তারা। কাল চাপে পড়ে সঠিক রিপোর্ট দিয়েছে।”

“কিন্তু স্যার ওরা এত চতুর। এত নিখুঁত প্ল্যান, এত নিখুঁত সবকিছু তবে ওরা লাশে ফিঙ্গার প্রিন্ট রাখল কেনো! ব্যাপারটা কেমন যেন খটকা লাগছে।”
ভাবুক কন্ঠে বলল জিহাদ। নিতিন জিহাদের কাধ চাপড়ে বলল,
” চমৎকার প্রশ্ন করেছো জিহাদ। তবে তোমার এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর নেই আমার কাছে। আমি আন্দাজ করতে পারি, তারা আগে থেকেই প্ল্যান করেছিল ফরেনসিক রিপোর্ট পাল্টানোর, সব আগে থেকেই সেট ছিল তাই খুন করতে গিয়ে এত কিছু ভাবেনি।”
“ওহ আচ্ছা।” বিজ্ঞের মতো বলল জিহাদ।

“আমি ভাবছি অন্য কথা।”
চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল অধরা। নিতিন কপাল কুঁচকে বলল,
“কী কথা?”
“আমি ভাবছি তুরাগ শাড়িটা নিল কার জন্য? সে এতিম, তার মা বোন নেই, প্রতিভার মৃত্যু হয়েছে। তবে সে কার জন্য নিলো?তার কি কোন গার্লফ্রেন্ড আছে? কিংবা স্ত্রী?”

অধরা প্রশ্নে নিতিন পকেট থেকে তার ফোন বের করল। তারপর লক খুলে গ্যালারিতে ঢুকে একটা ছবি ওপেন করে ফোনটা অপজিট সিটে বসা অধরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“ছবিটা দেখুন তো। এতে হয়তো আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।”

অধরা বরাবরের মতোই ফোনটা হাতে নিয়ে কৌতুহলভরা দৃশ্য ফেলল ফোনের স্ক্রিনে। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে একটা ফটোফ্রেমের ছবি। এই ফটোফ্রেমটা অধরা আগেও দেখেছে বেশ কয়েকবার। কোথায় দেখেছে? ও হ্যাঁ, তুরাগের ফ্ল্যাটে দেখেছে। তুরাগের বেডরুমের দেয়ালে টাঙানো ছিল ছবিটা। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে তোলা তুরাগের ছবি। ছবির নিচে ট্যাগ কার্ডে লেখা ‘তুরাগের প্রথম ফরেন ট্যুর।’ ছবিটায় চোখ বুলিয়ে তুরাগ ছাড়া সন্দেহজনক কাউকেই দেখল না অধরা। সে কপাল কুঁচকে নিতিনের দিকে তাকাল। অধরার হাবভাব বুঝে নিতিন মুচকি হাসল। হেসে বলল,
“ইন্সপেক্টর অধরা, আপনি অনেক বিচক্ষণ মানুষ। ছবিটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখুন। আমার বিশ্বাস ক্লু পেতে আপনার বেশিক্ষণ লাগবে না।”

নিতিনের কথা শুনে অধরা আবারও স্ক্রিনে মনোযোগ দিল। মিনিট তিনেক দেখার পর হঠাৎ অধরার চোখ পড়ল তুরাগের চোখের উপর থাকা নীল সানগ্লাসে। ব্লু সানগ্লাসটায় একটা ছায়া মানবী চোখে পড়ল অধরার। সেই ছায়া মানবীকে চিনতে অসুবিধা হলো না তার। সে ফোন থেকে চোখ তুলে বিস্মিত দৃষ্টি ফেলল নিতিনের দিকে। অধরার বিস্মিত ভাব আবারও হাসালো নিতিনকে। নিতিন বলল,
” আমার বিশ্বাস সত্য বনে গেল দেখলেন! আপনি আবারো আপনার বিচক্ষণতার প্রমাণ দিলেন। আপনার মনের সন্দেহটাই ঠিক। এই ছায়া মানবীই তুরাগের সেই স্পেশাল ওয়ান।”

পুরো ব্যাপারটা আর একবার ভাবতেই অধরার চেহারায় রাগ উল্কি এঁকে গেল। ফর্সা গালটা রক্তিম লাল করে দাঁত কিড়মিড় করে রাগত স্বরে বলল,
“সব গুলো বিশ্বাসঘাতক। এদের ফাঁসির রায় না হওয়া অবধি আমি দম নিব না। ”

“রিল্যাক্স ইন্সপেক্টর! এত হাইপার হবেন না, খুনের শাস্তি না পেলেও বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি পাবেই এরা। আমার কাছে বিশ্বাসঘাতকতার কোন ক্ষমা নেই। সব ঠিক থাকলে এদের কঠিন শাস্তি হবেই।”
অধরার রাগত চেহারার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল নিতিন। অধরা দু’হাতের তালু দিয়ে মুখ চেপে মিনিট খানেক সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। তারপর হাতে থাকা ডায়াল ঘড়িতে সময় দেখে নিল। চারটা বেজে পাঁচ মিনিট। সময় দেখে ড্রাইভিং সিটে বসা আদাবরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” দ্রুত ড্রাইভ করো। আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছাতে হবে।”
“জ্বি ম্যাডাম। ” অধরার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে আবারও ড্রাইভিং করায় মনোযোগ দিলো আদাবর।

নিতিন কৌতুহলী হয়ে বলল,
” আমরা যাচ্ছি কোথায়?”
“সিটি হাসপাতাল।” স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল অধরা। নিতিন ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেনো! ওখানে কী?”
“সার্কাস দেখব।” বলে হাসল অধরা। তারপর ফোন বের করে একটা নাম্বার ডায়াল করল। রিসিভ হতেই বলল,
” রিন্তিকা, সব রেডি?”

ওপাশ থেকে ইতিবাচক উত্তর এল। অধরা বলল,
“সব ঠিকঠাক করে জিনিস পত্র নিয়ে সিটি হাসপাতাল চলে যাও। আমি আসছি। আর হ্যাঁ, রিসিপশনে আমার জন্য ওয়েট করবে।”
বলে ফোন রাখল অধরা। নিতিন তখনো ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে অধরার দিকে। এবার নিতিনের কুঁচকানো ভ্রু দেখে অধরা হাসল। হেসেই বলল,
“আপনার ফোর্সকে সিটি হাসপাতাল যেতে বলুন। দর্শক ছাড়া সার্কাস জমে না। আমার পুলিশ ফোর্স ও যাচ্ছে পিছনের গাড়িতে।”
বলে একটা পুলিশ জিপের দিকে ইশারা করল অধরা। নিতিন অধরা মতিগতি বুঝার চেষ্টা করল। কিন্তু ফলাফল শূন্যতে গিয়ে ঠেকল। এই মুহুর্তে অধরার মতিগতি তার ভাবনার বাইরে। তবে অধরা যে কোন বাজিমাত করতে যাচ্ছে তার বেশ বুঝতে পারল সে। তাই না বুঝেই অধরার বলা মতো তার ফোর্সকে সিটি হাসপাতাল যেতে বলল। এদিকে জিপে বসা বাকিদের মনে কৌতুহল চেপে বসেছে। তারা মূলত যাচ্ছে কোথায়? তবে কি অধরা তুরাগদের খোঁজ পেয়ে গেছে? নাকি ঘটনা অন্য কিছু! কারোরই সঠিক ব্যাপারটা মাথায় আসছে না। নানান কথা আন্দাজ করছে। সবাই একরাশ কৌতুহল মনে চেপে চুপ করে থাকলেও প্রশ্নের ভান্ডার সম্পন্ন মস্তিষ্কের অধিকারী জিহাদ কোনভাবেই চুপ থাকতে পারলো না। কাচুমাচু করে বলেই ফেলল,
“ম্যাডাম আপনি কি তুরাগের সন্ধান পেয়ে গেছেন? আমরা কি এখন তুরাগকে এরেস্ট করতে যাচ্ছি।”
“না। তুরাগের সন্ধান জানি না আমি। তুরাগ যে জীবিত আছে তা জেনেছি কিছুক্ষণ আগে। আমি কিভাবে জানব তুরাগ কোথায়?”
নির্দ্বিধায় বলল অধরা। জিহাদ প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দিয়ে বলল,
“তাহলে আমরা যাচ্ছি কোথায়? তুরাগকে না ধরতে গেলে আমরা কাকে ধরতে যাচ্ছি!”
“আমরা যাচ্ছি সার্কাস দেখতে। সার্কাস দেখা শেষ হলে আমরা সার্কাস দেখানো জোকারকে গ্রেফতার করব। তারপর থানায় এনে সার্কাস শো চালু করব। তাকে অভিনেতা ও বলতে পারো।” মুচকি হেসে বলল অধরা।
“জোকার হাসপাতালে কেনো গেল?” না বুঝেই প্রশ্ন করলো জিহাদ। অধরা বলল,
” অভিনয় করতে। আমি আর কিছু বলতে পারব না। হাসপাতালে গেলেই বুঝতে পারবে কাহিনী।”

এরপর জিপময় নিরবতায় ভর করলো। সবাই যে যার মতো ভেবে যাচ্ছে। তখনো গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভেবে চলেছে নিতিন। পথের শেষে এলো গন্তব্য। থামল গাড়ি, নামল সবাই। অধরা নেমে দেখল তার ফোর্স হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই সিভিল ড্রেসে আছে। কারো গায়ে পুলিশ ইউনিফর্ম নেই। অধরা সবার দিকে তাকাল। কিছু একটা ইশারা করলো। সবার দৃষ্টি অধরার দিকে নিবদ্ধ। অধরা সবাইকে এলার্ট থাকতে বলল।তারপর নিতিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার ফোর্সকে হাসপাতাল ঘেরাও করতে বলুন। জোকার পালাতে পারে। পালালে বিশাল সমস্যা, বিনোদন মিস হয়ে যাবে। যা আমি কোনভাবেই চাচ্ছিনা। বি এলার্ট।”

খানিক থেমে সবার দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
” সার্কাস দেখতে হলে চলে আসুন সবাই। ”
বলে হাসপাতালের ভিতরের দিকে হাটা ধরল। একরাশ কৌতুহল নিয়ে নিতিন জিহাদসহ জিপে থাকা বাকিরাও অধরা পিছন ছুটল। অধরা রিসিপশনে গিয়ে এক মধ্যবয়সী মহিলার সাথে খানিক কথা বলল তারপর তাকে নিয়ে একটা রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিল। নিতিনরা বাইরে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকাল। এই মুহুর্তে নিতিনের মনে হচ্ছে অধরা সার্কাস শুরু করে দিয়েছে। অধরাই সার্কাসের অভিনেত্রী। নিতিন যখন সাত পাঁচ ভাবতে ব্যস্ত তখন ওই রুমের দরজা খুলে সাদা এপ্রোন পরিহিতা এক নারী বেরিয়ে এল। মুখে মাস্ক থাকার কারণে চেহারা বুঝা যাচ্ছে না। হাতে একটা ডাক্তারি ফাইল, এপ্রোনের উপর গলায় ঝুলানো স্টেথোস্কোপ। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, মাথার নিকষ কালো চুলগুলো পনিটেইল বাধা। ভাবভঙ্গি দেখে অনায়েসে বলা যায় সদ্য ইন্টার্ন শেষ করা চিকিৎসক। ডাক্তার সদৃশ সেই মহিলা নিতিনদের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“চলুন।”

জিহাদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আপনি কে? দেখুন আমরা কোন রোগী নই, যে আপনি আমাদের চিকিৎসা করবেন।”
উত্তরে তরুণী হাসল। যা চশনা সচ্ছ কাঁচের ভিতর থাকা চোখ দেখে বুঝা গেল। নিতিন এতক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তার সামনে থাকা মহিলার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার হাসি দেখে নিতিনের কপাল থেকে চিন্তার ভাজ সরে গিয়ে চোখে মুখে বিস্ময়ে ভাব দেখা গেল। নিতিন বুঝে গেলো তার সামনে দাঁড়ানো লেডি ডাক্তার আর কেউ না, সে ইন্সপেক্টর অধরা। অধরার গেট আপ দেখে ঘটনা খানিক আন্দাজ করতে সক্ষম হল সে। তাতেই তার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। সে মুচকি হেসে বলল,
“জিহাদ আমরা রোগী নই, আর উনি ডাক্তার ও নয়। সুতরাং, চিন্তার কারণ নেই। উনি তোমাকে চিকিৎসা করবে না, বরং সার্কাসের দর্শক সারিতে বসিয়ে সার্কাস দেখাবে। এম আই রাইট, ইন্সপেক্টর অধরা? ”
উত্তরে সামনে থাকা তরুণীর মাস্কের ভিতর থেকে একটা বাক্য আসল,
“এভস্যুলেটলি ইউ আর রাইট মি.নিতিন। চলুন, সার্কাস দেখা যাক।”
বলে অধরা হাসল। চশমার কাচ বেধ করে চোখ দিয়ে সেই হাসিটা বেরিয়ে এল। জিহাদ অবাক হয়ে বলল,
“ম্যাডাম আপনি?”
” হ্যাঁ, আমিই। চলো।”

অধরা সবাইকে নিয়ে সেকেন্ড ফ্লোরের সর্বশেষ রুমটার সামনে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
“সবাই বাইরে থাকুন। আমি ভিতরে যাচ্ছি। কেউ কেবিনে প্রবেশ করবেন না। ডোর গ্লাস দিয়ে সার্কাস দেখুন। ডোর লক করবেন না। জাস্ট ভেজিয়ে দিন। তবে, ভিতর থেকে জোকার বেরিয়ে আসল তাকে পাকড়াও করবেন। আর হ্যাঁ, কেউ খালি হাতে জোকারকে ধরবেন না। গ্লাভস পরে নিবেন আগে। বাকিটা আমি সামলাব। ”

মনে হাজারো প্রশ্নরা উথাল পাথাল ঢেউ খেললেও কেউ তা প্রকাশ করল না। সবাই আকাশসম কৌতুহল নিয়ে সায় জানাল। যার অর্থ তারা অধরার কথা অনুযায়ী কাজ করবে। অধরা সবাইকে এলার্ট করে কেবিনের দরজা ঠেলে ভিতরে ডুকল। কেবিনে প্রবেশ করে ভিতর থেকে দরজা ভেজিয়ে দিল। কেবিনের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সবাই তাদের কৌতুহল ভরা দৃষ্টি ডোর গ্লাস দিয়ে ভিতরে ফেলল। কেবিনের মাঝে সেট করা বেডের উপর শুয়ে থাকা রোগীকে দেখে সবাই আরেক ধপা চমকাল। তুষার শুভ্র বেন্ডেজে মোড়ানো একটা দেহ শুয়ে আছে সাদা ফোমের তুলতুলে বেডের মাঝখানটায়। চোখ আর ডান বাহুর কিছুটা অংশ ছাড়া বাকি শরীরটা ব্যান্ডেজে আবদ্ধ। চোখ দুটো বন্ধ তার। হয়তো ঘুমাচ্ছে কিংবা বেহুশ। দরজায় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই ভাবছে, এই রোগীর সাথে অধরার সার্কাসের কী সম্পর্ক? এখানে অধরা কী সার্কাস দেখাবে!
কেউই ভাবনার সমাধান বের করতে পারছে না।

সবাই অধীর আগ্রহে ডোর গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে। অধরা তার হাতে থাকা ফাইলটা খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখার ভান করল। তারপর কেবিনে থাকা নার্সের সাথে রোগীর ব্যাপারে খানিক আলাপ করল। নার্সের সাথে কথা বলার সময় অধরার এক হাত এপ্রোনের পকেটে ছিল, আরেক হাতে ফাইল ধরা ছিলো। বেশ দক্ষ চিকিৎসকের মতো বেশ আলাপ করছে সে। এই রোগী হ্যান্ডেল করছিল ডাঃ রিন্তিকা রাহি। তার আর অধরার দৈহিক গঠন খানিক মিলে যায়। এই মিলে যাওয়ার দিকটাকে কাজে লাগিয়ে রিন্তিকার গেট আপ নিয়ে কেবিনে এসেছে অধরা। অধরার নিখুঁত অভিনয় নার্স ধরতে পারল না।
নার্স জানাল, গত ২৪ঘন্টা রোগী অজ্ঞান অবস্থায় আছে। অধরা তার হাতে থাকা ফাইলটা নার্সকে দিয়ে রোগীর বেড সাইডে বসল। তারপর স্টেথোস্কোপ এর সাহায্যে রোগীর হার্টবিট চেক করতে লাগল। তারপর বিচলিত ভাব নিয়ে পকেট থেকে গ্লাভস পরিহিত মুঠো করা হাতটা বের করে এনে রোগীর বাহু চেপে ধরলো। সেকেন্ড দশেক পর হাত গুটিয়ে আরেকবার স্টেথোস্কোপ দিয়ে রোগীর হার্টবিট শুনে উঠে দাঁড়াল। বেড থেকে খানিক দূরে গিয়ে নার্স থেকে ফাইল নিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“রোগীর অবস্থা ক্রিটিকাল। মেডিসিন নিচ্ছে না বডি। এমন হলে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। আপনি রোগীর বাড়ির লোককে খবর দিন।”

নার্সের উত্তর দেয়ার আগেই একটা চিৎকার কানে এলো দুজনের। চিৎকার শুনে বিচলিত হওয়ার বদলে অধরা হাসল। যার অর্থ, কাজ হয়ে গেছে, সার্কাস ও অন হয়ে গেছে। অধরা পিছন ঘুরে বেডের দিকে তাকালো। রোগী বেডে নেই, বেড থেকে নেমে ফ্লোরে লাফাচ্ছে। অধরা বিচলিত হওয়ার ভান করে বলল,
“কী হয়েছে আপনার?”

রোগী উত্তর না দিয়ে বাহু চুলকাচ্ছে আর লাফাচ্ছে। বলার মতো অবস্থায় নেই। কেবিনের বাইরে থেকে সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। এই রোগীর না পুরো বডি ব্যান্ডেজ! হাটতে পারে না চলতে পারে না। তবে এখন লাফাচ্ছে কিভাবে! তবে কি এর ও সব অভিনয়? তাহলে এটাই কি ম্যাডামের দেখানো সেই সার্কাস?এমন ভাবনা ভেবে চলেছে সবাই।

মিনিট দুয়েক হলেও রোগীর লাফালাফি যখন শেষ হলো না তখন অধরা বলল,
“দৌড়ান, চুলকানি কমে যাবে। ”

অসহনীয় চুলকানি থেকে পরিত্রাণ পেতে অধরার কথা রোগীর কানে যেতেই রোগী কেবিনের দরজা দিকে ভৌ-দৌড় দিল। কেবিনের ভেজানো দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে দু’কদম এগুতেই অধরার কথা মোতাবেক কয়েকজন পুলিশ সেই ব্যান্ডেজ মানবকে আটকাল। খানিক পর অধরা মুখের মাস্ক খুলতে খুলতে বেরিয়ে আসল। তারপর রোগীর সামনে গিয়ে বলল,
” রোগী সাজার অভিনয়টা আপনি চমৎকার করেছেন ডাঃ কৌশিক।”

ব্যান্ডেজ মানব তখন কথা বলার অবস্থায় নেই। থাকলে হয়তো অবাক হতো কিংবা পালানোর চেষ্টা করতো। বর্তমানে সে অধরার দেয়া ইচিং পাউডারের কার্যকারিতা উপভোগ করছে। অধরার মুখে ডাঃ কৌশিক শুনে নিতিন ছাড়া বাকি সবাই রীতিমতো হা হয়ে গেল। এতক্ষণে তারা আসল ঘটনা বুঝতে পেরেছে। একটা বিষয় সবাইকে ভাবাচ্ছে তা হলো ডাঃ কৌশিকের চল-চাতুরী। ডাঃ কৌশিক তো অসুস্থ ছিল। সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হয়েছিল। তবে সেটাও কি বাকি সবার মৃত্যুর মতো অভিনয়? ঘটনা দেখে তো তেমনই মনে হচ্ছে, নাহলে সারা শরীরে ব্যান্ডেজ নিয়ে কেউ এভাবে দৌড়াতে পারে? কৌশিকের এসব যদি অভিনয় হয় তবে বলতে হয় কৌশিক ও প্রতিভা খুনের সাথে জড়িত ছিল। এমন ভাবনা মনে হতেই সবাই রাগত চোখে কৌশিকের দিকে তাকাল। জিহাদ অবাক হয়ে বলল,
“কৌশিক ও কি খুনে জড়িত ম্যাডাম?”
“এখনো বুঝতে পারছো না?”
নিতিন বলল। জিহান খানিক ভেবে মাথা চুলকে বলল,
“ম্যাডামের প্ল্যান বুঝতে সময় লাগে আমার। তবে এখন বুঝেছি। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারলাম না, তা হলো কৌশিক এমন লাফাচ্ছে কেনো!”
” বাস্তবতা বুঝতে সামান্য ইচিং পাউডার দিয়েছি কৌশিকের বাহুতে। যা ব্যান্ডেজের ভিতর দিয়ে অনেক দূর চলে গেছে। এতেই কাজ হয়েছে। তোমরা ফ্রিতে সার্কাস দেখতে ফেলে। এবার বলো কেমন লাগল সার্কাস?” স্মিত হেসে বলল অধরা।

“ভাবনার বাইরে।” অবাক কন্ঠে বলল জিহাদ। আদাবর বলল,
” আপনি আবারও বিচক্ষনতার পরিচয় দিলেন ম্যাডাম।”
অধরা হাসল। নিতিন বলল,
“ওয়েল ডান, মিস অধরা।”

অধরা আবারো হাসল। হাসি থামিয়ে বলল,
“মি.নিতিন আপনি আপনার টিম নিয়ে কড়া নিরপত্তার মাধ্যমে ডাঃ কৌশিককে এবং কেবিনে থাকা নার্সকে থানায় নিয়ে যান। খেয়াল রাখবেন যেন পালাতে না পারে। আমি আমার টিম নিয়ে আরেকটা সার্কাস দেখে আসি।”

নিতিন ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবলো তারপর বললো,
“ডাঃকৌশিকের ইচিং প্রবলেম সারাতে হবে। না হলে পেট থেকে কথা বের করাতে দায় হবে। আমি ডাঃ কৌশিককে ট্রিটমেন্ট করে থানায় পাঠিয়ে তারপর আপনার সাথে জয়েন করব। এই সার্কাস মজা লেগেছে, আরেকটা দেখার লোভ সামলাতে পারছি না।”

অধরাও খানিক ভেবে বলল,
“তাই হোক। আমি আপনাকে এড্রেস টেক্সট করব। আপনি কাজ শেষে জয়েন করুন। পারলে ফোর্স নিয়ে আসবেন, নিরপত্তাজনিত কারণ আছে। বুঝতেই পারছেন।”

“হ্যাঁ বুঝতে পারছি। আপনি যান। এদিকটা আমি সামলাচ্ছি।”

“ওকে। আমার দেরি হচ্ছে, আমি বের হচ্ছি।”
বলে হাতের গ্লাভস খুলতে খুলতে বেরিয়ে গেল অধরা। গ্লাভস জোড়া ডাস্টবিনের ফেলে হাসপাতালের বাইরে টহলরত পুলিশ ফোর্স নিয়ে আবারো অন্য গন্তব্যে রওনা হলো সে। সারাটা পথ কেস সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবল অধরা। অধরা তার ভাবনায় মজে থাকাকালীন সময়েই গন্তব্যে পৌঁছে গেল। আদাবর গাড়ি থামাল। ভাবনার সুতো কেটে অধরা ব্যাগ থেকে এক জোড়া হ্যান্ড গ্লাভস নিয়ে পরল। তার গায়ে তখনো ডাক্তারি পোশাক,তবে স্টেথোস্কোপ নেই । সে হাত দিয়ে চোখের চশমা ঠিক করে গাড়ি থেকে নামল। তারপর এপ্রোনের মাঝামাঝিতে ডান বাম দুইসাইডে থাকা পকেট দুটোতে দু’হাত রেখে দাঁড়াল। আশে পাশে চোখ বুলিয়ে সামনে তাকাল।

একটা জং ধরা লোহার গেট। লোহার গেটের দুপাশে দাঁড়ানো দুটো পিলারের দুপাশে টাঙানো নেভি ব্লু কালার দুটো সাইনবোর্ড। এক পাশে একটা সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে বাংলায় লেখা’ “জাতীয় মানষিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল,
শের-ই বাংলা নগর,ঢাকা।” অন্যপাশের সাইনবোর্ডে ও একি কথা লেখা তবে ভিন্ন ভাষায়। মানে ইংরেজিতে লেখা, NATIONAL INSTITUTE OF MENTAL HEALTH AND HOSPITAL.
SHER-E-BANGLA NAGAR,DHAKA. অধরা সাইনবোর্ড দুটোতে চোখ বুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
তারপর মনে মনে আওড়াল,”এখানেই থেমে গেছে হাজারো সুন্দর গল্প,হাজারো সুন্দর জীবন। থেমে গিয়ে রূপ নিয়েছে করুণতা, তাচ্ছিল্যতা আর ভয়াবহতায়।” কথাটা আওড়িয়ে গেটের দিকে পা বাড়ালো সে।
আগে থেকে এলার্ট করার কারণে অধরা আগে তার ফোর্স এসে পৌঁছেছে। অধরা আটজন পুলিশকে হাসপাতালের বাইরে অবস্থান করতে বলে আদাবর আর জিহাদকে নিয়ে হাসপালের ভিতরে ঢুকল। ভিতরে গিয়ে গ্র‍্যান্ড ফ্লোরে অধরার জন্য অপেক্ষারত সেখানকার ডাক্তার জিসান মালিকের সাথে কুশল বিনিময় করল। কিছু ব্যাপার বুঝিয়ে দিয়ে জিসান থেকে কয়েকটা জিনিস নিয়ে পকেটে রেখে সিড়ির দিকে এগুল। তাকে অনুসরণ করল, আদাবর,জিহাদ আর জিসান মালিক। সিড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠল।

তিনতলার চতুর্থ নাম্বার রুমের সামনে গিয়ে মাস্ক পরে নিল অধরা। ইশারায় সবাইকে বাইরে দাঁড় করিয়ে সে কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল। কোন প্রকার শব্দ না করেই ভিতরে প্রবেশ করায় কেবিনের ভিতরে বেডের উপর শুয়ে থাকা মায়লা কাপড় গায়ের এলোমেলো চুলের উদ্ভট মানুষটা চোখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। মাস্ক পরিহতা এক সুন্দরী ডাক্তার দেখে তার কালিতে মাখা কালো মুখের ভ্রু যুগল আপনাআপনি কুঁচকে গেলো। যা দেখে অধরার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। অধরা পকেট থেকে একটা কাঁচি বের করে বেডে শুয়ে থাকা ব্যক্তির দিকে ছুড়ে মেরে বলল,
“ক্যাচ!”

কিছু না বুঝেই শুয়ে থেকেই নিজের দিকে তেড়ে আসা কাঁচিটা হাতলের দিকে খপ করে ধরে ফেলল। এমনভাবে ধরল যেন তার হাত না কাটে। কারণ কাঁচিটা ধারাল আর খোলা ছিল। দক্ষ মানুষের মতো ক্যাচ ধরা দেখে অধরা মুচকি হাসল। তারপর আরেক পকেট থেকে একটা ইনজেকশন বের করল। ক্যাপ খুলে সিরিঞ্জে থাকা সাদা রঙের মেডিসিন চেক করল। উপর দিকে তাক করে দুই এক ফোটা মেডিসিন ফেলে মৃদুস্বরে বলল,

“এটা কী জানেন? গোখরা সাপের বিষ। কেউটে আর গোখরা সাপের বিষ ক্যান্সার রোগীদের কেমোথেরাপি আর অ্যান্টি ভেনাম তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। অ্যান্টি ভেনাম হলো একধরনের মেডিসিন। বিষধর সাপে কামড়ালে একমাত্র অ্যান্টি ভেনাম প্রয়োগের ফলেই মানুষ প্রাণ ফিরে পায়। বিষে বিষে বিষক্ষয় টাইপ আর কী। এই জন্যই কেউটে আর গোখরা সাপের বিষের ডিমান্ড আকাশচুম্বী। আমার পরিচিত এক আত্মীয় সাপের বিষের ব্যবসা করে, আমি তাকে মানিয়ে এটুকু নিয়ে এসেছি। কারণ, আমার মনে হয় এটা যদি মানষিক রোগীদের ও প্রয়োগ করা যায় তবে রোগী একদম সুস্থ হয়ে যাবে।”

থেমে আফসোসের সুরে বলল,
” আগে দু’বার দুটো রোগীকে দিয়েছিলাম। দেয়ার সাথে সাথে তারা মারা গিয়েছিল। তাই আমাকে ওই হাসপাতাল থেকে তাড়িয়ে দিল। আজই এই হাসপাতালে আমার প্রথম দিন। তাই আমি ঠিক করেছি আজই কারো উপর গোখরা সাপের বিষের থেরাপি এপ্লাই করব। এমন ভাবনা থেকেই সবাইকে ফাঁকি দিয়ে এখানে এসেছি। কারণ এখানে এসে বিষ থেরাপির কথা বলায় একজন নার্স আমার উপর নজর রাখছিল। যাক গে,এখন যখন আমি এসেই পড়েছি আপনার আর চিন্তা নেই। আমি এখন এই ইনজেকশন আমার হাতে পুশ করব। তারপর আপনি একটা ঘুম দিবেন,ঘুম থেকে উঠেই দেখবেন আপনি একবারেই সুস্থ। এবার হাত দিন তো!”
বলে ইনজেকশন হাতে রোগীর দিকে এগিয়ে গেল অধরা। এদিকে অধরার কথা শুনে রোগীর মুখটা ফ্যাকাশে আকার ধারণ করল। ভীত ঢোক গিলল। গোখরা সাপের বিষ থেরাপি দেয় কেউ মানুষিক রোগীকে? এই থেরাপি দেয়ার সাথে সাথে আমারও মৃত্যু হবে ভেবেই রোগী আরেক ঢোক গিলল । রোগী যেন তার হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলল। লাফ দিয়ে উঠে বসে ভয়ার্ত গলায় বলল,
“না না, দিবেন না ম্যাডাম। আমি ইনজেকশন ভয় পাই।”

অধরা রোগীর হাত খপ করে ধরে ইনজেকশনের সুঁই এগিয়ে নিয়ে বলল,
” ভয় পাবেন না। একদম পিওর গোখরা সাপের বিষ, বিন্দুমাত্র কেমিক্যাল মিক্স করিনি। সে হিসেবে এর কার্যকারিতা বেশি। সুতারাং ভয়ের কিছু নেই, কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। চোখের পলকের কাজ শেষ।”

অভয় দিয়ে অধরা সুই যখন রোগীর হাত বিধতে নিল। তখনই রোগী অধরাকে এক ঝটকায় সরিয়ে এক দৌড়ে দরজার দিকে গেল। দরজা খুলে বেরুতে গিয়েই আদাবর আর জিহাদের হাতের বাধনে আটকা পড়ল।
রোগী ব্যতিব্যস্ত হয়ে সামনের মানুষগুলোর দিকে না তাকিয়েই বলল,
“আমাকে বাঁচান, উনি আমাকে সাপের বিষ দিয়ে মেরে ফেলবে। প্লিজ যেতে দিন! আমি সুস্থ মানুষ। আমার কোন সমস্যা নেই।”

রোগীর কথায় জিহাদ আদাবর দুজনেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। আদাবর মনে মনে বলল,
” মানুষ তিন সময়ে নিজের অজান্তে সত্য কথা বা মনের কথা বলে দেয়। অতি রাগ,অতি ভয় আর অতি খুশির সময়। ম্যাডাম এই তিনের একটা বেছে নিয়ে ট্রিকস করে ফাঁসাল। রোগীর সুস্থতা যাচাই করার জন্য কৌশল ব্যবহার করেছে। কী চমৎকার বুদ্ধিমত্তা তার!”

অধরা পিছন থেকে বলল,
“আপনি ভয়ের চোটে সত্য কথাটা বললেন মৃদুল সাহেব। আপনার কিছুই হয়নি, আপনি সুস্থসবল মানুষ। আমি শুধু এই কথাটাই শুনতে চেয়েছি। তারজন্যই এতকিছু। ”

অধরার কথা শুনে মৃদুল পিছন তাকাল। ততক্ষণে অধরা তার মুখাবৃত মাস্ক খুলে ফেলেছে। অধরার চেহারা দেখে মৃদুল যেন আকাশ থেকে পড়ল। তার বুঝতে বাকি রইল না এতসব তার আসল রূপ ধরার জন্যই করা হয়েছে। মৃদুলের এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা মানুষটা সে-ই। নিজের খানিক বোকামির জন্য ভয়ে সত্যটা বলে ফেঁসে গেল। ভালোই ফেঁসেছে সে। এবার? এবার পালাতে হবে। সে ভেবেই আদাবর আর জিহাদকে ধাক্কা দিয়ে পালাতে চাইল। দুক’দম যেতেই নিতিন এসে মৃদুলের এক হাত খুব শক্ত করে ধরে ফেলল।

তারপর মৃদুলের অসহায় চেহারার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
“হ্যালো, আমি নিতিন সরকার। সি আই ডি এর সিনিয়র ইন্সপেক্টর। আজকাল পুলিশের সাথে জোট বেধে প্রতিভা কেস তদন্ত করছি। আর এখানে একটা সার্কাস দেখতে এসেছি ফোর্স নিয়ে।”

নিতিন তার কথার মাধ্যমে বুঝালো, তুমি বড় কারো হাতে পড়েছো। তুমি আর পালানোর চেষ্টা করোনা। তোমার পালানোর সব রাস্তা বন্ধ। নিতিনের কথার ভাব বুঝতে অসুবিধা হলো না মৃদুলের। চোখে সর্ষে ফুল দেখল সে।

অধরা জয়ের হাসি ঠোঁটের রেখায় টেনে বলল,
“অভিনয়টা আরেকটু ভালো করলে ও পারতেন। তুরাগরা কত নিখুঁত অভিনয় করে আর আপনি কি না অপরিপক্ক অভিনয়ের জন্য ধরা খেলেন! কী লজ্জাজনক বিষয়! ”

মৃদুল কোন জবাব দিল না। সে তখনো ক্ষীণ আশা নিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে ব্যস্ত। তা দেখে অধরা ফোন করে তার টিম মেম্বারদের আসতে বলল। ফোন রেখে অধরা বলল,
“মি.নিতিন, সার্কাস তো শেষ, এবার জোকারকে থানায় নিয়ে যাওয়া হোক?”

“ইয়াহ,সিউর। বাই দ্যা ওয়ে,গুড জব। আপনি কেস সমাধানের কাজ এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছেন। ”
হেসে বলল নিতিন। অধরাও কিছু বলল না। টিম মেম্বাররা এলে কড়া নিরপত্তার মধ্য দিয়ে মৃদুলকে নিচে নামিয়ে গাড়িতে উঠানো হলো। জিসান ও অধরার বুদ্ধিমত্তার বেশ প্রশংসা করে বিদায় নিলো।

মৃদুলের পাশে গোটা দশেক পুলিশ, সি আই ডি রেখে নিতিন গাড়ি থেকে নামল। গাড়ি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অধরা জিহাদ আদাবরের সাথে কথা বলছে। নিতিন ও সেদিকে গেল।
জিহাদ বলল,
“ম্যাডাম আপনি সাপের বিষ পেলেন কোথায়?”

” ইনজেকশনে থাকা ওগুলো বিশুদ্ধ পানি। ডাঃজিসান সম্ভবত তার কোন ওয়াটার পট থেকে নিয়েছে। আমি ভয় দেখানোর জন্য মিথ্যা বলেছি।” হেসে বলল অধরা। জিহাদ হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল।

অধরার কথা শুনে আদাবর বলল,
“ম্যাডাম, আপনার বলা মিথ্যাটাও বিশুদ্ধ ছিল । যার কারনে ধরতে পারেনি। ”

জিহাদ প্রশ্নবোধক চাহনিতে বলল,
“ম্যাডাম আপনি কিভাবে বুঝলেন যে ওরাও খুনের সাথে জড়িত?”

“প্রতিভা মির্জার মৃত্যুর পর কৌশিক আর মৃদুলকে আমার সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু ওদের দুজন হাসপিটালাইজড শুনে আমি সন্দেহের তালিকা থেকে তাদের বাদ দিয়ে দিই। কিন্তু মি.নিতিন সবার রহস্য উন্মোচন করার পর এদের উপর সন্দেহ হলো। বারবার মনে হচ্ছিল এরাও অসুস্থতার ভান করছে। তাছাড়া তুরাগ,শিলা,স্বরূপা,অভিলাষ জীবিত মানে সবার সামনে উপস্থিত থাকার সময়ে এসব বিষয় কে সামলিয়েছে? তারা পুলিশের কড়া নিরপত্তায় ছিল তখন নিশ্চয়ই অন্য কেউ ছিল। এসব ভেবেই অনেকটা সন্দেহবশত এসব করেছি। আমার বিশ্বাস ছিল, দিন শেষে এদেরকেও ওদের দলেই পাব। হলোও তাই। আমি বের হওয়ার আগে ফোর্স রেড়ি করে আমাদের আগে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। তারপর তাদের মাধ্যমে ডাঃ জিহান এবং রিন্তিকার সাথে কথা বলে সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছি। বাকিটা তো তোমরা জানোই।”

একদমে বলে শেষ করল অধরা। আদাবর বলল,
“এদের তো ধরে ফেললেন, এবার বাকিদের কিভাবে ধরবেন? ওরা তো পালাতক, কোথায় আছে কোন সূত্র নেই। তবে কোন সূত্র ধরে আগাবেন?”

অধরা গম্ভীরমুখে উত্তর দিল,
” তুরাগদের কাছ অবধি পৌঁছানোর সূত্র পেয়েছি।”
“কী সূত্র!”
কৌতুহলী হয়ে বলল নিতিন। অধরা প্লাস্টিক মোড়ানো একটা মোবাইল দেখিয়ে বললো,
“মৃদুলের ফোন।”
“ক্লু কোথায়?”
নিতিন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।

অধরা তার হাতে থাকা স্মার্ট ফোনের সাইড বাটন চেপে স্ক্রিন অন করল। সাথে সাথে স্ক্রিনে একটা ম্যাসেজ নোটিফিকেশন ভেসে ওঠল। মিনিট দশেক আগেই এসেছে ম্যাসেজটা। ম্যাসেজ দেখে জিহাদ বলল,
“আমার মাথা ঘুরাচ্ছে ম্যাডাম।”

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here